আজকের দেশব্রতী : ১১ নভেম্বর ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati 11 november 21 issue

Convention in Asansol

“ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে বাংলা বামপন্থাকেই চায়। তৃণমূল প্রচার করেছিল বাংলা ‘নিজের মেয়েকে চায়’ — এটা ঠিক নয়। এখানে রয়েছে বামপন্থী মেজাজ, বামপন্থী ঐতিহ্য। তবে এতদিন যেভাবে চলেছে সেই ব্যাকরণের বাইরে আজকের সময়কালে শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, দলিত আদিবাসী, ছাত্র-যুব সহ অন্যান্য বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে সংগ্রামী বামপন্থাকে এগিয়ে যেতে হবে। জলবায়ুর প্রশ্ন, বেকারত্বর প্রশ্ন, মানবাধিকার রক্ষা যেখানে বামপন্থার গোড়ার কথা হয়ে উঠবে।”

আসানসোলের রবীন্দ্র ভবনের পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত কনভেনশনে এ কথা বললেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।

গত ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের ১০৪তম দিবসে আয়োজিত এই কর্মসূচি থেকে সিপিআই(এমএল) এসওসি (স্টেট অর্গানাইজিং কমিটি) সংগঠন লিবারেশন যোগ দিল। শুরুতে লাল পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠান হয়। তারপর পার্টিতে যুক্ত হওয়া নেতৃবৃন্দ মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাল পতাকা হাতে তুলে ধরে ব্যক্ত করেন ঐক্যের অঙ্গীকার। যার মধ্যে অন্যতম উখড়া এলাকার দীর্ঘদিনের সুপরিচিত শ্রমিক নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জী, ঝাড়গ্রাম-গোপীবল্লভপুর-জঙ্গলমহলের প্রতিষ্ঠিত আদিবাসী নেতা লেবাচাঁদ টুডু, মেদিনীপুর শহরে পৌরকর্মী আন্দোলনের নেতা তপন মুখার্জি, পূর্ব বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম-গলসি গ্রামাঞ্চলের কৃষক সংগঠক বদরে আলম, মোজাম্মেল হক সহ এক সারি কর্মী ও সংগঠক সহ কয়েকশত সংখ্যক সদস্যরা। এদের স্বাগত জানিয়ে সাধারণ সম্পাদক বলেন, “এই কনভেনশন থেকে বেশ কয়েকজন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ কমরেড আমাদের পার্টির সাথে ঐক্যবদ্ধ হলেন। ঐক্যের এই প্রক্রিয়া সকলের মধ্যেই নতুন আশা জাগাচ্ছে।”

আসানসোল সহ সমগ্র এলাকায় কনভেনশনের প্রচার হয়েছিল বেশ নজরকাড়া। এর প্রভাবে বেশ কিছু সংখ্যক বামপন্থী মানুষ আগ্রহের সাথে কনভেনশনে আসেন। শুরুতে বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য অতনু চক্রবর্তী, জয়তু দেশমুখ। সঞ্চালনা করেন পার্টির পশ্চিম বর্ধমান জেলা সম্পাদক সুরিন্দর কুমার। সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কার্তিক পাল, সলিল দত্ত প্রমুখ। কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেন বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, হুগলী, হাওড়া জেলা থেকে আগত কয়েকশত কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। বক্তব্য রাখেন সোমনাথ চ্যাটার্জী। তিনি বলেন, “আজকের দিনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্তিত্ব নিয়ে থেকে লাভ নেই। পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করতে লিবারেশনের মতো বৃহৎ সংগঠনের সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে।”

November Revolution Anniversary

 

লেবাচাঁদ টুডু বলেন, “জল-জঙ্গল-জমির অধিকারের লড়াইয়ের সাথে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে যুক্ত করেই আমরা এগিয়ে যাবো। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ভারতের বুকে প্রকৃত এক কমিউনিস্ট পার্টি। এই পার্টির নীতি আদর্শ ও শক্তি দেখে আমি সাহস ও ভরসা পাচ্ছি। তাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন বিকাশের লক্ষ্যে আমরা এই পার্টিতে যোগ দিলাম। এ রাজ্যের মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম জেলার বিরাট একটা অংশ যাকে জঙ্গলমহল বলা হয় সেখানে একটি উন্নয়ন পর্যদ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখানকার আদিবাসী জনগণের যে স্বতন্ত্র বিশেষ পরিচিতি রয়েছে তার কোনও স্বীকৃতি নেই। আদিবাসী জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। তাই আমরা তাঁদের জন্য স্বশাসনের দাবি জানাচ্ছি। জমি, ফসলের দাম, কাজ, ন্যায্য মজুরি — এই সমস্ত দাবিতে আমরা বড় বড় কৃষক আন্দোলন করেছি। আজ সেই আন্দোলনকে আরও ব্যাপক ও তীব্রতর করে তুলতে হবে।” বক্তব্য রাখেন দলিত সংগঠনের নেতা শক্তিপদ বাদ্যকার। তিনি আম্বেদকারের আদর্শ ও কমিউনিস্ট মতাদর্শকে সমন্বয় করে দলিত গরিবদের জাগরণ ও সমাজের আমূল-পরিবর্তনের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। আসানসোল এলাকার সুপরিচিত বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সি কে দাস ’৬০-’৭০ দশকের স্মৃতিচারণা করে বলেন, সে সময় আমরা সাড়া জাগানো শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছিলাম। সমগ্র শিল্পাঞ্চলে বামপন্থার একটা শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যাছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বিরাট মাত্রায় জনসমর্থন লাভ করছে। বামপন্থা এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। বামপন্থীদের মধ্যে সরকারি ক্ষমতার মোহ, এমএলএ-এমপি-কাউন্সিলার-মেয়র প্রভৃতি পদের মোহ, সেগুলিকে রক্ষা করার জন্য আপসমুখী চরিত্র বিকাশ লাভ করেছে। এ থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আজ পু্ঁজিবাদী শক্তি বিপুল মাত্রায় প্রচার চালিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাকে মোকাবিলা করার উপযুক্ত পাল্টা প্রচার সংগঠিত করতে হবে, এ কাজে উপযুক্ত কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মানুষ বিকল্প চাইছে, ত্রুটি দুর্বলতা কাটিয়ে আমাদের যথাযোগ্য নেতৃত্বের ভুমিকা নিতে হবে।

সব শেষে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, আজ নভেম্বর বিপ্লবের ঐতিহাসিক দিন। এর গৌরবময় ইতিহাস কোনোদিনই ম্লান হবে না, যা থেকে আমরা অবশ্যই শিক্ষা নেব। রাশিয়ার মতো পিছিয়ে পড়া দেশে কমিউনিস্ট শক্তি কিভাবে বিপ্লব সংগঠিত করেছিল, গণতন্ত্রহীনতার পরিবেশে গণতন্ত্রের আকাঙ্খা তারা জাগিয়ে তুলেছিল, কি বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। যে অধিকারের জন্য আজকে আমরা লড়াই করছি — খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক নিরাপত্তা, মহিলাদের সমানাধিকার, কাজের অধিকার; আমাদের দেশে যে বুনিয়াদি দিকগুলির কোনও স্বীকৃতি নেই রাশিয়ার বুকে ১০৪ বছর আগে সেগুলি মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটাও বাস্তব সেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত আজ আর নেই। সেটা কেন পড়ে গেল বুঝে নিতে হবে। বাইরের কোনও আক্রমণ থেকে নয়, ভেতর থেকেই কোথাও সেই সম্ভাবনা বা গতি থমকে গিয়েছিল। সেখানে গণতন্ত্রের প্রশ্নটা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ ২১ শতকে পৃথিবীর যেখানেই সমাজতন্ত্র গড়ে উঠবে তারা রাশিয়া থেকে এই শিক্ষা নেবে।

কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও দেখা যাচ্ছে আজকের দুনিয়ায় পুঁজিবাদ মানবজাতির সংকট মোকাবিলা করতে পারছে না। যেমন তারা অতিমারী মোকাবিলা করতে পারছে না। খোদ আমেরিকার অবস্থা খুবই খারাপ। সেখানে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই, সবটাই ইনসিওরেন্স কার্ড ভিত্তিক। কার্ড তো চিকিৎসা দেবে না, সেখান থেকে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা টাকা পেয়ে যাবে। কিন্তু চিকিৎসার জনমুখী কোনও ব্যবস্থাপনা আদৌ গড়ে উঠছে না। আজ জলবায়ু নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর কখনও একাধিকবার ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে। এর কারণ প্রাকৃতিক কোনও বিষয় নয়, যে আর্থিক ব্যবস্থা চলছে তার মধ্যেই এর কারণটা রয়েছে। অর্থাৎ পুঁজিবাদ মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। কিন্তু এর বিকল্প কি? আজ কোনও দেশ হয়তো মডেল হিসাবে নেই, কিন্তু মানুষই বিকল্প গড়ে তুলবে। সংকট মানেই সম্ভাবনা। সেখানে রুশ বিপ্লব অবশ্যই অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আমাদের দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে অনেকগুলি ধারা ছিল তাদের অনেকেরই অনুপ্রেরণা ছিল নভেম্বর বিপ্লব।

আজ আমাদের দেশের পরিস্থিতির বিকাশ নানা দিক থেকে অভূতপূর্ব, যা আমরা কোনোদিনই ভাবিনি। যেমন আগামী ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করা হবে। দেশের বর্তমান শাসক বিজেপি ঘটা করে “অমৃত মহোৎসব” পালন করছে। যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল, প্রকাশ্যে ব্রিটিশের দালালি করেছিল তারা এখন ইতিহাসের জবরদখল করতে চাইছে। এদের হাত থেকে ইতিহাসকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। ইতিহাসকে জানা বোঝা, তাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই বিশেষ পরিস্থিতিকে আমরা ফ্যাসিবাদ বলছি। ইতালিতে ফ্যাসিবাদ জন্ম নেয়, জার্মানিতে সমাজতন্ত্রের নাম নিয়ে ফ্যাসিবাদ ছিল, যার ভয়াবহতা আমরা জানি, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। সেই ফ্যাসিবাদের অনুগামীরা আজ আমাদের দেশে শাসন ক্ষমতায়। এই আরএসএস ১০০ বছর আগে জন্ম নিয়েছিল। তার প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকার হিটলারের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল। তাই ফ্যাসিবাদের সাথে ওদের গাটছড়াটা নিছক আজকের নয়, জন্মসূত্রে পাওয়া। ফ্যাসিবাদ কোনও রাজনৈতিক স্বাধীনতাই দেবে না।

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসার কথা বলা যায়, যা খুবই দুঃখজনক। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেখানে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে বিরোধিতায় পথে নেমেছে। কিন্তু ত্রিপুরার বুকে যে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাবলী ঘটছে সেটা সম্পূর্ণ রাজ্যের বিজেপি সরকারের প্রশ্রয়ে ঘটছে। একেই আমরা ফ্যাসিবাদ বলছি। অর্থাৎ প্রকাশ্যে খোলাখুলিভাবে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা, মিথ্যাচার চালিয়ে যাওয়া।

Communist Revolutionary Forces unite in the party

 

এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহসের দরকার। একজন ব্যাক্তিও এই সাহস দেখাতে পারে। যেমন ৮৪ বছর বয়সী ফাদার স্ট্যান স্বামী দেখাতে পেরেছিলেন। তাই সাহসের কোনও বয়স নেই। অনেকে বলেন আন্দোলন কোথায়? নেতৃত্বের জন্য মানুষ অপেক্ষা করে না, তারা আন্দোলনের পথে এগিয়ে যায়। যেমন পাঞ্জাবের কৃষকরা, হরিয়ানার কৃষকরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় কাঁটাতার-পেরেক দিয়েও ওরা কৃষকদের ঠেকাতে পারেনি। এক বছর হতে চলল, লক্ষ লক্ষ কৃষক রাস্তায় ছাউনি করে আন্দোলন জারী রেখেছে। এটাই বিরোধী পক্ষ। চলমান প্রতিরোধের বিরোধীপক্ষ। নাগরিক আইন সংশোধন করে ধর্মের নামে নাগরিকদের বিভাজনের বিরুদ্ধে শাহিনবাগে এমনই লড়াই গড়ে উঠেছিল। রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় সে লড়াই ছড়িয়ে পড়েছিল। রোহিত ভেমূলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার পর জয়ভীম ও লাল সেলাম স্লোগান একসাথে রাজপথ কাঁপিয়ে শাসকের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। ছাত্ররা আম্বেদকর ও ভগত সিংকে একসাথে মিলিয়ে নতুন স্লোগান তুলে পথে নেমেছিল। জাতপাত নির্মূলীকরণ নিয়ে আম্বেদকরের বিপ্লবী ভাবনা স্বাধীনতা আন্দোলনের ময়দান থেকে উঠে এসেছিল। তাই আজকের দিনে যেমন বড় সংকট বড়ো মাত্রায় আক্রমণ নেমে আসছে পাশাপাশি গড়ে উঠেছে বড় মাত্রায় জনগণের প্রতিরোধ। রাঁচীতে আমরা আদিবাসী জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামকে দেশব্যাপী সংগঠিত করার লক্ষে এক আদিবাসী কনভেনশনের আয়োজন করেছি। আদিবাসীরা হলেন ফ্রন্টলাইন প্রতিরোধের শক্তি। তারা প্রকৃতির সবচেয়ে কাছে থাকে। তাই প্রকৃতিকে লুঠ করার বিরুদ্ধে সবার আগে তারাই রুখে দাঁড়াবে। কর্পোরেটদের জল-জঙ্গল-জমি লুঠের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সর্বভারতীয় সংঘর্ষ মোর্চা গঠন করা যায় কিনা সেই প্রচেষ্টা আমরা চালাচ্ছি।

আমাদের সামনে আগামী কর্তব্য হল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত ভাবে এবং সাহসের সাথে রুখে দাঁড়াতে হবে। কৃষক ও শ্রমিকদের যে বড় বড় গণআন্দোলনগুলি গড়ে উঠছে, দেশ বিক্রীর বিরুদ্ধে যে যে প্রতিরোধ সংগঠিত হয়ে চলেছে সেগুলির সাথে যুক্ত থাকতে হবে। এ জন্য আমাদের মনের প্রসারতা রাখতে হবে। ধৈর্য সহকারে ঠান্ডা মাথায় সকলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ফ্যাসিবাদকে ঠেকাতে একা বামপন্থীরা পারবে না। তাই বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতেই হবে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতা দখলে মরীয়া হওয়া একটা বড় বিপদ হিসাবে সামনে এসেছিল। কিন্তু বাংলা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ রাজ্যের বুকে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সম্প্রীতির যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে, যে গৌরবময় অতীত রয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই বাংলা বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলাদের আন্দোলনের উপর দাঁড়িয়ে আবারও বামপন্থাকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। পাশাপাশি ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচনের বাইরে এবং ভেতরে এই ঐক্য গড়ে উঠবে। ৫০০ কৃষক সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ ও দর্শনের লোক এক সাথে লড়াইয়ের ঐক্য গড়ে তুলেছে যা আজকের সময়ে অভূতপূর্ব ভাবে দেখা যাচ্ছে। এর সাথে বামপন্থার আদর্শ ও সাহসকে মেলাতে হবে। কেবল পুরানো সূত্র ধরে এটা এগুবে না। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয়ই শিক্ষা নেব, কিন্তু আজকের লড়াইয়ের জন্য নতুন উৎসাহ, উদ্দীপনা, অঙ্গীকার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এই আসানসোল শিল্পাঞ্চলে সংগঠিত ক্ষেত্র ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, পাবলিক সেক্টর চরম সংকটের মুখে। আজকের সময়ে শ্রমিকশ্রেণি নতুন ভাবে গড়ে উঠছে৷ ঠিকা কন্টাক্ট শ্রমিক, গিগ ওয়ার্কার, শিক্ষিত যুবকরা, মিড-ডে-মিল, আশা, অঙ্গনওয়ারী প্রকল্প কর্মীরা শ্রমিক আন্দোলনে নতুন নতুন উপাদান হিসাবে সামনে এসেছে। এদের সংগঠিত করার কাজে এগিয়ে যেতে হবে। আসানসোল এলাকা, যেখানে এক দিকে সন্ত্রাস, হিংসা দেখা গেছে অপর দিকে সম্প্রীতির বার্তা উঠে এসেছে। নিজের ছেলেকে হারানোর পরও একজন বাবা সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেন, এক উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন, একে ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বামপন্থার সামনে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুব আন্দোলন, জঙ্গল মহলের আদিবাসীদের আন্দোলন, মানবাধিকার রক্ষা এসব কিছুই এজেন্ডা হয়ে উঠবে। আগামী দিনগুলিতে ২০২২ সালের শুরুতে দেশের বুকে কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে। উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ডে নির্বাচন আসন্ন।

এগুলি গুরুত্বপূর্ণ, মানুষ সেখানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো রাস্তার লড়াই। এগুলিতে আমাদের আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। এগুলি আমাদের শক্তি যোগাচ্ছে, নতুন অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করছে। আমাদের নতুন রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে আরও বেশি করে নতুন প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। নভেম্বর বিপ্লবকে বলা হয় সেটা ছিল দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। বাস্তবে আজও দুনিয়া কাঁপছে। বিপ্লবী সমাধান, আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বিপ্লব অবশ্যই সম্ভব, যদি সাধারণ মানুষ একবার রুখে দাঁড়ায়। মুনাফার এক পাহাড়ের নীচে আমরা চাপা পড়ে আছি। আমাদের একটা গন্ডির মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার প্রাসাদটা ভেঙে পড়বেই। আমাদের সবাইকেই বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সময়কালে জীবনের প্রথম দিনে যে উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল তাকে আবারও ফিরিয়ে আনতে হবে। সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। এ সাহসের কোনও বয়স নেই।

State at the Center

পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেকারি কমাতে এবার বিদেশে কর্মসংস্থানের চেষ্টা চালাবে বলছে। মূল পরিকল্পনাটি কেন্দ্রের — ভাবনায় ও ব্যবস্থাপনায়, তাতে সামিল হচ্ছে রাজ্যও।

বেকারি হ্রাসের প্রশ্নে মোদী সরকারের মূলত কোনও অবদান নেই। বরং করে আসছে গুচ্ছের প্রতিশ্রুতির প্রতারণা। বছরে দু’কোটি কর্মসংস্থান তো করেইনি। উপরন্তু সরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান লাগাতার লাটে তুলে দিচ্ছে। ব্যাপক বিলগ্নীকরণ, কর্মসংকোচন ও বেসরকারিকরণ তার প্রমাণ। উধাও হয়েছে লক্ষ লক্ষ কাজ, পদ। সরকারি সম্পদ চালান করে দেওয়া হচ্ছে লুটেরা পুঁজিপতিদের হাতে। অন্যদিকে যথেষ্ট ধরা পড়ে গেছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আওয়াজের আবহে কর্মসংস্থানের ধোঁকাবাজি। ২০২০-২১’র অতিমারীতে এটাও উন্মোচিত হয়ে গেছে যে, আজকের ভারত প্রধাণত পরিযায়ী জীবিকা-নির্ভর দেশ। সিএমআইই’র মূল্যায়নে নথিবদ্ধ বেকারির সর্বভারতীয় গড় ৬.৯ শতাংশ। রাজ্যওয়ারি বেকারির হার সবচেয়ে বেশি হরিয়ানায় — ২৬.৪ শতাংশ। এই গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মোদী সরকার বানিয়েছে শ্রমজীবী স্বার্থবিরোধী এক মারাত্মক ‘লেবার কোড’। যারফলে উপরন্তু কাজের অধিকার ও কর্মসংস্থান কচুকাটা করার একচেটিয়া লাইসেন্স পেয়ে যাবে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ।

কর্মসংস্থানের প্রশ্নে রাজ্যের মমতা সরকারও দ্বিচারিতা করে চলছে। ক্ষমতায় এসে বলেছিল বেকারের কর্মসংস্থান করা থাকবে বিশেষ লক্ষ্য। তারপরে কি করেছে! বিগত বিধানসভা নির্বাচনেও বস্তুত মিথ্যাচার চালিয়েছে। বলেছে, ক্ষমতায় আসার দশ বছরের মধ্যে ১ কোটি ২০ লক্ষ কর্মসংস্থান করে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রশ্ন থেকে গেছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় বেকারের হাতে কত কত কাজ মিলেছে? মজুরি বা বেতনের নমুনাই বা কী! বিশেষত যুবশক্তি ও নারীসমাজের কর্মসংস্থান হয়েছে কত? এসবের কোনও বিস্তৃত রিপোর্ট রাজ্য সরকার প্রকাশ করেনি। রাজ্যের বর্তমানে বেকারির ভাগ ৬.২ শতাংশ। সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় সামান্য কম মাত্র। কর্মসংস্থান কেন্দ্রে কর্মপ্রার্থী হিসেবে নাম নথিভুক্ত করার সংখ্যা ৩০ লক্ষ ৫০ হাজারের কাছাকাছি। ২০২০-তে নতুন নাম লিখিয়েছে লক্ষাধিক বেকার। ধরেই নেওয়া যায় অনথিভুক্ত বেকারির আরও কয়েকগুণ বেশি। অতিমারীকালীন সময়ে বোঝা গেল বেকারির চাপ বেড়েছে কত! বেসরকারি ক্ষেত্রে এর নিরসন কত কি কবে হবে সবই অনিশ্চিত। আদৌ হবে কিনা কে বলতে পারে! তবু সরকারি তথা সরকার পরিচালিত পরিপোষিত ক্ষেত্রে শূন্যপদে নিয়োগ করা হচ্ছে না। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগ মিলে মোট শূন্যপদের সংখ্যা ২ লক্ষেরও বেশি। এছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলে শূন্যপদ রয়েছে ১ লক্ষ ৫০ হাজারের মতো। এই দুইয়ের যোগফলে সাড়ে তিন লক্ষের মতো চাকরির ব্যবস্থা এখনই হতে পারে, যুদ্ধকালীন পদক্ষেপে হওয়া উচিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ ও বিভিন্ন পরিকাঠামো খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। কিন্তু এসব নিয়ে রাজ্য সরকারের কোনও হেলদোল নেই। সেই দায় কার্যত এড়িয়ে চলছে। আর যেসব কর্মসংস্থান করে দেওয়ার কেরামতি জাহির করছে তা মূলত অস্থায়ী চরিত্রের — চুক্তিপ্রথায় ও ঠিকা প্রথায়। চুক্তিপ্রথায় মানে — করানো হয় স্থায়ী কর্মচারির কাজের সম স্তরের সম পরিমাণ কাজ, পাশাপাশি বসে কাজ, সমান সুবিধা স্রেফ ছুটিছাটায়, কিন্তু সম বেতনে নয়; নিয়োগ করা হয় বেতনকাঠামো, পিএফ, গ্র্যাচুইটি বিহীন অর্দ্ধেক পারিশ্রমিকে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়ত কয়েকবছর অন্তর বড়জোর এককালীন কিছু ইনক্রিমেন্ট মেলে মাত্র। স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে কাজ করালে যেখানে বছরে বেতন ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, সেখানে সম পরিমাণ কাজের জন্য মমতা সরকার খরচ করছে দু’হাজার কোটি টাকার মতো। অর্ধেকেরও কম টাকায় দায় সারা হচ্ছে। এইভাবে রাজ্য সরকার কর্মসংস্থানের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলছে। কাজ পাওয়ার যাবতীয় ভাগ্য খোলার শর্ত দেখিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগ কি খোলে সেদিকে। বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে পরের পর সরকারি আয়োজন অনুষ্ঠান হয়ে আসছে, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থশ্রাদ্ধ হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এতসব অপদার্থতার প্রেক্ষাপটে রাজ্য সরকার এখন আবার কেন্দ্রের পরিকল্পনার শরিক হিসাবে বিদেশে কর্মসংস্থান করে দেওয়ার কথা বলছে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে ও প্রশিক্ষণ দিয়ে, অনেকটা জার্মান মডেলে। কেন্দ্রীয় সরকার এরকম এক কোটি কর্মপ্রার্থীর নাম তালিকাভুক্ত হওয়ার পরিসংখ্যান শোনাচ্ছে, যারমধ্যে নাকি এই রাজ্যের প্রার্থীদের নাম-ধামও রয়েছে। কিন্তু এক কোটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে পশ্চিমবাংলার কোটা কত তা না করা হচ্ছে খোলসা করে বলা, না করা হচ্ছে ভালো করে খতিয়ে দেখা। রাজ্য ব্যগ্র হয়ে পড়ছে কেন্দ্রের তালে।

bypoll-pointers-anger

সামনের বছরের শুরুতে হতে চলা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনগুলির প্রাক্কালে ১৩টি রাজ‍্যের ও কেন্দ্রশাসিত দাদরা ও নগর হাভেলির মোট ৩টি লোকসভা ও ২৯টি বিধানসভা আসনে ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনের ফলাফল ভারতের রাজনৈতিক আবহে এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত তুলে ধরল। সাধারণত উপনির্বাচনের ফলাফল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেই যায়। কিন্তু এই উপনির্বাচন বিস্ময়কর কিছু ফলাফল সামনে এনেছে। সবচেয়ে অবাক করা ফল দেখা গেল বিজেপি শাসিত হিমাচল প্রদেশে। সেখানকার একমাত্র লোকসভা আসনটি এবং উপনির্বাচনের তিনটি বিধানসভা আসনই কংগ্রেস জিতে নিয়েছে। বিজেপি’র পক্ষে সবচেয়ে উল্লেখযোগ‍্য লাভ এসেছে তেলেঙ্গানায় যেখানে টিআরএস থেকে দলবদল করে আসা একজন প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছে বিজেপি।

অন‍্য যে রাজ‍্যে বিজেপি বিপুল লাভ করেছে তা হল আসাম। সেখানে বিজেপি ও তার জোটসঙ্গী ইউপিপিএল উপনির্বাচনের পাঁচটি আসনই জিতেছে। এই পাঁচটির মধ‍্যে চারটি আসনে এই বছরের গোড়াতেই সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস ও তার জোটসঙ্গী এআইইউডিএফ এবং বিপিএফ জিতেছিল। আসাম ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের মত বিপুল জনবৈচিত্র‍্য ও সাংস্কৃতিক বহুত্ব সম্পন্ন এলাকায় বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীদের ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি শান্তি, সামাজিক সংহতি ও মানবাধিকারের পক্ষে ভীষণ বিপজ্জনক। আসামের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি চারটি আসনেই বিপুল ভোটে পরাস্ত হয়েছে। এর মধ‍্যে দুটি আসনে তারা গত বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছিল। বিজেপি দ্বিতীয় অবস্থান বজায় রেখেছে বটে তবে ভোট শতাংশের হিসেবে এবার বাম ভোটে সামান্য অগ্রগতি চোখে পড়েছে।

মূলধারার গণমাধ‍্যমের বিশ্লেষকেরা বিজেপি’র পরাজয় ও বিহারে তাদের জোটসঙ্গী জেডিইউ’র কোনোক্রমে জয় পাওয়াকে প্রয়াত নেতাদের প্রতি সহানুভূতির কারণ দেখিয়ে ব‍্যাখ‍্যা করছেন। কিন্তু হিমাচল, হরিয়ানা ও রাজস্থানে বিজেপি’র পরাজয় থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মোদী সরকার তথা বিজেপি’র বিপর্যয়কর নীতি ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কাজ করেছে। এমনকি কর্ণাটকেও বিজেপিকে একটি আসনে হারতে হয়েছে নতুন মুখ‍্যমন্ত্রীর নিজস্ব এলাকায়। রকেট গতিতে নিত‍্য প্রয়োজনীয় দ্রব‍্যের মূল্যবৃদ্ধি, উধাও হয়ে যাওয়া স্থায়ী কাজ ও কমতে থাকা আয় — এই মারাত্মক ত্রিবিধ সমাহারের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত গণক্ষোভ এই উপনির্বাচনগুলিতে জনগণের বড় অংশের মনে স্পষ্টতই যথেষ্ট ছাপ ফেলেছে। কৃষক আন্দোলনকে চূর্ণ করতে ও প্রতিবাদী কৃষকদের বদনাম করতে মোদী-যোগী-খাট্টার শাসন যা করে চলেছে তা এই ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

বিজেপি’র বিরুদ্ধে এই ক্রমবর্ধমান গণক্ষোভ ও ভোটে বিজেপিকে হারিয়ে দেওয়ার দৃঢ় সংকল্পের সাধারণ বার্তা এই উপনির্বাচনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এই গণক্ষোভকে শক্তিশালী গণসংগ্রামে চালিত করা ও তাকে নির্বাচনী ময়দানের কার্যকরী বিরোধীপক্ষ হিসেবে বদলে দেওয়াই ২০২২এ আসন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনগুলির আগে সবচেয়ে জরুরি কাজ হিসেবে থাকছে। আন্দোলনরত কৃষকদের সামনে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও পাঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনে কৃষক-বিরোধী মোদী সরকারকে শাস্তি দেওয়ার এবং সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনীর বিভাজনকামী বিপর্যয়কর রাজনীতিকে রুখে দেওয়ার এক চমৎকার সুযোগ। কার্যকরী বিরোধী ঐক‍্য অবশ্য এই প্রশ্নে আর এক চ‍্যালেঞ্জ। বিহারের জোট ভেঙে দুটি আসনে কংগ্রেস ও আরজেডি উভয়েরই প্রার্থী দেওয়াটা দুর্ভাগ‍্যজনক। আরজেডি যত ভোটে জেডিইউর কাছে হেরেছে কংগ্রেস যদিও তার থেকে কম ভোট পেয়েছে, কিন্তু জোটে এই ফাটল স্পষ্টতই ভুল বার্তা দিল।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ নভেম্বর ২০২১)

 Historic Farmers’ Movement

আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২১ ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের একবছর পূর্ণ হতে চলেছে। প্রায় বর্ষব্যাপী অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে, চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জনগণের ক্ষমতায় কী বিস্ময়কর শক্তি নিহিত থাকতে পারে! শত শত কৃষক সংগঠন, তারা জনগণের সামাজিক এবং মতাদর্শগত ক্ষেত্রের এক সুবিস্তৃত অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু তারা একসাথে জুড়ে আছেন কী অভূতপূর্ব ঐক্য, অদম্য উৎসাহ উদ্দীপনা আর যৌথ শৃঙ্খলার প্রতীক হয়ে — লাগাতার প্ররোচনা, হুমকি ও ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার আর পরিকল্পিত হিংস্র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও!

গত আগস্ট মাসের শেষে দিল্লী সীমানায় অনুষ্ঠিত সারা ভারত জনতার সম্মেলন শুধু লড়াকু কৃষকদের ঐক্যই নয়, কৃষক আন্দোলনের প্রতি বিভিন্ন শ্রেণী ও অংশের মানুষের ক্রমবর্ধমান জনসমর্থনকেও তুলে ধরেছে। গত ৫ আগস্ট মুজাফ্ফরনগর মহাপঞ্চায়েত দেখিয়ে দিয়েছে ২০১৩’র ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসার এই উৎপত্তিস্থল কীভাবে কৃষকদের প্রতিরোধ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক দুর্ভেদ্য দুর্গ হয়ে উঠছে। ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ্ও দেখিয়েছে কৃষকদের প্রতি দেশব্যাপী সমর্থন এবং মোদী সরকারের বিরুদ্ধে গোটা দেশের জনরোষ ক্রমশ কীভাবে একই অভিমুখে ধাবিত হয়ে একই বিন্দুতে মিলিত হতে চলেছে। সর্বনাশা কৃষি আইন, শ্রম কোড এবং বেসরকারিকরণ ছাড়াও মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব এবং দেশের সম্পত্তি বেচে দেওয়া হয়ে উঠেছে এখন প্রধান উদ্বেগের বিষয়।

ঠিক এই পটভূমিতেই লখিমপুর গণহত্যা ঘটেছে। আগেই মোদীর মন্ত্রী বনে যাওয়া অতীতের এক কুখ্যাত দুর্বৃত্ত অজয় মিশ্র কৃষকদের এমন এক উচিত শিক্ষা দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল যাতে তারা নাকি লখিমপুর ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না। এই গণহত্যা আসলে সেই হুমকির এক নৃশংস, ঠাণ্ডা-মাথার রূপায়ণ। এর বিরুদ্ধে লখিমপুর এবং সারা দেশের কৃষকদের সংযত ও দ্রুত, সাহসী ও সংকল্পবদ্ধ প্রতিবাদ যোগী সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। সরকারকে কৃষকদের সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় বাধ্য করে তবেই তারা শহীদ সাথীদের অন্তিম বিদায় জানিয়েছেন। অজয় মিশ্র, তার ছেলে আশিস মিশ্র এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে সরকারকে এফআইআর দায়ের করতে হয়েছে এবং আশিস মিশ্রকে গ্রেফতার করতে হয়েছে।

Towards the First Anniversary

 

এই বর্বর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে কৃষক আন্দোলন নিজের অবস্থানে অনড় এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় স্থিতধী থেকেছে, আর সরকারকে কয়েকটি প্রাথমিক আশু দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছে। সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী অবশ্য এখনও আশা করছে, আরও হিংস্রতা লেলিয়ে দিয়ে কৃষকদের সম্পূর্ণ হতোদ্যম, নিশ্চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে। হরিয়ানায় খট্টর তার দলের লোকজনকে লাঠি তুলে নিতে এবং কৃষকদের পেটাতে নির্দেশ দিয়েছেন (পুলিশ ইতিমধ্যেই একজন কৃষককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে), মহারাষ্ট্রে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্য মুখোশধারী দুষ্কৃতিরা বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট কৃষকনেতা সুভাষ কাকুশ্তেকে আক্রমণ করেছে, আর দিল্লীতে আইসা’র ছাত্রীরা যখন অজয় মিশ্রের পদত্যাগ দাবি করে অমিত শাহ’র বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, শাহ’র পুলিশ তাদের যৌন নির্যাতন করে। কৃষক আন্দোলনকে নিজের সমস্ত শক্তিকে সংহত করে হুমকি ও হিংসার দ্বারা আন্দোলনকে চূর্ণ করার ছক ধ্বংস করতে হবে।

একই সঙ্গে আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো, জনগণের ঐক্যকে ভেঙে দেওয়া এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার নিরন্তর চেষ্টা চলেছে। সাম্প্রতিক সিঙ্ঘু সীমানায় উৎপীড়নের এক ঘটনায় ধর্মীয় বিশ্বাসের জঙ্গি সমর্থক নিহাঙ্গদের একটি গোষ্ঠী এক দলিত যুবক লখবির সিং-এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নেয়। এই ঘটনা প্রচণ্ড রূঢ় আঘাত হয়ে নেমে এসেছে; গত প্রজাতন্ত্র দিবসের বিশৃঙ্খলার পর সম্ভবত এটাই আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। পাঞ্জাব সরকার একটি বিশেষ তদন্ত টিম গঠন করেছে এবং কৃষক সংগঠনগুলিও এই ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করে দেখছে। বিশদে যে তথ্য উঠে আসছে, তাতে বেশ খানিকটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। লখবিরের পরিবার ও গ্রামের মানুষজন কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না — যে মানুষ গ্রামের বাইরে ক্বচিৎ পা রেখেছেন তিনি কীভাবে সিঙ্ঘু সীমানায় পৌঁছে গেলেন! কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে যেখানে এই হত্যার দায় নেওয়া ধর্মীয় গোষ্ঠীটির প্রধান আমন সিংকে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমরসহ বিজেপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকতে দেখা গেছে। বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বাবা আমন সিং-এর বৈঠকে পাঞ্জাব পুলিশের বরখাস্ত কর্মী তথা অভিযুক্ত খুনী গুরমিত সিং-এর উপস্থিতি এই গোটা আখ্যানকে আরও সন্দেহজনক করে তুলেছে ।

জম্মু ও কাশ্মীরে নির্দিষ্ট নিশানায় সন্ত্রাসবাদী হত্যাভিযানের সাম্প্রতিক ঢেউ এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে দুর্গাপূজা চলাকালীন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসা কৃষক আন্দোলনের পরিসরে লালিত হিন্দু মুসলমান শিখ সম্প্রীতির উদ্দীপনার সামনে এক চ্যালেঞ্জ। আগামী বছরের শুরুতে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও পাঞ্জাবের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে, সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করা ও কৃষক আন্দোলনে সামনে উঠে আসা রুটি-রুজি ও উন্নয়নের অ্যাজেন্ডা থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে দিন-রাত ঘাম ঝরাচ্ছে। কৃষক আন্দোলন প্রথম বর্ষপূর্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। ভারতকে কর্পোরেট লুঠ, সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে, আসুন আন্দোলনের অর্জনকে রক্ষা করি এবং ছড়িয়ে দিই!

- লিবারেশন সম্পাদকীয়, নভেম্বর ২০২১ সংখ্যা

human rights activists

৩ নভেম্বর পশ্চিম আগরতলা থানার তদন্তকারী আধিকারিক এসআই শ্রীকান্ত গুহ কর্তৃক স্বাক্ষরিত ৪১এ ধারায় দিল্লীর আইনজীবী শ্রীযুক্ত মুকেশ এবং আনসার ইন্দোরির বিরুদ্ধে এক নোটিশ পাঠানো হয়। এই দু’জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা নেওয়া হয়। মামলার নম্বর হল,পশ্চিম আগরতলা থানা ২০২১, ডব্লিওএজি-১৮১, তারিখ ০৩/১১/২০২১। ঐ মামলায় ১৫৩এ, ১৫৩বি, ৪৬৯, ৪৭১, ৫০৩, ৫০৪, ১২০বি আইপিসি এবং ইউএপিএ১৩ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। ত্রিপুরার ইতিহাসে এই প্রথম ইউএপিএ ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। অক্টোবরে বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রাজ্যজুড়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মসজিদে আক্রমণের ঘটনা ঘটে। তা নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন সামাজিক মাধ্যমে তথা টুইটার, ফেসবুক ও ইউটিউবে তাদের একান্ত নিজস্ব ও ভিন্নমত প্রকাশ করে। ত্রিপুরা পুলিশের অপরাধ দমন বিভাগের সাইবার অপরাধ দমন শাখা সামাজিক মাধ্যমে এরকম ১০২টি পোস্ট পরীক্ষা করে এখনো পর্যন্ত ৬৮ জনের বিরুদ্ধে এই মামলা নথিভুক্ত করেছে বলে খবরে প্রকাশ। ৩ নভেম্বরের পূর্বে বিভিন্ন সময়ে এই ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়। এই ধরনের পোস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা, উস্কানি দেওয়া সহ গুজব রটনা করে ত্রিপুরা সরকার ও পুলিশের মানহানি করা এবং একইসাথে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক একতা বিনষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশের তদন্তকারী আধিকারিক আগরতলা পশ্চিম থানায় আগামী ১০ নভেম্বর তাদের দু’জনকে ডেকে পাঠিয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক হিংসা ও আক্রমণের ঘটনাবলী খতিয়ে দেখতে এবং পিইউসিএল নামক একটি মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের অংশ হিসাবে এই দু’জন আইনজীবী সহ মোট ৪ জন গত ৩০ অক্টোবর ত্রিপুরায় এসেছিলেন। গোমতী জেলার কাকড়াবন থানার দরগা বাজারে, উত্তর ত্রিপুরা জেলার পানিসাগরে ও রোয়া বাজারে তারা ঘটনাবলী খতিয়ে দেখেন এবং ঊনকোটি ত্রিপুরা জেলার কৈলাশহরে জেলা শাসকের সাথে কথা বলে ৩১ অক্টোবর রাতে তারা আগরতলা ফিরে আসেন। ১ নভেম্বর তারা দিল্লী ফিরে যান। ১ নভেম্বর ফিরে যাওয়ার পূর্বে আগরতলা প্রেস ক্লাবে তারা একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। দিল্লী ফিরে গিয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং ফেসবুক লাইভে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ফেসবুক লাইভে তুলে ধরা বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে পুলিশ এই মামলা নিয়েছে বলে অভিযোগ।

lawyers and human rights activists

 

এখানে এটা খুবই স্পষ্ট যে, ভিএইচপি ও বজরং দলের নামে যারা রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় মিছিল থেকে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়াল, সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবন-সম্পত্তির উপর, মসজিদের উপর আক্রমণ সংঘটিত করল, ধর্মীয় গুরু প্রফেট মহাম্মদের নামে বিকৃত শ্লোগান ও উস্কানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করল, পুলিশ তাদের এখনো গ্রেপ্তার করেনি। এখনো পর্যন্ত নাকি ১১টি অভিযোগ ও ৪টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে এবং ৫ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু তারমধ্যে প্রকৃত অপরাধীরা কেউ নেই বললেই চলে। অথচ পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা নিচ্ছে, যারা ঘটনাস্থলে গিয়ে জনগণের সাথে কথা বলে, প্রকৃত ঘটনা যাচাই করে সত্যিটা তুলে ধরে সাম্প্রদায়িক শান্তি সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করেছে। সংবাদ মাধ্যমে ও সামাজিক মাধ্যমে তারা ভিন্ন ও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ’র মত দানবীয় কালো আইন প্রয়োগ করেছে। সরকারের নির্দেশে পুলিশ নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য এবং জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এই ধরনের মামলা নিয়েছে। সংবিধান প্রদত্ত ভিন্ন মত ও বিরোধী মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার দাবিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা ছাড়া এআর কিছুই নয়। এটা ভয় দেখিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা। তাছাড়া এই ঘটনাবলীর সাথে বাস্তবে এদের কোনোপ্রকার সম্পর্ক নেই এবং ঘটনার সময়ে তারা এখানে ছিলেনও না। তাই পুলিশের আনা এই অভিযোগ মনগড়া, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

তাই দিল্লীর আইনজীবীদের উপর থেকে এই মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি দাবি জানায়। বাংলাদেশে সংঘটিত হিংসার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ত্রিপুরায় সম্প্রতি অক্টোবর মাসে রাজ্যজুড়ে পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হিংসা ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর আক্রমণের ঘটনায়, বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য, উস্কানি ও বিকৃত শ্লোগান অবাধে ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তি সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগে অভিযুক্ত প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দাবি জানাচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার জন্য দাবি করছে।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির

movement of villages


[ প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে দেওয়া রিপোর্ট ]

গত ১ নভেম্বর ‘সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’ ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একটি প্রতিনিধি দল পুরুলিয়ার অযোধ্যায় যায়। বেশ কিছুদিন যাবৎ যে গণ আন্দোলন সেখানে চলছে তার সংহতিতে। ‘ঠুড়গা পাম্পড স্টোরেজ প্রকল্প’ তৈরির বিরুদ্ধে। অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে প্রকৃতি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠি এই প্রকল্পের ফলে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। অযোধ্য পাহাড়ের আদিবাসী নেতৃত্ব গত ৯ অগাস্ট এক সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। সেখানে জঙ্গল বাঁচাও কমিটি, প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ, ভারত জাকাত মাঝি পরগনা মহল এবং অন্যান্য সংগঠন যোগ দিয়েছিল। বিভিন্ন জেলার আদিবাসী ও অ-আদিবাসী মানুষ একজোট হয়ে এই সমাবেশকে সফল করেন। ৮ অক্টোবর তাঁরা পুরুলিয়া জেলা শাসককে ডেপুটেশন দেন এবং সেখানে ধর্ণায় বসেন, পরে জেলা শাসকের আশ্বাসে তখনকার মত অবস্থান উঠিয়ে নেন। হাইকোর্টেও এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চলছে। হাইকোর্টে প্রাথমিক সাফল্যও কিছু পাওয়া গেছে। আদিবাসী অধিকার মঞ্চ ও পার্টির প্রতিনিধি দল গত সোমবার ওখানে পৌঁছায়। দলে ছিলেন হুগলী জেলার পাগান মুর্মু ও গোপাল রায়, বাঁকুড়া জেলার রামনিবাস বাস্কে, মঙ্গল মুর্মু এবং পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য ফারহান হোসেন খান।

পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড় প্রকৃতিপ্রেমিদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। আবার আদিবাসীদের কাছে, বিশেষত সাঁওতাল সমাজের মানুষদের কাছে এই ‘আযোদিয়া বুরু’ পবিত্র স্থান, একে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রথা ও ঐতিহ্যের ধারা। ইদানীং কালে এই এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে একটা আশঙ্কা ও ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এখানকার মনুষজন কিছুটা সংগঠিতভাবে এই আশঙ্কা বা ভয়কে পরাস্ত করতে চাইছেন। এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ পাহাড় এখন কর্পোরেটদের গ্রাসে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে যা জানা যায় —

Ayodhya hills

 

১) এখানকার পর্যটনকে ঘিরে একটি বেআইনি জমি-চক্র চলছে। বাইরে থেকে আসা অ-আদিবাসী ব্যবসায়ি প্রথমে কোনও আদিবাসী মানুষের নামে থাকা বনের জমি অন্য কোনও আদিবাসী মানুষের নামে কিনে নেয়। পরে দ্বিতীয় জনের কাছ থেকে একটা লম্বা সময়ের মেয়াদে সেই জমি লিজ নিয়ে সেখানে লজ বানিয়ে ব্যাবসা শুরু করে। যে পরিমাণ জমি তারা লিজ নিচ্ছে কোনও এক আদিবাসীর কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ বনের জমি দখল করে এইসব লজ বানানো হচ্ছে। এই বেআইনি কাজে প্রশাসনের মদত থাকছে। ফলত পর্যটন শিল্প এখানকার আদিবাসীদের অর্থনৈতিক স্বস্তি দেওয়ার বদলে দুর্নীতি ও জমি লুটের ক্ষেত্রে পর্যবসিত হয়েছে।

২) ইতিমধ্যে ‘পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট’ (PPSP) নামে যে প্রকল্পের দরুণ একটি লোয়ার (পাহাড়ের নীচে) ও একটি আপার (পাহাড়ের ওপরে) ড্যাম বানানো হয়েছে তাতে বিশাল অংশের বন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বনের এই অংশ হাতিদের বিচরণ ও বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা ছিলো। এরপর থেকে হাতিদের লোকালয়ে প্রবেশ ব্যাপক বেড়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা।

৩) এখানে যে নতুন ঠুড়গা পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট (TPSP) হচ্ছে তা এখানকার মানুষকে ধোঁকা দিয়ে। পঞ্চায়েত থেকে কোনও একটা মিটিং ডেকে সেখানে টিফিন পেতে গেলে সই লাগবে, এই বলে কিছু পরিমাণ মানুষের সই নিয়ে সেটাকেই গ্রামসভার স্বীকৃতি বলে দেখানো হয়েছে।এই প্রকল্প নিয়ে কোনও চর্চা আলোচনা না করে, কোনওরকম উল্লেখ না করেই এ কাজ করা হয়েছে। এখানে প্রজেক্ট হলে মূল বনভূমিটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। ১১টা গ্রাম সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হওয়ার মুখে। এখানকার মানুষের অনুমান অনুযায়ী এই প্রজেক্টের মধ্যে দিয়ে সরকারের লাভের পরিমাণ খুব কম। এই প্রজেক্টকে দেখিয়ে এখানকার পাহাড়ের কাঠ ও পাহাড়ে সুড়ঙ্গ কেটে মাটির নীচের যে মূল্যবান মাটি রয়েছে তা পাচার হওয়ার সন্দেহ করছেন এখানকার মানুষ, যা PPSP করার সময় দেখা গিয়েছিলো। পূর্ব অভিজ্ঞতাতে তাঁরা দেখেছিলেন কীভাবে মানুষের কাছ থেকে জমি কিনে, পরে কিছু মাটি পাড়ে লাগানো হয়েছিলো আর বেশিরভাগটা ট্রাকে করে ত্রিপলের প্যাকিং দিয়ে বাইরে পাঠানো হয়েছিলো।

৪) এই প্রকল্পকে রুখে দেওয়ার জন্য এখানকার নেতৃত্ব সুপেন হেমব্রম, নকুল বাস্কেরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সাথে সাথে পাহাড়ের মানুষের চাহিদাগুলির দাবিও তাঁরা করে যাচ্ছেন। এখানকার নেতৃত্ব মনে করছেন অধিকাংশ মানুষ তাঁদের সাথে রয়েছে। কিছু মানুষ প্রোজেক্ট হলে কাজ পাবে বলে প্রচার করছেন, আর কিছু জনকে (মূলত তৃণমূলকর্মী) আগের থেকেই টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে যারা এই প্রজেক্টের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু এই প্রজেক্ট নিয়ে হাইকোর্টে কেস চলছে তাই এখানকার স্থানীয় নেতৃত্ব এখন মূলত গ্রামসভাগুলি গঠনের চেষ্টা করছেন।

৫) পুলিশ ইতিমধ্যে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে একটি মামলা দিয়েছে স্থানীয় নেতৃত্বদের বিরুদ্ধে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর। ওখানে সেদিন অরণ্যের অধিকার আইন সম্পর্কে একটি সচেতনতা যাত্রা চলছিল। যদিও এই দমন করার চক্রান্তকে আমল দিচ্ছেন না স্থানীয় আদিবাসী সমাজের মানুষজন।

লিডারদের সাথে খোলামেলা আলোচনা পার্টি ও আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “আপনাদের সাথে লড়াই-এর সংহতিতে আমরা রয়েছি, ভবিষ্যতে প্রয়োজনে আমরা সাথে থাকবো”।

অযোধ্যা হিল টপে ছাতনি গ্রামের বাসিন্দা এবং এই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব নকুল বাস্কে বলেন, “আমাদের হাতিয়ার ফরেস্ট রাইটস এক্ট। এটাকে কাজে লাগিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এই প্রকল্প চাই না। একেই রোজগারের লোভ দেখিয়ে সহজ সরল গ্রামবাসীদের জমি অনির্দিষ্টকালের জন্যে লিজ নেয়া তার পাশাপাশি মাপের বেশি জমি দখল করে নিচ্ছে দিকুরা। যার ফলে কাটা পড়ছে অনেক জঙ্গলের গাছ। এগুলোর সঙ্গে কিছু গ্রামের নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

Thurga project

“আদিবাসীরা গাছের একটা ডালে হাত দিলে বনবিভাগের অফিসাররা তেড়ে আসে অথচ বাইরের কোম্পানি এসে চোখের সামনে পুরো জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলছে — তা নিয়ে কারোর মুখে কোনো কথা নেই” খুব সাবলীলভাবে কথাগুলো বলে গেলেন পুরুলিয়ার অযোধ্যায় পরিকল্পিত ঠুড়গা পাম্প স্টোরেজ প্রকল্পের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের নেতা নকুল বাস্কে।

ভারতীয় অরণ্য আইন (১৯২৭) ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন (১৯৭২/ ২০০২/২০০৬) এবং অংশত অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০) অনুযায়ী ঐতিহাসিকভাবে অরণ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল বনদপ্তরের হাতে। উক্ত আইনগুলিতে আদিবাসী বা বনবাসী মানুষের অরণ্য নির্ভর অস্তিত্বের কথা কোথাও ছিল না। অরণ্যের জমি মানেই ‘সরকারি জমি’। এই ধারণার সুযোগ নিয়ে ভারতবর্ষের অরণ্যের জমিতে হওয়া আরও অনেক বড় বড় প্রকল্পের মতো পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়াতে শুধুমাত্র অযোধ্যা পাহাড়ের বুকেই চারটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কেন্দ্র, রাজ্য এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানি জাপানের ‘ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি’র (জাইকা) যৌথ পরিকল্পনায় প্রকল্পগুলি গড়ে তোলার কথা হয় বামনী, ঠুড়গা, বান্দু, কাঁঠালজল — এই চারটি নদীর উপর। পরিকল্পনামাফিক ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পুরুলিয়া পাম্পড্ স্টোরেজ প্রোজেক্ট (পিপিএসপি)-র কাজ শুরু হয় বামনী নদীর উপরে। নির্মাণের কাজ চলে ২০০৮ সাল পর্যন্ত। এই পর্যায়েই ২০০৬ সালে পাশ হয়ে গেছে ‘বন অধিকার আইন’ যা আদিবাসী ও বনবাসীদের অরণ্যে কৃষি ও বাসভূমির ব্যক্তিগত অধিকার, বনজ সম্পদ সংগ্রহ ও বনভূমির উপর সামুদায়িক অধিকার, অরণ্যের পরিচালনা ও ব্যবহারের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবুও বনবাসীদের অজ্ঞতা আর অরণ্যের বিষয়ে শহুরে মধ্যশ্রেণীর সহজাত উপেক্ষাকে সম্বল করে, অযোধ্যাবাসীর সাথে কোনো আলোচনা না করে, শুধুমাত্র চাকরি দেওয়া ও প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে ব্যবহারের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই এই প্রকল্পের নির্মাণ সম্পন্ন হয়।

সাধারণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে নদীতে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখা হয় এবং জলধারার স্রোতের মুখে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। কিন্তু ছোটনাগপুর মালভূমির অন্তর্গত অযোধ্যার পাহাড়ি এলাকায় নদী-নালাগুলিতে জলের পরিমাণ বেশি থাকে না। এক্ষেত্রে নদীর উপর কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে ভিন্ন উচ্চতায় দুটি জলাধার তৈরি করা হয়। উচ্চ জলাধারে সঞ্চিত জল নিম্ন জলাধারে ছাড়া হলে টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। কিন্তু নদীতে জলের পরিমাণ কম থাকায় পরবর্তী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উচ্চ জলাধারে দ্রুত প্রয়োজনীয় জল মজুত হয়না। তখন নিম্ন জলাধারের জল পাম্প করে উচ্চ জলাধারে পাঠানো হয়। টারবাইন ঘুরিয়ে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, পাম্প করে জল উচ্চ জলাধারে পাঠাতে তার চেয়ে কুড়ি শতাংশ বেশি বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে। অর্থাৎ পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তার চেয়ে বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রকল্পকে পরিচালিত করতে প্রয়োজন। এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ক্রয় করা হয় গ্রিড থেকে। ব্যয়বহুল এই প্রকল্পটি একটি পাওয়ার ব্যাক আপ প্ল্যান হিসেবে কাজ করে যা শহরে অথবা বৃহৎ কলকারখানায় বিদ্যুতের তাৎক্ষণিক ঘাটতি পূরণ করে। নিয়মিত বিদ্যুৎ উৎপাদন এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য নয়।

Thurga project_2

 

পুরুলিয়া পাম্পড্ স্টোরেজ প্রকল্পের ফলশ্রুতি স্বরূপ অযোধ্যা পাহাড়ের ছটি টিলার বারোশো একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে, কাটা পড়েছে সাড়ে তিন লক্ষ গাছ। দুটি জলাধারে আবদ্ধ হয়ে হারিয়ে গেছে বামনী নদী। যার ফলশ্রুতিতে অপ্রতুল হয়েছে চাষের জল, কমেছে জলস্তর। জলাধার দুটির মধ্যে জল প্রবাহের জন্য পাহাড় ভেদ করে একাধিক সুড়ঙ্গ খনন করা হয়েছে। ফলত পাহাড়ে ভূমিক্ষয় ও ধ্বস নামার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই সুড়ঙ্গপথের জন্য উপযুক্ত পথ অনুসন্ধানের অজুহাতে পাহাড়ের গর্ভস্থল থেকে লুঠ হচ্ছে খনিজ আকরিক। জঙ্গলের হাতি খাবার না পেয়ে প্রায়শই হানা দিচ্ছে গ্রামে, চাষের ক্ষেতে। সংখ্যা কমছে খরগোশ, ভাল্লুক, ময়ূর, হরিণ, বনবিড়াল, শূকর, সাপ ও অন্যান্য পশুপাখির। অরণ্য ধ্বংস হওয়ায় বনবাসীরা হারিয়েছেন পশুচারণভূমি, রোজকার জ্বালানির উপকরণ, ঘর তৈরির সরঞ্জাম, বিক্রির জন্য কেন্দু পাতা কিংবা বনৌষধি ভেষজ গাছ। পুরো প্রোজেক্টে মাত্র চারজন স্থানীয় আদিবাসী যুবক সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পেয়েছেন, তবে তা বেসরকারি সংস্থার অন্তর্গত এবং অস্থায়ী চাকরি। এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দৈনিক গড়ে ৮৫০-৮৬০ মেগাওয়াট হারে ব্যবহারের জন্য চলে যাচ্ছে রাঁচি, আরামবাগ বা কলকাতায়। প্রকল্প তৈরি হওয়ার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অযোধ্যায় স্বাস্থ্য বা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির বদলে তৈরি হয়েছে বড় বড় রাস্তা।

২০১৫ সালে পুরুলিয়া পাম্পড্ স্টোরেজ প্রকল্প থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে ঠুড়গা নদীর উপর দ্বিতীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সরকার। ৪,২০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের জন্য পরামর্শদাতা সংস্থা হিসেবে নিযুক্ত হয় কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের অধীনস্থ ওয়াপকস, জাপানি সংস্থা জে পাওয়ার, কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি, সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন। অথচ মতামত নেওয়া হয় না অযোধ্যার আদিবাসী বনবাসীদের, যাঁদের অনুমতি ছাড়া কোনও প্রকল্পই গড়ে উঠতে পারে না। ‘বন অধিকার আইন’ অনুযায়ী গ্রামের ব্যবহার্য জঙ্গল গ্রামসভার সাধারণ সম্পত্তি বা কমিউনিটি ফরেস্ট রিসোর্স৷ গ্রামের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ একসঙ্গে বসে যে গ্রামসভা তৈরি করবেন, তা এই জঙ্গল দেখাশোনা করবে। বনভূমিতে এধরনের কোনও প্রকল্প করতে গেলে গ্রামসভা ডেকে প্রকল্পের বিবরণ স্পষ্ট করে জানিয়ে ন্যূনতম পঞ্চাশ শতাংশ গ্রামবাসীর সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ হতে হবে মহিলা। এক্ষেত্রে তাঁর কিছুই করা হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত বনবাসীরা ২০১৮ সালে কলকাতার হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে এই প্রকল্পের বিরোধিতায় মামলা করলে সরকারের পক্ষ থেকে আদালতে ১৭টি গ্রামসভার মধ্যে মাত্র অযোধ্যা ও বাগমুন্ডি — এই দুই গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রামসভার নথি দেখানো হয়। এরমধ্যে একটিতে সই ছিল মাত্র ২৪ জনের আর অন্যটিতে একটিও নয়। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী শুধুমাত্র অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ১,৬০০’র বেশি। ২০১৯ সালে জুলাই মাসে কলকাতা হাইকোর্ট আন্দোলনকারীদের পক্ষে রায় দেয়। প্রকল্পের কাজে স্থগিতাদেশ বজায় থাকে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করে রাজ্য সরকার। গত সেপ্টেম্বর মাসে তার শুনানি শেষ হয়েছে। আদালতের রায় প্রকাশের অপেক্ষায় আছেন অযোধ্যাবাসী।

এই রাজ্যে ‘বন অধিকার আইন’ সম্পূর্ণরূপে লাগু হয়নি কোথাও। এই আইন পাশ হওয়ার ষোলো বছর পরেও সরকার বনবাসীদের আইনের ন্যূনতম অধিকারগুলো জানাবার কোনো প্রচেষ্টাই করেনি। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি সেই অসম্পূর্ণ কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। প্রত্যেক গ্রামে গিয়ে নিজেরাই গ্রামসভা ডেকে গঠন করছেন ‘বন অধিকার সমিতি’। কাজটা সহজ নয়। কারণ ব্রিটিশ আমল থেকে অরণ্য রক্ষণাবেক্ষণের একমাত্র অধিকারী বনদপ্তর। গ্রামসভার মাধ্যমে ‘বন অধিকার সমিতি’ গঠনের মাধ্যমে এই আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার গোড়ায় সরাসরি আঘাত করা হচ্ছে। গ্রামসভাগুলির ক্ষমতায়ন হলে যেকোনো প্রকল্পের জন্য সহজে বনভূমির হস্তান্তর কঠিন হয়ে পড়ে। অরণ্যের রক্ষক বনবাসীর সাথে শিল্পগোষ্ঠীর অঙ্গুলিহেলনে কাজ করতে অভ্যস্ত ক্ষমতার সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। সেই কারণেই গত ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর অযোধ্যা পাহাড়ে ‘প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’র উদ্যোগে ‘জনচেতনা র‍্যালি’র সাতজন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টে মামলা দায়ের করা হয়। গত ৮ অক্টোবর সারা রাজ্যের বনাঞ্চলে ‘বন অধিকার আইন’ চালু করা এবং প্রতিটি গ্রামে গ্রামসভা গঠনের দাবিতে ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগণা মহল’, ‘পুরুলিয়া জুয়ান মহল’ ও ‘প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’র তরফ থেকে পুরুলিয়ায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও অবস্থানের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এই কর্মসূচি আটকানোর জন্য সমগ্র জেলা জুড়ে পুলিশ ব্যারিকেড করে আন্দোলনকারীদের বাস-গাড়ি আটকে দেয়। ‘অযোধিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলন’ সংহতি মঞ্চের কর্মীদের হুড়া থানায় প্রায় ছ’ঘণ্টা আটক করে রাখা হয়। এছাড়া আন্দোলনকারীদের ডেপুটেশনে আসার জন্য প্রয়োজনীয় বাস না দেওয়ার জন্য বাস মালিকদের উপর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে, হুমকি দিয়ে, নানা ছল চাতুরি করে মিছিলের অংশগ্রহণকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়।

development or destruction

 

বহু বাধা সত্ত্বেও মূল কর্মসূচিতে যোগ দিতে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়সহ, মানবাজার, বান্দোয়ান, নেতুড়িয়া, সাঁতুড়ি ইত্যাদি অঞ্চল থেকে এবং বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় ৪,০০০ আদিবাসী মানুষ ধামসা, মাদল, তীর-ধনুক নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন। অরণ্যবাসীর এই আন্দোলন আর শুধুমাত্র ঠুড়গা প্রকল্প বাতিলের আন্দোলনে আবদ্ধ হয়ে নেই। রাজ্যের বনাঞ্চলে ‘বন অধিকার আইন’ লাগু করা, গ্রামসভা গঠনের দাবির পাশাপাশি বনভূমি ধ্বংস করে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন কেন্দ্র গঠনের বিরোধিতা, অযোধ্যায় প্লাস্টিক, থার্মোকল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা সহ আদিবাসীদের ধর্মীয়স্থান সুতানটানডি, মারাংবুরুর সংরক্ষণের কথাও উঠে এসেছে তাঁদের দাবি সনদে। পুরুলিয়া প্রশাসন এই সমাবেশের দাবি সনদের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বন অধিকার আইন’ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের ঔদাসীন্যের কথা স্বীকার করে নেন। আগামী ১০ নভেম্বর আদিবাসী দপ্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে ‘বন অধিকার আইন’ লাগু করার প্রক্রিয়া নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। যদিও এই রকম বহু মিথ্যে আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিতে অভ্যস্ত আন্দোলনকারীরা প্রয়োজনে দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।

তবে এই লড়াই শুধুমাত্র আদিবাসী ও বনবাসীদের নয়। গত ছ’সাত বছরের ইতিহাস দেখাচ্ছে, দেশের আইন পরিবেশ বাঁচাতে যে সব রক্ষাকবচ তৈরি করেছিল, সেগুলো ক্রমশ আলগা, দুর্বল হচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯, এই পাঁচ বছরে পরিবেশের উপর শিল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য গঠিত এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রুলস, সংক্ষেপে ইআইএ, একের পর এক সংশোধন করেছে কেন্দ্র। সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি (সিইএ) সারা দেশে ৫৬টি জায়গা এই ধরনের জলাধার ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য চিহ্নিত করেছে। যারমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেই কম পক্ষে ন’হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব বলে সিইএ তাদের রিপোর্টে কেন্দ্রকে জানিয়েছে। অর্থাৎ অনুমান করা যায় আরও অন্তত পাঁচটি প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আবার স্বল্প পরিসরে কয়েক কিলোমিটার ব্যবধানে পরিকল্পিত প্রকল্পগুলিকে একসাথে দেখলে পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র আদায়ের জন্য সরকার পুরুলিয়ার অযোধ্যার জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা করে আসছে। ঠুড়গা প্রকল্পের পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বান্দু এবং কাঁঠালজল প্রকল্পের জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের দুটি পর্যায়ের ছাড়পত্র পেয়ে গেছে। ঠুড়গা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আটকানো যাবে না বান্দু এবং কাঁঠালজল প্রকল্প। এই চারটি প্রকল্পের জন্য অযোধ্যা পাহাড়ে প্রায় ২,০০০ হেক্টর জমির প্রয়োজন যারমধ্যে ১,০০০ হেক্টরই বনভূমি। বামনী নদী এবং ঠুড়গা নদী একসাথে গিয়ে পড়েছে শোভা নদীতে, যা পরবর্তীতে মিলিত হয়েছে সুবর্ণরেখার সাথে। ফলে বামনী আর ঠুড়গা নদী হারিয়ে গেলে কমবে সুবর্ণরেখায় জলের পরিমাণ। অযোধ্যা পাহাড়ের সন্নিহিত এলাকায় মেঘ ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি নামায়। প্রকল্পগুলির ফলে কমবে বৃষ্টির পরিমাণ, নামবে জলস্তর। বামনী প্রকল্পে কাটা পড়েছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ গাছ, যারমধ্যে একটি গাছও অনত্র লাগানো হয়নি। ঠুড়গা প্রকল্পে কাটা পড়বে আরও অন্তত আড়াই লক্ষ গাছ। বাতাস, জল, মাটি এবং জীববৈচিত্র্য — বাস্তুতন্ত্রের এই চারটি উপাদানের একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেই আঘাত লাগে প্রকৃতির ভারসাম্যে। নাগরিক সমাজের পরিবেশের প্রতি ঔদাসীন্য অব্যাহত থাকলে এই শতাব্দীর শেষে ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপ বাড়বে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও জানিয়ে দিচ্ছে আয়লা, বুলবুল, আমফান বা ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকায়। অল্প সময়ের মধ্যে অতিবৃষ্টির জন্য বন্যা, তারপর দীর্ঘ সময় ধরে অনাবৃষ্টির ফলে খরা হচ্ছে। শহরের মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য আজ যে প্রকল্প তৈরি হচ্ছে আগামীতে তার সর্বোপরি ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিস্তার নেই কারোর।

তবে জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে উপচে পড়া জনসমাবেশ ভরসা জোগায় যে অরণ্য রক্ষা করার দায়ভার তুলে নিয়েছেন এই অরণ্যের অধিবাসীরাই। অরণ্যে স্বশাসন প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি তাঁদের কাছে আত্মমর্যাদার, স্বাভিমানের৷ আর বিশ্বজোড়া পরিবেশ ধ্বংসের শতাব্দীতে ঠুড়গা প্রকল্পের বিরুদ্ধে লড়াই আমার আপনার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ঠুড়গা প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে এই সামগ্রিক মাপকাঠিতে দেখতে হবে।

- নাতাশা খান
(পূর্বাঞ্চল ডট.কো থেকে পুনঃপ্রকাশিত)

endangered world

এবছর অক্টোবর মাসে আমরা একের পর এক নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে দেখলাম, যার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে লাগাতার বৃষ্টিপাত হয়ে চলল। পরিণামে বন্যা, কৃষি জমির সমুদ্রের নোনা জলের নীচে চলে যাওয়া, ফসল নষ্ট, ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির মতো ঘটনাগুলোও ঘটল। এবছরে প্রকৃতিকে উত্তরাখণ্ডেও অত্যন্ত রুষ্ট রূপে দেখা গেল, প্রবল বৃষ্টিপাত ও ধ্বসে পাহাড় ঘেরা রাজ্যটা বিপর্যস্ত হল এবং পশ্চিমবাংলা থেকে যাওয়া অন্তত দশজন ট্রেকার ঐ বিপর্যয়ের শিকার হলেন। বুলবুল, আমপান, ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ের হানাদারিও নিয়মিত পরিঘটনা হয়েই দেখা দিচ্ছে। যেগুলো ‘অস্বাভাবিক’ প্রাকৃতিক ঘটনা বলে বিবেচিত হত, সেগুলোরই ‘নিয়ম’ হয়ে ওঠাটা ভয়াবহ এক আশঙ্কাকেই, পৃথিবীর অস্তিত্বের সংকটের দিকেই ইঙ্গিত করে। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়গুলো শুধু পশ্চিমবাংলার, ভারতের বা নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের উদ্বেগের বিষয় নয়। দুনিয়া জুড়েই এখন এসবের প্রবল আবির্ভাব এবং এগুলোর সঙ্গে যে জলবায়ু পরিবর্তনের যোগ তাও এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের ভাবনা ও গবেষণা প্রকৃতির এই উগ্ৰ আচরণের পিছনে কারণ হিসাবে খুঁজে পেয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ণকে। এবং এই উষ্ণায়ণের প্রশমন ছাড়া, পৃথিবীর বেড়ে চলা তাপমাত্রায় রাশ টানা ছাড়া পৃথিবীর বাঁচার, তার টিঁকে থাকার অন্য কোনো পথ যে নেই সেই স্বতঃসিদ্ধতা এখন প্রতিষ্ঠিত। আর তাই ১৯৯৭’র ডিসেম্বরের কিয়োটো প্রোটোকলের পর থেকে নিয়মিতভাবেই রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে হয়ে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তন কেন্দ্রিক, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে রাশ টানা নিয়ে আলোচনা। বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বা পার্টি এই সমস্ত আলোচনায় অংশ নেন, গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণে অগ্ৰগতি কি আদৌ ঘটে? এবছরেও রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে ১ নভেম্বর থেকে স্কটল্যাণ্ডের গ্লাসগোয় শুরু হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনা যা চলবে দু’সপ্তাহ ধরে। ১২০টির বেশি দেশের প্রায় ২৫,০০০ পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপ্রধান, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী ও অন্যান্যরা জড়ো হচ্ছেন গ্লাসগো শহরে, পরিবেশ সম্মেলনে অংশ নিতে। এই প্রতিবেদন লেখা যখন চলছে, গ্লাসগোয় আলোচনা তখনও জারি রয়েছে। কাজেই, সেখান থেকে চূড়ান্ত ফয়সালা কি বেরিয়ে আসছে তা জানতে এখনও কয়েক দিন বাকি। তবে, সেখানের চর্চায় গুরুত্ব পাওয়া বিষয়গুলোর দিকে আমরা দৃষ্টিপাত অবশ্যই করতে পারি।

রাষ্ট্রপুঞ্জের অভিধা অনুযায়ী গ্লাসগো সম্মেলনের পরিচয় হল সিওপি২৬ — কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ ২৬। সম্মেলনে যারা যোগ দিচ্ছে তারা সবাই পার্টি, আর এবারেরটা তাদের ২৬ নম্বর সম্মেলন। গ্লাসগো সম্মেলনকে ২০১৫’র প্যারিস সম্মেলনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চক্র বলে মনে করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন যে মাত্রা অর্জন করেছে এবং তার পরিণামে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই প্রকৃতির ঘটানো যে বৈপরীত্যমূলক ও চরম রূপের ঘটনাগুলো দেখা যাচ্ছে, সেটাই বোধকরি গ্লাসগো সম্মেলনের গুরুত্ব পাওয়ার এমন কারণ। খরা ও বন্যা, দাবদাহ ও শৈত্যপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড় ও দাবানল, প্রবালপ্রাচীরের ধ্বংস, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রের জলস্তরের বৃদ্ধি — এই সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর প্রাবল্য অবশ্যই নিষ্ক্রিয়তা পরিহার করে সচেতনতা ও সক্রিয়তার দাবি জানায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষজ্ঞদের অভিমত — যেটাতে পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরাও সহমত —পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে গেলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে শিল্প যুগের শুরুর আগের সময়ের তাপমাত্রার চেয়ে ২ ডিগ্ৰি সেলসিয়াসের বেশি করলে চলবেনা। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ১.১ ডিগ্ৰি সেলসিয়াস বৃদ্ধির বর্তমান স্তর থেকে শতাব্দীর শেষ নাগাদ ঐ বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্ৰি সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখতে পারলেই আরো মঙ্গল। আর গ্ৰিনহাউস গ্যাসই যেহেতু তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটায়, তার উৎপন্নের উৎস কয়লা ও পেট্রল-ডিজেলের মতো জীবাষ্ম জ্বালানির নিয়ন্ত্রণ ও সেগুলোর প্রয়োগ যথেষ্ট মাত্রায় কমালে তবেই ঐ লক্ষ্য পূরণ সম্ভব। রাষ্ট্রপ্রধানরা যে প্রতিশ্রুতি দেন তা পূরণে অনীহা দেখা যায়, এবং বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যে-সমস্ত প্রতিশ্রুতি রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে পাওয়া গেছে সেগুলো পালন হলেও এই শতকের শেষ নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্প পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে বাড়বে ২.৭ ডিগ্ৰি সেলসিয়াস, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যা খানিকটা বেশি। পৃথিবীর অস্তিত্বের বিপন্নতাই কি তবে ভবিতব্য? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অনিবার্যতাকে খণ্ডন করতে হলে এই শতকের মাঝামাঝি, ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো জরুরি। নেট-জিরো বলতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণকে শূন্যে বেঁধে রাখাটা বোঝানো হচ্ছে। কয়লা, পেট্রল-ডিজেলের মতো জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যবহারের পরিমাণ এমন হতে হবে যেন সেগুলোর দহনের মধ্যে দিয়ে বের হওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড বিদ্যমান ব্যবস্থায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে — গাছ, মাটি, সাগরের মতো যে আধারগুলো কার্বন গ্ৰহণ করে, সেগুলো যেন নিঃসরণ হওয়া ঐ পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডকে শুষে নিতে পারে।

গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণে দায় কাদের বেশি এবং পরিমণ্ডলে এর জোগানের হ্রাসে আন্তরিকতা ও সক্রিয়তা কাদের বেশি দেখানো উচিত? এর উত্তরটা একেবারেই জটিল নয় — যারা অনেক কাল ধরে কয়লা এবং পেট্রল-ডিজেল বেশি পুড়িয়ে, গ্যাস বেশি ব্যবহার করে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়েছে, এই বিষয়ে দায়িত্ব অবশ্যই তাদের বেশি। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, পৃথিবীতে যত গ্ৰিনহাউস উৎপন্ন হয় তার ৮০ শতাংশই সৃষ্টি করে জি-২০’র অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো, বিশেষভাবে চীন, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, রাশিয়া ও জার্মানির অর্থনীতি। কিন্তু কার্বন উৎপাদনকে হ্রাস করতে, অর্থাৎ, নিজেদের অর্থনীতিকে নতুন ধারায় চালিত করতে এরা কতটা রাজি হবে? চীন বলছে, তারা গ্ৰিনহাউস গ্যাস উৎপন্নের শীর্ষে পৌঁছাবে ২০৩০ সালে, তার পর থেকে কয়লা, পেট্রল-ডিজেলের ব্যবহারকে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে এনে নেট-জিরো লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছবে ২০৬০ সালে। তাদের কাছে দাবি করা হচ্ছে, তারা যেন নেট-জিরোর স্তরে পৌঁছায় আরো দশ বছর আগে ২০৫০ সালে। সেই দাবির প্রতি অঙ্গীকারের কোনো প্রতিশ্রুতি তারা দেয়নি। আমেরিকাই এখনও পর্যন্ত পরিমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি গ্ৰিনহাউস গ্যাসের জোগান দিয়েছে, এবং আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো, গ্ৰেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের মূল সংঘটক। পৃথিবী ও প্রকৃতির রক্ষায় তাদের কি বেশি দায়িত্ব নিতে হবে না? কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, পরিবেশের সুরক্ষার স্বার্থে আমেরিকা ২০২৫’র মধ্যে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩৩’র মধ্যে নেট-জিরোয় পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করুক। কিন্তু এবিষয়ে কোনো ইতিবাচক সাড়া তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।

Disrupted nature

 

গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের উৎসেই নিয়ন্ত্রণ — পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির রোধে এই রণনীতি নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। কিন্তু এর সঙ্গেই যে প্রশ্নটা মাথাচাড়া দেয় তা হল — এরজন্য বড় অর্থনীতিগুলোতে প্রচলিত ব্যবস্থা তথা চালু অর্থনৈতিক মডেলটাকে পাল্টানোর প্রয়োজনীয়তা কি অপরিহার্য নয়। ঐ দেশগুলো ধনতন্ত্র চালিত এবং সেই অর্থনীতিতে কর্পোরেটদের প্রাধান্য এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। এক সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, গত তিন দশকের বেশি সময়কালে পৃথিবীর পরিমণ্ডলে যত গ্ৰিনহাউস গ্যাস পাঠানো হয়েছে তাতে ৭০ শতাংশ অবদান হল ১০০টি কর্পোরেট সংস্থার। গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণে কর্পোরেটরা শুভবুদ্ধি ও মুনাফা ত্যাগী মানসিকতা দেখাবে ধরে নিয়ে তাদের ওপর ভরসা করার দিকেই কি আমরা এগিয়ে যাব? এরচেয়ে ভিত্তিহীন অবলম্বন আর কিছু হতে পারে না। প্রেসিডেন্ট হওয়ার চার মাসের মধ্যেই ট্রাম্প যখন প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেন এবং তার পিছনে যুক্তি হিসাবে দেশের অর্থনীতির ক্ষতির কথা বলেছিলেন, তাঁর বিবেচনায় কর্পোরেট স্বার্থই অগ্ৰাধিকার পেয়েছিল। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন আমেরিকাকে পুনরায় প্যারিস চুক্তিতে শামিল করলেও তিনিও চলতি ধারার পন্থী এবং অর্থনীতিতে কর্পোরেট আধিপত্য হ্রাসের পক্ষানুরাগী নন। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গটা এইভাবে প্রচলিত ব্যবস্থার রূপান্তরণের অনিবার্যতাকে সামনে নিয়ে আসছে।

কার্বন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগে যেহেতু নির্দিষ্ট দেশের সরকারকে পদক্ষেপগুলো করতে হবে, আন্তর্জাতিক স্তরের আলাপ-আলোচনার সাথে সমস্ত দেশে গৃহীত ও প্রয়োগ হওয়া কর্মসূচিগুলির ভূমিকাও তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারতে আমরা এমন একটা সরকারকে শাসন ক্ষমতায় দেখছি যাদের কাছে পরিবেশ সুরক্ষার চেয়ে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। গ্লাসগোয় মোদী সূর্য থেকে শক্তি আহরণের পরামর্শ দিয়েছেন। দেশে চালু করা ‘নলকে জল’, ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’, ‘উজ্জ্বলা’ প্রকল্পর উল্লেখ করে সরকারের পরিবেশ প্রীতির পরিচয় রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন। কিন্তু দেশে বনভূমির ওপর কর্পোরেটদের দখলকে অনায়াস করতে বন ও পরিবেশ আইনকে লঘু করে তুলছে তাঁর সরকার। নিরবচ্ছিন্নভাবে চালানো হচ্ছে বেসরকারিকরণের ধারা। মোদীর ধারণায় কর্পোরেটরা হল ‘সম্পদ স্রষ্টা’, আর সেই সৃষ্টিকে মসৃণ করতে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, বনভূমি তুলে দেওয়া হচ্ছে তাদের হাতে। এইভাবে জল-জমি-জঙ্গল লুট হয়ে যাওয়ার মূল হোতা হয়ে উঠছে সরকার নিজেই। তবে, শুধু নরেন্দ্র মোদীর সরকারই নয়, বিভিন্ন দেশের সরকারের অনুসরণ করা ‘উন্নয়ন’ মডেল পরিবেশের প্রতি বৈরিতা দেখাচ্ছে।

পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কিছু প্রতিশ্রুতি সম্মেলন থেকে উঠে এসেছে। গ্ৰিনহাউস গ্যাস মিথেনকে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০২০’র স্তর থেকে ৩০ শতাংশ হ্রাসের কথা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০৪০ সালের মধ্যে কয়লা পুরোপুরি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৪০টি দেশ। অন্য দেশে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে আর্থিক সহায়তা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন ও আরো কয়েকটা দেশ। আবার, বন বিনাশের প্রতিশ্রুতিও কয়েকটা দেশের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। এগুলো সবই প্রতিশ্রুতি, সেগুলোর রূপায়ণ কতটা হয় তা আমাদের নজরে রাখতে হবে। এরআগে দেওয়া বহু প্রতিশ্রুতি শূন্যগর্ভ শব্দ হয়েই রয়ে গেছে যা সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা ও অনাস্থার মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। পরিবেশ কর্মী সুইডিশ তরুণী গ্ৰেটা থুনবার্গ রাষ্ট্র নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার, জনগণের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে কপট হাবভাবের সমালোচনা করেছেন। থুনবার্গ এবং পরিবেশ আন্দোলনের অন্যান্য কর্মী রাষ্ট্রনেতাদের শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে গ্লাসগোর পার্কে প্রতিবাদ আন্দোলনেও শামিল হয়েছেন। গ্লাসগো সম্মেলনকে থুনবার্গ “শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতি দিয়ে সবুজ সাফের উৎসব” বলেও বর্ণনা করেছেন। এটা অতএব স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে যে, পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে ও তুলছে যে ব্যবস্থা তাকে অটুট রেখে তারমধ্যেই পরিবেশকে বাঁচানোর রাস্তা খোঁজাটা নিরর্থক প্রয়াস ছাড়া অন্য কিছু নয়। জনগণের সচেতনতা, তাদের উদ্যোগ, প্রতিবাদই হতে পারে পরিবেশ রক্ষার, পৃথিবীকে বাঁচানোর নির্ধারক শর্ত। চলমান ব্যবস্থাকে পাল্টানোর সচেতনতা সক্রিয়তাই রাষ্ট্রকে কার্বন শূন্যতার পথে অঙ্গীকারবদ্ধ করতে পারে।

- জয়দীপ মিত্র

The state of Yogi

কয়েক মাস পরেই উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে নতুন এক শিরোপা অর্জন করে নিল যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে রাজ্যের বিজেপি সরকার। বেঙ্গালুরুর একটি সংস্থার সমীক্ষায় বড় রাজ্যগুলিতে অপশাসনের যে ক্রম প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সবার প্রথমে ঠাঁই করে নিয়েছে যোগীর উত্তরপ্রদেশ। এই তালিকায় সবার শেষে স্থান হয়েছে কেরলের।

বেঙ্গালুরুর সংস্থা ‘পাবলিক অ্যাফেয়ার্স সেন্টার’ (পিএসি) নানারকম মাপকাঠিতে ১৮টি বড় রাজ্যের সরকারের প্রশাসনিক সাফল্য মেপেছে। সবচেয়ে কম নম্বর পাওয়া রাজ্য সরকারকে অপশাসনের তালিকার এক নম্বরে রাখা হয়েছে। এই স্থানটি অর্জন করেছে যোগী আদিত্যনাথের সরকার। এই মাপকাঠিকে বলা হচ্ছে ‘পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ইনডেক্স’। গত পাঁচ বছর ধরেই এই তালিকা প্রকাশ করছে সংস্থাটি। উত্তরপ্রদেশের অবস্থা খুব ভল কখনই ছিল না এই পাঁচ বছরে। কিন্তু এবার তারা সবার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০১৬-তে প্রথম তালিকা তৈরির সময়ে যোগীর রাজ্যের ক্রম ছিল ১২। সেবার ১৭টি রাজ্যকে ধরা হয়েছিল, বাদ ছিল তেলঙ্গানা। কিন্তু উত্তরপ্রদেশেরও পিছনে ছিল মধ্যপ্রদেশ, অসম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহার। ২০১৯ সাল থেকে মাপকাঠিতে কিছু পরিবর্তন করেছে পিএসি। সংস্থার দাবি, এরফলে সমীক্ষার কাজ আরও নিখুঁত হয়েছে। সুশাসনের তালিকায় প্রথমে রয়েছে বাম শাসিত রাজ্য কেরল। কিন্তু যেসব রাজ্য উত্তরপ্রদেশের পিছনে ছিল, বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা উন্নতি করে বেশি নম্বর আদায় করে নিয়েছে। যোগীর রাজ্য সেক্ষেত্রে চলে গিয়েছে সবার পিছনে। নির্বাচনের মুখে উত্তরপ্রদেশ সরকার যখন প্রচারের ঢাক বাজানো শুরু করে দিয়েছে, দেশব্যাপী বিজেপি’র প্রচারযন্ত্র উচ্চকিত স্বরে বলতে শুরু করেছে — পিছিয়ে পড়া রাজ্যটির ভোল বদলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ, সেই সময়ে পাবলিক অ্যাফেয়ার্স সেন্টারের এই সমীক্ষার রিপোর্টটি শাসক দলের পক্ষে হজম করা শক্ত হবে।

- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ নভেম্বর ২০২১

33 lakh children

“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়”। দেশের ক্ষুধা সূচক নিয়ে একটি প্রশ্নের উত্তরে প্রকাশ পেল চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেখানে রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশের অন্তত ৩৩ লাখ শিশু অপুষ্টির শিকার। করোনা আবহে সেই সংখ্যাটা অনেকখানি বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে।

অপুষ্টিতে ভুগছে দেশের ৩৩ লাখেরও বেশি শিশু। তথ্য জানার অধিকার আইনে এক আবেদনের উত্তরে এমন তথ্য জানিয়েছে কেন্দ্রের নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকই। শুধু তাই নয়, এই ৩৩ লাখের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি গুরুতর অপুষ্টির কবলে পড়েছে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র, বিহার এবং গুজরাট।

গত দেড় বছর ধরে চলতে থাকা করোনা অতিমারী পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে ঘা দিয়েছে যথেষ্ট। এদিনও মন্ত্রকের তরফে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, অতিমারীতে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির আকাল গরিবদের মধ্যে আরও বাড়তে পারে। তথ্য জানার অধিকার আইনে সংবাদসংস্থা পিটিআইয়ের করা এক আবেদনের উত্তরে মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে গুরুতর অপুষ্টির শিকার প্রায় ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯০২টি শিশু (সিভিয়ারলি অ্যাকিউট ম্যালনারিশড বা ‘স্যাম’) এবং মাঝারি তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে প্রায় ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ৪২০টি শিশু (মডারেটলি অ্যাকিউট ম্যালনারিশড বা ‘ম্যাম’)। সব মিলিয়ে ৩৪টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সংখ্যাটা ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ৩২২। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘পোষণ’ ট্র্যাকার অ্যাপেই ধরা পড়েছে এই তথ্য।

এই পরিসংখ্যান যথেষ্ট ভীতিপ্রদ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। কারণ, গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় গুরুতর অপুষ্টিতে ভোগা (‘স্যাম’) শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৯১ শতাংশ! যেখানে গতবার সংখ্যাটা ছিল ৯ লাখ ২৭ হাজার ৬০৬ জন, সেখানে এবারে তা বেড়ে ১৭ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় মাপকাঠিতে কিছুটা বদল করা হয়েছে। গত বছর সব মিলিয়ে ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ছ’মাস থেকে ছ’বছরের তথ্য সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছিল কেন্দ্রকে। এবার পোষণ ট্র্যাকারের মাধ্যমে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করেছে কেন্দ্র, নির্দিষ্ট করা হয়নি শিশুদের বয়সও।

‘স্যাম’এর অর্থ, তাদের উচ্চতা অনুযায়ী শারীরিক ওজন খুবই কম থাকে এই শিশুদের। তাদের শরীরের ইমিউনিটি বা অনাক্রম্যতা খুবই কম হওয়ায় যে কোনও রোগে তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে ৯ গুণ বেশি। যে শিশুরা ‘ম্যাম’এ ভুগছে, তাদেরও অসুস্থ হওয়া এবং মৃত্যুর আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। অপুষ্টিতে ভোগা ওই শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বাড়বে বলেই মনে করছেন এক বেসরকারি হাসপাতালের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসক।

এই পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, কিশোরী এবং তরুণীদের জন্য পোষণ অভিযান প্রকল্পও শুরু করেছিল কেন্দ্র। কিন্তু তা যে বিশেষ কাজে আসেনি, তা জানান দিচ্ছে কেন্দ্রের তথ্যই। ‘চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ’ সংস্থার সিইও এবিষয়ে এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অতিমারি আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে এমন তীব্র আঘাত হেনেছে যে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে। যার ফলে গত এক দশকে যতটা উন্নতি করা গিয়েছিল, তার চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় মিড-ডে মিলও আর পাচ্ছে না দরিদ্র শিশুরা। এরফলে তাদের খাদ্য সঙ্কট আরও বেড়েছে।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে এমনিতেই নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের চেয়েও নীচে রয়েছে ভারত। ২০২০ সালে ভারত ছিল ৯৪তম স্থানে, সেখানে ২০২১তে ভারত নেমে গিয়েছে ১০১তম স্থানে।

- এই সময়, ৮ নভেম্বর ২০২১

source of this power

৭ নভেম্বর ২০২১। রোববারের সন্ধ্যে। রবীন্দ্র সদনের কাছে এক্সাইড মোড়ে দেখা গেল এক বছর কুড়ির যুবক পড়ে আছে ফুটপাতে। ঐ অঞ্চলে কর্তব্যরত এক সিভিক ভলান্টিয়ার (তন্ময় বিশ্বাস) তার বুট পরা পা চাপিয়ে রেখেছে মহম্মদ জাফর নামক ঐ যুবকের বুকের উপর। চলছে লাথি। সংবাদমাধ্যম বলেছে, ওই যুবক এক মহিলার ব্যাগ ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। কারণ যাই হোক, এই নৃশংস ছবি এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই উঠেছে সমালোচনার ঝড়। তার চাপে ড্যামেজ কন্ট্রোলে তৎপর হয়েছে কলকাতা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।

বছরখানেক আগে আমেরিকার মিনিয়াপোলিসের রাস্তায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের গলায় হাঁটু মুড়ে বসে অত্যাচার করেছিল শ্বেতাঙ্গ পুলিশ আধিকারিক ডেরেক শভিন। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে সারা বিশ্ব আন্দোলিত হয়। কিছুদিন আগে আসামে দরং জেলায় উচ্ছেদের প্রতিবাদে ধেয়ে আসা এক প্রান্তবাসী হতদরিদ্র মুসলিম বৃদ্ধকে রাস্তায় পুলিশ গুলি করে। তারপর সেখানেই তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার বুকের ওপর পুলিশের অনুগ্রহপুষ্ট এক ক্যামেরাম্যানের বুট পায়ে লাফানোর দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। কলকাতার এক্সাইড মোড়ে গ্রিন পুলিশের বর্বরোচিত আচরণ আরও একবার মিনিয়াপোলিসের ঘটনার ও আসামের সেই খুনে স্মৃতি উস্কে দিল।

পুলিশ-প্রশাসন বরাবরই শাসকশ্রেণীর পোষ্য। ফলত, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতাভোগীর বশংবদ। ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী, দলিত-আদিবাসী সহ সমাজের অন্যান্য অংশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন-গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষেরা নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে যখনই রাজপথের দখল নিয়েছে, তখনই সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে রুখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন। জনবিরোধী বিজেপি সরকারের জমানায় তা আরও ভয়ঙ্কর হয়েছে। সমসময়ে মানুষ এনআরসি-সিএএ’র বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছে। কৃষক বিরোধী নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চলছে। ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে গোটা দেশ জুড়ে পথে নেমেছে ছাত্রসমাজ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই পুলিশী হিংস্রতার সাক্ষ্য স্পষ্ট। হাথরাসে রাতের অন্ধকারে দলিত কিশোরীর দেহ জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে অতি সম্প্রতি আইসা’র ছাত্রীদের যৌনাঙ্গে পুলিশের লাথি — বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর পুলিশের বর্বরতায় আমরা শিউড়ে উঠেছি। ঐ সরকারগুলো মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবে না। তাই তাদের পুলিশ এইভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে সাহস পায়। কিন্তু আমাদের রাজ্যেও তার ছায়াপাত?

হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে — এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আজকে পশ্চিমবঙ্গেও সাধারণ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার চরম বিপন্ন। খেটে খাওয়া মানুষের হকের দাবিটুকু তুলে ধরার সুযোগটাও কেড়ে নিচ্ছে সরকার। স্কুল-কলেজ-অফিস-কারখানা-কোথাও কোনও ইউনিয়ন গড়ে তোলার জো নেই। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষই শেষ কথা বলবে। শাসকশ্রেণীর চিরাচরিত চরিত্র, ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-কৃষকের জোট বাঁধার পথ বন্ধ করে দেওয়া। কী কেন্দ্রীয় কী রাজ্য সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী নীতি ও আচরণের বিরোধিতায় নিজ নিজ দাবিদাওয়া নিয়ে বামপন্থীরা মিটিং-মিছিলের আয়োজন করলে, পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে, কোভিড পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করে মিটিং-মিছিল বাতিল করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। অথচ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নির্লজ্জভাবে তৃণমূল সরকার কোভিড পরিস্থিতিতে জায়গায় জায়গায় জমায়েত করছে। এভাবেই দিনের পর দিন এক বিশাল অংশের মানুষের গণতন্ত্র হরণ চলছে। সেক্ষেত্রেও আমরা আন্দোলন দমনে প্রশাসনেরর অতিসক্রিয়তায় ডিওয়াইএফ কর্মী মইদুল ইসলামকে প্রাণ হারাতে দেখেছি। চাকরির দাবিতে তিনি বিক্ষোভ জানাতে শহরে এসেছিলেন। আর এই প্রশাসনের চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি কীভাবে দুর্নীতি, তোলাবাজি, মস্তানরাজ চলছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। খেটে খাওয়া ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষ মুখ বুজে গুন্ডাবর্গির জুলুম সহ্য করছে। সরকারি সম্পত্তি লুঠ হচ্ছে। প্রশাসন সেখানে নীরব দর্শক। কারণ ঐ লুঠেরারা রাজ্যের শাসকদলের মদতপুষ্ট।

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা লক্ষ্য করছে গোটা দেশ। কতশত মানুষ ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের কারণে অকালে মারা পড়ে! বছরের পর বছর সামাজিক বৈষম্য সয়ে বেঁচে থাকে লাখো লাখো মানুষ। এই রাজ্যেও কি সরকার পুলিশ-প্রশাসনকে সেইভাবেই চালানোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে না? এক্সাইড মোড়ের ঘটনা কি সেই ভাবনাকে উস্কে দেয় না? একজন ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’এর যে উন্মত্ত চেহারা দেখা গেল, সেখানে যে ডিউটিরত পুলিশ অফিসাররা যেভাবে যন্ত্রের মতো থাকলেন — এতো ঔদ্ধত্য আসে কোথা থেকে? এর উৎস রয়েছে পুলিশের হাতে দমনপীড়ন চালানোর ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পলিসির মধ্যেই।

রাষ্ট্রের এই নগ্নরূপকে ধিক্কার!

- ত্রিয়াশা

Act and the UAPA

মোদী সরকার ক্ষমতায় সাত বছর পার করে আট বছর চলার মধ্যে দিয়ে নিজের একটা পরিচিতিকে মার্কামারা করে তুলেছে। প্রকট হয়ে সামনে আসা এই পরিচিতিটা শুধু কর্পোরেটতন্ত্রের বিকাশের নির্দেশকই নয়, শাসনধারায় ঔপনিবেশিক দমনরীতির অনুগামী হওয়ারও পরিচায়ক। ভগৎ সিং-এর ব্যক্ত আশঙ্কা সত্যি হয়ে আজ রাষ্ট্রের মধ্যে চূড়ান্ত রূপে বিরাজমান — বাদামি সাহেবরা শাসন ক্ষমতায় বসে একনিষ্ঠভাবে ঔপনিবেশিক শাসনরীতির উপাসনা করে চলেছে। ঔপনিবেশিক শাসকদের মতই সরকারের সমালোচকদের ও বিরোধী মত পোষণকারীদের বরদাস্ত করা তাদের ধাতে নেই। আর তাই বিরোধীদের কয়েদে পুরতেই মোদী সরকার মেতে ওঠে এবং তার এই উদ্যোগে সে বড় অবলম্বন করে তোলে দুটো দানবীয় আইনকে। এই আইন দুটো হল দেশদ্রোহ/রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এবং ইউএপিএ বা অবৈধ কার্যকলাপ নিরোধক আইন। আইন দুটো চরিত্রগতভাবে দানবীয় এবং মানবাধিকার হরণের উৎস হওয়ায় সেগুলো প্রত্যাহারের দাবি বারবারই উঠেছে এবং সম্প্রতি এনিয়ে সোচ্চার হলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর এফ নরিম্যান। তিনি প্রস্তাব করেছেন — আইন দুটো প্রত্যাহারের বিষয়টা সরকারের শুভেচ্ছার ওপর ছেড়ে না রেখে সুপ্রিম কোর্টের উচিত নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে দেশদ্রোহ আইনকে এবং ইউএপিএ’র ‘আপত্তিকর অংশকে’ বাতিল করা।

আইন দুটো প্রত্যাহারের দাবি কতটা ন্যায়সঙ্গত তার বিচারে মনোনিবেশ করাটা এখানে প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারাতেই দেশদ্রোহের সংজ্ঞা দেওয়া আছে এবং ঐ ধারাই হল দেশদ্রোহ আইন। স্বাধীনতা সংগ্ৰামীদের দমন করতে ও জেলে পুরতে আইনটা বানিয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা এবং রং নির্বিশেষে পরের পর সরকারগুলো সাগ্ৰহে এই আইনকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো ব্যক্তি ব্যক্ত বা লিখিত কথার মধ্যে দিয়ে, অথবা সংকেত বা দৃষ্টিগ্ৰাহ্য উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে সরকারের প্রতি ‘রাজনৈতিক অসন্তোষ’ ব্যক্ত করলে তা দেশদ্রোহ বলে পরিগণিত হবে। ‘রাজনৈতিক অসন্তোষ’ শব্দবন্ধের মধ্যে সরকারের প্রতি বিদ্বেষ এবং বৈরিতার সমস্ত ধরনের অনুভূতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ১৯৬২ সালে কেদার নাথ সিং মামলায় বলেছিল যে, কেবলমাত্র হিংসা উস্কিয়ে তোলার উদ্দেশ্য থাকলে তবেই কাউকে দেশদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত করা যাবে, অন্যথায় তার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশিকাকে উপেক্ষা করাটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বিরোধিতার দমনে এই আইনের আকছার প্রয়োগ হচ্ছে। সরকারি তথ্য বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯’র মধ্যে দেশদ্রোহ আইনে ৩২৬টা মামলা হয়েছে, এরমধ্যে মাত্র ৬ জনকে অপরাধী সাব্যস্ত করা গেছে। অর্থাৎ, এই আইনে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার হার ২ শতাংশেরও কম। তবে, কিছু আইনজীবী, সাংবাদিক এবং বিদ্বজ্জন আর্টিকেল ১৪ নামে একটা পোর্টাল চালান এবং সেখানে দেশদ্রোহ আইনে অভিযোগ দায়েরের একটা পরিসংখ্যান রয়েছে। ঐ পোর্টালে ২০১০’র ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০’র ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশদ্রোহ আইনে মামলার হিসাব রাখা হয়েছে, এবং তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর এই আইনে মামলা বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। ৩২৬ অভিযুক্তর মধ্যে ৬ জনের অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার সরকারি পরিসংখ্যান থেকে এটা একেবারেই পরিষ্কার যে, এই আইনে ব্যাপক সংখ্যাধিক অভিযুক্তকে বিনা দোষে জেলে আটক রাখাটাই সরকারের অভিপ্রায়।

এই আইন প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বেশ কয়েকটা মামলা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ভমবাটকেরে তাঁর আবেদনে বলেছেন, এই আইন সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক এবং আইনটাকে “সুস্পষ্টরূপে ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বাতিল করতে হবে”। এই আবেদনের শুনানি গ্ৰহণের সময় প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এবছরের ১৫ জুলাই এই ঔপনিবেশিক আইনকে অব্যাহত রাখা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন ছিল, “এটা ঔপনিবেশিক যুগের আইন আর এই আইনটা ব্রিটিশরা ব্যবহার করেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করতে; মহাত্মা গান্ধী, গোখলে ও অন্যান্যদের কণ্ঠরোধ করতেই ব্রিটিশরা এটাকে ব্যবহার করেছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও আইনসমূহর মধ্যে এটাকে রাখার প্রয়োজনীয়তা কি এখনও রয়েছে। …” আইনটার অপব্যবহারের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, “পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর যে, কোনো রাজ্য বা কোনো দল কারুর কথা শুনতে না চাইলে তারা ঐ সমস্ত লোকজনকে মামলায় জড়াতে এই আইনটাকে ব্যবহার করবে”। তবে প্রধান বিচারপতি আইনটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পক্ষে মত দিলেও অ্যাটর্নি জেনারেল আইনটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে কথা বলেন এবং আইনটির উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে কিছু নির্দেশাত্মক নীতি জারির অনুরোধ করেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের কথা থেকে স্পষ্ট, মোদী সরকার যেকোনোভাবেই আইনটিকে অব্যাহত রাখার পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দীপক গুপ্তও বলেছেন, “বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার লক্ষ্যে নাগরিকদের মধ্যে ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই দেশদ্রোহ আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং আইনটিকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে”।

ইউএপিএ তৈরি হয়েছিল নকশালবাড়িতে কৃষক অভ্যুত্থানের বছর ১৯৬৭ সালে। কেউ-কেউ বলে থাকেন, এই আইন তৈরির প্রেক্ষাপট ছিল চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ। আবার অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, সেই সময়ের দেশজোড়া গণবিক্ষোভ দমনের লক্ষ্যেই তৈরি হয়েছিল এই আইন। আইনটাকে ২০০৪, ২০০৮ ও ২০১২ সালে তিন দফায় সংশোধন করে আজকের রূপ দেওয়া হয়েছে। এটা মূলত সন্ত্রাস মোকাবিলার আইন হলেও আজ এর প্রয়োগ বেশি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সামাজিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী, সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, সন্ত্রাস প্রতিরোধের চেয়েও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চরিতার্থতাতেই সরকারের কাছে ইউএপিএ বড় অবলম্বন হয়ে উঠেছে। এই আইনটা যে দানবীয় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল, এই আইন প্রয়োগ করে সরকার তার অপছন্দের লোকজনকে বছরের পর বছর বিনা বিচারে জেলে আটক রাখতে পারে। এই আইনে চার্জশীট দেওয়ার সময়সীমা হল ছ’মাস। অর্থাৎ, বিচার প্রক্রিয়া শুরু না করে কোনো অভিযুক্তকে ছ’মাস জেলে বন্দী করে রাখা যাবে। এরপর পুলিশ ছ’মাস অন্তর একটা করে সাপ্লিমেন্টারি বা অতিরিক্ত চার্জশীট পেশ করে যায় আর অভিযুক্তর কারাবাসের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হতে থাকে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় প্রথম চার্জশীট পেশ করা হয়েছিল ২০১৮ সালের নভেম্বরে। কিন্তু আজও অভিযুক্তরা জেলে আটক এবং বিচার শুরুই হয়নি। এই আইনে জামিন লাভ একরকম অসম্ভব হয়ে উঠেছে, এবং কেন তার আলোচনা একটু পরে করা হচ্ছে।

ইউএপিএ’তে পুলিশের হাতে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যা রাষ্ট্রের হাতে নাগরিক পীড়নের আশঙ্কাকেই তীব্রতর করে তোলে। এই আইনে ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’এর পরিসরকে এতটাই ব্যাপ্ত করা হয়েছে যে সরকার চাইলে যে কোনো নাগরিককেই এই আইনে অভিযুক্ত করতে পারে। যে কোনো প্রতিবাদকেই এই আইনে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বলে চালানো সম্ভব। ন্যায়বিচারের সাধারণ ধারণা বলে, অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নির্দোষ বলে গণ্য করতে হবে। ইউএপিএ’তে এই ধারণার মান্যতা নেই। দানবীয় আইন টাডা ও পোটা বাতিল হয় যথাক্রমে ১৯৯৫ ও ২০০৪ সালে। কিন্তু ঐ আইন দুটোর যে ধারাগুলো অগণতান্ত্রিক, মানবাধিকার হরণকারী সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য সমালোচিত ও ধিক্কৃত হয়েছিল, সেগুলোকে ঠাঁই দেওয়া হল ইউএপিএ’তে।

ইউএপিএ’তে আগাম জামিনের কোনো সংস্থান নেই। এই আইনে জামিন লাভ সম্ভব হতে পারে যদি সরকার পক্ষের আইনজীবী, অর্থাৎ পিপি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে যথার্থ বলে মনে না করেন। কিন্তু সরকার কাউকে আটক রাখতে চাইলে কোনো পিপি’র পক্ষে কি সেই অভিপ্রায়ের বাইরে যাওয়া সম্ভব? আবার, অভিযুক্ত সম্পর্কে কেস-ডায়েরি পড়ে আদালতের বিচারপতি যদি মনে করেন যে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোকে সত্যি বলে মনে করার যুক্তিসম্মত কারণ রয়েছে, তবে পিপি জামিন দিতে সম্মত হলেও বিচারপতি জামিন খারিজ করতে পারেন। ইউএপিএ’তে জামিন আরো অসম্ভব হয়ে উঠেছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। ইউএপিএ’তে একটা মামলায় জামিন সংক্রান্ত রায়ে বিচারপতি খানউইলকারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলে, ইউএপিএ’তে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ আনা হয়েছে, আদালতকে প্রাথমিকভাবে সেগুলো সত্যি বলে মনে করতে হবে। ফলে, জামিনের শুনানির পর্যায়ে অভিযুক্তর পক্ষে পেশ করা সাক্ষ্যপ্রমাণগুলোর বিবেচনার কোনো সুযোগ আর থাকছে না। দিল্লী হাইকোর্ট ইউএপিএ’তে অভিযুক্ত দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল এবং আসিফ তানহার জামিন মঞ্জুর করতে গিয়ে সরকারকে তিরস্কার করে বলে, ‘বিরোধী মতের দমনের’ জন্যই ইউএপিএ’কে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা আরও বলে, সরকার যে কোনো প্রতিবাদকে ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’ বলে চালাতে চাইলে আদালত তাকে সমর্থন করবেনা। কিন্তু জামিন মঞ্জুরির দিল্লী হাইকোর্টের ঐ রায় সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট আবার বলে, ঐ রায়ে ইউএপিএ’কে লঘু করে তোলা হয়েছে। এবং কোনো আদালত যেন ঐ রায়কে আইন-গ্ৰাহ্য দৃষ্টান্ত বলে কাজে না লাগায়। ফলে, ইউএপিএ’তে জামিন লাভ আকাশকুসুম ব্যাপার হয়েই উঠেছে এবং একটু আগে উল্লিখিত সুপ্রিম কোর্টের ঐ মতামতের পর কোনো আদালতের কোনো বিচারপতিই ইউএপিএ মামলায় জামিন দিতে প্রয়াসী হবেন না। আজ যখন অনেকেই এই অভিমত পোষণ করছেন যে, ইউএপিএ মামলায় জামিনের শুনানি প্রহসনের ব্যাপার হয়ে উঠেছে, সেটাকে আর অবান্তর বচন বলে মনে করার কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না।

ওপরে যা উপস্থাপিত হল তার থেকে আইন দুটোর দানবীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। যে কোনো বিরোধিতার দমনে মোদী সরকার এবং বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলো আইন দুটোর যথেচ্ছ প্রয়োগ ঘটিয়েছে। জেএনইউ’র ছাত্র আন্দোলন, ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনা, সিএএ বিরোধী আন্দোলন — এই সমস্ত ন্যায়সঙ্গত সরকার বিরোধিতার দমনে এবং এমনকি দিল্লী দাঙ্গার তদন্তে কারচুপির মাধ্যমে বৈরি জ্ঞান করা মানুষজনদের মামলার জালে জড়াতে মোদী সরকারের কাছে পীড়নের হাতিয়ার হয়েছে এই দুটো আইন। আইন দুটোর নিরন্তর ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রয়োগ গণতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটিয়েছে ও ঘটিয়ে চলেছে, এবং রাষ্ট্রের পুলিশী চরিত্রকেও সংশয়াতীত করে তুলছে। আইন দুটোর বিলোপের প্রয়োজনীয়তা গণতন্ত্রের পক্ষে অপরিহার্য বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। বিচারপতি নরিম্যানের বক্তব্য তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে — “আমি সুপ্রিম কোর্টের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ করব, তাদের কাছে অমীমাংসিত থাকা দেশদ্রোহ আইনের মামলাগুলোকে তারা যেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফেরত না পাঠায়। সরকার আসবে এবং চলে যাবে, কিন্তু নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে ১২৪এ ধারাকে এবং ইউএপিএ’র আপত্তিকর অংশগুলোকে বাতিল করাটা আদালতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এখানকার নাগরিকরা তখন আরও স্বচ্ছন্দে নি:শ্বাস নিতে পারবেন’’। বিচারপতি নরিম্যান দেশদ্রোহ আইনের সঙ্গে ইউএপিএ’র আপত্তিকর অংশগুলোকে বাতিলের পরামর্শ দিলেও আমরা আইন দুটোর আগাগোড়া বাতিলেরই প্রস্তাবই করছি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কি নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা করতে সম্মত হবে? সুপ্রিম কোর্ট জুলাই মাসের মাঝামাঝি দেশদ্রোহ আইন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও পরবর্তী শুনানির সময় স্থির করে উঠতে পারেনি। গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে আইন দুটোর বাতিল যে অপরিহার্য, আশা করি সুপ্রিম কোর্টকে তা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।

- জয়দীপ মিত্র

Comrade Kamini Roy

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের আলিপুরদুয়ার জেলার বাবুরহাট ‘ক’-শাখা সম্পাদক কমরেড কামিনী রায় ৮ নভেম্বর নিজের বাড়িতে প্রয়াত হয়েছেন। তিনি বেশ কিছুদিন যাবত অসুস্থ ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। পার্টির আলিপুরদুয়ার জেলা কমিটির পক্ষে সুনীল রায়, গণেশ রায়, হরেন রায়, জয়মণি রায় এবং অন‍্যান‍্য কমরেডগণ প্রয়াত কমরেডের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে মরদেহে রক্তপতাকা দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান। পার্টির জেলা সম্পাদক কমরেড চঞ্চল দাস অন্ত‍্যেষ্টিস্থলে গিয়ে প্রয়াত কমরেডকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। কামিনী রায় ২০০৩ সালে পার্টির সদস‍্যপদ লাভ করেন। তার আগে প্রায় ৩০ বছর সিপিআই(এম) সদস্য হিসেবে ছিলেন। এলাকায় সিপিআই(এমএল)-কে বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, পৌত্রী, কন‍্যা, জামাতা, দৌহিত্র ও দৌহিত্রীকে। কমরেড কামিনী রায় লালসেলাম।

 

খণ্ড-28
সংখ্যা-39