আজকের দেশব্রতী : ১৯ আগস্ট ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati 19 august

Taliban Takeover

১৬ আগস্ট ২০২১

আফগানিস্তানের চলমান ঘটনাক্রমে আমরা গুরুতরভাবে উদ্বিগ্ন। সাধারণ নাগরিকদের উপর হিংসাত্মক অপরাধ, মহিলাদের উপর নিপীড়ন, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার উপর আক্রমণের খবর দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তালিবানদের নাটকীয়ভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল দেশটিকে ব্যাপক নৈরাজ্য ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

আমেরিকার বিদেশনীতি এই সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলার জন্য সর্বতোভাবেই দায়ী। ১৯৮০ ও ১৯৯০-তে তালিবানের উত্থানের পথ মসৃণ করার সময় থেকে ৯/১১ পরবর্তীতে আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ ও দখলদারি হয়ে আজকের অপরিকল্পিত মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সন্ধিক্ষণ পর্যন্ত আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপ ও কব্জা করার এই নকশা আফগানিস্তানকে এই দুর্দশার খাদে এনে ফেলেছে।

১৯৯৬-২০০১’র তালিবানি শাসনের অতীত অভিজ্ঞতা এবং এর চরম পশ্চাৎপদ ও অনুশাসনের নিগড়ে বাঁধা মতাদর্শ ও রাজনীতি গোটা বিশ্বকে বিশেষত সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াবাসীকে আফগানিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর উদ্বেগের মধ্যে রেখেছে। আমরা আশা করি বিশ্ব জনমত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ আফগানিস্তানের আসন্ন তালিবান জমানাকে সংযত করবে এবং সেখানকার জনগণকে সমস্যাদীর্ণ দেশটিতে শান্তি, প্রগতি ও গণতন্ত্রের লক্ষ্যে নিজেদের মতো করে লড়াই চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে।

আমরা ভারত সরকারের কাছে আফগানিস্তানে থাকা সমস্ত ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনা এবং বর্তমানে পড়াশোনা, জীবিকা ও অন্যান্য কাজে ভারতে বসবাসকারী আফগান নাগরিকদের এদেশে নিরাপদে বসবাস ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। বর্তমান সংকট বহু আফগান নাগরিককে তাঁদের দেশে শান্তি ও স্থিতি না ফেরা পর্যন্ত ভিনদেশে শরণার্থী হতে বাধ্য করবে। ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন যে কতটা অযৌক্তিক তা এই সন্ধিক্ষণে আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। আইনটিতে যে বৈষম্য আছে তা আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলমান শরণার্থীদের গুরুতর অসুবিধায় ফেলবে।

যখন আফগানিস্তান সহ গোটা দুনিয়ায় শান্তি, সুস্থিতি ও গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য আফগান নাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোই কর্তব্য তখন আফগানিস্তানের বিকাশমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এদেশে ইসলাম-বিদ্বেষ ও হিংসা ছড়ানোর যে কোনো প্রচেষ্টাকে আমাদের সতর্কতার সাথে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আফগানিস্তানে ধর্মান্ধ শক্তির উত্থানের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশে ধর্মান্ধতাকে প্রত্যাখ্যান করার এবং আমাদের নিজেদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক প্রগতি ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে মজবুত করার জন্য আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।

- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি

Taliban and women

আফগানিস্তানে তালিবানদের আরেকবার ক্ষমতা দখল বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। উদ্বেগের কেন্দ্রে আছে নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সেনা অভিযান চালানোর অন্যতম যুক্তি হিসেবে “নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই”-কে সামনে তুলে ধরেছিল। সেই সময়কার আফগান নারীকে তুলে ধরা হয়েছিল অধিকারহীনতার প্রতীক হিসেবে। নিদারুণ বাস্তবতা থেকে আফগান মহিলাদের মুক্ত করার লক্ষ্যে আফগানিস্তানে মার্কিন মিলিটারি আগ্রাসন চালানো এক জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা হয়েছিল। দুই দশক পর, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, তালিবানদের সাথে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে নারীর অধিকার সুরক্ষিত রাখার প্রশ্ন একটি বারের জন্যও উচ্চারিত হয়নি।

বিগত চার দশক ধরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের জনজীবনে দুর্দশার গভীরতম ক্ষত মেয়েদেরই ধারণ করতে হয়েছে। দেশ পুনর্গঠন ও দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাই মেয়েরাই ছিলেন সবচেয়ে আগ্রহী ও উদ্যমী। প্রথম পর্বের তালিবানি শাসন পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই, ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে, বিভিন্ন পৃষ্ঠভূমি থেকে আসা আফগান নারী কর্মীরা ব্রাসেলস শহরে সম্মিলিত হয়ে একটি দাবিপত্র সংকলিত করেছিলেন। ৬২টি দাবি সম্বলিত দাবিপত্রটি জাতিসংঘ, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে প্রদান করা হয়। এই ‘ব্রাসেলস শোহরত’ চারটি বুনিয়াদি বিষয়কে কেন্দ্র করে সূত্রবদ্ধ হয় : স্বাস্থ্য; শিক্ষা, গণমাধ্যম ও কৃষ্টি; মানবাধিকার ও সংবিধান; এবং শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নারী। এই বুনিয়াদি বিষয়গুলিকে সামনে রেখেই আফগানিস্তান পুনর্গঠনের লক্ষ্যে লড়েছেন আফগান মহিলারা। তালিবান শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসানের পরও আফগানিস্তানের সমাজজুড়ে তালিবানি প্রভাব নেহাত কম ছিল না এবং মার্কিন অভিভাবকত্বে চলা সরকারও পদে পদে মহিলাদের অগ্রগতি ও অধিকার খর্ব করতে সক্রিয় ছিল। এইসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়েই প্রবল উদ্যমে শিক্ষায়, বহুবিধ কর্মক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনে সামনের সারিতে উঠে এসেছিলেন আফগান মহিলারা। কিন্তু শান্তি চুক্তির প্রক্রিয়া যখন শুরু হল তখন তাঁদেরই সম্পূর্ণ বাদ রাখা হল। তালিবানদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি বৈঠকে কোনও আফগান মহিলার ঠাঁই হয়নি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সাথে তালিবানদের ২০টির বেশি শান্তি বৈঠক হয়েছে, কিন্তু তার একটিতেও কোনও মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন না। আফগান সরকারের সাথে তালিবানদের যে বৈঠকগুলি হয় তার দুটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মহিলা প্রতিনিধি ছিল। বস্তুত, বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতে যে শান্তি প্রক্রিয়া চলে তার সর্বত্রই এই চিত্র দেখা যায়। একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় ১৯৯২ থেকে ২০১১ পর্যন্ত যত শান্তিচুক্তি হয়েছে তার স্বাক্ষরকারীদের মাত্র চার শতাংশ মহিলা এবং ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে স্বাক্ষরিত ৩০০ শান্তিচুক্তির মাত্র ১৮টিতে নারীর অধিকার সম্পর্কে কিছু না কিছু উল্লেখ আছে।

জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২০০০ সালের ৩১ অক্টোবর একটি রেজলিউশন পাস করেছিলো। ‘রেজলিউশন ১৩২৫’ নামে পরিচিত এই ঘোষণায় সমস্ত পক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শান্তি প্রক্রিয়ায় মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার এবং সমস্ত শান্তি চুক্তিতে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নকে বিশেষ গুরুত্বে স্থাপন করার। সংঘর্ষ নিরসনে, শান্তি আলোচনায়, শান্তি স্থাপনে, শান্তি রক্ষায়, মানব সংবেদি কার্যক্রমে, সংঘাত পরবর্তী পুনর্গঠনে – সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় মহিলাদের পূর্ণ সংযোগ ও সমান অংশগ্রহণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা জোরালোভাবে তুলে ধরে এই রেজলিউশন-১৩২৫। জাতিসঙ্ঘের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত রাষ্ট্রকেই এই নির্দেশিকা কঠোরভাবে মেনে চলার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ অবমাননা করা হয়। বাদ রাখা হয় মেয়েদের।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ অংশিদারিত্ব থেকে বাদ রাখার এই মুদ্রারই আরেক পিঠ হল তালিবানি ফতোয়া যা জীবনযাপনের সমস্ত প্রকাশ্য ধারা — শিক্ষা শ্রম কৃস্টি রাজনীতি — সমস্ত কিছু থেকেই বাদ দিয়ে দেয় মেয়েদের। ভারতে ক্ষমতাসীন আরএসএস-বিজেপিও নারীর প্রকাশ্য স্বাধীন জীবন নাকচ করে গৃহাভ্যন্তরে নারীকে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। তালিবান বা আরএসএসের এই চরম অবস্থানকে নিরন্তর ইন্ধন যোগায় মেয়েদের পূর্ণ ও সমান অংশগ্রহণের গুরুত্ব ক্রমাগত খর্ব করে চলার স্বাভাবিকতা। অপেক্ষাকৃত অগ্রণী বৃত্তেও সাধারণত এই স্বাভাবিকতা বিরাজ করে।

The Call of August 2021

১৫ আগস্ট ২০২১ ভারতের ব্রিটিশ পরাধীনতা-মুক্তির পঁচাত্তরতম বার্ষিকী শুরু হল। কিন্তু কী বিচিত্র পরিহাস! আজ স্বাধীনতার প্রাপ্তিগুলির উদযাপন তো বহু দূরের কথা, ভারতবাসীকে বেশি বেশি করে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে ঔপনিবেশিক যুগের নিষ্ঠুরতা ও দমন পীড়নের দুঃসহ স্মৃতি। কারণ দেশ আজ কোভিড-২ এবং মোদী-২-এর সাঁড়াশি আক্রমণে যন্ত্রণাজর্জরিত। অবস্থা এমনই যে, স্বয়ং ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কৈফিয়ত চাইতে হয়েছে — কেন এতগুলো বছর পর আজও তাদের ঔপনিবেশিক শাসকের সিডিশন ল’ বা রাষ্ট্রদ্রোহ আইন দরকার হচ্ছে! রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বা ভারতীয় পিনাল কোডের ১২৪এ ধারা, যা ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমনের জন্য ব্যবহার করত, সমালোচক বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য বর্তমান শাসকদের সেই আইনের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আর এটা ঔপনিবেশিক শাসনের কোন বিচ্ছিন্ন নিদর্শন নয়।

আইনগুলোর থেকেও বড় কথা, সমসাময়িক শাসনের নিষ্ঠুরতা, নাগরিকদের প্রতি ভারতের বর্তমান শাসকদের মনোভাব — যে নাগরিকদের ‘নগণ্য প্রজা’ হিসেবে দেখার বহরটা দিন দিন বাড়ছে। এই প্রবণতাই ঔপনিবেশিক তুলনাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলছে। ইউএপিএ আইনের একটা ঔপনিবেশিক-উত্তর ধারাবাহিকতা আছে, যা ঔপনিবেশিক যুগকেও হয়তো লজ্জা দেবে। এক অশীতিপর যাজক ও মানবাধিকার কর্মী যিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়েছেন ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী অধিকারের জন্য লড়াই করে, যিনি লড়েছেন উচ্ছেদের বিরুদ্ধে এবং মর্যাদার জন্য, জেলে যেসব বন্দীরা বছরের পর বছর সাধারণ সুযোগ সুবিধা ও অধিকার বঞ্চিত অমানবিক পরিবেশে জীবনীশক্তি খুইয়ে চলেছেন তাদের মুক্তির জন্য, সেই মানুষটিকে ঝাড়খণ্ড থেকে উৎখাত করে মহারাষ্ট্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে জেলে মেরে ফেলার জন্য! পার্কিনসন্স আক্রান্ত ফাদার স্ট্যান স্বামীকে জল পান করার জন্য একটা সিপার আর একটা স্ট্র পর্যন্ত দেওয়া হয়নি দীর্ঘদিন। জীবনের শেষ ক’টা দিন রাঁচিতে নিজের পরিচিত জনের মধ্যে কাটানোর শেষ ইচ্ছেটুকু পর্যন্ত বারে বারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সেই জামিন-শুনানিরই একটি দিনে এল তাঁর মৃত্যু সংবাদ।

ফাদার স্ট্যান স্বামীর ঘটনাটিও বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, অনেক বড় একটি ছককেই উন্মোচিত করেছে মাত্র। তিনি ছিলেন, আদ্যন্ত সাজানো ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বিনা বিচারে আটক ষোল জনের একজন। আর অধিকার রক্ষার আন্দোলনের কর্মী ও প্রতিবাদী নাগরিকদের বিরুদ্ধে এরকম বেশ কয়েকটি ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা খাড়া করা হয়েছে; ‘দিল্লী দাঙ্গা মামলা’ যেটিতে নাতাশা, দেবাঙ্গনা এবং আসিফ সম্প্রতি দিল্লীর হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, কিন্তু এখনও অনেককেই যে জেলে পচতে হচ্ছে সেটা বিশেষ করে আরেকটি নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের নমুনা। এরকম সাজানো প্রত্যেকটি ষড়যন্ত্র মামলা, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্যাতন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকদের মামলাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আর ব্রিটিশ শাসকদের যেমন প্রধানত দানবীয় আইন আর দমন পীড়ন মূলক পদক্ষেপের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল, মোদী সরকারেরও আছে ইচ্ছেমত ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো এবং নির্দোষকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য বৈদ্যুতিন তথা প্রমাণ গোপনে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য অশুভতম নজরদারির অস্ত্রভাণ্ডার।

আমরা এখন জানি যে একটি ইজরায়েলি কোম্পানি সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ মোকাবিলার নামে সাইবার-নজরদারির স্পাইওয়্যার বিক্রি করেছিল (এই সংস্থা খোলাখুলি তাদের যাচাই করা পছন্দের সরকারগুলিকে প্রযুক্তি বেচার কথা স্বীকার করেছে) এবং গোটা বিশ্ব জুড়ে ইতিমধ্যেই ৫০,০০০ ফোনকে নিশানা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাওয়া ভারতের তালিকায় রয়েছেন বিরোধী নেতা ও ভোট কুশলী, অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী (এর মধ্যে ফাদার স্ট্যান স্বামীও আছেন), একজন নির্বাচন কমিশনার (যিনি ২০১৯-এর নির্বাচনে মোদীকে আদর্শ আচরণ বিধি লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন), ভারতের প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন যে মহিলা তার পরিবারের সদস্য এবং এমনকি কর্মরত বিচারকরা ও মোদীর নিজের মন্ত্রীসভার সদস্যরাও। এ থেকে আমাদের একটা পরিষ্কার ধারণা হয় যে কী ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক নজরদারি এবং ব্ল্যাকমেল-এর উপর মোদী-শাহ রাজ তার সরকার পরিচালনার স্থাপত্য গড়ে তুলেছে!

যখন পুলিশ প্রশাসন, জেল ও গোপন নজরদারির প্রযুক্তি সমেত গোটা দমনমূলক ব্যবস্থা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে এবং আন্দোলন ও সন্ত্রাসবাদকে একাকার করে ফেলা হয়েছে, তখন সেইসব সন্ত্রাসবাদী যারা বিদ্বেষপরায়ণ এবং ভয়ঙ্কর মুসলিম-বিরোধী জনতাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের অবাধ বিচরণের কোনো বাধা নেই! স্বাধীনতা দিবসের এক সপ্তাহ আগে, বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৫০০০ হিন্দুত্ববাদীর এক জনতা ভারতের জাতীয় রাজধানী দিল্লীর পার্লামেন্ট স্ট্রিটে জড়ো হয়ে মুসলিম হত্যার শ্লোগান দিতে থাকে। ঐ জমায়েত দাবি করতে থাকে — “বিদেশি” আইন বাতিল করে ভারতীয় আইন লাগু করতে হবে। এই ধরণের উগ্র হিন্দুত্ববাদী জনতার আগ্রাসী সাম্প্রদায়িকতার আদি উৎস আরএসএস কিন্তু “বিদেশি” আইন বলে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ইউএপিএ বা এএফএসপিএ-এর মত ঔপনিবেশিক যুগের আইনগুলোর কখনও বিরোধিতা করেনি! বরং আর এস এস সবসময় ভারতীয় সংবিধানকে “পশ্চিমী ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত” বলে ঘোষণা করে এসেছে এবং এই সংবিধান বাতিল করে তার জায়গায় ‘মনুস্মৃতি’কে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে যেটি আসলে নারী ও নিপীড়িত বর্ণগুলির দাসত্বের এক দলিল।

কোভিড অতিমারি পরিস্থিতি, বিশেষ করে কোভিড-এর প্রাণঘাতী দ্বিতীয় ঢেউ বাস্তবটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গোটা বিশ্ব দেখেছে কীভাবে কাতারে কাতারে ভারতবাসীকে অক্সিজেনের অভাবে মরতে হয়েছে, কীভাবে সেই সব মৃতদেহ চরম অমর্যাদা ও তাচ্ছিল্যে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কীভাবে গণচিতা জ্বালিয়ে পোড়ানো হয়েছে আর গণকবর খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার সংসদে বলছে, ভারতে অক্সিজেনের অভাবে কেউ মারা যায়নি! জনসাধারণের কোভিড পরীক্ষা ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে মৃতদেহের গণনা পর্যন্ত আমরা শুধু দেখে গেলাম মানুষের জীবনের প্রতি এই সরকারের কী ভয়ঙ্কর তাচ্ছিল্য আর অশ্রদ্ধা।

চরম উদ্ধত এবং চরম উদাসীন এই সরকার অনবরত বার্তা দিয়ে চলেছে যে এই বিপুল প্রাণহানি নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই, তারা গ্রাহ্যই করে না। মোদীর, ‘বিপর্যয়ের মধ্যে সুযোগ খোঁজার’ আপ্তবাক্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে এই সরকার অতিমারীকে শুধু কর্পোরেট মুনাফা বাড়ানো এবং জনসাধারণের সম্পদ, অধিকার, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার একগুচ্ছ সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়ে চলেছে।

১৯৪৭ সালে ভারত আত্মপ্রকাশ করেছিল এক আধুনিক গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের স্বপ্ন এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য নিয়ে। আজ ভারত পরিণত হয়েছে এক ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে’ এবং ভারতবাসী দিন কাটাচ্ছেন জুলুমশাহীর দুঃস্বপ্নের মধ্যে। এক দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন এই মুহূর্তের জরুরি আহ্বান : চাই জুলুম শাহী থেকে স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় মদতে বিপর্যয় ও ধ্বংস থেকে স্বাধীনতা, ফ্যাসিবাদ থেকে স্বাধীনতা!

(এম এল আপডেট, ১০ আগস্ট, ২০২১)

August 15 ashoknagar

৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে দেশের কোটি কোটি মানুষের কলতানের মধ্যে একইসাথে কল্লোলিত হয় সিপিআই(এমএল) ও তার সমস্ত সহযোগী গণসংগঠন। পার্টি-কেন্দ্র থেকে আগে থাকতেই রাখা হয় এক সংগঠিত আহ্বান। ঘোষণা করা হয় জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের “অঙ্গীকার”। সেইমতো রাজ্যের জেলায় জেলায় শপথে শপথে মুখরিত হয় পার্টির ও পার্টি প্রভাবিত নানা শক্তি নানা রূপে। নিছক ‘পূজার ছলে ভুলে থাকা নয়’, রাষ্ট্রীয় দমন-সামাজিক অধীনতা ও অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য অব্যাহত সংগ্রামে সংগঠিত হওয়ার নিদান ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো জায়গায় বিশেষ উদ্যোগে সামিল করানো হয়েছে শিশু ও কিশোরদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয় পতাকা ও পার্টির রক্তলাল পতাকা উত্তোলন করেছেন মহিলা সংগঠক। কোথাও কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মূর্তির সামনে। শ্লোগান উঠেছে “স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ভগৎ সিং’দের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা কর্পোরেটদের হাতে সঁপে দেওয়া চলবে না”! কোনো এক গাঁয়ের ধানের ক্ষেতের পাশের মাঠ থেকে ভেসে আসে বৃন্দগান “মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে ...”। পার্টি আয়োজিত কোনো উদযাপন কর্মসূচিতে সামিল হয়েছেন সিপিএম থেকে আসা শক্তি, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন তাদেরই বর্ষীয়ান নেতা। বিস্তারিত রিপোর্ট উল্লেখের অবকাশ নেই। গ্রাম-নগর, শহর-শিল্পাঞ্চল সর্বত্রই সংগঠিত হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে অবিচল থাকার ঘোষণা। দিনের সকাল থেকেই কর্মসূচি শুরু হয়ে যায়, কোথাও কোথাও চলে সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা। সর্বত্র পাঠ করা হয় স্বাধীনতা দিবসের “অঙ্গীকার”, কোন কোন ক্ষেত্রে একযোগে সংবিধানের প্রস্তাবনাও। দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও ধ্বনিই আজকের বাংলা থেকে শুরু করে আসমুদ্র হিমাচলের রণধ্বনি।

Kashipur-Baranagar genocide

সে সময়টা ছিল ছাত্র যুবদের আত্মত্যাগের উজ্জ্বল সময়, সে সময়টা ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অন্ধকারতম সময়। সাতের দশকে মুক্তির মহাকাব্য লিখতে মরণপণ করা যুবকদের শেষ করতে রাষ্ট্র তার সমস্ত শক্তিকে নিয়োজিত করেছিল, সেটা ছিল খুনে সিদ্ধার্থ জমানার সময়, কংগ্রেসী গুন্ডা এবং আরও কিছু শক্তি যোগ দিয়েছিল নরমেধ যজ্ঞে। বারাসত, বেলেঘাটা, কোন্নগর, ডায়মন্ডহারবার — একটার পর একটা জায়গায় সংগঠিত হচ্ছিল গণহত্যা, ময়দানে খুন হন কবি ও রাজনৈতিক নেতা সরোজ দত্ত। সেই সময়েই কাশীপুর-বরানগরে সংগঠিত হয়েছিল নারকীয় গণহত্যা, ১২-১৩ আগস্ট দু’দিন দু’রাত্রি ধরে একটা অঞ্চলের শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের অধিকাংশ ছিল কিশোর, তরুণ, যুবক। মুখে আলকাতরা মাখিয়ে যে হুগলি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তরতাজা যুবকদের, সেই হুগলি নদী দিয়ে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে বয়ে গেছে অনেক জল। তারপর ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসন আর এক দশকের তৃণমূল শাসন অতিক্রান্ত, ভঙ্গ হয়েছে গণহত্যার বিচারের প্রতিশ্রুতি।

ইতিমধ্যে আবার এক তমসাচ্ছন্ন সময়ে প্রবেশ করেছে ভারতবর্ষ। আর তাই কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার ৫০ বছর পূর্তি নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে।

১৩ আগস্ট, প্রত্যেক বছর এই দিনটিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সমবেত হয় কলকাতার উত্তর শহরতলীর সিঁথি মোড়ে শহীদ স্মারকস্তম্ভের সামনে। এবারের শহীদস্মরণ কর্মসূচিতে সামিল হয়েছিল আরও কিছু ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন। প্রথমে মাল্যদান ও নীরবতা পালনের মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, তারপরে কয়েক ঘন্টার সভা থেকে এক জীবন্ত দিকনির্দেশের বার্তা বেরিয়ে আসে।

দীর্ঘ অসুস্থতা সত্বেও হাজির হয়েছিলেন পার্টি নেতা পার্থ ঘোষ, তিনি সেই সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়ে ছাত্র যুবদের রাস্তার লড়াই-এর স্মৃতি তুলে ধরে ধরেন এবং বলেন “এই গণহত্যার বিচারের দাবিতে লড়াই চলতে থাকবে, আজকের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের জন্যও এটা জরুরি”। পার্টি নেতা কার্তিক পাল বলেন, “আমরা আজ আওয়াজ তুলেছি বাংলার বুকে গণহত্যা আর নয়, একথার অর্থ গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে”। এই গণহত্যার সত্য উদঘাটনে যে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল তাতে শহিদ পরিবারের বহু মানুষ যেমন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তেমনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন অনেক গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ। এআইসিসিটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তিনি বলেন আজও সেই তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলোনা। উত্তর ২৪ পরগণার সিপিআই(এমএল) নেতা নবেন্দু দাশগুপ্ত বলেন, “নতুন প্রজন্মের কাছে কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার ইতিহাস পরিচিত করানো দরকার। ন্যায়বিচারের দাবিতে চাপ জারী রাখতে হবে।” ‘আজকের দেশব্রতী’ পত্রিকার সম্পাদক বলেন, “ইতিহাসের চাপা পড়া সত্যকে তুলে আনতে হয়, কংগ্রেসী যে নেতার মৃত্যুকে অজুহাত করে গণহত্যালীলা চালানো হয়েছিল সেই হত্যায় পাঁচ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল, অথচ শতাধিক মানুষের হত্যাকান্ডের আজও কোনও তদন্ত হল না, বিচার হল না, একজনেরও সাজা হল না।” সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সেই অন্ধকার জমানা এবং জরুরী অবস্থার সেই দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনার বিজেপির কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) রেড স্টারের পক্ষে রাজু সিংহ, নিউ ডেমোক্র্যাসির সুশান্ত ঝা, শ্রমিক আন্দোলনের সাথী কুশল দেবনাথ ও ভারতের সাম্যবাদী দলের নেত্রী বর্ণালী মুখার্জী। রাষ্ট্র এই হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষ মদত দিয়েছিল।

demand for trial of Kashipur-Baranagar genocide

 

একুশ শতকের গোড়ায় গুজরাট থেকে শুরু হয়ে আজ ছত্রিশগড়, কাশ্মীর, দিল্লীতে গণহত্যা ঘটে চলেছে; শহীদ চারু মজুমদারের মতোই জেল হেফাজতে খুন হচ্ছেন ফাদার স্ট্যান স্বামী, প্রতিবাদীদের জেলে পোরা হচ্ছে, তাই রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করা ও তার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন নাট্যব্যক্তিত্ব দেবাশিস চক্রবর্তী, মহিলা নেত্রী ইন্দ্রানী দত্ত, ছাত্র নেতা নীলাশিস বসু। সভায় উচ্চারিত হয় নির্মাতা নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথ্যচিত্র ‘উজান বেয়ে’র প্রসঙ্গ। সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার ও মেঘনা মজুমদার, ছাত্র সাথী সায়ন, অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থা, নীতীশ রায় ও শান্তনু ভট্টাচার্য, কবিতা পাঠ করেন শোভনা নাথ ও ভিয়েত ব্যানার্জি। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জয়তু দেশমুখ ও অন্বেষা গণহত্যার বিচার চেয়ে ও ফ্যাসিবাদকে রোখার স্লোগান তুলে সভার কাজ শেষ করেন। এই কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় নজর কেড়েছে নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা — আইসা’র সদস্যরা।

50th anniversary of Kashipur

কাশিপুর-বরানগরের গণহত্যার ৫০ বছর পূর্তি দিবসে ১৩ আগস্ট মেদিনীপুর শহরে ‘২১-এর ডাকে’ প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে আওয়াজ ওঠে গণহত্যার বিচার চাই। একইসঙ্গে বিচার চাওয়া হয় ফাদার স্ট্যানের পুলিশ হেফাজতে হত্যার। বিচার চাওয়া হয় জঙ্গলমহলের ৫০ জন আদিবাসী যুবক যারা দীর্ঘদিন বিনা বিচারে জেলে আটক আছে তাদের মুক্তির। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রেশনে আধার সংযুক্তির মধ্য দিয়ে রেশন ব্যাবস্থা তুলে দিয়ে এবং নতুন কৃষি আইন পাশ করিয়ে দেশের জমি সহ পুরো খাদ্য বাজারটা আদানি-আম্বানির মতো কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে।

এর বিরুদ্ধে সারা দেশের কৃষক দিল্লীর বুকে আটমাস-ব্যাপি যে অবস্থান আন্দোলন করছে তার প্রতি পুরো সমর্থন জানানো হয়। কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক সহ সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে দমন করে ব্রিটিশ উপনিবেশকালের রাজদ্রোহী আইনের মতো ইউএপিএ চালু রেখে বিজেপির স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন করার কোন নৈতিক অধিকার নেই। বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রের সরকার সব বিষয়ে বিভাজনের রাজনীতি কায়েম করার চেষ্টা করছে। এমনকি একশো দিনের কাজেও বিভাজনের নীতি এনেছে। ২০০৬ সালের বন-আইন বদলে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে বনের জমি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সভা থেকে কর্পোরেটদের দালাল বিজেপিকে হটানোর ডাক দেওয়া হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের মঙ্গল মুর্মু, বাংলা পক্ষ’র আলোকরঞ্জন চক্রবর্তী, এসসি-এসটি স্বাধীকার মঞ্চের শোভন পাল, ছাত্র কর্মী নিস্বর্গ মাহাতো এবং সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি সদস্য বাবলু ব্যানার্জি। এছাড়া কবিতা পাঠ করেন রাণা। সভা পরিচালনা করেন শৈলেন মাইতি। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ছাত্র নেতা সৌমায়ন, রাজদীপ এবং অন্যান্যরা, এপিডিআর’এর বাণীকান্ত বারিক পৌর আন্দোলনের নেতা তপন মুখার্জী।

gang rapists in Binain

৮ আগস্ট হাওড়ার আমতা বিধানসভার বাইনান অঞ্চলের অধিবাসী মধ্যতিরিশের শারীরিক প্রতিবন্ধী মহিলা, স্থানীয় ৬ জন ব্যক্তির দ্বারা গণ-ধর্ষণের শিকার হন। মূল অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী।

১৭ আগস্ট সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে গণধর্ষণের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুততার সাথে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ-তদন্তসহ শাসকদলের কর্মীদের অবিলম্বে গ্রেফতার এবং নির্যাতিতার চিকিৎসা এবং নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে হাওড়া জেলা শাসকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ এবং দাবীসনদ জমা দেওয়া হয়।। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন আইপোয়া হাওড়া জেলা সম্পাদিকা কল্যাণী গোস্বামী, রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত, এআইসিসিটিইউ নেত্রী মীনা পাল,আইসার রাজ্য সভাপতি নিলাশিস বসু এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত ও রতন দত্ত। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন কমরেড মাধব মুখার্জি ও সুষমা মুখার্জি।

প্রতিনিধিদল হাওড়ার ডিএম-এর কাছে দাবিসনদ জমা দিতে গেলে ডিএম দুয়ারে সরকার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এডিএম-এর সাথে দেখা করতে পাঠানো হয়। এডিএম দেবারতি ঘোষ জানান তিনি এই ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। প্রতিনিধিদলের সামনেই তিনি আমতার বিডিওকে ফোন করে খোঁজ নিয়ে জানান যে নির্যাতিতা মহিলাটি উলুবেড়িয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু বর্তমানে সেখানে নেই। কোন প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে কিনা সেটাও তারা জানে না। গণ ধর্ষণের ঘটনায় দুজন অভিযুক্তকে এখনো পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। তারা ফেরার।

অত্যন্ত উদ্বিগ্নের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনা ঘটেই চলেছে। বাইনানের এই ভয়ংকর ঘটনাটি দেখিয়ে দেয় যে বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর আধিপত্য রাখার জন্য বা প্রতিহিংসার রাজনীতিকে চরিতার্থ করার জন্য মহিলাদের কিভাবে নিশানা করা হয়। অভিযুক্তরা শাসকদলের কর্মী বলেই দলের মদতে গা ঢাকা দিয়েও থাকতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন দ্রুত এই ঘটনার হস্তক্ষেপ করুন ও উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

মহিলা সমিতি দাবি জানায় --

  • নির্যাতিতা মহিলাটি ও তার পরিবার কোথায় আছে সেই তথ্য গোপন রাখা চলবে না।
  • অবিলম্বে অভিযুক্তদের খুঁজে বার করে গ্রেফতার করতে হবে।
  • অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে
  • মহিলাটি এবং তার পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে হবে। এবং তারা যাতে তাদের নিজগৃহে ভয়হীন শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস বসবাস করতে পারে তার ব্যবস্থা প্রশাসনকে করতে হবে।

বাংলার মেয়েরা তৃণমূল কংগ্রেসকে তৃতীয় বার ক্ষমতায় আনার জন্য বিপুলভাবে ভোট দিয়েছেন। তাই আমরা চাই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে রাজ্য প্রশাসন উদ্যোগ নেবে। আশা করি এই নির্যাতন ধর্ষণ খুন বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন দ্রুত এই ঘটনার হস্তক্ষেপ করুন ও এবং দোষীদের গ্রেফতার এবং উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করুন।

Sukant's birthday

১৬ অগাস্ট বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য-র জন্মদিবস পালিত হল যাদবপুরের সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থা-র পক্ষ থেকে।


কবি সুকান্ত তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো যাদবপুর টি.বি হাসপাতালের যে কেবিনে ছিলেন সেই ঘরে ও হাসপাতালের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। উপস্থিত ছিলেন টিবি হাসপাতালের সুপার সুব্রত রায় সহ হাসপাতালের কর্মীরা ও সংযোগ-এর সদস্যরা। এরপরে যাদবপুর সুকান্ত সেতু হকার মার্কেটের ভেতরে কবি সুকান্তের মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। হকার-ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন।আবৃত্তি পরিবেশন করেন পার্থ রায়, সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রণব মুখার্জি, সুব্রত ভট্টাচার্য, স্বপন চক্রবর্তী। মাল্যদান করেন সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থার সভাপতি প্রণব মুখার্জি সহ সুব্রত ভট্টাচার্য, কল্পনা দেশমুখ, দিলীপ ঘোষ, স্বপ্না চক্রবর্তী, সিপিআই(এমএল) নেতা বাবুন চ্যাটার্জী, অমলেন্দু চৌধুরী সহ অন্যান্যরা।

Motion Against Modi

৯ আগস্ট, ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ দিবসে কিসান সংসদে অনুষ্ঠিত হল ১৩তম এবং শেষ অধিবেশন — যে অধিবেশন ছিল শুধুমাত্র মহিলা প্রতিনিধিদের জন্য। তাঁরা দাবি করলেন কর্পোরেটরা কৃষিক্ষেত্র ছাড়ো এবং মোদী প্রধানমন্ত্রীর গদি ছাড়ো। কিসান সংসদ সর্বসম্মতভাবে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করেছেন।

অনাস্থা প্রস্তাবটি সভায় উত্থাপিত হয় ৬ জুলাই। ৯ আগস্ট কিসান পার্লামেন্টে চারটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় — নেতৃত্ব দেন ডঃ রণবীর কাউর ভাঙ্গু, রীমান নইন, ঊষা রাণী, সুনীতা টিকাইত, পি কৃষ্ণাম্মাল, সুদেশ, জসবীর কাউর নাট এবং মউরীন কালেকা প্রমুখ। অর্থনীতিবিদ ডঃ অনুপমা পাঞ্জাবী (পাতিয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়), সমাজকর্মী নভশরণ কাউর, এআইপিডব্লিউএ সম্পাদিকা এবং সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য কবিতা কৃষ্ণাণ, লক্ষ্মৌ-এর এআইপিডব্লিউএ নেত্রী মীনা সিং, পাঞ্জাব কিসান ইউনিয়ন নেত্রী জসবীর কাউর নাট, এআইএসএ এবং কিসান আন্দোলন কর্মী নভকিরণ নাট প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ও আরো অনেকে সভায় ভাষণ দেন। বক্তারা মোদী জমানাকে দায়ী করেন — হিন্দুত্ব সন্ত্রাসবাদীতা, পেগাসাস গোয়েন্দাগিরি, শ্রম আইনের ক্ষয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দেওয়া, কৃষিক্ষেত্র, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে কর্পোরেট মুনাফাখোরদের কাছে বিকিয়ে দেওয়ার জন্য।

সভায় সিদ্ধান্ত হয় এই কিসান পার্লামেন্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকবে — সংযুক্ত কিসান মোর্চার কর্মসুচি ১৫ আগস্টে কিসান মজদুর আজাদী সংগ্রাম দিবস হিসাবে পালনের প্রস্তুতির জন্য।

মহিলা সংসদ এবং কিসান সংসদের ঘটনাবলি সামগ্রিকভাবে কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে পাটনা এবং বেনারসেও অনুষ্ঠিত হয়। পাটনায় অধ্যাপিকা ভারতী এস কুমারকে সংসদের স্পীকার পদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সভার অংশগ্রহণকারীরা যে বিলগুলি আনেন তা হল — শ্রম আইনকে শ্রমজীবীদের পক্ষে জোরদার করা, স্বাস্থ্যের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে নিশ্চিত করা, খাদ্যদ্রব্য ও রান্নার গ্যাসের মূল্য বেঁধে দেওয়া। এই প্রস্তাবগুলির পক্ষে বক্তব্য রাখেন এআইপিডব্লিউএ সাধারণ সম্পাদিকা মীনা তেওয়ারী। তিনি বলেন, ভারতের নাগরিকরা এই নকল পার্লামেন্টকে বাস্তবায়িত করার জন্য সংগ্রাম করবেন।

Sulli Deal

গিটহাব নামের একটি ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্মে সুল্লি ডিল নামের একটি অ্যাপ্লিকেশন টুইটার নেটিজেনদের নজরে আসে ৪ জুলাই নাগাদ। মুহূর্তের মধ্যে নেট-দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেয় এই অ্যাপ্লিকেশনের বিষয়বস্তু। সাংবাদিকতা, বিমান-চালনা, সমাজসেবার কাজে যুক্ত প্রায় শতাধিক মহিলার ছবি বিপণনী সামগ্রী হিসাবে নিলামে প্রদর্শিত হচ্ছিল সুল্লি ডিল অ্যাপ্লিকেশনের পর্দায়। বিভিন্নক্ষেত্রে কর্মরত এই শতাধিক নারীর প্রত্যেকেই ঘটমান অন্যায়, বাস্তবিক বৈষম্য ও দেশের মসনদে বসে থাকা ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সরব ব্যক্তিত্ব এবং এরা সকলেই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। শহুরে অভিধায় সুল্লি শব্দটি যৌন-হেনস্থামূলক। আগেও সামাজিক মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী রথী মহারথীদের সুল্লি শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে মুসলিম মহিলাদের হেনস্থা করতে দেখা গেছে। আমেরিকান কোম্পানি গিটহাবের সাহায্যে এই অ্যাপ্লিকেশন তৈরির পর পিতৃতান্ত্রিকতা ও ফ্যাসিবাদের এই ন্যক্কারজনক আস্ফালন রমরমিয়ে চলেছে ২০ দিন ধরে। নিজের বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে, হেনস্থার শিকার বেশ কিছু মহিলা সুল্লি ডিলের বিষয়টি জানতে পারেন ও দেশের রাজধানীর অধিবাসী হিসাবে দিল্লী পুলিশের দ্বারস্থ হন। ফ্যাসিবাদের তল্পিবাহক দিল্লী পুলিশ যথারীতি কাউকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়নি।

বছর শুরুর প্রথম ঈদের সময়, ভারতীয় ও পাকিস্তানি মুসলিম মহিলাদের ছবি একই কায়দায় ইউটিউব ও টুইটারের মতন সামাজিক মাধ্যমগুলিতে নিলামে তোলা হয়েছিল ‘লিবারাল ডজ’ নামের একটি একাউন্ট থেকে। ৭৭ পয়সার মূল্যে এই নিলামে যৌন-পণ্য হিসাবে প্রদর্শিত হয়েছিলেন কংগ্রেস দলের সর্বভারতীয় আহ্বায়ক হাসিবা আমিনও। হাসিবা আমিন পুলিশি তদন্তে আস্থা রাখলেও, সাইবার দুনিয়ায় যৌন-হেনস্থা ও অপরাধকে আটকানোর দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় রিসোর্সের অভাবে হাসিবার অভিযোগের সুরাহা হয়নি আজ অবধি। প্রবল প্রতিবাদ ও জনরোষের মুখে পড়ে গিটহাব থেকে সুল্লি ডিল অ্যাপ্লিকেশনটি প্রত্যাহার করা হলেও, ‘গোড্যাডি’ নামের অন্য একটি প্ল্যাটফর্মে সুল্লি ডিল পুনরায় রেজিস্টার করা হয়েছে।

‘ফেমিনিজম ইন ইন্ডিয়া’য় এই বিষয় নিয়ে নিজেদের মতামত জানাতে গিয়ে, আফরিন ফাতিমা খান, (সুল্লি ডিলে হেনস্থা হওয়া মহিলাদের একজন) বলছেন, “এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আদর্শ হিন্দু-রাষ্ট্রে মুসলিম নারীদের যৌন-দাসে পরিণত করতে বাধ্য করা হবে।” এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির সময়, ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের কাশ্মীরের জমি দখলের সাথে, কাশ্মীরী মুসলিম মহিলাদের উপর দখলদারি পাবার আশায় উন্মত্ত আস্ফালন চাপা থাকেনি। বিজেপি শাসিত হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর ও উত্তর প্রদেশের বিজেপি মন্ত্রী বিক্রম সিং সাইনি প্রকাশ্যে বিজেপির কর্মী সমর্থকদের কাশ্মীরী মুসলিম মহিলাদের বিয়ে করার জন্য উৎসাহ দেয়। এই ঘটনা, ভারতের ফ্যাসিস্ট শাসকদের কাশ্মীরের সাথে কাশ্মীরের মুসলিম মহিলাদের শরীর ও স্বায়ত্ততার উপর কব্জা চাওয়ার নিকৃষ্ট আকাঙ্খার উলঙ্গ প্রদর্শন। পাঠক মনে করুন মৌলবাদী নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করায় সাফুরা, গুলফিশাদের রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের পাশাপাশি কীভাবে সামাজিক মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী পিতৃতান্ত্রিক হিংসার শিকার হতে হয়েছিল। আজকেও সুল্লি ডিলের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা মুসলিম নারীদের কন্ঠরোধের প্রয়াস, সেই পরিচিত ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রসারকেই চিহ্নিত করে।

ভারতবর্ষের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া মৌলবাদী নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারকে দিশা দেখিয়েছিলেন ভারতের মুসলিম নারীরা। শাহীনবাগ, পার্কসার্কাসের মতো সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রগুলির প্রাণশক্তি, মুসলিম নারীদের লক্ষ করে লিঙ্গ-ভিত্তিক হেনস্থামূলক পরিকল্পিত প্রচার চালিয়েছিল গোদী-মিডিয়া নামে পরিচিত বিভিন্ন মূলধারার খবরের মাধ্যম ও বিজেপির কুখ্যাত আইটি সেল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যাল রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ভারতে মুসলিম মহিলা রাজনীতিবিদদের উপর নির্দেশিত হিংসা ও হেনস্থার প্রকৃতি অপেক্ষাকৃত গুরুতর ও তার প্রসারও বহুব্যাপ্ত। শতকরা ৫৫ শতাংশ আগ্রাসী হেনস্থা বা ট্রোলিং-এর লক্ষ্য মুসলিম মহিলা নেতৃত্ব ও রাজনীতিবিদরা। অন্যান্য ধর্মের মহিলাদের তুলনায় ৯৪.১ শতাংশ মুসলিম মহিলা ধর্ম-জাতি ভিত্তিক কটূক্তির শিকার হন।

রাষ্ট্র ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি ‘পাবলিক প্লেসে’ মহিলাদের গতিবিধি, মেলামেশার পরিধি নিয়ন্ত্রণে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় সামাজিক মাধ্যমের পিছনের নেটওয়ার্কের গঠন গোপনীয়তা ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের বিকল্প পরিধি তৈরি করে মহিলাদের জন্য। যার মাধ্যমে মেয়েরা সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য, মতামত, পছন্দ ও সিদ্ধান্তগুলি অভ্যাস করার সুযোগ পান। সামাজিক মাধ্যমে মহিলাদের নিশানা করে নামানো আক্রমণের ফলে মহিলারা নিজেদের মতপ্রকাশের বিকল্প পরিধি থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকেন। প্ল্যান ইন্টারন্যাশন্যাল নামের একটি গ্লোবাল সার্ভের মতে, কোভিডের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে মহিলা ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের উপর হিংসার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার বহুলভাবে কমিয়ে এনেছেন বা ছেড়ে দিয়েছেন। খোদ জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্য বলছে, কোভিড লকডাউনের পর থেকে সাইবার স্পেসে মহিলা ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের উপর হিংসা পাঁচগুণ বেড়েছে। অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, মাত্র ৩৩ শতাংশ ভারতীয় মহিলা সামাজিক মাধ্যমের সাথে যুক্ত। ভারতে ৫১ শতাংশ মহিলার হাতে ফোন আছে। মাত্র ১৪ শতাংশ মেয়ে অ্যান্ড্রয়েড প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। আমাদের দেশের ৫২ শতাংশ মহিলা সামাজিক মাধ্যমে হেনস্থা, হিংসা ও ট্রোলিং-এর ভয়ে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে চান না।

এমতাবস্থায়, সুল্লি ডিল বা অনুরূপ লিঙ্গ-জাতি-ধর্ম ভিত্তিক বৈষম্যমূলক প্রতিটি অপপ্রয়াস ভারতীয় নাগরিকদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘনকেই সূচিত করে। সামাজিক মাধ্যমে নারী ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের সুরক্ষা ও গতিবিধি নিশ্চিত করার বদলে, শাহ-মোদীর মদতে সুল্লি ডিল, আইটি সেল ও গোদী-মিডিয়ার বিদ্বেষমূলক প্রচার, সার্বিকভাবে মহিলাদের সামাজিক অবস্থানকে কোণঠাসা করছে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্দেশে প্রকাশ্য বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোয় সিদ্ধহস্ত কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, পারভেশ বর্মার মতো বিজেপির নেতাদের সামাজিক মাধ্যমে অনুগামী আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

২০১৪ সালে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলিত ও মুসলিম সমাজের উপর হিংসার ঘটনা আরও তীব্র হয়েছে। এহেন মোদীর রাজনীতিতে প্রবেশ হিন্দুত্ববাদী আরএসএস’এর সক্রিয় কর্মী হিসাবে। দেশের শীর্ষাসনে বসে, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে হাতিয়ার করে মোদী আরএসএস প্রচারক হিসাবে কাজ করছেন। ভারতের বৈচিত্র‍্যের ইতিহাসকে মুছে হিন্দুরাষ্ট্রের আফিমে দেশকে রণক্ষেত্র করে তুলতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরএসএস’এর জন্মলগ্ন থেকেই। হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী/মনুবাদী আদর্শের উপর ভিত্তি করে তৈরি আরএসএস রাজনীতি।

আরএসএস’এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ ও ‘হিন্দুত্ববাদ’এর ধারণার প্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার বিভিন্ন লেখায়, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণের কথা লিখে গেছেন। ‘সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোচ অফ হিস্ট্রি’ নামের বইতে সাভারকার পূণ্য বা গৌরব অর্জনের স্বার্থে মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণের ন্যায্যতার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সম্প্রদায়ের মহিলাদের উপর যৌন-হিংসাকে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন সাভারকার।

সম্প্রতি দিল্লীর যন্তর-মন্তরে জড়ো হওয়া ফ্যাসিবাদের দালাল বিজেপি আর ফ্যাসিবাদের সংগঠক আরএসএস নেতা-মন্ত্রীরা মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে হিংসার আহ্বান রাখার পরেও তাদের গ্রেপ্তার করতে নারাজ স্বরাষ্ট্র-মন্ত্রকের আওতায় থাকা দিল্লী পুলিশ। ‘জয় শ্রীরাম’ না বললে টুকরো করে ফেলার হুমকি দিয়ে গজেন্দ্র চৌহানরা বুক ফুলিয়ে ঘুরছে, অন্যদিকে এই হিংসা আর উস্কানির বিরোধিতা করায় সমাজকর্মী, ছাত্র, যুবদের গ্রেপ্তার হতে হচ্ছে দিল্লী পুলিশের হাতে। ভারতের বর্তমান শাসকদল জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে একের পর এক জনবিরোধী আইন লাগু করার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ভারতের সংবিধানকে রক্ষা করার লড়াই চালাচ্ছে দেশের কৃষক, মজদুর, নারী, দলিত, আদবাসী, ছাত্র, যুবরা। সুল্লি ডিলের মাধ্যমে মুসলিম মহিলাদের পরিকল্পিত কণ্ঠরোধের প্রয়াসকে ব্যর্থ করে হেনস্থার শিকার মহিলারা সংঘবদ্ধ হয়ে, শাসকের চোখে চোখ রেখে বিচারের দাবি করছেন।

ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা সংবিধান হত্যাকারী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে এহেন প্রতিস্পর্ধাই আগামীর পাথেয়।

(সূত্র: লিবারেশন, আগস্ট ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হিমা ফতিমার নিবন্ধ “সুল্লি ডিলস: এ প্লেস ফর ‘অকশনি’’ অব মুসলিম উইমেন বাই হিন্দুত্ব প্যাট্রিয়ারকাল বাইগটস”)

- সম্প্রীতি মুখোপাধ্যায়

Read Betty

টোকিয়ো অলিম্পিকে এবার ভারতের নারী শক্তির জয় জয়কার। পদকের পর পদক জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন মেয়েরা। পদক জয়ী, অ-জয়ী প্রত্যেক খেলোয়াড়ই খেলার আসরে তাঁদের অসামান্য প্রতিভা দেখিয়েছেন। দেশের মানুষও তাঁদের হাজারো কুর্নিশ জানিয়েছেন। গর্বিত সকলেই। দেশের মানুষ যখন খুশিতে উদ্বেল, এরই মধ্যে এক লজ্জাজনক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল। হকি দলের সদস্য বন্দনা কাটরিয়া ভারতের একমাত্র মহিলা হকি খেলোয়াড়, যিনি অলিম্পিকে হ্যাট্রিক করেছেন। দলিত বন্দনার এত সাফল্য প্রতিষ্ঠায় উচ্চবর্ণের দম্ভে প্রচন্ড ঘা পড়েছে, তাই গায়ের জ্বালা মেটাতে রোষ উগরে দেওয়া হল সেমিফাইনালে ভারতের হকি দল আর্জেন্টিনার কাছে হেরেছে, কারণ দলিত দলে আছে বলেই এই হার! এই ছুতো ধরে হিংস্র জাতি বিদ্বেষী নারী বিদ্বেষী মনুবাদী দাম্ভিক গুন্ডারা বিজেপি শাসিত উত্তরাখন্ডে বন্দনার পরিবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কুৎসিত বাক্যবাণে তাঁদের বিদ্ধ করল, এমনকি সপরিবারে খুনের হুমকি পর্যন্ত দিল! এই ধিক্কৃত ঘটনায় সকলেই মর্মাহত। প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল, এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় তাৎক্ষণিক দুঃখ প্রকাশ করা ও ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো এবং হামলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা। কান্নায় ভেঙে পড়া পরাজিত হকি দলকে প্রধানমন্ত্রী সান্ত্বনা দিয়েছিলেন ‘পাশে আছি’। তাঁর এই আচরণকে কি পাশে থাকা বলে? একজন মহিলা খেলোয়াড়কে পর্যন্ত রাষ্ট্র যথাযথ তাঁর সম্মান, নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হল! এটা স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে দেশের সবচেয়ে বড় লজ্জাজনক দিক!

ঐ সময়েই এ বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের সংকীর্ণ গ্রাসে পড়লেন উচ্চ মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া মুর্শিদাবাদের ছাত্রী রুমানা সুলতানা। আমরা গর্বিত। কিন্তু ফল ঘোষণা করতে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ সভাপতি ছাত্রীর নাম ঘোষণার সময় বারংবার তাঁর ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করেছিলেন! যা অত্যন্ত নিন্দনীয়, এই আচরণ শিক্ষা জগতের কলঙ্ক। অধিকাংশ মহিলা খেলোয়াড়কে দারিদ্রের সাথে লড়াই করে উঠে আসতে হয়। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে নিষ্ঠার সাথে প্রবল ইচ্ছাশক্তির বলে নিজেদের হাজির করছেন অলিম্পিক ময়দানে। জয়ী হওয়ার স্বপ্নপূরণে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোকাবিলার কঠিন চ্যালেঞ্জটাও তাঁদের কাছে বাড়তি চাপ। সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে যে উন্নত পরিকাঠামো জরুরী এ পোড়া দেশে তা নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের সে পরিকল্পনাও নেই, তাই এই খাতে বাজেট বরাদ্দও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে! তার চেয়ে বরং সরকারের কাছে বেশি জরুরি হল বিজেপির নেতা নেত্রীদের নামে ক’টা স্টেডিয়াম বনানো যায়! সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর ‘খেলো ইন্ডিয়া’ প্রকল্প একটা ভাঁওতাবাজি ফাঁকা আওয়াজ।

মনুবাদীরা যতই মেয়েদের অবলা বানানো এবং ঘরবন্দী করার হাজারো চেষ্টা করুক, পারবে না। জাত ধর্ম নির্বিশেষে সর্বক্ষেত্রে মেয়েরা আজ সম অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের সামনের সারিতে। সে মহাকাশ অভিযানে হোক আর লাশ কাটা ঘরে (ল্যাব অ্যাটেন্ডেট), সমান স্বচ্ছন্দ্য। অতিমারীর কষ্টকর পরিবেশ মোকাবিলা করে, মীরাবাই চানু, লাভলিনা বারগোহাঁই, পি ভি সিন্ধুরা যখন দেশের হয়ে অলিম্পিকের মাঠে পদক জয়ের কঠিন লড়াই লড়ছেন, ঠিক সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশে এক ঘৃণ্য ঘটনা ঘটল, সপ্তদশী নেহাকে জিনস্ পরার অপরাধে পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক প্রভুরা তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলল! একই ঘটনা ঘটল মধ্যপ্রদেশে, মোবাইল ফোন ব্যবহারের জন্য দুই নাবালিকাকে অকথ্য অত্যাচারে অর্ধমৃত করা হল। মধ্যযুগীয় ঘটনা প্রবাহ গুজরাতেও ঘটল! গুজরাত তো আবার নারী নিপীড়নে আরও এগিয়ে, সামান্য সুযোগ পেলেই মেয়েদের উচিত শিক্ষা দিতে নির্যাতনের যত নিকৃষ্টতম রূপ আছে তা প্রয়োগ করে পরিবার থেকে প্রশাসন। পৈশাচিক গুজরাত দাঙ্গা তার চরম নিদর্শন। লকডাউনে গোটা দেশের জনজীবন যখন স্তব্ধ এবং অস্বাভাবিক তখনও মেয়েরা কোথাও সুরক্ষিত নয়! অতি সম্প্রতি আরও একটা নিঃশব্দ হাতরাস কান্ড ঘটে গেল দিল্লীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নয় বছরের শিশু কন্যা বাড়ির পাশেই শ্মশানের কুলার থেকে পানীয় জল নিতে গিয়ে আর ফিরল না! নরপশু শ্মশানের পুরোহিত ও তার সঙ্গীদের লালসার শিকার হল মেয়েটি, তারা ছিঁড়ে খেলো তাঁকে, আবার ঐ শ্মশানেই পুড়িয়ে দিল দেহটা, তারপর শিশুটির মাকে খবর দেওয়া হল তাঁর মেয়ে বিদ্যুৎ পিষ্ট হয়ে মারা গেছে, কি মর্মান্তিক কষ্ট কর! মাকে শেষ দেখাটাও দেখতে দিল না নরপিশাচসরা। উচ্চবর্ণের লোকেরা এভাবেই দলিত মেয়েদের শেষ করে দিতে চাইছে! শাসক দলের মদত না থাকলে এমন ঘটনা বার বার ঘটে? অবশ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই তো ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কব্জায়। প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রকল্প যে কত ভেক তা নারী সমাজ ধরে ফেলছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ আর মুখোশ খসে পড়ছে সর্বক্ষেত্রে। একদিকে মহিলা খেলোয়াড়রা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন আর এই উজ্জ্বলতার নীচে এক অদ্ভূত অন্ধকারের দিকে ক্রমশ মেয়েদের ঠেলে দিচ্ছে এই পিতৃতান্ত্রিক ফ্যাসিষ্ট সরকার।

একবিংশ শতাব্দীর কি পরিহাস!

নারীর সুরক্ষার এবং ক্ষমতায়ন মোদী সরকার যে চায় না তা আরও একবার স্পষ্ট হল। বহু লড়াইয়ের ফসল হিসেবে নির্ভয়া তহবিল গঠন হয়েছিল। এই তহবিল সমস্ত রকম নারী কল্যাণে ব্যয় হবে। কিন্তু সম্প্রতি অক্সফ্যাম সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই তহবিলের জন্য ৪৩৫৭.৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। অথচ এই তহবিলের সিংহ ভাগ টাকা অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কাজে লাগিয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের হাতকেই শক্তিশালী করেছে! যত ধর্ষণ খুন যৌন হেনস্থা গাহর্স্থ্য হিংসা অ্যাসিড হামলা বাড়ছে, ততোধিক অবহেলিত হচ্ছে নির্ভয়া ফান্ড। সমস্ত রকম ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো বহুদূরের কথা, ধর্ষিতা নারীরা যাতে দ্রুত ন্যায় বিচার পান, তার প্রমাণ সংরক্ষিত রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এখনও তৈরিই হয়নি। এবং নির্যাতিতাকে এই সংক্রান্ত যা যা পরিষেবা দেওয়া জরুরি সে সব ব্যবস্থার কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনাও সরকারের নেই। এমনকি এই দপ্তরের আধিকারিকরা জানেন না, কিভাবে কোন খাতে এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে! নারী সুরক্ষার নামে চলছে পুরো ধাপ্পাবাজী। নারী সুরক্ষার আইন অনেক আছে, কিন্তু রক্ষকই তো ভোগী! তাহলে কার্যকরি পদক্ষেপ নেবে কে? বরং বেটিদের রক্ষার নামে তাদের মূক বধির করে ঘরে ফেলে রাখার চক্রান্ত চলছে। তবে অত সহজ নয়, বাংলার মেয়েরা তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। গত নির্বাচনে ফ্যাসিষ্ট মোদী-যোগীর বাংলায় ক্ষমতা কায়েমের বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব দিয়েছেন। আশা করব, আগামী নির্বাচন গুলোতেও উদ্ধত পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারী বিজেপির বিরুদ্ধে মেয়েরা রুখে দাঁড়াবেন।

নির্যাতন অন্য রূপেও হচ্ছে, কোভিড বিধি পালনে প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞাপনের বহর খুব, ‘দুগজ কি দূরী, মাস্ক পহেন না, হাত ধোনা জরুরি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মেহনতি কাজ হারানো মানুষ পেটের ভাত জোটাতে প্রতিদিন গাদাগাদি করে ট্রেনে বাসে যাতায়াত করছেন। অথচ ভ্যাকসিনের সাপ্লাই নেই, মেয়েরা তো সবচেয়ে কম ভ্যাকসিন পাচ্ছেন। আশা স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার জন্য কোনো পিপিই কিট দেওয়া হচ্ছে না। সেবা দিতে গিয়ে কত আশাকর্মীর কোভিডে মৃত্যু হল কিন্ত তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হল না। কোভিডকালে কৃষক বিরোধী, জনবিরোধী তিন আইন বাতিলের দাবিতে কিষাণের সাথে কৃষাণীরা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় মাসের পর মাস দিল্লির রাস্তায় ধর্ণায় বসে আছেন। সরকারের মদত পুষ্ট গুণ্ডারা তাঁদের ওপর অত্যাচারও চালিয়েছে! মাইক্রো ফিনানস কোম্পানিগুলোর জ্বালায় হাজার হাজার গরিব মেয়েরা প্রায় প্রতিদিন এ ঋণ মকুবের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন! সরকারের তাতে কোনো হেলদোল নেই। বরং কোভিড কালে মোদী সরকার একের পর এক জনবিরোধী নীতি নেওয়ার ফল স্বরূপ নিজেই মানুষকে বিধি ভাঙ্গতে বাধ্য করেছে এবং কোভিড ছড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর এই ফালতু লোক ঠকানো বিজ্ঞাপনে বিপুল অর্থ ব্যয় না করে, গরিব মানুষের খাওয়া-চিকিৎসার জন্যে তা ব্যয় করলে এত মানুষের কোভিডে এবং অনাহারে মৃত্যু আটকানো যেত। অবশ্য মানুষ মরল কি বাঁচল, তাতে কান্ডজ্ঞানহীন এই সরকারের কিছু যায় আসে না! ওনারা তো সর্বদা কর্পোরেটদের সেবায় ব্যস্ত কি না! সরকারের এই উদাসীনতার জন্য মানুষ এতটাই বিপর্যস্ত ও বিপদগ্রস্ত যে সুপ্রিম কোর্টও কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যদিও কোর্টের নির্দেশকে পাত্তা না দিলেও উদ্ধত মোদী সরকার বেশ চাপে আছে। এত সব সমস্যা নিয়ে বেশি হৈচৈ করলে ‘দেশপ্রেমিক’ প্রধানমন্ত্রী আবার ‘রাষ্ট্র দ্রোহ’ আইন ঠুকে দিচ্ছেন!

এ রাজ্যের মেয়েরাও সুরক্ষিত নয়, ধর্ষণ খুন শ্লীলতাহানি অব্যাহত। তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পিছনে মেয়েদের ভোট একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। বাংলার নারীসমাজ তাই আশা করে, তাঁদের সার্বিক সুরক্ষার জন্য রাজ্য সরকার দ্রুত উল্লেখযোগ্য ও কার্যকরি পদক্ষেপ নেবে। আন্দোলন তো চলবেই।

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে আওয়াজ উঠুক, নির্ভয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে মেয়েরা জোট বাঁধছে, এগিয়ে চলেছে।

- চৈতালি সেন

defense industry

ঝড়ের বেগে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সংসদে একের পর এক পাস করানো হল অনেকগুলো বিল — অচিরেই রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে যা আইনে পরিণত হতে চলেছে। ঠিক যেভাবে গতবছর অতিমারীর সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পাস করানো হয়েছিল শ্রম কোড ও কৃষি বিল, এবার সেই একই ধারায় বিমা শিল্পকে বেসরকারিকরণের দরজা খুলে দিতে, প্রতিরক্ষা শিল্পে ধর্মঘটকে বেআইনী ঘোষণা করতে মোদী সরকার চরম অগণতান্ত্রিক পথে কর্পোরেটদের স্বার্থসিদ্ধি করতে একগুচ্ছ বিলে সবুজ সংকেত দিয়ে বসল।

পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা প্রতিরক্ষা শিল্পের ৪১টি অর্ডন্যান্স কারখানাকে ৭টি কর্পোরেশনে বদলে ধাপে ধাপে সমগ্র এই ক্ষেত্রটাকে বেসরকারিকরণের শয়তানি উদ্দেশ্য নিয়ে মোদী সরকার বিরাট বড় এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এর আগে, কেন্দ্রীয় শ্রম কমিশনারের দপ্তরে এই সংক্রান্ত প্রশ্নে শ্রম বিরোধ মীমাংসার বৈঠকগুলোতে প্রতিরক্ষা শিল্পের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলোকে দু’পায়ে মাড়িয়ে আপস মীমাংসার চলমান প্রক্রিয়াকে অসমাপ্ত রেখেই ঘোষণা করলেন, কেন্দ্রীয় সরকার এই শিল্পকে কর্পোরেশন করতে অঙ্গিকারবদ্ধ। পরিহাস এটাই, যে ইস্যুকে (অর্থাৎ, কর্পোরেশন বানাবার) শ্রম বিরোধ হিসাবে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক স্বীকৃতি দেয়, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রালয় জানায় যে এই বিষয়টা হল নীতিগত সিদ্ধান্ত, এটা শ্রম বিরোধের পরিসরে আনা যাবে না।

বেশ কিছুদিন আগে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সচিব/ডিরেক্টর পার্সোনাল প্রতিরক্ষা শিল্পের সাথে যুক্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের কাছে এই শিল্পকে আরও কার্যকর ও উৎপাদনমুখী করার কি কি বিকল্প প্রস্তাব রয়েছে, তার লিখিত পরামর্শ দিতে আবেদন করেন। ফেডারেশনগুলো ৩০,০০০ কোটি টাকার উৎপাদন বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা পেশ করে, তা চোখেও না দেখে ফেলে দেওয়া হল বাজে কাগজের ঝুড়িতে। ইতিমধ্যে, ডিফেন্স প্রডাকশন অ্যান্ড এক্সপোর্ট প্রমোশন পলিসি কাউন্সিল, ২০২০ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে সাতটা কর্পোরেশনে বিলগ্নীকরণ করা হবে। বিরোধ মীমাংসার চলমান প্রক্রিয়ায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক তড়িঘড়ি যতি চিহ্ন টেনে দেওয়ায় শ্রমিক কর্মচারীদের কাছে ধর্মঘটের পথে যাওয়া ছাড়া আর ভিন্ন কোন রাস্তা ছিল না। সমস্ত কেন্দ্রীয় ফেডারেশন অগত্যা ২৬ আগস্ট থেকে লাগাতার ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।

ইমার্জেন্সি ডিফেন্স সার্ভিস অর্ডিন্যান্স, ২০২১

প্রতিহিংসা পরায়ণ কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সাথে প্রত্যাঘাত করল ইমার্জেন্সি ডিফেন্স সার্ভিস অর্ডিন্যান্স, ২০২১ জারি করে। চটজলদি রাষ্ট্রপতি ওই অধ্যাদেশটিতে স্বাক্ষর করে সেই মুহূর্ত থেকেই তাকে কার্যকর বলে ঘোষণা করলেন। চরম দমনমূলক এই অধ্যাদেশ গোটা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে থেমে থাকল না, শ্রম কোডে ধর্মঘটের সংজ্ঞার সীমা অতিক্রম করে কারখানা চত্বরে সমস্ত ধরনের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের রূপ, যেমন, ধর্ণা-অবস্থান, ধর্মঘটের সপক্ষে প্রচার এমনকি, ওভারটাইম করতে সম্মত না হওয়াকেও ধর্মঘটের আওতায় নিয়ে এলো। ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে মারাত্মক শাস্তি, সঙ্গে সঙ্গে ছাঁটাই ও চাকুরি থেকে বহিষ্কার, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের বিধান রয়েছে এই অধ্যাদেশে। পুলিশ-প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে ঢালাও ক্ষমতা, আর এই সমস্ত বেআইনী কার্যকলাপের জন্য শিল্পের আধিকারিক ও প্রশাসনকে বাঁচাতে দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ আইনী সুরক্ষা। আদালতে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে পারবে না। তাঁদের আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া হল।

ছল চাতুরি ও প্রতারণার হরেক উদাহরণ

কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশগুলোকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন যে, এই সাতটি কর্পোরেশন হবে পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন, আর কর্মীদের স্বার্থও থাকবে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। কিন্তু ঘটনা এটাই যে, এই শিল্পে কর্মীদের নিয়োগ করে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩০৯ ধারার অধীনে। কেন্দ্রীয় সরকারের কনসলিডেটেড তহবিল থেকেই কর্মীদের বেতন প্রদান করা হয়। তাঁদের নিয়োগপত্রে কখনো কোথাও একথা লেখা ছিলনা যে, তাঁদের কাজের শর্তাবলী ভবিষ্যতে বদলাতে পারে। কিন্তু এখন, কর্মীদের বেতন দেওয়া হবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পক্ষ থেকে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নয়, আর এই সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর আর্থিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, বিএসএনএল’র মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা সেই সাক্ষ্যই বহন করে।

কর্মীদের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

অর্ডন্যান্স ফাক্টরি বোর্ড ইতিমধ্যেই ২৭০টি আইটেমকে নন-কোর বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। অর্থাৎ, এই সমস্ত আইটেম এরপর থেকে আর প্রতিরক্ষা কারখানায় তৈরি করা হবে না। ওই সমস্ত ইউনিটের জন্য কর্মকর্তারা জানান এখনো কোনো পথরেখা তৈরি করা হয়নি। পেনশন প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা এখনো সমাধান হল না। শুধুমাত্র পুরনো পেনশন প্রকল্পে নথিভুক্ত কর্মীরাই পেনশন পাবেন। নতুন পেনশন প্রকল্পের অধীনে যে ৪০,০০০ কর্মী রয়েছেন তাঁরা কিভাবে পেনশন পাবেন তা এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশাই থেকে গেল। এতদিন পর্যন্ত যে নিয়ম ছিল, তা হচ্ছে, নয়া পেনশন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার কর্মীদের বেতনের ১৪ শতাংশ প্রদান করতো আর কর্মীরা দিতেন ১০ শতাংশ। কর্পোরেশন তৈরি হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদেয় অংশ ১৪ থেকে কমে ১০ শতাংশ হবে, কারণ, একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরাই ১৪ শতাংশ পাওয়ার অধিকারি, কর্পোরেশনের অধীনে কর্মীরা নন।

আইএনটিইউসি’র ডিগবাজি

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই শিল্পে বাম মনোভাবাপন্ন একটি ফেডারেশন, আইএনটিইউসি, বিএমএস — এই তিনটি সরকার স্বীকৃত ফেডারেশন রয়েছে, আর এর বাইরে রয়েছে তিনটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সম্মিলিত কেন্দ্রীয় ফেডারেশন (এআইসিসিটিইউ, টিইউসিসি এবং এলপিএফ)’র এনপিডিএফ যারা সর্বভারতীয় স্তরে ক্রিয়াশীল। সকলে মিলেই ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয় ও এই দানবীয় অধ্যাদেশের বিরোধিতা করে। কিন্তু, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সাথে বৈঠক চলাকালীন আকস্মিকভাবে আইএনটিইউসি কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর হাতে খামে মোড়া এক চিঠি দিয়ে কর্পোরেশন গঠনের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়িয়ে যুক্ত কার্যক্রম থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেয়। তিনটি স্বীকৃত ফেডারেশনের মধ্যে ফাটল ধরে। অতঃপর, আইএনটিইউসি বাদে বাকি ফেডারেশনগুলি নিজেদের মধ্যে বৈঠক শেষে যুক্ত আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আইএনটিইউসি মনে করে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যখন আশ্বাস দিয়েছেন যে কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে আর কর্পোরেশনগুলো থাকবে পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন, তাই এপ্রশ্নে আর না এগোনোই ভালো। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কথা কোন সার্কুলার মারফত তারা নীচুতলায় কর্মী মহলে জানায়নি, আর তাই, গত ২৩ জুলাই কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা শিল্পে দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচিতে এরাজ্যে তাদের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ সামিল না হলেও কারখানা স্তরের নেতারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

তবে, দিন কয়েক আগে আইএনটিইউসি’র রাজ্য নেতৃবৃন্দ জানান যে প্রতিরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্ত আন্দোলনে তাদের সংগঠন সক্রিয়ভাবেই যুক্ত থাকবে।

আশার আলো

প্রতিরক্ষা শিল্পের উচ্চতর কর্তৃপক্ষ প্রতিটি কারখানার আধিকারিককে নির্দেশ পাঠায়, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের আহূত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে কারখানার কোন কোন শ্রমিক অংশ নিচ্ছেন তার একটা তালিকা যেন প্রস্তুত করা হয়। ২৩ জুলাই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দেখা গেল, বিক্ষোভকারীদের ভিডিও রেকর্ড করার ব্যবস্থা। কিন্তু এত চোখরাঙানি সত্ত্বেও এআইসিসিটিইউ’র কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল কারখানার কর্মী নেতারা সদলবলে অংশ নেন প্রকাশ্য ওই বিক্ষোভ সভাগুলোতে। ইছাপুর রাইফেল কারখানা ও দমদম অর্ডন্যান্স কারখানার গেটে সংগঠিত বিক্ষোভসভায় এআইসিসিটিইউ সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন অংশ নেয়।

ইতিমধ্যে, কেন্দ্রীয় স্তরে, আইএনটিইউসি বাদে চারটি ফেডারেশন, সারা ভারত ডিফেন্স এমপ্লয়িস ফেডারেশন, বিএমএস অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় প্রতিরক্ষা মজদুর সংঘ, এআইসিসিটিইউ, টিইউসিসি ও এলপিএফ অনুমোদিত ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ ডিফেন্স এমপ্লয়িস ফেডারেশন এবং সারা ভারত বহুজন ডিফেন্স এমপ্লয়িজ ফেডারেশন প্রতিরক্ষা শ্রমিকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসদের পিটিশন কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে স্বাক্ষর সম্বলিত এক ডেপুটেশন দেওয়া হবে আর সেই লক্ষে ২ অক্টোবর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান। ইডিএসও বিল ২০২১ রদ করা ও প্রতিরক্ষা শিল্পকে কর্পোরেশন করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবিতেই চলবে এই প্রচার অভিযান।

- অতনু চক্রবর্তী

Taliban rule in Afghanistan

১৫ অগস্ট ২০২১ কাবুল অধিকারের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ আফগানিস্তানের দখল নিল তালিবানরা। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হবার মাত্র একশো দিনের মধ্যেই মার্কিন ও ন্যাটো মদতপুষ্ট আসরাফ গনি সরকারের পতন ঘটল। এর আগেও তালিবান সরকার দেখেছে আফগানিস্তান। তখন সেই সরকারের প্রধান ছিলেন মোল্লা ওমর। আফগানিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ওসামা বিন লাদেন ও তার সহযোগীরা মার্কিন ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালায়। আল কায়দার সেই আক্রমণের সবচেয়ে আলোচিত দিক ছিল ট্যুইন টাওয়ার ধ্বংস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের পর আর কোনও শক্তি কখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে আক্রমণ শানাতে পারেনি। মার্কিনীরাই গোটা বিশ্বকে শাসন করে এসেছে একছত্রভাবে। ভিয়েতনাম সহ পৃথিবীর নানা জায়গায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হামলা চালিয়েছে, একের পর এক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের পুতুল সরকার বসিয়েছে। সেই কারণেই এই উলটপুরাণের অভিঘাত হয়েছিল যথেষ্ট। মার্কিনী সেনেট ও রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ-এর তরফে ঘোষিত হয়েছিল ‘ওয়ার অন টেরর’এর কথা। আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল মার্কিন সামরিক বাহিনী। সঙ্গে ছিল ন্যাটো। তালিবান ও নর্দান অ্যালায়েন্স লড়াই চালিয়েও শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হয়। মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি সরকার আফগানিস্তানে বহাল থাকে দু’দশক ধরে।

মোল্লা ওমর এবং তারপর ওসামা বিন লাদেনকে আমেরিকা হত্যা করে। তালিবানের সঙ্গে মার্কিনীদের চুক্তি হয় যে তারা আল কায়দাকে কোনওরকম জায়গা দেবে না। একসময়ে সোভিয়েত প্রভাবকে অপসারণের জন্যই যে আল কায়দা ও মুজাহিদিনদের তৈরি করেছিল মার্কিন রাষ্ট্র ও গোয়েন্দা দপ্তর সিআইএ — সে কথা আজ সবারই জানা। আফগানিস্তানের সোভিয়েত সমাজবাদী ভাবনায় প্রভাবিত প্রগতিশীল সরকার, যাদের আমলে আফগানিস্তানে নারী অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার সহ নানা কিছুর চমকপ্রদ উন্নতি হয়েছিল, আল কায়দা ও মুজাহিদিনদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবার মধ্যে দিয়ে তার বিনাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল সিআইএ তথা মার্কিন রাষ্ট্র। ট্যুইন টাওয়ার ধ্বংস ও অন্যান্য কিছু ঘটনার পর একসময়ের মানসপুত্র সেই আল কায়দাই হয়ে দাঁড়াল মার্কিন রাষ্ট্রের অন্যতম নিশানা। ততদিনে সোভিয়েত ভেঙে গেছে, আল কায়দার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে তাদের কাছে। মূলত ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক সংগঠন আল বাগদাদির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গেও তাদের যুদ্ধ ও মদতের এরকম ইতিহাস আছে।

তালিবানের সঙ্গে মার্কিনীদের লড়াই চলেছে আফগানিস্তান দখলের পরেও। সেই লড়াইয়ের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে বোঝাপড়ারও চেষ্টা চলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি থাকার সময় বিপুল বৈদেশিক খরচ কমানোর জন্য বাইরে থাকা মার্কিনী সেনা ও পরিকাঠামোকে খানিকটা গুটিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। এরই সূত্র ধরে ঘোষণা করা হয় যে আফগানিস্তান থেকে সরে আসবে মার্কিন সেনা। নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের পরাজয়ের পর বাইডেন নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রাট সরকার ক্ষমতায় এসেও আগের সরকারের এই নীতি বজায় রাখে।

মে মাসের প্রথম থেকে ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে ধাপে ধাপে সরে আসতে শুরু করে। ২,৫০০ মার্কিন সেনা সহ ৯,৬০০ ন্যাটো সেনাকে প্রথমে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর পরেই আফগানিস্তানের দক্ষিণে হেলমন্দ প্রদেশে সরকারী আফগান বাহিনীর সঙ্গে তালিবানদের সশস্ত্র লড়াই এর খবর সামনে আসে। তালিবানদের মহিলা নীতির কথা সবাই জানেন। তারা মেয়েদের পড়াশুনো ও বাইরে বেরনোকে মোটেই ভালো চোখে দেখেনা। মালালাকে গুলি করার আইকনিক ঘটনাটি গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, এরকম আরো অনেক ছোট বড় ঘটনাই নানা সময়ে ঘটেছে। তালিবানের উত্থানের এই পর্বের প্রথম দিকেই এরকম এক নারকীয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে তারা তাদের পুরনো অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় নতুন করে। ৮ মে ২০২১এ কাবুলে এক মেয়েদের স্কুলে ভয়ঙ্কর বোমা বিস্ফোরণ হয় এবং তাতে মারা যান প্রায় পঁচাশি জন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন স্কুলের ছোট ছাত্রী।

কিন্তু এই ঘটনার পরেও মার্কিন বা ন্যাটোর নীতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। মে মাসের মাঝামাঝি মার্কিন ও ন্যাটো শক্তি আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারের বিমানঘাঁটি থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এরপরেই তালিবানরা কাবুল ও কান্দাহারের সংযোগকারী শহর গজনী আক্রমণ করে।

জুন মাসের মধ্যেই আফগানিস্তানের উত্তরের শহরগুলির অধিকাংশ চলে আসে তালিবানদের দখলে। সেন্ট্রাল এশিয়ার সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগাযোগের পথ তালিবানদের দখলে চলে আসার পর আফগান সংলগ্ন তাজাকিস্তান এলাকার সীমান্তে তাজিক সরকার সেনা মোতায়েন করে।

আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় সেনাঘাঁটি বাগরাম থেকে ২ জুলাই ন্যাটো বাহিনী সেনা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করে। এর দু’দিন পরেই কান্দাহারের পাঞ্জোয়াই দখল করে নিতে সক্ষম হয় তালিবানেরা। এই পাঞ্জোয়াই ছিল প্রথম পর্বে তালিবানদের উত্থানের মূল ঘাঁটি।

ইরানের সঙ্গে পশ্চিম আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকার মূল শহর ইসলাম কোয়ালা তালিবানরা দখল করে নেয় ৯ জুলাই। এর পাঁচদিন পরে ১৪ জুলাই আফগানিস্তানের পূর্ব সীমান্তের পাকিস্তান সংলগ্ন শহর স্পিন বোল্ডাক দখল করে নেয় তালিবানরা। সেখানে অসামারিক ব্যক্তিবর্গকে নির্বিচারে খুন করে তালিবানরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন সহ বিশ্বের পরাশক্তিগুলি মূলত নিন্দাসূচক বিবৃতি দিয়েই দায় সারে। তালিবানদের কার্যধারা অব্যাহত থাকে। এরপর জুলাই মাসেই লস্কর গহ, কান্দাহার ও হিরাট সহ একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ শহরে তালিবানদের আক্রমণ শুরু হয়।

অগস্টের গোড়া থেকেই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যায় যে আসরাফ গনির সরকার কাবুলের মধ্যেই ক্রমশ সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অগস্টের প্রথম থেকেই কাবুলে একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হামলায় হত্যালীলা চালাতে থাকে তালিবানরা। অন্যদিকে তালিবান বাহিনীর হাতে একের পর শহর জনপদের দখল চলে আসতে থাকে। জারাঞ্জ, কুন্দুস, সের ই পাল, তালোকান, ফারাহ, আইবাক অগস্টের প্রথম সপ্তাহে তালিবানরা দখল করে নেয়। আইবাক দখলের সময় তালিবানদের কোনওরকম বাধারও সম্মুখীন হতে হয়নি। তখনি বোঝা যায় আফগান গনি সরকারের থেকে দেশের নিয়ন্ত্রণ কার্যত তালিবানদের হাতেই চলে গেছে।

১২ অগস্ট গজনী ও হিরাট তালিবানদের দখলে আসে, ১৩ অগস্ট তারা কান্দাহারের দখল নেয়। ১৪ অগস্ট মাজার শরিফ দখলের পর ১৫ অগস্ট সকালেই তারা কাবুলে ঢুকে পড়ে। গনি সরকারের কাছে তারা বার্তা পাঠায় আলোচনার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের। গনি সরকার তা মেনে নিতে বাধ্য হন। মার্কিন ও অন্যান্য পরাশক্তির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে চলা ৪৫ মিনিট বৈঠকের পর আফগানিস্তানের সরকার তালিবানদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আসরাফ গনি পদত্যাগ করে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে দেশত্যাগ করেন। তালিবানরা কাবুলের প্রাসাদের দখল নেয়। কুড়ি বছর ধরে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে চলা আফগান সরকারের পতন হয় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারপর্ব শুরু হওয়ার মাত্র একশো দিনের মধ্যেই। এত দ্রুত তালিবানী বিজয় দেখিয়ে দেয় আসরাফ গনি সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলেও সেই নির্বাচন অনেকটাই ছিল আরোপিত। এই সরকারের সঙ্গে আফগান জনগণের বৃহত্তর অংশের নাড়ির বন্ধন ছিল না। তারা মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর দখলদারদের বসানো পুতুল সরকার হিসেবেই একে দেখেছিল। তালিবানদের লড়াইকে আফগান ভূখণ্ডের ওপর মার্কিন, ন্যাটোবাহিনী তথা বিদেশী শক্তির দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে দেশের জনগণের বড় অংশ না দেখলে তালিবানের বিজয় এত দ্রুত ও এত সহজে হতে পারত না।

তালিবান শাসনের এই নয়া রূপটি কেমন হবে তা আগামীদিনে ক্রমশ স্পষ্ট হবে। এজন্য আমাদের অবশ্যই আরো অপেক্ষা করতে হবে। তালিবানরা ইতোমধ্যেই জানিয়েছে যে আফগানিস্তানের মাটিকে তারা সন্ত্রাসের জমি হিসেবে ব্যবহার করতে দেবে না। আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদই শুধু নয়, তাদের বিরোধিতার কথাও তারা বলেছে। কিন্তু তালিবান জমানা আবার শুরু হতেই সবচেয়ে আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন সেখানকার নারীরা। রাস্তাঘাটে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা, স্কুল কলেজে মেয়েদের শিক্ষা সহ নানা সাধারণ নারী অধিকারও কতটা রক্ষিত হবে — সেই নিয়ে ঘোরতর আশঙ্কা রয়েছে। দেশের ভেতরের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে যেমন আওয়াজ তুলতে হবে, তেমনি বিশ্ব জনমতকেও আফগানিস্তানে নারী ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য নতুন সরকারের ওপর নিরন্তর চাপ রেখে যেতে হবে।

- সৌভিক ঘোষাল

government insurance companies

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর বাজেট বক্তৃতায় ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের কথা বলেছিলেন। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের প্রয়াস থেকে আপাতত হাত গুটিয়ে রাখলেও বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের পথে তিনি সক্রিয় পদক্ষেপ করেছেন। সাধারণ বিমা ব্যবসায় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের রয়েছে চারটে সংস্থা — ন্যাশনাল ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, নিউ ইণ্ডিয়া অ্যাসুয়েরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, ওরিয়েন্টাল ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এবং ইউনাইটেড ইণ্ডিয়া ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এগুলোর যে কোনো একটার বেসরকারিকরণ করতে গেলে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন আবশ্যক। কেননা, যে আইনের অধীনে এই কোম্পানিগুলো তৈরি হয়েছিল তাতে শর্ত ছিল — কোম্পানিতে সরকারি মালিকানা থাকবে কমপক্ষে ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ, কোম্পানি পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতেই। বেসরকারিকরণ করতে গেলে সরকারি মালিকানাকে নামিয়ে আনতে হবে ৫১ শতাংশের নীচে এবং আইনের সংশোধন করেই তার বাস্তবায়ন সম্ভব। বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে নির্মলা সীতারামণের পেশ করা সাধারণ বিমা ব্যবসা (জাতীয়করণ) আইনের সংশোধনী বিল লোকসভায় পাশ হয়ে গেল আগস্টের ২ তারিখে। ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও’র তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে ফোনে আড়িপাতাকাণ্ডের আলোচনার দাবিকে কেন্দ্র করে সংসদে যখন অচলাবস্থা চলেছে, তার সুযোগ নিয়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই লোকসভায় ধ্বনি ভোটে পাশ করানো হয়েছে এই সংশোধনী বিলকে। সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই অধিবেশনে মোদী সরকার সংসদে দেড় ডজনেরও বেশি বিল পাশ করিয়েছে, এবং প্রতিটা বিলের জন্য গড় সময় ব্যয় করা হয়েছে ছয় থেকে সাত মিনিট! কর্পোরেটস্বার্থের প্রতিভূ রূপে যে সরকার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সরকারি বিমা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়াটাই যে তার অগ্ৰাধিকার হবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে কৃষকস্বার্থের পরিপন্থী তিনটে কৃষি বিল কোনো আলোচনা ছাড়াই যেভাবে সংসদে পাশ করানো হয়েছিল, বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করতে বিমা আইনের সংশোধনী বিল পাশে সেই পথেরই আশ্রয় নিল মোদী সরকার।

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের যে বিমা সংস্থাটার বেসরকারিকরণ করবে বলে সরকার মনস্থ করেছে সেটা হল ইউনাইটেড ইণ্ডিয়া ইনসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এই সংস্থায় বিমাকারীর সংখ্যা ১.৭৪ কোটি, কোম্পানির কর্মী সংখ্যা প্রায় ১৪,০০০ এবং জমা হওয়া প্রিমিয়ামের পরিমাণ সাড়ে ১৭,০০০ কোটি টাকার বেশি। বেসরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেট সংস্থার হাতে গেলে নিয়ন্ত্রণকারী কর্পোরেট সংস্থা শুধু ঐ বিপুল পরিমাণ অর্থ ইচ্ছেমত ব্যবহারের অধিকারীই হবে না, ১৪,০০০ কর্মীর ভবিষ্যতও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। কর্পোরেট সংস্থা সমস্ত কর্মীকে বহাল নাও রাখতে পারে, এবং কর্মীরা তাদের ওপর ধার্য করা মাত্রাধিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে কর্পোরেট সংস্থা তাদের ছাঁটাই করার পথেও যেতে পারে। এছাড়া, বিমা সংস্থায় যাঁরা পলিসি করেছেন তাঁদের সুরক্ষাও যে সুনিশ্চিত থাকবে এমন নয়। বেসরকারি বিমা সংস্থা প্রিমিয়াম সংগ্ৰহে যতটা আগ্ৰহী, বিমাকারীদের পাওনাগণ্ডা মেটাতে তাদের উৎসাহ তেমন দেখা যায়না। সরকারি বিমা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে বিমাকারীদের অভিযোগ যেখানে নগন্য, পাওনাগণ্ডা না পাওয়া নিয়ে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিমাকারীদের অভিযোগ কম নয়। বিমা শিল্পের কর্মীদের যৌথ মঞ্চ এআইআইইএ জানিয়েছে, ২০২০-২১ বর্ষে রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগের পরিমাণ যেখানে ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ, বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিমাকারীদের অভিযোগের পরিমাণ সেখানে ছিল একেবারে ৮২ শতাংশ। বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর তুলনায় সরকারি বিমা সংস্থাগুলোর ওপর জনগণের আস্থা ও ভরসা কেন অনেক বেশি তা যে কেউই উপলব্ধি করতে পারবেন।

কোনো বিশেষ কারণে নির্মলা সীতারামণ বিমা কোম্পানিতে সরকারি অংশিদারিত্বকে কমিয়ে আনার পদক্ষেপকে বেসরকারিকরণের উদ্যোগ বলে স্বীকার করতে চাইছেন না। তিনি বলছেন, আইন সংশোধন করে বিমা সংস্থায় সরকারি অংশিদারিত্বকে ৫১ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনার পদেক্ষেপের লক্ষ্য বেসরকারিকরণ নয়, সাধারণ মানুষ যাতে বিমা সংস্থার শেয়ার কিনে তাতে লগ্নি করতে উৎসাহী হন এবং শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংস্থার মূলধন যাতে বাড়ে সেই লক্ষ্যেই ঐ পদক্ষেপ। কিন্তু সীতারামণ নিজেই কি বিমাক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের কথা বলেন নি? বাজেট বক্তৃতায় তিনি কি বলেছিলেন তা স্মরণ করা যাক — “রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের দুটো বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং একটা সাধারণ বিমা কোম্পানির বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ গ্ৰহণের প্রস্তাব আমরা করছি। এরজন্য আইনের সংশোধনের প্রয়োজন হবে।” বাজেট বক্তৃতায় তিনি যা বলেছিলেন সে কথা কি তিনি বিস্মৃত হয়েছেন? তা সম্ভবত হওয়ার নয়। আসল ব্যাপারটা সম্ভবত হল, মোদী সরকার এবং আদানি-আম্বানিদের তথা কর্পোরেটদের স্বার্থ একাকার হয়ে জনগণের সামনে এসেছে। তাঁরা বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ নিচ্ছেন — এই কথাটা সংস্থার কর্মী, বিমাকারী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে মোদী সরকার সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত এবং জনগণের মধ্যে সরকারের কর্পোরেট স্বার্থরক্ষাকারী ভাবমূর্তিই জোরালো হয়ে উঠত। এটাকে এড়ানোর লক্ষ্যেই সম্ভবত সীতারামণের ঐ সত্যের অস্বীকার।

সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সাধারণ বিমাক্ষেত্রের চারটে সংস্থার কর্মীরাই প্রতিবাদে নেমেছেন। তাঁরা বেসরকারিকরণের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, পাশ হওয়া বিল প্রত্যাহারের দাবিতে ৪ আগস্ট ২০২১ একদিনের ধর্মঘটের ডাক দেন। চারটে সংস্থার ৫২,০০০ কর্মী ও অফিসার ধর্মঘটে অংশ নিয়ে কাজ বনধের আহ্বানকে সফল করে তোলেন। বিমা কর্মীদের সারা ভারত সমন্বয় সমিতি এআইআইইএ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “এই পদক্ষেপের ফলে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের চারটে বিমা কোম্পানির বেসরকারিকরণেই সমর্থ হবে … এটা বেসরকারিকরণ নয়, বরং বড় আকারে বেসরকারি অংশগ্ৰহণের প্রচেষ্টা বলে অর্থমন্ত্রী যে যুক্তি দিচ্ছেন তা কিছুটা হাস্যকর বলেই শোনাচ্ছে।” তাঁরা আরও জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোই দেশে সামাজিক ন্যায়কে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থা ছাড়া দরিদ্র, নিপীড়িত ও প্রান্তিক জনগণ তাঁদের অধিকারের নাগাল পাবেন না। বিমা কর্মীদের আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে ব্যাঙ্ক কর্মীদের সারা ভারত সমন্বয় সমিতি। তাঁরা জানিয়েছেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে বাঁচান, ভারতকে বাঁচান’ শ্লোগানকে তুলে ধরে তাঁরা বেসরকারিকরণ বিরোধী লড়াই চালিয়ে যাবেন।

১৯৯০’র দশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নামানো কাঠামোগত সংস্কারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে চালু হয় বেসরকারিকরণের ধারা। বেসরকারিকরণ শুধু কর্পোরেটতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলার পথকেই প্রশস্ত করেনি, তা প্রশাসনিক ক্ষেত্রের নৈতিকতার অধঃপতন ঘটিয়ে দুর্নীতিকেও বাড়বাড়ন্ত করে তোলে। উৎকোচের বিনিময়ে জমি, খনিজ ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক সম্পদকে যেমন নামমাত্র অর্থে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তেমনি খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চলের, বনজমিতে বাস করা জনগণের উচ্ছেদ ও তাদের ওপর কর্পোরেটদের দাপট ও জুলুমবাজিকেও বেড়ে চলতে দেওয়া হয়েছে। আর এতে সরকারের মদত যে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রোয়জন। রাডিয়া টেপ আমাদের জানিয়েছে, সরকারের নীতি, সিদ্ধান্তের নির্ধারণে কর্পোরেট লবিস্টদের ভূমিকা কতটা নির্ধারক হয়েছে, নির্দিষ্ট কোনো দপ্তরের মন্ত্রী কে হবেন তা ঠিক করতেও কর্পোরেটরা সফল হয়েছে। তবে, কর্পোরেট প্রীতির বিচারে এবং কর্পোরেট সাঙাততন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মোদী জমানা যে ইউপিএ জমানাকে অনেক ছাড়িয়ে গেছে তা এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করতে, তাতে অন্তর্ঘাত হানতে এদের লাগামহীন উৎসাহ। ভারতীয় জনগণের, শ্রমিক-কৃষকদের শ্রমে নির্মিত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোকে কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে তারা অনেক বেশি বেপরোয়া। শোনা যাচ্ছে, সাধারণ বিমা ব্যবসায় জড়িত সংস্থার বেসরকারিকরণের সাথে এলআইসি’র ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির অভিপ্রায়ও মোদী সরকারের রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের নিরাপত্তায় আস্থা রেখে কোটি-কোটি মানুষ সরকারি বিমা সংস্থাগুলোকে বেছে নিয়েছেন, এই সংস্থাগুলোর পলিসিকেই নিজেদের সঞ্চয়ের মাধ্যম করেছেন। আর বেসরকারিকরণের উদ্যোগ কোটি-কোটি মানুষের সঞ্চয়কে, তাদের নিরাপত্তাবোধকে বিপন্ন করে তুলেছে। বিমা কোম্পানির বেসরকারিকরণের উদ্যোগ সচল হওয়ায় নির্দিষ্ট কোনো বেসরকারি দেশি বা বিদেশী বিমা কোম্পানি পর্দার আড়ালে অপেক্ষা করছে কিনা তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে, বিলটাকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবিকে অগ্ৰাহ্য করে রাজ্যসভাকে মার্শাল পরিবৃত দূর্গ বানিয়ে বিলকে যেভাবে সেখানে পাশ করানো হল তাতে দোসর কোনো পুঁজিপতির হাতে সরকারি বিমা সংস্থাকে তুলে দেওয়ার বিজেপির অভিপ্রায় একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। আর তাই কোম্পানিরাজ প্রতিষ্ঠার অভিমুখে গৃহীত এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আশু প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা ভারতীয় জনগণের কাছে অপরিহার্য কর্তব্য রূপেই হাজির হয়েছে।

- জয়দীপ মিত্র

to their path

তাঁরা নেই — তবে আজকের দিনে বারবারই মনে হয় নদীয়ার কৃষক আন্দোলনের সংগঠক শহীদ আবু, জালালদের সংগ্রামী জীবনের শিক্ষা আজ আঁকড়ে ধরা বড়ো প্রয়োজন। তাঁরা গরিব মানুষের স্বার্থে যে আন্দোলনের ধারা গড়ে তুলেছিলেন সেটাকেই আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। নদীয়ার নওপাড়া অঞ্চলে শহীদের রক্তে ভেজা মাটিতে আয়োজিত শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠান থেকে এই কথা উঠে এল। ১৯৯২ সালে ৯ আগস্ট সিপিআই(এমএল) কৃষক নেতা আবু হোসেন সেখ শহীদ হন। পাত্রদহ গ্রামে তার শহীদবেদীতে হল স্মরণ ও শপথ গ্রহণ কর্মসূচি। সভায় বক্তব্য রাখেন সন্তু ভট্টাচার্য, কাজল দত্তগুপ্ত, কলম বিশ্বাস, জীবন কবিরাজ, জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ প্রমুখ। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন এই এলাকার সংগ্রামী নেতা আনসারুল হক। এলাকার মানুষ আগ্রহের সাথে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শোনেন। কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের কাজ, খাদ্য, ফসলের দাম প্রভৃতি দাবি উঠে আসে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পগুলিতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, সেখানে গরিবের প্রতি বঞ্চনা ও দলীয় আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।

 

== সমাপ্ত ==

খণ্ড-28
সংখ্যা-31