শীতলকুচি হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি : “আরো শীতলকুচির মতো গণহত্যা করব” বলা হুমকিবাজ রাজনীতিবিদদের অবিলম্বে ভোট প্রচার থেকে নিষিদ্ধ কর!!
১২ এপ্রিল ভোটের দিন, সিআইএসএফ জওয়ানরা কোচবিহারের শীতলকুচিতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ৪ জন ভোটারকে হত্যা করে।
এই ৪ জনই গরিব শ্রমিক পরিবারের মানুষ। এরমধ্যে নুর আলম মিয়াঁ এবং মনিরুজ্জামান মিয়াঁ পরিযায়ী শ্রমিক, শমিউল হক প্রথমবারের ভোটার এবং হামিদুল মিয়াঁ মিস্ত্রীর কাজ করতেন। এছাড়াও একটি অন্য ঘটনায় ১৮ বছরের আনন্দ বর্মনকে দুষ্কৃতি গুলি করে হত্যা করে।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর দ্বারা এই গুলিচালনার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের ভোটে তাদের ভূমিকা সম্বন্ধে কিছু গুরুতর প্রশ্ন সকলের মনে জাগিয়েছে। শান্তি বজায় রাখা এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করানোর বদলে, কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালাচ্ছে এবং ভোটারদের মনে ভীতি তৈরি করছে। বিজেপি নেতাদের বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছে যে সিআইএসএফ যেন বিজেপি’র পক্ষ নিয়ে ভোটারদের ভয় দেখাতেই এসেছে। নীচে কয়েকটি ঘটনার কথা বলা হল যেখানে বিজেপি নেতারা তাদের ভাষণে শীতলকুচি গণহত্যা উল্লেখ করে সাম্প্রদায়িক হুমকি দিয়েছে এবং ভোটারদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে।
- সিআইএসএফ এবং অন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে। সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে ঘুরে শীতলকুচি গণহত্যা ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে ভোট প্রচারসভায় মিথ্যা ভাষণ দিয়ে বলেন যে মমতা ব্যানার্জী শুধু চারজন মুসলমানের মৃতের জন্যেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু হিন্দু ব্যক্তির জন্যে করেননি, কারণ তিনি খালি মুসলমান তোষণ করতে চান। সত্যি কথাটা হল পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জায়গায় পাঁচজন মৃতের জন্যেই শোক পালন করা হয়। কিন্তু চারজনের মৃত্যুর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়।
- বিজেপি’র পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি দিলীপ ঘোষ হুমকি দেয় যে “কেউ বাড়াবাড়ি করলে আবার শীতলকুচি হবে”। তিনি একথাও বলেন “শীতলকুচিতে দুষ্টু ছেলেরা গুলি খেয়েছে। দুষ্টু ছেলেরা আর থাকবে না বাংলায়”।
- আরেকজন বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু বলে “বেশি খেলতে যেও না, শীতলকুচি খেলে দেব”। সে আবার বলে যে, “একজনকে মারলে শীতলকুচির মতো চারজনকে মারব”।
- লোকসভা ভোটের সময় সায়ন্তন বসু বলেছিলেন যে “সিআরপিএফ-কে বলে দেওয়া হবে যে পা লক্ষ্য করে গুলি নয়, গুলি যেন বুক লক্ষ্য করে চালানো হয়”। সেই সময় নির্বাচন কমিশন বলে যে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কোনো পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছিল? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের শাস্তি না দেওয়ার অক্ষমতার জন্যেই সায়ন্তন বসু কেন্দ্রীয় বাহিনীর হয়ে হুমকি দেওয়া চালিয়ে যেতে পেরেছে।
সত্যিটা হল যে বিজেপি নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তাদের নিজেদের পার্টির সেনাবাহিনী হিসেবে প্রচার করছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি কিভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীদের অপব্যবহার করছে।
বিজেপি নেতাদের এই হুমকিগুলো সমাজে সাম্প্রদায়িক বার্তাও দিচ্ছে কারণ সিআইএসএফের গুলিতে মৃত্যু হওয়া সকলেই মুসলমান।
শীতলকুচির ঘটনা সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন
- এরকম কোনো প্রমাণ নেই যে মৃত চারজন জওয়ানদের বন্দুক ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল বা তারা কোনো ধরনের হিংসার ঘটনায় জড়িত ছিল।
- এই ঘটনায় জড়িত একজনের নাম মৃণাল হক যার গায়ে বেশ কিছু লাঠির ঘায়ের দাগ আছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে যে মৃণালকে জওয়ানরা মারলে ওখানকার স্থানীয় ভোটাররা প্রতিবাদ করে এবং তখনই সিআইএসএফ গুলি চালায়। এই লাঠির ঘা নির্বাচন কমিশনের বিবৃতির সাথে খাপ খাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন বলে যে মৃণাল ভোটের লাইনে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সেখানকার লোকেরা ভুলভাবে যে জওয়ানরা তাকে আক্রমণ করেছে। তখন ভিড় জড়ো হয়ে জওয়ানদের আক্রমণ করে।
- প্রাথমিক খবরে বলা হচ্ছিল যে ৩০০-৪০০ জন জড়ো হয়েছিল ওখানে। পড়ে সেই সংখ্যা নেমে আসে ৭০-৮০ জনে। ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে নূন্যতম শক্তি লাগে। কেন সিআইএসএফ-কে মোতায়েন করা হয়েছিল, যেখানে তাদের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে ছেলেটিকে মারার পর গ্রামবাসীরা উত্তেজিত হয়ে যায়, ৭০-৮০ জনের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গুলি চালানোর প্রয়োজন হবে কেন?
- সিআইএসএফ-এর বিবৃতি অনুযায়ী কোনো মৃতই অস্ত্র হাতে ছিল না। তাদের যদি হিংসা ছড়ানোর ইচ্ছা থাকত তাহলে তারা নিশ্চয়ই অস্ত্র হাতেই আসত। তার মানে তারা ভোট দিতে এসেছিল। বিশাল সিআইএসএফ ব্যাটেলিয়ান উপস্থিত আছে জেনেও ওই চারজন খালি হাতে এসে জওয়ানদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে গেছিল এমনটা ভাবাই যায় না।
- এটা বোঝা যাচ্ছে না যে কেন নির্বাচন কমিশন সিআইএসএফ-এর বিবৃতি প্রমাণ ছাড়া মেনে নিল। নিশ্চয়ই এই ঘটনার ভিডিও সিআইএসএফ-এর কাছে থাকার কথা।
আমাদের দাবী
- আমরা শীতলকুচির গুলিচালনার স্বাধীন তদন্ত চাই।
- আমরা চাই, যে সিআইএসএফ জওয়ানরা গুলি চালিয়েছে এবং যে অফিসার সেই আদেশ দিয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করা হোক এবং এই গণহত্যার বিচার করা হোক।
- আমরা চাই সিআইএসএফ বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া হোক এবং ভোটারদের বিশ্বাস বাড়ানোর জন্যে পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
- আমারা চাই নির্বাচন কমিশন দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসু, আমিত শাহ এবং অন্য যে কোন রাজনীতিবিদ যারা মৃতদের অসম্মান করছে এবং সাম্প্রদায়িক হুমকি দিচ্ছে তাদের ভোটের প্রচার থেকে নিষিদ্ধ করুক এবং তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন বিধি এবং ‘জন প্রতিনিধিত্ব আইন’ অনুযায়ী কেস শুরু করুক।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে প্রভাত কুমার