’৭০ দশকের বারাসাত গণহত্যাকাণ্ডের ৫০ বছর উপলক্ষে বারাসাত ব্যারাকপুর রোডের বড়বড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত শহীদবেদী পুনর্নির্মাণ করে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় মূলত সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সহ বারাসাতের বিভিন্ন নকশালপন্থী সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের উদ্যোগে ও উপস্থিতিতে। শুরুতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে নীরবতা পালনের পর শহীদবেদীতে মাল্যদান করেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য অনিমেষ চক্রবর্তী, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সদস্য নির্মল ঘোষ, বারাসাতের বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতা দুলাল চ্যাটার্জী, নোটন কর এবং হুগলি জেলা থেকে আগত স্বপন মাতব্বর, কলকাতা থেকে সুপ্রিয় চৌধুরী, বন্দী মুক্তি কমিটির চন্দন সাহা, গণআন্দোলনের সংগঠক নীলকণ্ঠ আচার্য্য, মানবাধিকার কর্মী জয়ন্ত সিনহা সহ আরো অনেক। সংক্ষিপ্ত সভায় বক্তব্য রাখেন নির্মল ঘোষ, দুলাল চ্যাটার্জী, স্বপন মাতব্বর, বন্দীমুক্তি কমিটির চন্দন সাহা ও ’৭০ দশকের শহীদবেদী নির্মাণ নিয়ে ধারাবাহিক কাজ করে চলা প্রাবন্ধিক সুপ্রিয় চৌধুরী।
ঘটনায় প্রকাশ ১৯৭০ সালের ১৯ নভেম্বর উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাত ব্যারাকপুর রোডের ধারে বড়বড়িয়া এলাকার বাসিন্দারা ভোরবেলায় দেখতে পেয়েছিলেন রাস্তার পাশে ও ধানক্ষেতের ওপর পড়ে থাকা আটজন তরতাজা যুবকের লাশ। প্রত্যেকের শরীরেই ছিল অনেকগুলো ক্ষতচিহ্ন। কারো চোখ উপড়ে নেওয়া হয়েছিল, কারো বা চোয়াল উড়ে গিয়েছিল, (প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের মতে এক জনের দেহে তখনো নাকি প্রাণ ছিল) সবার দেহেই কমপক্ষে পাঁচ-ছটি করে বুলেটের ফুটো। ভোর রাতে শুনতে পাওয়া যায় পরপর একাধিক গুলির শব্দ, পরে মাঠের ধারে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায় শীতের ওই অত ভোরেও লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী। সেই সময়ে ওই এলাকার বাসিন্দা, ইটভাটা শ্রমিক আন্দোলনের বামপন্থী নেতা প্রয়াত শুকুর আলী, তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারা সম্ভব হয়েছিল, সব মর্মন্তুদ ঘটনার কথা। বারাসাত গণহত্যায় নিহত আটজন যুবকের নাম যথাক্রমে কানাই ভট্টাচার্য, সমীর মিত্র, স্বপন পাল, সমীরেন্দ্র দত্ত, যতীন দাস, গণেশ ঘটক, তরুণ দাস ও শংকর চট্টোপাধ্যায়। এঁদের প্রত্যেকের বাড়ি ছিল দক্ষিণেশ্বর লাগোয়া আড়িয়াদহ। ওই তরুণ-যুবকরা সবাই ছিলেন এলাকার পরিচিত নকশালপন্থী কর্মী হিসাবে।
(১) কানাই ভট্টাচার্য – আদি নিবাস পূর্ব বাংলার ফরিদপুর। একটি ছোট লন্ড্রির দোকান চালিয়ে কোনমতে নিজের এবং পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরে টেক্সম্যাকো কারখানায় চাকরি পান। ১৯৫৬-তে যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে।
(২) সমীর মিত্র – আড়িয়াদহ কালাচাঁদ হাইস্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হয়েছিলেন বরানগর বিকেসি কলেজে।
(৩) স্বপন পাল – কালাচাঁদ হাইস্কুল থেকে অত্যন্ত ভালো ফল করে বরানগর বিকেসি’তে পড়তেন ফিজিক্সে অনার্স। মূলত কবি মুরারি মুখোপাধ্যায়কে দেখেই তাঁর রাজনীতিতে আসা। মৃত্যুর সময় বয়স ছিল মাত্র ২০।
(৪) সমীরেন্দ্র দত্ত – কালাচাঁদ হাইস্কুলের আরেক কৃতী ছাত্র। পরবর্তীতে বরানগর বিকেসি’তে কেমিস্ট্রি অনার্স। শহীদ হওয়ার সময় প্রথম বর্ষ। বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর।
(৫) যতীন দাস – আদি নিবাস পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা। টেক্সম্যাকো কারখানায় ইলেকট্রিক ওয়েল্ডার।
(৬) গণেশ ঘটক – নিম্নবিত্ত শ্রমিক পরিবারের সন্তান। চরম অভাবের সংসারেও অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন উত্তরপাড়া প্যারীমোহন কলেজে। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর।
(৭) তরুণ দাস – কালাচাঁদ হাইস্কুলের ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দ্রোহের আগুনে। শহীদ হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর।
(৮) শংকর চট্টোপাধ্যায় – মোটা ফ্রেমের চশমার পিছনে উজ্জ্বল একজোড়া স্বপ্নদর্শী চোখ। কালাচাঁদ হাইস্কুলের অসম্ভব মেধাবী এই ছাত্রটি প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে জুলজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন। একাধিক সায়েন্স জার্নালে সেইসময় তাঁর লেখা প্রকাশিত হত প্রায় নিয়মিত।
নকশালবাড়ির রাজনীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন এইসব তরুণ যুবরা, সমাজবদলের লড়াইতে সেদিন তাঁরা সামিল হয়েছিলেন। এইসব সোনার টুকরো যুবকরা এই সমাজ ও দেশ থেকে হারিয়ে গেছেন আদর্শকে ভালোবেসে, শহীদের মৃত্যু বরণ করে নিয়েছিলেন ’৭০ দশকের কংগ্রেসী সন্ত্রাস আর রাষ্ট্রের বুলেটে। সেদিন কত কত মায়ের কোল খালি হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের কথা, যারা সেদিন শাসকের সৃষ্ট সন্ত্রাসের পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন, যা দ্রোহকালের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। একটা গোটা প্রজন্মকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রদ্রোহিতার অজুহাতে হত্যা করে, পুলিশের হেফাজতে বা কারান্তরালে রেখে অত্যাচার করে পঙ্গু-বিকলাঙ্গ-মৃতদেহ করে দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে।
১৯৭৭ পরবর্তী সময়ে বামফ্রন্ট সরকার নানা কমিশন বসিয়েছিল। ’৭০ দশকের কাশিপুর বরানগর, আরিয়াদহ, বেলাঘাটা, কোন্নগর, হাওড়া, বহরমপুর জেলের হত্যাকান্ড ইত্যাদি গণহত্যার বিচারের জন্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আজো সেইসব হত্যাকাণ্ডের দোষীদের কোনো সাজা হয়নি, ন্যায়বিচার পাননি শহীদ পরিবারগুলি। অধিকাংশ দোষী পুলিশকর্তা ও গুন্ডারা নির্লজ্জের মতো ঘুরে বেরিয়েছে, কোনও কোনও কুখ্যাত পুলিশ অফিসারের পদোন্নতিও হয়েছিল। দুঃখজনক ঘটনা হলেও সত্যি, এবিষয়ে বামফ্রন্ট সরকারের প্রশাসন হিরন্ময় নিরবতা পালন করে চলে। পরে শাসনক্ষমতার পালা বদলের পরেও বিচারের দাবি উপেক্ষা আর প্রতারণার বিষয় হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার হয়, শাস্তি হয়; কিন্তু এখানে কত রঙের সরকার গেল এল, ’৭০ দশকের ঘাতকদের বিচার করে শাস্তি হয়নি, হয় না। ইতিহাসের সেই ফয়সালা আজও বাকি রয়েছে। তাই শহীদদের ঋণ শোধ করার সংগ্রাম জারি থাকবে।
- দেবল