নন্দীগ্রাম উপাখ্যান
Nandigram anecdote

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আদ্যোপান্ত উদারিকরণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ২০০৩ সালে বাইপাসের ধারে বেসরকারী চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য কয়েক একর জমি স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়েছিলেন। এর ফলে সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা লাটে ওঠার রাস্তা পাকা হল। মানুষ ন্যূনতম চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

বাম জমানাতেই সুতাকল, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, অটো মোবাইল প্রভৃতি কারখানা বন্ধ হতে থাকলো এবং এর সাথে যুক্ত কয়েক হাজার সহযোগী প্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। চটকলগুলি টিমটিম করে চলছিল। এই সময় রাজ্য সরকার লগ্নি টানতে ফলতায় দেশের মধ্যে প্রথম এসইজেড অঞ্চল গড়ে তোলে।

এরপর সিঙ্গুরের বহুফসলী জমিতে ব্যক্তি মালিকানায় শিল্প গড়ে তোলার জন্য জমি অধিগ্রহণ, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন, প্রতিবাদ, অত্যাচার এবং প্রতিরোধে সরকারের পিছু হটা।

তখন দেশে দেশে শ্রমিকদের অধিকারের দাবিতে এসইজেড-এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও বিশেষ করে উড়িষ্যায় পস্কো’র জমি অধিগ্রহণ তথা এসইজেড-এর বিরুদ্ধে বামেরা আন্দোলনে সামনের সারিতে। পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকার তখন ইন্দোনেশিয়ার কুখ্যাত সালেম গোষ্ঠীকে নন্দীগ্রামে ২৫ হাজার একর জমিতে কেমিক্যাল হাব গড়ার জন্যে অনুমোদন দিয়েছে। এই সময় লক্ষ্মণ শেঠের অতি সক্রিয়তা সর্বজন বিদিত। এরপরের ঘটনা জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ, গণহত্যা, মানুষের প্রতিরোধ এবং সরকারের পিছু হটা। মমতা ব্যানার্জি বা শুভেন্দু অধিকারীরা এই আন্দোলনের কুশীলব ছিলেন না, এই আন্দোলনের কুশীলবরা হলেন নন্দীগ্রামের সংগ্রামী মানুষ। যতই চেষ্টা করুন বুদ্ধদেব, লক্ষ্মণ শেঠ, মমতা এবং শুভেন্দুরা নন্দীগ্রামের সংগ্রামের ইতিহাসকে পাল্টাতে পারবেন না। ২০০৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর লক্ষ্মণ শেঠের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ’ জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নোটিশ জারি করে। সেখানে উল্লেখ করা হয় নন্দীগ্রাম ও খেজুরি দুটো ব্লকে ২৫ হাজার একর জমি সরকার অধিগ্রহণ করবে।

৩ জানুয়ারি ২০০৭ অধিগ্রহণের নোটিশ পঞ্চায়েতে টাঙিয়ে দেওয়া মাত্রই নন্দীগ্রাম জেগে ওঠে। এই নোটিশের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীরা কালীচরণ পঞ্চায়েতে জমা হন। গ্রামবাসীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ নির্মমভাবে লাঠিচার্জ করে। পুলিশের জীপের তলায় একজন কিশোরের মৃত্যু হয়। জনতা উত্তেজিত হয়ে পুলিশ জীপ পুড়িয়ে দেয় এবং বেশ কিছু রাস্তা কেটে দেয়।

৪ জানুয়ারী ২০০৭ সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এক তথ্য অনুসন্ধাকারী দল পাঠায়। এই দলে ছিলেন দিবাকর ভট্টাচার্য, মলয় তেওয়ারি, নিতাই মণ্ডল, জিতু প্রসাদ, বিপ্রদাস চ্যাটার্জি (প্রয়াত) এবং শঙ্কর মিত্র (প্রয়াত)। ৬ জনের টিম প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই কলকাতা থেকে রওনা দেয়। নন্দীগ্রামে ঢোকার আগেই তেখালি ব্রীজের উপর সিপিএমের বাহিনী এদের উপর চড়াও হয়, ঘিরে ধরে শাসাতে থাকে। পুলিশ এসে ৬ জনকে প্রথমে “উদ্ধার” করে, তারপর সারাদিন “ডিটেনশন” এবং শেষে “গ্রেপ্তার” করে। ২১টি মারাত্মক ধারা চাপানো হয়। বেশ কিছু দিন জেল-জীবন কাটিয়ে জামিনে তাঁরা ছাড়া পান। যে মামলা এখনও চলছে।

৫ জানুয়ারী ২০০৭ গ্রামবাসীরা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলে। এই কমিটিকে তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিআই, এসইউসিআই(সি) সমর্থন করে।

৭ জানুয়ারী ফের গুলি চলে, তাতে ভরত মণ্ডল সহ ৫ জন শহীদ হন। অভিযোগ ওঠে সিপিএম নেতা শঙ্কর সামন্তের বাড়ি থেকে গুলি চলেছে। উত্তেজিত জনতা শঙ্করের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়, সেই আগুনেই শঙ্কর সামন্তের মৃত্যু হয়।

এরপর সেই ভয়ঙ্কর সূর্যোদয়ের ঘটনা -- ১৪ ই মার্চ ২০০৭ সাল। কাশীপুর-বরানগরের মতো আর এক নৃশংস গণহত্যার সাক্ষী থাকল রাজ্য। এরপর বহুবার নন্দীগ্রামে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন পার্টির পক্ষ থেকে আন্দোলনে সংহতি জানাতে যাওয়া হয়েছে। তার পরেরটা সবই ইতিহাস।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত  

খণ্ড-28
সংখ্যা-12