বিরসা মুণ্ডার জন্মজয়ন্তী ১৫ নভেম্বরকে নরেন্দ্র মোদি সরকার “জনজাতীয় গৌরব দিবস” হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৫ নভেম্বর দিনটি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দিবসও বটে। খেয়াল রাখতে হবে যে ভারত রাষ্ট্র, বিশেষত আরএসএস-বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতায় চলা মোদি সরকারের আমলে, ভারতের আদি বাসিন্দাদের সর্বমান্য “আদিবাসী” শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করতে রাজি নয়। আদিবাসীর বদলে আরএসএস-এর প্রিয় শব্দ হল বনবাসী বা বনে বসবাসকারী। এবং নতুন ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের সময় তারা রাজ্যের নাম ঝাড়খণ্ডের বদলে বনাঞ্চল রাখতে উঠেপড়ে লেগেছিল। ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের লক্ষে কয়েক দশক ধরে চলা আন্দোলনে তীব্র লড়াই লড়তে হয়েছিল ঝাড়খণ্ড নামটি পাওয়ার জন্য।
বিজেপি যদি ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতায় থাকত তাহলে নিশ্চয় মোদি ঝাড়খণ্ডকেই বেছে নিত এই নতুন দিবসের উচ্চকিত ঘোষণার মঞ্চ হিসেবে। ভাগ্যিস ঝাড়খণ্ডের মানুষ ২০১৯ বিধানসভা নির্বাচনে হারিয়ে দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ছত্তিশগড়, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রও বর্তমানে বিজেপির শাসনাধীন নয়। তাই মোদি ১৫ নভেম্বর র্যালির জন্য বেছে নেয় মধ্যপ্রদেশ রাজ্যকে। র্যালির প্রচার, ব্যানার ও সাজসজ্জায় খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে বিরসা মুণ্ডা তথা ভারতের উপনিবেশ-বিরোধী লড়াইয়ে আদিবাসীদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে সম্মান জানাতে নয়, বরং নরেন্দ্র মোদি ও শিবরাজ সিং চৌহানকে বড় করে তুলে ধরতেই এই র্যালি সংগঠিত হচ্ছে।
এই উদযাপনের আসল পরিহাস অবশ্য দিবসটির নামকরণ বা ঘোষণাস্থল বেছে নেওয়ার মধ্যে নেই, আসল পরিহাস লুকিয়ে আছে আদিবাসীরা বর্তমানে যে বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছেন তার মধ্যে। আদিবাসী পরিচিতি ও অধিকারের ওপর ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় হামলার যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে ভারতের আদিবাসী সমাজকে তার মধ্যে। আজকের সরকারের সমস্ত নীতি নির্ধারিত হচ্ছে ভারতের সবরকম সম্পদের ওপর কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার লক্ষে। ভূমি, অরণ্য, নদী, খনি এবং সরকারি ব্যয়ে ও জনতাকে বলিতে চড়িয়ে দশকের পর দশক ধরে গড়ে ওঠা সব সরকারি সম্পত্তি – সমস্ত কিছু অত্যন্ত ব্যবস্থিতভাবে তুলে দেওয়া হচ্ছে গুটিকয় কর্পোরেট কোম্পানির হাতে। ভারতের জনগণ খুব সঠিকভাবেই এই শাসনের নাম দিয়েছে “আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজ”।
এই কর্পোরেট লুন্ঠনের সবচেয়ে কঠোর মূল্য চোকাচ্ছে ভারতের আদিবাসীরা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলা কর্পোরেট আগ্রাসনে সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে ও সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীরাই। আদিবাসীদের এই বিপুল ও সুব্যবস্থিত উচ্ছেদকে আড়াল ও বৈধ করা হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে। এবং এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের যে কোনও প্রতিরোধকে উন্নয়ন বিরোধী এন্টিন্যাশনাল বলে দেগে দিয়ে চূর্ণ করা হচ্ছে আর তাদের সুব্যবস্থিতভাবে সাজা দেওয়া হচ্ছে।
ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীরা সংবিধানের পঞ্চম তপশীলের আওতায় নিজস্ব গ্রামসভার সাংবিধানিক অধিকার চাইলে রঘুবর দাস সরকার তাকে রাজদ্রোহ বলে অভিযুক্ত করে নির্বিচারে জেলে পুরতে থাকে। এইসব রাজদ্রোহের অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জেলবন্দী আদিবাসীদের মুক্তির দাবি তোলায় ফাদার স্ট্যান স্বামিকে ইউএপিএ মামলা দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের কারাগারে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। ছত্তিশগড়ের সুকমা জেলায় আদিবাসীরা পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের বিরোধিতা করলে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয় সিলগার গ্রামে। এবং মোদি-ঘোষিত এই জনজাতীয় গৌরব দিবসেই সংবাদ আসে ২৭ জন তথাকথিত মাওবাদীকে হত্যা করার যার মধ্যে সম্ভবত বেশিরভাগই আদিবাসী, মহারেষ্ট্রের গড়চিরোলি জেলায়।
এইসব অর্থনৈতিক উচ্ছেদ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পাশাপাশি আদিবাসীরা এক তীব্র সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সম্মুখীন। আরএসএস দিনরাত কাজ করে চলেছে আদিবাসীদের ধর্মের লাইনে বিভাজিত করার। “ঘর ওয়াপসি” অভিযানের মাধ্যমে বহু পরিবারকে হিন্দু ধর্মে আসতে বাধ্য করছে এবং আদিবাসী প্রতিরোধের উপনিবেশ-বিরোধী ইতিহাসকে খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ বলে নতুন মোড়কে পরিবেশন করছে। ১৮৫০ এ মুর্মু ভাইবোন সিধু কানু চাঁদ ভৈর ফুল ঝানোর নেতৃত্বে সাঁওতাল হুল বা তারপর বিরসা মুণ্ডার উলগুলান অন্তর্বস্তুতে ছিল ঔপনিবেশিক শাসন ও তার যুগল দোসর সামন্ত জমিদারী ও মহাজনী শোষণের বিরদ্ধে গণ অভ্যুত্থান। উলগুলানের রণধ্বনি “আবুয়া দিশম, আবুয়া রাজ” (আমাদের দেশ, আমাদের শাসন) — ঠিক ১৮৫৭-র আজিমুল্লা খানের “হাম হ্যায় ইসকে মালিক, হিন্দস্তাঁ হামারা” (এই দেশ আমাদের, আমরা তার মালিক) সংগীতের মতই — ছিল এক জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের ঘোষণা যা কংগ্রেসের পূর্ণ স্বরাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও ২৯ বছর আগে ঘোষিত হয়েছিল। সংঘ পরিবার এই গৌরবময় ইতিহাসকে অন্তর্ঘাত চালিয়ে আত্মসাৎ করতে চাইছে এবং তাকে হিন্দুরাষ্ট্র প্রকল্পের লেজুড়ে পরিণত করতে চাইছে।
উচ্ছেদ, অত্যাচার ও সাংস্কৃতিক অধীনতার বাস্তব বিপদকে “জনজাতীয় গৌরব”-এর মিস্টিমাখা বুলি দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাবে না। আদিবাসী আন্দোলনকর্মীরা, যারা তাঁদের গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী এবং যারা আজকের এই কর্পোরেট-কম্যুনাল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করার জন্য দৃঢ়তার সাথে লড়ে চলেছেন, তাঁদের সকলে মিলে আজ দেশজুড়ে এক জোরালো ও প্রাণবন্ত ঐক্য গড়ে তুলতে হবে বিজেপির এই ধূর্ত ছককে বানচাল করে দিতে এবং কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রযুব, মহিলা ও সমস্ত নিপীড়িত সামাজিক শক্তির সাথে সংহতি ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে কর্পোরেট আগ্রাসন ও ফ্যাসিবাদী হামলাকে প্রতিহত করতে। ১৪-১৫ নভেম্বর ফাদার স্ট্যান স্বামির গড়ে তোলা কেন্দ্র বাগইচাতে যে আদিবাসী অধিকার কনভেনশন সংগঠিত হল এবং গঠিত হল আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চা তা এই সংহতি ও প্রতিরোধের লক্ষে এক উৎসাহজনক পদক্ষেপ।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৬ নভেম্বর ২০২১)