আজকের দেশব্রতী : ২২ এপ্রিল ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
Heading 22 April Issue

CPI (ML) Foundation Day Calls

২২ এপ্রিল, ২০২১ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ( মার্কসবাদী লেনিনবাদী)-র বাহান্নতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই বিশেষ দিনটিতে আমরা আমাদের সকল শহীদ ও প্রয়াত নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি এবং সাম্প্রতিক অতীতে যে সব সাথীদের হারিয়েছি তাদের ভালোবাসায় স্মরণ করছি। আমরা আবেগউষ্ণ বিপ্লবী অভিনন্দন জানাই আমাদের সমস্ত সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের এবং ভারতের জনগণকে যারা ফ্যাসিবাদী মোদী সরকারের নিষ্ঠুর থাবা থেকে আমাদের দেশকে, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামোকে এবং মানুষের অধিকারগুলিকে বাঁচাতে কঠিন সংগ্রাম করে চলেছেন। আমরা আমাদের সংহতি ও সমর্থন জানাচ্ছি পৃথিবীর সমস্ত অংশের ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রগতিশীল অংশকে এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সমস্ত আন্দোলনরত শক্তিকে।

পর পর দুটি বছর কোভিড-১৯ অতিমারীর আবহে আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাদিবস উদযাপন করতে হচ্ছে। সত্যি বলতে কি, সরকারি পরিসংখ্যান, যেখানে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য কম করে দেখানো হয়, সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই দ্বিতীয় ঢেউ ইতিমধ্যেই গত বছরের প্রথম ঢেউয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের থেকেও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বেশিরভাগ জায়গায়, স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থায় শয্যা, ওষুধ ও টিকার অপ্রতুলতার সংবাদ আসছে। সরকার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার জন্য সাধারণ মানুষকে দায়ী করছে, কিন্তু সরকারের নিজের প্রস্তুতির চূড়ান্ত অভাব, আত্মসন্তুষ্টি এবং কোভিড বিধির ব্যাপক উল্লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে নির্বাচিত ছাড় (যেমন কুম্ভমেলা এবং পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের কান্ডজ্ঞানহীন আট-দফা নির্ঘন্টের প্রচারপর্বে রোড শো এবং বিভিন্ন মেগা সমাবেশ) হচ্ছে মুখ্য কারণ যার জন্য কোভিড যুদ্ধে ভারতকে এমন ভয়ানক ও দীর্ঘস্থায়ী মূল্য দিতে হচ্ছে।

অতিমারী মোকাবিলায় ব্যর্থ সরকার কিন্তু এই সংকটকে কর্পোরেটদের শক্তিবৃদ্ধি এবং মানুষের অধিকারগুলি শেষ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাতে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। কৃষি আইনগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে কৃষি, বিশেষ করে কৃষি বিপণন এবং কৃষিপণ্যের বেশিরভাগের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আদানি ও আম্বানিদের হাতে তুলে দেওয়া যায়, চলতি কথায় যাকে কোম্পানি-রাজ বলা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে চালু শ্রম আইনগুলিকে সরিয়ে সেখানে আনা হচ্ছে নতুন শ্রম কোড যা কাজের পরিবেশ এবং কাজের শর্ত ও শ্রমিকদের মজুরির আরও অবনমন ঘটাবে আর মালিকদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে। সরকারের আগ্রাসী বেসরকারীকরণ অভিযান রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র এবং সরকারি সম্পত্তিকে ধারাবাহিকভাবে দুর্বল ও ধ্বংস করে চলেছে আর রেল, বিমানবন্দর, ব্যাঙ্ক এবং ইস্পাত কারখানাসহ গোটা জাতীয় অর্থনীতিকে মুষ্টিমেয় কয়েকটি কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দিচ্ছে। নয়া শিক্ষা নীতি শিক্ষাকে ক্রমশ আরও বেসরকারী, ব্যয়বহুল এবং ডিজিটাল করে তুলবে। এর ফলে বঞ্চিত এবং প্রতিকূল অবস্থায় থাকা ছেলেমেয়েদের শিক্ষার অধিকার বলতে আর কিছু থাকবে না।

ভারতবর্ষের মানুষ অবশ্য তাদের অস্তিত্ব এবং অধিকারের উপর এই লাগাতার আক্রমণকে সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ করে চলেছেন। এক শক্তিশালী সমান নাগরিকত্ব আন্দোলনের পর আমরা সাক্ষী থাকছি এক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের। বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন ক্রমশ বৃহত্তর সামাজিক অ্যাজেন্ডা এবং রাজনৈতিক প্রচারাভিযান হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে। প্রকল্প কর্মী এবং চূড়ান্ত শোষিত ও অসুরক্ষিত মহিলা কর্মী এবং দলিত ও অন্যান্য বঞ্চিত শ্রেণীর অনিয়মিত ও অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগ্রাম গোটা ভারত জুড়ে বেড়ে উঠছে। লক্ষ লক্ষ তরুণ ভারতীয় যারা ইতিমধ্যেই শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য লড়াই করছেন, তারাও কৃষক আন্দোলন এবং বেসরকারীকরণ-বিরোধী প্রচারাভিযানে আগ্রহী হয়ে উঠছেন ও অংশগ্রহণ করছেন। এই পরিবর্তন নির্বাচনেও প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। বিহার নির্বাচনে এই ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনার এক জোরালো ঝলকের উদ্ভাস নজরে এসেছে।

বিহার নির্বাচনে পার্টির অর্জিত সাফল্য এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সাহসী ও দৃঢ় অবস্থান নিয়ে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে, পার্টির স্পষ্ট উচ্চারণ বাম আন্দোলন ও ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধে পার্টি সম্পর্কিত ধারণাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। পার্টির পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য সুযোগ যেমন বেড়েছে তেমনই দায়িত্বও বেড়েছে। তদনুযায়ী আমাদের নিজেদের প্রস্তুত হতে হবে এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। বিভিন্ন অংশের সংগ্রামকে একই কেন্দ্রাভিমুখী করে জনগণের এক ঐক্যবদ্ধ বলিষ্ঠ প্রতিরোধের রূপ দেওয়া জরুরি এবং তা সম্ভবও যা মোদী-শাহ-যোগী রাজ ও সঙ্ঘ বাহিনীর ফ্যাসিস্ট আক্রমণকে পরাস্ত করবে। সাথীরা গত বছর বিহার নির্বাচনে এবং বর্তমানে তামিলনাড়ু, পুদুচেরি, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জেও বিপুল উদ্দীপনায় সাড়া দিয়েছেন। পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের আসন্ন নির্বাচনী দফাগুলির জন্যও আমাদের উপযুক্ত ভাবে তৈরি হতে হবে। কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রথম ঢেউয়ে আমরা বিপন্ন মানুষের পাশে ছিলাম, চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আমাদের আবার সেটাই করতে হবে।

পার্টির বাহান্নতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে, আসুন পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমরা নতুন করে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হই এবং আমাদের সমস্ত শক্তি ও উদ্যমকে সংহত করি!

সিপিআই(এম এল) দীর্ঘজীবী হোক।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

কেন্দ্রীয় কমিটি
সিপিআই(এম এল)-লিবারেশন

22 april Asansol22 April Fansidewa

 

রাজ্যের সমস্ত পার্টি অফিস ও কাজের এলাকায় লেনিনের জন্মদিবস তথা পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপিত হয়। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আসা অহ্বান ও অঙ্গীকারকে আগামি দিনে সৃজনশীল ভাবে কার্যকর করা শপথ নেওয়া হয়। ২ মে রাজ্যের নির্বাচনি ফলাফল যা-ই হোকনা কেন পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শপথ নেন সকলে। পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আসানসোলে হটন রোডে লেনিনের মূর্তিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, বিকেলে আসানসোল কর্পোরেশন চত্বরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রচারসভায় পার্টির আহ্বান ও অঙ্গীকার ঊর্ধেতুলে ধরেন।

মহান মার্কসবাদী শিক্ষক কমরেড লেনিনের ১৫১তম জন্মদিবস ও ৫৩তম পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবসে দার্জিলিং জেলার খড়িবাড়ি লোকাল কমিটির উদ্যোগে শচীন্দ্র চন্দ্র চা বাগানের চাপাটি লাইনে তরাই সংগ্রামী চা শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসের সামনে পতাকা উত্তোলন, কমরেড লেনিনের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও শহীদ স্মরণ করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির অঙ্গীকারপত্র পাঠ ও ব্যাখ্যা করেন রাজ্য সদস্য কমরেড পবিত্র সিংহ। উপস্থিত ছিলেন জেলা সদস্য কান্দ্রা মুর্মু, রাজকুমার এক্কা, পার্টি সদস্য সুকনাথ ওরাঁও, রাফায়েল ওরাঁও, ফুলজেন ওরাঁও প্রমুখ। কর্মসূচীটি পরিচালনা করেন কমরেড সুমন্তি এক্কা।

Editorila Heading

পশ্চিমবাংলার ২০২১-এর নির্বাচনের বাকী অর্দ্ধেক পর্ব শেষ হওয়ার পথে। এমন অনভিপ্রেত আট দফায় প্রলম্বিত, মানবাধিকার বিরোধী, ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক বিদ্বেষ-বিভাজন সর্বস্ব নির্বাচন এর আগে কখনও পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। সত্তর দশকে কংগ্রেসী সন্ত্রাসে ভোট লুঠের কারণে ১৯৭২-এর নির্বাচন পরিণত হয়েছিল প্রহসনে। দীর্ঘ বামফ্রন্ট শাসনে একাধিক নির্বাচন কলুষিত হয়েছিল রিগিং আর সন্ত্রাসের কারণে। তৃণমূল শাসনেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, বিশেষত ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে। কিন্তু এর কোনোটাই বিজেপির তুলনায় ধারে কাছে আসে না। নির্বাচনী গণতন্ত্র নিপীড়িত হওয়ার বাংলার কালপঞ্জীতে বিগত নজিরগুলো আজ আর শীর্ষতম হিসেবে বিচার্য হতে পারে না। কারণ এবারের নির্বাচনে সমস্ত দিক থেকেই বীভৎসতা সংঘটিত হচ্ছে নজীরবিহীন মাত্রায়। আর তা সংগঠিত করছে আরএসএস চালিত বিজেপি।

আট দফায় নির্বাচনের যুক্তি ধোপে টেঁকে না। তৃণমূলী নির্বাচনী সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি হতে না দেওয়ার যুক্তিজাল বিছানোটা একটা অজুহাত। আসল লক্ষ্য হল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জোড়া ফলার চাহিদা মতো সভা-সমাবেশ করতে পারার সময় সুযোগের বন্দোবস্ত করে দিতেই এত দফা আয়োজনের বহর। অলক্ষে কেন্দ্রের শাসকদলের প্রভাব খাটানো হয়েছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ওপর। নির্বাচন কমিশনও বকলমে বিজেপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে আসছে একের পর এক। তার তোফাও মিলছে হাতে গরম! নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাঝপথে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের অবসরগ্রহণের দিনক্ষণ ছিল পাকা, আর তিনি বিদায় নেওয়ার পরপরই পুরস্কার হিসেবে পেয়ে গেলেন গোয়ার রাজ্যপাল পদ। তাঁর জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়ে গেছেন নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। কমিশনের সব সদস্যের সামনে পিছনে গোপনে হয়ত ঝুলছে নানা টোপ। নয় কি? নাহলে করোনা আগ্রাসন ধেয়ে এলেও এবং সেই বিপদ বুঝে বাকি সমস্ত নির্বাচন এক দফাতেই সেরে ফেলার যুক্তি থাকলেও, কে শোনে কার কথা! না শুনছে বিজেপি, না শুনছে নির্বাচন কমিশন। ভোটদানের অবাধ পরিবেশ, ভোটারদের নিরাপত্তা রক্ষার কথা বলে বিপুল সংখ্যায় আনা হল কেন্দ্রীয় বাহিনী। তার অনর্থক বিপুল আর্থিক খরচের দুঃসহ বোঝা চাপানো হল রাজ্যের কাঁধে। কোথায় সুরক্ষিত থাকল নিরাপত্তা! পড়ল ছাপ্পা ভোট, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল বিজেপির হয়ে প্রভাব খাটানোর, ভোটের লাইনে বাহিনী দৌরাত্ম্য দেখিয়েছে; গুলি করে মেরে ফেলেছে চারজন নিরীহ নাগরিককে। ঘটনাচক্রে তাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সন্দেহ দানা বাঁধছে, গুলিকান্ডের পিছনে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির ইন্ধন ছিল। বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে গণতন্ত্রের কত বিপদ তার প্রমাণ মেলে গুজরাটে, উত্তরপ্রদেশে, ত্রিপুরায় ও অন্যত্র। ইউএপিএ থেকে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ; সিট থেকে নিয়া-র নিপীড়নমূলক হাতিয়ার প্রয়োগেও বোঝা যায় বিজেপি কেমন প্রশ্নাতীত সমালোচনারহিত শেকল পরানো 'গণতন্ত্রে'র প্রবর্তক। পাশাপাশি নির্বাচন সম্পন্ন করার পেছনে সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ চলেছে। তার ওপর কোটি কোটি টাকা ওড়ানো হচ্ছে দলীয় নির্বাচনী খরচে। কোটি টাকার এক-একটি রোড-শো, সভা করছে বিজেপি। এপর্যন্ত হিসাব হল, নির্বাচনী প্রচারে বিমান-হেলিকপ্টার বাবদ খরচ হয়েছে একশ কোটি টাকার ওপর। এর নব্বই শতাংশই খরচ করেছে বিজেপি। এখনও নির্বাচনী প্রচার শেষ হতে দু-দফা বাকি। সুতরাং আরও কোটি কোটি টাকা উড়বে। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে কালো টাকা আনার কথা দিয়েও ফাঁকি দিয়ে চলেন। অন্যদিকে তাঁদের দলের নির্বাচনী খরচের জন্য এত অগুনতি অর্থের যোগান আসে কোথা থেকে? ‘পি এম কেয়ারস্ ফান্ড’ থেকে? যেটিকে ক্ষমতার জোর খাটিয়ে হিসাব দেওয়ার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে! নাকি পেয়ারের শিল্পপতিদের কাছ থেকে ইলেক্টোরাল বন্ডের বিনিময়ে স্রোতের মতো আসছে অর্থরাশি! এতসব দেখেও নির্বাচন কমিশন অদ্ভুত নির্বিকার! অথচ অর্থের অভাব দেখিয়ে জনখাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় আবশ্যিক ন্যূনতম কতকিছু মেটানো হয় না। বাংলায় ভোট চাইতে নেমে কেন্দ্রে ও কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপির হিম্মৎ নেই গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সম্প্রীতির লক্ষ্যে কি করেছে সেইসব জবাব দেওয়ার। দেশজুড়ে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিস্থিতির এত শোচনীয় হাল কেন? কেন কৃষক তার উৎপন্ন ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, ঋণফাঁস থেকে তার মুক্তি মিলছে না? কেন শ্রমিকের অস্তিত্ব মূলত নির্ভর হয়ে যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়ে যাওয়ার মধ্যে? কেন শিক্ষা এত ব্যয়বহুল ও সংকোচনের শিকার হচ্ছে? কেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা তথৈবচ? কেন করোনার ছোবল থেকে বাঁচার দায় কেবল রাজ্যগুলোর তথা জনতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কেন করোনা পরীক্ষা নিয়ে বেসরকারি চড়া মূল্যের ব্যবসা চলতে দেওয়া হচ্ছে? কেন্দ্রীয় সরকার ভ্যাকসিনের দাম নির্ধারণে বিস্তর বৈষম্যের পলিসি চাপিয়ে দেয় কি করে? মুনাফাখোর উৎপাদক-ব্যবসায়ীদের তোষণ করতেই নয় কি! জনজীবনের এইসব আরও কত কি বিষয় রয়েছে। যার প্রত্যুত্তর এড়িয়ে বিজেপি নির্বাচনকে ভাসাতে মরীয়া বিদ্বেষ-বিভাজন-সাম্প্রদায়িক-জাতিবাদী রাজনীতির জিগিরে।

বিজেপিকে তাই আর ধোঁকাবাজি চালাতে দেওয়া যায় না, ঠাঁই দেওয়া নয়, ভোট দেওয়া নয়; ভোটদানে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলার মাটি দূর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক গৈরিক দুর্বৃত্ত!

The peasant movement 140 days

দিল্লীর কৃষক আন্দোলন বাংলা নববর্ষের দিন ১৪০ তম দিন অতিক্রম করল।

সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পক্ষ থেকে এক প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, কিছু শস্যহানি হওয়া সত্ত্বেও কৃষক আন্দোলন শক্তিশালীভাবে চলছে। বিজেপি ও তার সহযোগী নেতাদের সামাজিক বয়কট জারি আছে।

করোনা লকডাউনের সময় ভারত সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে তিনটি কৃষি আইন পাশ করে। তারা ভেবেছিল কৃষকরা ঐ সময়ে তা বিরোধিতা করতে পারবেন না। কিন্তু কৃষকেরা তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন জেনে ঐ অতিমারীর সময়েও সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেন। অতিমারী চলতেই থাকে। এখন রবি শস্য কাটার সময় এবং তা বিক্রিও করতে হবে। এই ব্যস্ততার সময়েও তাঁরা দিল্লির সীমানায় তাঁদের মরশুমী আয়কে বাজি রেখে প্রতিবাদ চালু রেখেছেন। কৃষক এবং কৃষি মজুরদের পরস্পরের প্রতি গভীর নির্ভরতা ও সামাজিক বন্ধনের দৌলতে ফসল তোলার সময় কৃষকদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও শস্য হানি কমই হয়েছে। তাই উচ্চকণ্ঠে বলা যায় কৃষকদের উৎপাদিত শস্য থেকে তাদের দূরে রেখেছে এই সরকারই।

বিজেপি এবং জেজেপি নেতাদের সামাজিক বয়কটের ঘোষণা করেছেন কৃষকেরা, কারণ ঐ নেতারা তাঁদের ক্রমাগত হয়রান ও বদনাম করেছেন। কৃষকদের চরম হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বিজেপি-জেজেপি নেতারা নানা কর্মসূচী নিয়েছেন একটাই উদ্দেশ্যে, তা হল হিংসায় প্ররোচনা দেওয়া ও আন্দোলনকে দূর্বল করার জন্য। কৃষকরা হরিয়ানার কৃষক-বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যেকটি সভা ও সূচীর বিরোধিতা করছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বারাউলির সভা বাতিল করেছেন। কৈথালে উপ-মুখ্যমন্ত্রীর সভার বিরোধিতার জন্য লাঠিচার্জ করা হয়। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা কৃষকদের ওপর পুলিশী প্রতিক্রিয়ার নিন্দা করেন। হরিয়ানায় বিজেপি-জেজেপি সরকার অনাস্থা প্রস্তাবে বেঁচে গেলেও জনগণ এবং সাধারণ নাগরিকের আস্থা সম্পূর্ণভাবে হারিয়েছেন।

সিংঘু বর্ডারে ইতিমধ্যে কিছু সমাজ-বিরোধী কৃষকদের কয়েকটি তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাঁবুতে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং তাঁবুর বাইরে একটি গাড়ি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্রুতই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং কোনো ব্যক্তিই আহত হননি। এই ঘটনায় কুন্দালি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা এই ঘটনাগুলি, কিন্তু কৃষকরা এই আচরণে মোটেই ভীত নন।

জাতীয় কৃষক সম্মেলনের ডাক সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার

বাংলার সমস্ত কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের সংগ্রামী সাথীরা,

আপনারা জানেন যে লক্ষ লক্ষ কৃষক-খেতমজুর নভেম্বর মাস থেকে দিল্লির সীমান্তে কৃষকবিরোধী/কর্পোরেট স্বার্থরক্ষাকারী কেন্দ্রীয় কৃষি আইনগুলির বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বে তারা সব কৃষকের জন্য লাভজনক এমএসপির আইনি নিশ্চয়তা চাইছে।

তীব্র শীত, বৃষ্টি এবং গরমে ১৪৩ দিনের বিক্ষোভ সত্ত্বেও নিষ্ঠুর কেন্দ্র সরকার ন্যায্য দাবি পূরণ করেনি, তাই এখন পর্যন্ত ৩৮৫ জনেরও বেশি কৃষক শহীদ হয়েছেন। কেন্দ্রের শাসকদলের রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন উপায়ে আন্দোলনকে আক্রমণ করা এবং বিভিন্ন ভাবে কৃষকদের অসম্মানিত করা ছাড়াও রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনে মত্ত হয়ে উঠেছে।

এখনই সময় এসেছে, সবাই হাতে হাত মিলিয়ে এই বোধহীন সরকারকে আমাদের বিশাল ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রদর্শন করার এবং নাগরিকরা এইভাবে উপেক্ষিত হতে পারেনা -- সেই বার্তা সরকারের কানে পৌঁছে দেওয়ার।

১০ মে ২০২১ হরিয়ানার শোনেপত জেলার সিংঘু সীমান্তে সংযুক্তে কিষাণ মোর্চা জাতীয় কৃষক সম্মেলন আয়োজিত করেছে। ১০ মে এক ঐতিহাসিক  দিন -- ১৮৫৭ সালে ওই দিনেই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহ, শুরু হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে কৃষক-খেতমজুররা বীর যোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছিল।

বাংলার সব জেলার কৃষক ও খেতমজুর প্রতিনিধিদের ১০ মে ২০২১ সকাল ১০.০০ থেকে সন্ধ্যা ৬.০০ অবধি এই জাতীয় সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানাচ্ছি।

অনুরোধ করছি যাতায়াতের ব্যবস্থা নিজেদের করতে তবে সিংঘু সীমান্তে আপনাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা করবে।

আপনাদের আন্দোলনের সাথী
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা

Report of the party's investigation team

গত ১০-০৪-২০২১ শনিবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সাধারণ নির্বাচনে (৪র্থ দফা) কোচবিহার জেলার ৫-শীতলকুচি (তপশীলি জাতি) বিধানসভা ক্ষেত্রের বুথ নং- ৫/১২৬-এ মোট চারজন সাধারণ ভোটারের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর পক্ষ থেকে ৬ জনের একটি প্রতিনিধিদল ১৮-০৪-২০২১ রবিবার উপরোক্ত বুথ এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলিতে গিয়ে আহত ও নিহত সহনাগরিকদের বাড়ি যাওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষজনের সাথেও সাক্ষাত করে।

প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাবুন দে, মুকুল বর্মন, দর্পহরি রায়, প্রজাপতি দাস (এঁরা প্রত‍্যেকেই পার্টির কোচবিহার জেলা কমিটির সদস‍্য), কমরেড সুনীতা বর্মন এবং পার্টি রাজ‍্য কমিটির তরফে কোচবিহার জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ‍্য কমিটি সদস্য কমরেড চঞ্চল দাস।

ঘটনাস্থল :
আমতলী মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (আমতলি এমএসকে এলাকার বাসিন্দাদের কাছে “মাদ্রাসা” নামেই বেশি পরিচিত), গ্ৰাম+পোঃ- জোড়পাটকী, মাথাভাঙ্গা ১নং ব্লক। জেলা-কোচবিহার‌। বিধানসভা ক্ষেত্র — ৫-শীতলকুচি (তপশীলি জাতি), বুথ নং-৫/১২৬

শীতলকুচি বাজার থেকে রওয়ানা হয়ে মাথাভাঙ্গা যাওয়ার রাস্তায় প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কাউয়ার ডেরা (অধুনা গোলকগঞ্জ) স্টপেজ থেকে ডানদিকে প্রায় ৪ (চার) কিলোমিটার গণহত্যার অকুস্থল “আমতলী মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (বুথ নং- ৫/১২৬)”। রাস্তার ডানদিকে অবস্থিত মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের শুধুমাত্র রাস্তা বরাবর ডানদিক লাগোয়া অংশটুকুই পাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের উল্টো দিকে অর্থাৎ রাস্তার বামদিকে একদল পুলিশকে (চারচাকা গাড়িসহ) বসে থাকতে দেখা গেল। ঘটনার পর থেকে ঐ এলাকায় নিয়মিত পুলিশি টহল দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বলে রাখা দরকার যে, রাস্তাটাকে সীমানা ধরে ডানদিকের এলাকা অংশ নং-৫/১২৬ এবং ডানদিক বরাবর কিছুদূর এগিয়ে গেলেই অংশ নং-৫/১২৫-র এলাকা শুরু।

অংশ নং-৫/১২৬-এলাকার ভোটগ্ৰহণ কেন্দ্র এই এমএসকে-টি এলাকার প্রায় শেষ সীমানায় অবস্হিত।

এমএসকে-র উল্টোদিকে অর্থাৎ রাস্তার বামদিকে রয়েছে অংশ নং-৫/১১৮ এবং অংশ নং- ৫/১১৯-র এলাকা। ফলে স্বভাবতই ঐ MSK-সংলগ্ন এলাকায় (ছোট্ট গঞ্জ মতো, কয়েকটি দোকানও রয়েছে) সবসময় পার্শ্ববর্তী সব এলাকার মানুষজনের ওঠাবসা, আড্ডা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এলাকায় প্রধানত সংখ‍্যালঘু মানুষের বসবাস। প্রায় প্রতিটি পরিবারের কোনো না কোনো সদস‍্য পরিযায়ী শ্রমিক। হিন্দু-মুসলমান প্রত‍্যেকেই পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে একসাথে বসবাস করে আসছেন।

গোলকগঞ্জ থেকে আমাদের পথপ্রদর্শক রতন দাসের বাড়ি ও দোকান এমএসকে-র উল্টোদিকে (রাস্তার বামদিকে) অবস্থিত। প্রতিনিধিদলের আমরা সবাই প্রথমে রতন দাসের বাড়িতে গিয়ে বসি এবং কথাবার্তা বলতে থাকি। ইতিমধ্যে সেখানে স্থানীয় ব‍্যবসায়ী আলিজার রহমান আসেন এবং আমাদের পরিচয়, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চান। আলোচনা চলাকালীন তিনি পরিস্কারভাবে জানান যে বাইরে থেকে আসা বিজেপির কোনো লোককে তারা এলাকায় ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন এই কারণে যে, ইতিপূর্বে বিজেপির লোকজন এসে উদ্দেশ‍্যপ্রণোদিতভাবে এলাকায় অশান্তি লাগানোর চেষ্টায় ভিডিও তৈরি করে নিয়ে গিয়ে বাইরে গুজব ছড়াচ্ছে। তিনি জোরের সাথে এও দাবি করেন যে এযাবতকাল এই এলাকায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কোনো হিংসার ঘটনা তো ঘটেইনি এমনকি সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও সেরকম কোনো অপচেষ্টা এলাকার সকল বাসিন্দা মিলে যে কোনো মূল্যে রুখবেন।

সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সবাই একে একে ঐ দিনের (১০-০৪-২০২১) ঘটনায় নিহত এবং আহতদের পরিবারের সাথে দেখা করতে তাদের বাড়িতে যাই এবং প্রত‍্যক্ষদর্শীদের সাথেও কথা বলি।

এলাকার মানুষজনের সাথে কথা বলে ঘটনাক্রম যা জানা গেল তা নিম্নরূপ:

ঘটনার সূত্রপাত ১০ এপ্রিল ২০২১ শনিবার সকাল আনুমানিক ৯টা নাগাদ। বুথ নং-৫/১২৬-র ভোটারদের জন্য টিএমসি-র পক্ষ থেকে যে ক‍্যাম্প করা হয়েছিল (পার্শ্ববর্তী কাজীর মোড় এলাকায়) সেই ক‍্যাম্পে ইসিআই-নির্ধারিত লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি লোক জমায়েত হয়েছে এই অজুহাতে স্থানীয় বিজেপি দলের অভিযোগের ভিত্তিতে বিজেপির কর্মী সমর্থকদের উপস্থিতিতে পুলিশ সেক্টর থেকে আসা জংলী পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা মৃদু লাঠিচার্জ করে ও ক‍্যাম্পে ভাঙচুর করে। সেখান থেকে ফেরার পথে রাস্তায় অষ্টম শ্রেণীর পড়ুয়া জাহিদুল হক (১৪ বৎসর, পিতা-মজিদ মিঞা)-কে অযাচিতভাবে বেধড়ক মারধর করে (ছেলেটিকে মেরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় এবং তার মুখ দিয়ে গ‍্যাঁজলা বেরোতে থাকে)। বিনা প্ররোচনায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের দ্বারা এই ছেলেটিকে নিগ্রহের প্রতিবাদ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন স্থানীয় যুবক। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন ভদ্রমহিলাও যুবকদের সাথে সামিল হয়ে নির্দোষ নাবালক জাহিদুলকে নিগ্ৰহের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। মোবাইলে এই সমস্ত ঘটনার ভিডিওগ্ৰাফি করতে গেলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা মোবাইল কেড়ে নেওয়ারও চেষ্টা করে।

বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে অ্যাম্বুলেস ডেকে এনে আহত ছাত্রটিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর তরফে প্রকৃত অভিভাবকদের ছাড়াই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়‌। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিলে জওয়ানরা লাঠি উঁচিয়ে জনসাধারণের দিকে তেড়ে যায় এবং উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করে।

এই ঘটনাস্থল ভোটগ্ৰহণ কেন্দ্র (৫/১২৬, MSK) থেকে আনুমানিক ৩০০/৩৫০ মিটার দূরে।

সেই সময় ভোটগ্ৰহণ কেন্দ্রে (৫/১২৬) ভোট নির্বিঘ্নেই চলছিল বলে জানা গিয়েছে। অর্থাৎ বাইরের ঘটনার কোনোরকম প্রভাব ভোটগ্ৰহণ কেন্দ্রে উপস্থিত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের মধ্যে ছিল না।

ইতিমধ্যে আনুমানিক বেলা ৯:৪৫ নাগাদ হঠাৎ করে চারচাকা গাড়িতে চড়ে আসা কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি)-র জংলী পোশাক পরিহিত কয়েকজন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান এসে গাড়ি থেকে নেমে এমএসকে-র মূল গেট দিয়ে না ঢুকে পাঁচিলের শেষাংশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে হেঁটে MSK-র মাঠে ঢোকে এবং বিনা প্ররোচনায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের দিকে লক্ষ‍্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।

একটি গুলি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় সফরুদ্দিন-এর কাঁধ ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। গুলিতে আহত সফিরুদ্দিন সেই অবস্থাতেই এমএসকে-র পাকা দেওয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকাতেই প্রাণে বেঁচে যায় বলে জানা গিয়েছে। এরপরই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।

এই অবস্থায় পলায়নরত ভোটারদের লক্ষ্য করে আরও গুলি ছোঁড়া হয় এবং গুলিবিদ্ধ দুজন (মনিরুল ইসলাম ও হামিদুল মিঞা, দুজনেরই বয়স-২৮ বৎসর) মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী এলাকার (অংশ নং-৫/১২৫) বাসিন্দা নুর আলম (১৯ বৎসর, এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটার) নিজের ভোট তার নির্দিষ্ট বুথে (৫/১২৫) দিয়ে এসে উপরোক্ত এমএসকে (বুথ নং-৫/১২৬)-র পার্শ্বস্থ জমিতে (জ্যেঠতুতো দাদা ও তার নিজের যৌথভাবে লিজ নেওয়া) কাজ করার জন্য জ‍্যেঠতুতো দাদার বাইক নিয়ে জমির সামনে এসে পৌঁছোলে তাকে জংলী পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের মধ্যে একজন আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দিতে থাকে। ভয়ে নুর আলম বাইক ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে তাকেও গুলি করা হয় এবং গুলিবিদ্ধ নুর আলম সেখানেই লুটিয়ে পড়ে।

এছাড়াও জংলী পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের ছোঁড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় কলেজ পড়ুয়া সামিউল হক (১৯ বৎসর, এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটার)। সে তার দিদি (আঞ্জুমা খাতুন, স্নাতক) ও একমাত্র ভাই (সাহিদুল হক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটার) সহ ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিল। তার ছোটোভাই সাহিদুল ভোট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাঠের মধ্যে কিউআরটি-র জংলী পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের মধ্যে একজন তাদের হাতে থাকা ফাইবার গ্লাসের লাঠি দিয়ে সাহিদুলের মাথায় আঘাত করে এবং সে তৎক্ষণাৎ মাঠেই লুটিয়ে পরে। সেই অবস্থাতেই তাকে লাঠি দিয়ে আরো মারা হয়। সেটা দেখে বড়ভাই সামিউল ছুটে আসে এবং সংশ্লিষ্ট জওয়ানের পা জড়িয়ে ধরে ছোটোভাই সাহিদুলকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাতর অনুরোধ করতে থাকে। এরকম অবস্থায় ঐ জওয়ান সামিউল হক-এর বুক-গলা বুটসহ পা দিয়ে চেপে ধরে এবং গুলি করে মেরে ফেলে।

সুপরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ণ ঘটনাটি ঘটানোর (আনুমানিক ৪০-৪৫ সেকেন্ড) পরপরই উক্ত গুলিচালনার ঘটনায় অভিযুক্ত ক্যুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি)’র পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা যে চারচাকা গাড়িতে চড়ে এসেছিল সেই গাড়িতে চড়েই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। উল্লেখ্য যে ওই জওয়ানেরা মাঠে ঢুকে গুলি চালিয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত ওই চারচাকা গাড়ির ইঞ্জিন চালু অবস্থায় ছিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় ঐ বুথে (৫/১২৬) ভোটগ্ৰহণ স্হগিত হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ দুজনকে স্থানীয় লোকেরাই নিজেদের ব‍্যবস্থাপনায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধা এবং অহেতুক হেনস্থার শিকার হতে হয়। বাকি দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যান বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে সবাইকেই মৃত বলে ঘোষণা করা হয়‌।

এদিকে এই ডামাডোলের মধ্যেই পুলিশ সেক্টরের অধীন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান এবং পোলিং বুথে কর্তব্যরত চারজন জওয়ানও ভোটকর্মীদের ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এরপর জনরোষ উক্ত বুথে কর্তব‍্যরত ভোটকর্মীদের উপর গিয়ে পড়ে এবং তার ফলে ভোটকর্মীরাও আহত হয়েছেন। পাশাপাশি এটাও ঘটনা যে স্থানীয় কিছু মানুষ উত্তেজিত জনতার হাত থেকে ভোটকর্মীদের রক্ষা করেছেন। প্রায় দেড়ঘন্টা বাদে প্রশাসনিক লোকজন এসে ভোটকর্মীদের সেই বুথ থেকে নিয়ে চলে যায়।

নিহত চারজন সহনাগরিকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়সহ অন‍্যান‍্য তথ্য :

১) মনিরুল ইসলাম (২৮)‌। পিতা - আমজাদ হোসেন। তিন ভাই, এক বোন, বাবা-মা, স্ত্রী এবং একমাত্র শিশুকন্যা (বয়স-৪৫দিন) নিয়ে পরিবার। গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান মনিরুল পেশায় রাজমিস্ত্রি, বর্তমানে গ‍্যাংটক (সিকিম)-এ কর্মরত। ভোটের দুইদিন আগে বাড়িতে এসেছেন। কন্যাসন্তান জন্মগ্ৰহণের খবর কর্মক্ষেত্রে বসেই পেয়েছিলেন কিন্তু সেসময় বাড়িতে আসার সুযোগ হয়নি। এবারে ভোট দেওয়ার জন্য বাড়িতে আসার পাশাপাশি নিজের মেয়ের সাথেও সর্বপ্রথম সাক্ষাত হয়।

২) হামিদুল মিঞা (২৮)। পিতা - দিল মহম্মদ মিঞা। দিল মহম্মদ মিঞা'র বড়ছেলে স্ত্রী ও কন‍্যাসন্তান রেখে একবছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। মেজ ছেলে বিবাহিত, ছোটোছেলে হামিদুল মিঞা (বিবাহিত) পেশায় রাজমিস্ত্রি।

গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান হামিদুল-এর বাড়িতে চার বৎসর বয়সী এক কন‍্যাসন্তান এবং নয়মাসের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এবং বাবা-মা রয়েছে।

৩) সামিউল হক (১৯)। পিতা - আফসার আলি মিঞা। আর্থিক অনটনের কারণে নিজে নিয়মিত কলেযে ভর্তি না হয়ে দূরশিক্ষার মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এর পাশাপাশি একটি ব‍্যাঙ্কের অধীনে ব‍্যাঙ্কের কিয়স্ক-এর বিভিন্ন কাজকর্মসহ অন্যান্য টুকিটাকি কাজকর্ম করে পরিবারকে স্বচ্ছল করার চেষ্টায় ব্রতী সামিউলের বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও স্নাতকোত্তীর্ণ দিদি (আঞ্জুমা খাতুন) ও উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষার্থী ভাই (সাহিদুল হক) রয়েছে। সামিউল নিজে এবং ভাই সাহিদুল দুজনেই এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটার।

উপরোক্ত মৃত তিনজন সহনাগরিকই বুথ নং-৫/১২৬-এর ভোটার।

৪) নুর আলম মিঞা (১৯)। পিতা - জোবেদ আলি মিঞা। চার বোন এবং একমাত্র ভাই নুর আলম মিঞা। বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও স্বামীপরিত‍্যাক্তা এক দিদি এবং তিনজন ছোটোবোন রয়েছে যার মধ‍্যে এক বোন বিবাহিতা। বাবা শারীরিকভাবে সুস্থ নন। পরিবারের অন‍্যতম প্রধান উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলো নুর আলম।

অংশ নং-৫/১২৫-এর বাসিন্দা নুর আলমের পরিবারের ছোটোবড়ো সকলেই বছরের অর্ধেক সময় পার্শ্ববর্তী রাজ‍্য বিহারে ইঁটভাটায় শ্রমিক(পরিযায়ী) হিসেবে কাজ করে। ঐ সময় বাড়ি তালাবন্ধ অবস্থায় থাকে। ঘটনার দিন বাড়িতে ছিলেন কেবলমাত্র নুর আলম (এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটার) এবং তার বাবা (ভোটদানের জন্য কয়েকদিন আগেই বিহার থেকে বাড়িতে এসেছেন)। নুর আলমের মৃত‍্যুসংবাদ (মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর) বর্তমানে কেরল রাজ‍্যে কর্মরত এক পরিচিত লোকের ফোন মারফত বাড়িতে থাকা অসুস্থ বাবার কাছে অনেক দেরী করে পৌঁছায়। (তার বাবাসহ অন‍্যান‍্য আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীরা জানতেন যে নুর আলম জমিতে চাষাবাদের কাজে ব‍্যস্ত রয়েছে)। নুর আলমের মৃত‍্যুসংবাদ পেয়ে বিহার রাজ‍্যে ইঁটভাটায় শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত মা, দিদি ও বোনেরা বাড়ি ফিরে আসেন। এটি একটি ভূমিহীন পরিবার। ধরলা নদীর চর এলাকায় বিগত ৩০-৪০ বছর ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও এখনও জমির পাট্টা হয়নি।

উপরোক্ত গুলিকান্ডে নিহত সহনাগরিকদের পরিবার এখনও কোনো সরকারী সাহায্য পায়নি। নিহতদের মধ্যে কারো কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সখ্যতা আছে বলে জানা যায়নি।

পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও এলাকার গরিব মেহনতি মানুষসহ প্রত‍্যেকেই উপরোক্ত গুলিকান্ডের সঠিক তদন্তসাপেক্ষে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করেছেন।

অনুসন্ধানকারী দলের পক্ষে
বাবুন দে, জেলা কমিটি সদস্য,

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, কোচবিহার জেলা কমিটি

Meeting in support of Kapil Krishna Tagore

বিজেপিকে ভোটে হারাও বাংলা বাঁচাও লক্ষ্যকে সামনে রেখে গাইঘাটা বিধান সভা কেন্দ্রের সিপিআই প্রার্থী কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরের সমর্থনে ১৯ এপ্রিল ঠাকুর নগর খেলার মাঠে এক নির্বাচনী সভা অনুষ্টিত হল। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের গাইঘাটা লোকাল কমিটির আহবানে সংগঠিত এই সভায় প্রার্থী কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, ছাত্র সংগঠন আইসা-র নেত্রী অন্নেষা রায় বক্তব্য রাখেন। মুখ্য বক্তা ছিলেন লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপংকর ভট্টাচার্য। শুরুতে কাগজ না দেখানোর গান করেন বাবুনী মজুমদার এবং মেঘনা মজুমদার।

দীপঙ্কর তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন বাচীক শিল্পী শোভনার আবৃত্তি করা আমীর আজিজের কবিতা ‘সব মনে রাখা হবে’ লাইনটি উদ্ধৃত করে। তিনি বলেন, সত্যিই এবারের বিধানসভা নির্বাচন মনে রাখতে হবে। পশ্চিমবাংলা কেন, সারা দেশের কোথাও আগে এভাবে নির্বাচন হয়নি। দেশ জুড়ে এমনকি আমাদের রাজ্যেও যখন করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়ছে তখন রাজ্যে এক মাসের বেশি সময় ধরে আট দফায় নির্বাচন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, গৃহমন্ত্রী সকালবেলা ভোট প্রচার করছেন, বিকালবেলা দিল্লিতে গিয়ে করোনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের নিয়মে সন্ধ্যা সাতটার পর প্রচার বন্ধ, যাতে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ না পায়। শীতলকুচীতে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো চার জনকে গুলি করে হত্যা করল কেন্দ্রীয় বাহিনী, আর তিন দিন সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর এবং সমশেরগঞ্জ দুটি কেন্দ্রের প্রার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সেখানে নুতন ভোটের দিন হল ১৩ মে ঈদের দিন। অথচ সেখানে জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মুসলমান। বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে, হত্যার রাজনীতি করছে। এই নির্বাচন বাংলার মানুষের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে দীপঙ্কর বলেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’। দেশকে কিছুতেই ‘জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ’ বানাতে দেওয়া যাবে না। বিজেপি দেশের মানুষের পয়লা নম্বর শত্রু। পশ্চিমবাংলায় পার্টির নির্বাচনী পলিসি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দীপঙ্কর বলেন, নির্বাচনও একটা আন্দোলন। সীমিত সংখ্যক এবং নিয়মিত আন্দোলনের জায়গাতেই সিপিআই(এমএল) প্রার্থী দিয়েছে। মিড ডে মিলের কর্মীদের কাজ এবং মজুরি নিয়মিত করা, চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি, তাদের হাসপাতালের ব্যবস্থা রাজ্যের জ্বলন্ত দাবি। লক ডাউনের কারণে ভারতের কর্পোরেট ও ধনি ব্যাবসায়ীরা লক্ষ কোটি টাকার কর ছাড় পেয়ে গেল অথচ পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহিতাদের উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে ঋণ পরিশোধের জন্য। আমাদের পার্টি ঋণ মুক্তি আন্দোলনের সুচনা করেছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব এবারে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করছে। বেকার যুবকদের কাজের দাবি, নয়া শিক্ষা নীতিতে শিক্ষার সুযোগ কমে যাওয়ার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, কৃষক সংগ্রামের অঞ্চল এবং শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলি থেকেই আমাদের মোট ১২টি আসনে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। রাজ্যে ২০১৬-র নির্বাচনে জয়ী বাম বিধায়কদের মধ্যে যাঁরা এখনও লাল ঝান্ডার সাথে আছেন, সিপিআই(এমএল) সেই সব আসনেই সমর্থন করছে। পশ্চিমবাংলার বাম ঐতিহ্যকে মনে রেখেই ফ্যাসিবাদকে পরাস্থ করতে হবে। কত বছর আগে সুকান্ত বলেছিলেন, ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন’। কমরেড কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর স্বচ্ছ ভাবমুর্তির মানুষ। গাইঘাটা বিধানসভা ক্ষেত্রের মানুষদের কাছে এক চমৎকার সু্যোগ আছে একজন বামপন্থী মানুষকে বেছে নেওয়ার। কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের নেতা হিসাবে বলা হয়। তিনি আসলে সম নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলনের অগ্রনায়ক। দীপঙ্কর বলেন, নাগরিকত্বের বিষয়েও নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশের মানুষকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে, বাংলার মানুষদেরও বিপদে ফেলতে চাইছে। যদি জন্মসুত্রে নাগরিকত্ব অথবা আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া বাতিল করা হয় তাহলে প্রমাণ করতে হবে যে ২০১৪-র ৩১ জুলাই পর্যন্ত যাঁরাই এই দেশে এসেছেন তারা উদ্বাস্তু, ধর্মীয় কারণে উৎপীড়নের শিকার। যার মানে হল, নাগরিকত্ব দেওয়া নয় বে-নাগরিক করে দেওয়া। আসামে বিজেপি সরকার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষকে বে-নাগরিক করে দিয়েছে। যাদের মধ্যে ১৫ লক্ষ হিন্দু বাঙালী। তাদের ‘ডি ভোটার’ (সন্দেহজনক ভোটার) বানিয়ে দিয়ে জবরদস্তি ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছে। শুধু হিন্দু মুসলিম বিভাজন নয় পরিবারের মধ্যেও ভাগ হয়ে গিয়েছে। দীপংকর আহবান জানান বিজেপিকে হারাতে হবে বাংলায় ডিটেনশন ক্যাম্প রুখে দিতে হবে।

শিক্ষা এবং সংস্কৃতির আন্দোলনের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ির উল্লেখ করে দীপংকর বলেন, যে সময় বাংলায় নিম্ন বর্ণের দরিদ্র মানুষের শিক্ষার কথা বলছেন তখন মহারাষ্ট্রে জ্যোতিবা ফুলে, সাবিত্রীবাই ফুলে শিক্ষার কথা বলছেন।আম্বেদকার বলছেন, শিক্ষিত হও। নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষাকেই বিকৃত করলেন। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের কথা হল সবল আর দুর্বলের মিলন হতে পারেনা। যেমন শোষক আর শোষিতের মিল হবে না। তা যদি করা হয় তবে সবল আরও সবল হবে, দুর্বল আরও বেশি দুর্বল হবে। সারা দেশ পশ্চিমবাংলার দিকে তাকিয়ে আছে। দিল্লীর বুকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কৃষক নেতারা আমাদের রাজ্যে এসে বলে গেলেন বিজেপিকে হারাও। সারা দেশে ব্যাঙ্ক, বীমা রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির শ্রমিক, বিএসএনএল সহ সমস্ত সরকারি সংস্থার কর্মচারিরা দুদিন ব্যাপি ধর্মঘট করে মোদী সরকারের দেশ বেচার নীতির বিরোধিতা করেছেন।

পশ্চিমবাংলায় তৃণমুলের সরকার গণতন্ত্রের প্রসার করতে দেয়নি। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনেকেই ভোট দিতে পারেনি। এর বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চলবে। এই সময়ে দেশের মানুষের পয়লা নম্বর শত্রু বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে। কমরেড কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর আমাদেরও প্রার্থী। “ভোট দিবেন কিসে কাস্তে ধানের শীসে”। কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরকে জয়ী করার আবেদন রেখে দীপংকর ভট্টাচার্য বক্তব্য শেষ করেন।

সভায় সারা সময় ধরেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সিপিএম-এর প্রাক্তন সাংসদ অসীম বালা এবং সিপিআই নেতা বিরাট মন্ডল।

Campaign in support of Krishnapada Pramanik

নদীয়ার বুকে শ্রী চৈতন্যর উদার সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, বিজেপির ঘৃণার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাংলার মাটি আমাদের অনুপ্রেরণা - দীপঙ্কর ভট্টাচার্য্য

বিজেপির নেতারা বুদ্ধিজীবীদের “রগড়ে” দেওয়ার কথা বলছে কেন? কারন পঃ বাংলার বুকে আজও প্রতিবাদের কথা হয়, শিক্ষা সংস্কৃতি, গণতন্ত্রের কথা হয়। এই নদীয়ার বুকে শ্রী চৈতন্য থেকে লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, সুকান্ত থেকে জীবনানন্দ বাংলার এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এখানে ধর্মের কথা যখন ওঠে তখন ঘৃণার কথা নয়, প্রেমের কথা হয়। “মেরেছিস কলসির কানা তা বলে কি প্রেম দেবো না!” “যত মত তত পথ” - এই উদার ঐতিহ্য এখানে রয়েছে। এখানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ হয়েছে। সেখানে জীবন উৎসর্গ করেছেন একজন অবাঙ্গালী বীর স্বাধীনতাকামী মঙ্গল পান্ডে। এই বাংলার মাটি আমাদের রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দেয়। বিজেপি বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতি চাপিয়ে দিয়ে বাংলাকে দখল করতে চাইছে। ওদের অশ্বমেধের ঘোড়াকে রুখে দিন। সবচেয়ে গরীব মেহনতি বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রার্থীকে ভোট দিন। গত ১৮ এপ্রিল নদীয়া জেলার নাকাশিপাড়া বিধানসভার কেন্দ্রস্থল বেথুয়াডহরীতে আয়োজিত এক জনসভায় এই কথা বললেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। এছাড়া কৃষি সংকট, কৃষক আন্দোলন, এনআরসির নামে মানুষের সমস্ত অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি প্রাঞ্জল বক্তব্য রাখেন। এই কেন্দ্রে পার্টির প্রার্থী কৃষ্ণপদ প্রামানিকের সমর্থনে জনসভায় ভালোই জনসমাগম হয়েছিলো। উপস্থিত ছিলেন পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণনগর (দক্ষিণ) কেন্দ্রে পার্টির প্রার্থী সন্তু ভট্টাচার্য।

শুরুতে আইসার কর্মীদের উত্তাল স্লোগান সভাকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। স্বাগত ভাষণ দেন পার্টির রাজ্য ও নদীয়া জেলা কমিটি সদস্য কাজল দত্তগুপ্ত। সভার সঞ্চালক নদীয়া জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ বলেন, নাকাশীপাড়ায় বিজেপি বেশ কয়েকটি জায়গায় দাঙ্গা বাধাঁনোর চক্রান্ত করেছে। ওদের লক্ষ ধর্মীয় মেরুকরণ করা। কিন্তু নীচু তলায় কৃষক ও গ্রামীণ গরিব মানুষকে বিভাজিত করতে ওরা পারবে না। কৃষি সংকট, কাজ ও মজুরি সংকটে জর্জরিত গ্রামীণ মেহনতি মানুষের সংগ্রামী একতা গড়ে উঠবেই। সিপিআই(এমএল) সেই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। জমির অধিকার, কাজ-খাদ্য র দাবিতে নাকাশীপাড়ায় সংগ্রামী ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। রাজ্যের তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি-দলবাজি, কৃষক ও গরিব মানুষের প্রতি সীমাহীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে পার্টি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে সেই বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন। পার্টির পলিটব্যুরো নেতা কার্তিক পাল কৃষকের অধিকার কেড়ে নিয়ে কোম্পানিরাজ প্রতিষ্ঠা করার বিজেপির চক্রান্তের স্বরূপ তুলে ধরেন। কৃষি উপকরণের খরচ বাড়িয়ে দিয়ে ফসলের নায্য দাম থেকে বঞ্চিত করে ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিদের চরম দূর্দশার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হন। পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য ও শ্রমিক নেতা বাসুদেব বসু শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও শ্রমের অধিকারের উপর বিজেপি সরকারের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সংগ্রামী বামপন্থাকে শক্তিশালী করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ নতুন করে ছড়িয়ে পড়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, সারা দেশে ২ লক্ষেরও বেশি মানুষ আজ নতুন করে সংক্রমিত। দেখা যাচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে রাজধানী শহরগুলিতে হাসপাতালে বেড নেই, অক্সিজেন নেই, এমনকি শ্মশানে চিতা জালানোর জায়গা নেই। কেন্দ্র সরকার স্বাস্থ্য বীমা আয়ুষ্মান ভারতের কথা বলছে আর রাজ্য সরকার স্বাস্থ্যসাথী বীমার কথা বলছে। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে কাজ না হলে,জেলা হাসপাতালে ডাক্তার,অষুধ, এ্যাম্বুলেন্স না থাকলে, স্বাস্থ্যবীমার কার্ড দিয়ে কি হবে? তাই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবীমার কার্ড জুমলা ছাড়া আর কিছুই নয়। গরিব মানুষের স্বাস্থ্য পরিসেবার অধিকার ভারতের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। একই রকমভাবে টাকা দিয়ে ডিগ্রি কেনার জন্য যে নয়া শিক্ষানীতি চালু করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে, শিক্ষার অধিকারের দাবিতে ভোট দেওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান। নয়া কৃষিআইন প্রশ্নে তিনি বলেন,এই আইন নতুন করে কালোবাজারি মজুতদারী সৃষ্টি করবে, পুঁজিপতিরা বিপুল মুনাফা করবে, গরিবের রেশন ব্যবস্থা উঠে যাবে। আমেরিকা থেকে খাদ্য আমদানী করার পথে সরকার এগিয়ে চলেছে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদলে ওয়েষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, অর্থাৎ পশ্চিম ভারত তথা গুজরাটের আম্বানী আদানীদের রাজত্ব বিজেপি কৃষিতে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তাই নতুন করে কৃষকের স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়েছে। তিনি এনআরসির সিএএ-র নামে দেশের নাগরিকদের অধিকার হরণ করার বিরুদ্ধে বলেন, বিজেপি কেবল হিন্দু মুসলিম বিভাজন নয়, হিন্দু মুসলিম সহ সমস্ত ধর্মের সমস্ত ভাষাভাষীর পরিবারের অভ্যন্তরে বিভাজন ডেকে এনেছে। ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্পের মাধ্যমে আসামের বুকে এ জিনিস ঘটেছে। তাই আসামের বুকে মানুষ বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। বাংলার বুকে এই চক্রান্তকে রুখে দিতে জনগণের সংগ্রামী একতা গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিজেপি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা সমস্ত নিপীড়িত মানুষের অধিকারের পাশে দাঁড়াবো। স্বাধীনতার সময়কালে দেশভাগের দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস স্বত্বেও বাংলার বুকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর একতা গড়ে উঠেছে। একে ভাঙ্গার চক্রান্ত মানুষ অবশ্যই রুখে দেবে। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলার বুকে বামপন্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলা সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে। এ ছাড়াও জনসভায় বক্তব্য রাখেন নাকাশিপাড়া কেন্দ্রের পার্টির প্রার্থী কৃষ্ণপদ প্রামানিক।

The-country-is-ruined-by-Epidemic-touch

আবার কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ক্রমে ক্রমে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু রাজ্যে তীব্র স্বাস্থ্য সংকট মাথা চাড়া দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা সংখ্যা, কোভিড মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কিট, প্রাণদায়ী ওষুধ, অক্সিজেন এমনকি টিকার বিস্তর অভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। অসমের ডবল ইঞ্জিনের বিজেপি সরকার তো জানিয়েই দিল যে, কোভিড চিকিৎসার ওষুধ রেমডেসিভিয়ার এপিএল রোগীদের আর বিনামূল্যে সরবরাহ করা যাবে না, ফলে গ্যাঁটের কড়ি ফেলে  তা কিনতে হবে। ওই ইঞ্জেকশন কিনতে হবে ১৬৫২ টাকা খরচ করে। বিমানবন্দরেও কোভিড পরীক্ষার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে সব যাত্রীর কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে মাথাপিছু ৫০০ টাকা। রাজনৈতিক ক্ষমতার নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীভবনের মতোই কোভিড টিকা নিয়েও মোদী সরকার শুরু করেছে অমানবিক ব্যবসা, রাজনৈতিক খেলা। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোকে দুহাতে বিলোনো হচ্ছে টিকা, কিন্তু মারাত্বকভাবে আক্রান্ত অ-বিজেপি রাজ্য, যেমন, মহারাষ্ট্র, সেখান থেকে রীতিমতো বঞ্চিত হচ্ছে।

ইতিমধ্যেই পরিযায়ী শ্রমিকরা আবার নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। আবার রুটি রুজি হারানোর আতঙ্ক গ্রাস করেছে গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের। আজ থেকে একবছর আগের দেশব্যাপী লকডাউন, থালা বাজানো ও মোমবাতি জ্বালানোর ভূয়া আশ্বাসে করোনা তো নির্মূল হয়নি, বরং গরিবগুর্বোদের অর্থনৈতিক সামাজিক জীবনে নামিয়ে আনে দুঃসহ যন্ত্রণা ও হাহাকার। সমাজের সবচেয়ে বিপন্ন ও প্রান্তসীমায় থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মহিলা ও শিশুরা কল্পনাতীত যন্ত্রণার কবলে পড়েন।

গত বছর লকডাউনে সাধারণ মানুষের সর্বনাশা প্রভাব নিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান অনেক বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষা চালায়। কিছুদিন আগে এরকম আরেকটা সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ইন্ডিয়ান স্কুল অফ ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও আইইম্প্যাক্ট ১০টি রাজ্যের ৩১টি জেলায় ৯৪২টি গ্রামে ৪৮১৯টি পরিবারের মধ্যে এক সমীক্ষা চালায় গতবছর মে-জুন মাসে। রাজ্যগুলো হচ্ছে, রাজস্থান, বিহার, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, উত্তারাখন্ড, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, পশ্চিম বাংলা ও ঝাড়খন্ড। তারা এই সমীক্ষাটি প্রকাশ করেন, “এমার্জিং চ্যালেঞ্জেস ইন দ্য পোস্ট কোভিড কন্টেক্স্ট” শিরোনামে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামীণ ভারতে রুটি-রুজি খোয়ানো, খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট এবং শিশু সন্তানদের শিক্ষার উপরই সবচেয়ে বড় আঘাত নেমে এসেছে। প্রায় ১৭ শতাংশ গ্রামীণ শ্রমজীবী কোনোক্রমে লকডাউনের সময়ে তাঁদের আয় ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ হলেও, ৯৬ শতাংশ পরিবার চার মাসের বেশি নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি।

কেন্দ্রীয় সরকারের বহু ঘোষিত ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা’ নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মাত্র ১৯ শতাংশ পরিবার উক্ত প্রকল্প অনুযায়ী রেশন পেয়েছেন, আর ওই প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য যে সুবিধা পাওয়া যায়, যেমন, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ভাতা ইত্যাদি তা পেয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ পরিবার। সমীক্ষা থেকে জানা যায়, নিশ্চিত রোজগারের জন্য ৯২ শতাংশ মজুর নরেগার উপরই নির্ভরশীল। দেখা গেছে, ১০ টার মধ্যে ৯ টি পরিবারই অসংগঠিত ক্ষেত্রর উপর রোজগারের জন্য নির্ভরশীল আর ১০টার মধ্যে ৬ টি পরিবার দৈনিক মজুর বা অন্য রাজ্যে কাজের উপর নির্ভর করে থাকেন।

দেখা গেছে, শিক্ষাব্যবস্থায় যত উপর দিকে একজন উঠছে, ততই বেড়ে চলেছে স্কুল ছুটের সংখ্যা। অর্থাৎ, বেশিদিন আর পড়াশুনো চালিয়ে যাবার সামর্থ বহু পরিবারের নেই। দশটার মধ্যে একটা পরিবারে সর্বোচ্চ শিক্ষিত হল স্নাতক। ৪৪ শতাংশ পরিবারের সদস্য মাধ্যমিকের গন্ডি পার করতে পারেনি। দুই শতাংশ পরিবারের সদস্য কোনোদিনই স্কুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি। এই তথ্য ২০১১-র সেন্সাসের তথ্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে, যা দেখিয়েছিল, মাত্র ৮ শতাংশ ভারতীয় স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এটাও দেখা গেছে, যারা যারা উচ্চ মাধ্যমিক বা কলেজ শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছে তাঁদের জন্য স্থানীয় শ্রমবাজারে দৈনিক মজুরের কাজ ছাড়া আর কোনো সুযোগই নেই। প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন স্নাতক স্থানীয়ভাবে কারুর বাড়িতে পারিবারিক সহায়ক, দৈনিক মজুর বা অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে পাড়ি দেয়।

এদিকে এই কোভিডকালে, মাত্র এক বছরের মধ্যে আর্থিক বৈষম্য কদর্য হারে বেড়েছে। একশ জন সবচেয়ে ধনী ভারতীয় গত এক বছরে যে সম্পদ কুক্ষিগত করেছে, তার দশ শতাংশ দেশের দরিদ্রতম মানুষদের মধ্যে বিতরণ করলে প্রত্যেকেই পেতেন ৯৪,০০০ টাকা। একদিকে এই অতি ধনীদের বিপরীতে ৩.২ কোটি মানুষ দারিদ্রের কবলে পড়েছেন আর ৭.৫ কোটি মানুষ নতুন করে যুক্ত হয়েছেন দারিদ্র সীমার নীচে। মাত্র এক বছরের এই করোনা কালে ভারতে অর্বুদপতিদের সংখ্যা ১০২ থেকে এক লাফে বেড়েছে ১৪০-এ। যে বছরে ভারতের জিডিপি ৭.৭ হারে সংকুচিত হয় সেই বছরেই এই অতি ধনীদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমান লাফ দিয়ে বাড়ে ৯০.৪ শতাংশ হারে।

গত বছরের নজীরবিহীন মানবিক সংকট থেকেও সরকার কোনো শিক্ষাই নিল না। না রাজ্য না কেন্দ্র। আবার কোভিডের নতুন প্রকোপের সাথে সাথে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফিরতে শুরু করেছেন, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, যে বিষয়টা সামনে আসছে না তা হোল, মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের ভয়ঙ্কর বিপন্নতা। পরিযানের সময়ে মহিলা পরিযায়ীদের বিশেষ সমস্যা ও সংকটের প্রতি চোখ বন্ধ করেই রয়েছে সরকার। মহিলা জাতীয় কমিশনের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের কাছে গত বছরই এক অ্যাডভাইজারী পাঠানো হয়, যাতে বিশেষ করে নারী শ্রমিক ও শিশুদের জন্য একপ্রস্থ কল্যাণমূলক পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়। মা ও শিশুদের নিশ্চিত খাদ্য, আশ্রয়স্থল থেকে বাড়িওয়ালা যাতে উচ্ছেদ না করে, সন্তানসম্ভবা মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, যৌন নির্যাতনের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখা, প্রভৃতি সুপারিশগুলো প্রায় কোনো রাজ্য সরকারই বিন্দুমাত্র সাড়া দিল না। রাষ্ট্রনায়কদের অপরাধসম উদাসীনতা ও নির্লিপ্তি পরিস্থিতেকে আরও ঘোরালো করে তুলছে। সরকারী নির্লিপ্তির জন্য উত্তর প্রদেশে লাগামহীন কোভিড সংক্রমণের বিস্তার দেখে এলাহাবাদ হাই কোর্ট রাজ্য সরকারকে তুলোধোনা করে ৫টি শহরে লকডাউন ঘোষণা করে দিল আগামী ২৬ এপ্রিল থেকে। ১৩৫ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ এই ভারতবর্ষে এখনো পর্যন্ত মাত্র ১.১৯ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে পেরেছেন। অক্সিজেনের আকালের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতেও কোভিড আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। কোভিডের এই মারাত্বক দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় মোদী সরকার প্রত্যাহার করে নিল ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার জীবনবীমা প্রকল্পটি। এর আগে কেন্দ্র চুপিসাড়ে বন্ধ করে দিয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা’য় পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে বাড়তি রেশনের প্রকল্প। এদিকে, রেমডেসিভিয়ার ওষুধ নিয়ে যে কালোবাজারি শুরু হয়েছে তাতে এবার হাতে নাতে ধরা পড়লো মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে আরও মজবুত করা, সরকারী চিকিৎসাকে আরও বিস্তৃত করে ব্যাপকতম নাগরিককে তার আওতায় নিয়ে আসা, কাজ হারানো মানুষ ও আয়কর আওতার বহির্ভূত মানুষদের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান প্রভৃতি একগুচ্ছ ত্রাণ প্রকল্প ঘোষণা করার বদলে মোদী সরকার উল্টো পথে হেঁটে দেশের সমস্ত সম্পদকেই বিক্রি করে দিতে শুরু করলো কর্পোরেটদের হাতে।

গোটা দেশ যখন অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউতে বেসামাল, দেশের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তখন দেশবাসীর এই চরম দুর্দিনে নিজেদের দায়িত্ব থেকে সরে বাংলা দখল করতে মরিয়া হয়ে যুদ্ধে সামিল হয়েছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার এই জঘন্য খেলার পরিণতি যে কোথায় নিয়ে যাবে, তা ভবিষ্যতই বলবে।

-- অতনু চক্রবর্তী 

Where has the six years of Modi government

কেন্দ্রে মোদী সরকার ছ’বছর পার করেছে। এই সময়কালে দেশকে কোথা থেকে কোথায় এনে ফেলেছে সেটা মিলিয়ে নেওয়া দরকার। বিজেপি ‘সোনার বাংলা’ করে দেওয়ার বুলি ঝাড়ছে আর এই ছলে চাইছে মানুষের ভোট আত্মসাৎ করতে। আজ আর কথা আমল দিলে চলবে না, আচরণের ভিত্তিতেই বিজেপি’কে দিতে জবাব।

মোদী জমানায়

১) ভারত ৪৫ বছরের সীমা ছাড়িয়ে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বেকারির মধ্যে পড়েছে। (এনএসএসও)

২) পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত ৩০টি শহরের মধ্যে ২২টি শহর ভারতে। (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)

৩) গত ৩০ বছরের মধ্যে এই ৬ বছরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় জীবন গেছে সেনাদের। (ভারতীয় সেনা বিভাগ)

৪) ৮০ বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সর্বোচ্চ শিখরে। (Credit Suisse Report)

৫) মহিলাদের বসবাসের পক্ষে ভারত এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ। (টমাস রয়টার্স সমীক্ষা)

৬) ২০০০ সালের পর জিডিপি ঠেকেছে তলানীতে।

৭) গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাশ্মিরী তরুণ সন্ত্রাসবাদী হয়েছে গত ৬ বছরে। (ভারতীয় সেনা বিভাগ)

৮) ভারতের ব্যাঙ্কগুলো বিপর্যস্ত ৬,৬০,০০০ কোটি টাকা ব্যাড লোন বা এনপিএ-র ধাক্কায়।

৯) দারিদ্র্য বেড়েছে ২৩ শতাংশ।

১০) ইউনাইটেড স্টেটস্ কমিশন ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষার প্রসঙ্গে ভারতকে দুশ্চিন্তাজনক দেশের শ্রেণীতে ফেলেছে।

১১) ভারতের কৃষকরা ১৮ বছরের ভেতর সবচেয়ে কম শস্যের মূল্য পেল। (ওয়ার্ল্ডপ্রাইস ইনডেক্স)

১২) গরু সম্পর্কিত হিংসা ও মব লিঞ্চিংয়ে মোদি সরকার রেকর্ড করেছে। (India Spend Data)

১৩) সম্পদের বিচারে ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৈষম্যমূলক দেশ। (বিশ্ব সম্পদ রিপোর্ট )

১৪) ভারতীয় মুদ্রা এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নীচে।

১৫) পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ভারত পৃথিবীর তৃতীয় খারাপ দেশ। (ইপিআই রিপোর্ট)

১৬) ফরেন ফান্ডিং ও দুর্নীতিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভারতের ইতিহাসে প্রথম। (ভারতের ফিনান্স রিপোর্ট)

১৭) ৬ বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদী একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। ৭০ বছরে এমন ঘটেনি। পিএমএর বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।

১৮) ভারত বিদেশের সঙ্গে যুদ্ধে না পারলেও দেশে বড় বড় যুদ্ধ চলেছে সিবিআই বনাম সিবিআই, আরবিআই বনাম সরকার, সুপ্রীম কোর্ট বনাম সরকার। কারণ মোদীজী সমস্ত গণতান্ত্রিক সংস্থাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছেন।

১৯) সুপ্রীম কোর্টের চার বিচারক সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান, ‘ভারতে গণতন্ত্র বিপন্ন’।

২০) প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে এই প্রথমবার গায়েব হয়েছে সর্বোচ্চ গোপনীয় তথ্য।

২১) ধর্মীয় উন্মদনা ও হিংসা পৌঁছেছে ৭০ বছরের মধ্যে শীর্ষে।

২২) ভারতের মিডিয়া ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বিশ্বাসযোগ্যতায় পৌঁছেছে।

২৩) গ্লেবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা বিশ্ব অনাহারের সূচকে বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১০২ নম্বর স্থানে । এমনকি পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর নেপালও ভারতের ওপরে আছে। (গ্লোবাল হাঙ্গার রিপোর্ট)

২৪) জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর রিপোর্ট প্রকাশ হতে প্রচন্ড দেরী হয়। ২০১৭ সালের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে মাত্র। ফলে বিচার কী হয় বোঝাই যায়।

২৫) আইএমএফ মোদী সরকারের তথ্য ও তা প্রকাশের ধরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তার বিলম্ব নিয়েও দুশ্চিন্তা জানিয়েছে। কর রাজস্বের সম্ভাব্য পরিমাণ ও আভ্যন্তরীণ মোট উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছে। কিছুই তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য লাগছে না। ভবিষ্যতে অন্য সরকার এলে তারাও বিপদে পড়বে।

২৬) ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনীতির অপরাধীকরণে দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভয়াবহ। পূর্বতন বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিঙ্গার, বিজেপি’র প্রাক্তন মন্ত্রী স্বামী চিন্ময়ানন্দর মামলা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মালেগাঁও বোমা মামলার অভিযুক্ত প্রজ্ঞা ঠাকুর এখন সাংসদ এবং হাস্যকর হল তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্যানেলে আছেন। অভিযুক্ত উগ্রপন্থী দেশরক্ষার সিদ্ধান্ত নেবেন, ভারত ছাড়া এমন কোথাও নেই। ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি অপরাধীদের থেকে বিপুল টাকা নিয়েছে। লোকে কী বলবে তা নিয়ে ভাবে না। ‘আরকেডব্লিউ ডেভেলপার্স লিমিটেড’ থেকে নেয় ১০ কোটি টাকা। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সংগঠিত করার টাকা যোগানোর তদন্ত করছে ইডি। এটা বিজেপি’ই নির্বাচন কমিশনকে জানায়।

২৭) নির্বাচন কমিশনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর নেই। ৩৪৭টি আসনে প্রার্থীর ক্ষেত্রে তারা নির্লজ্জের মতো পক্ষপাতিত্ব করেছে। একমাত্র অশোক লাভাসা আপত্তি করায় এখন তাঁর ও তাঁর পরিবারের ওপর মানসিক নির্য্যাতন চলছে।

২৮) ২০১৯এর মার্চে ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্স প্রকাশ করে। দেশের মানুষ কত ভালো আছে এবং সরকার কেমন শাসন করছে তা বোঝা যায় যাতে। তাতে মোদীজী সরকারের পতন অভূতপূর্ব। দেশের মানুষ ও দেশ এত কষ্টে কখনও থাকেনি। ছ’টি সূচকের ভিত্তিতে সামুহিক সুখের বিচার হয়। পার ক্যাপিটা জিডিপি, সুস্থ জীবন ও গড় আয়ু, জীবনে নিজের পছন্দ বাছার স্বাধীনতা, সমাজের পাশে থাকা বা নিঃস্বার্থ সাহায্য করা ও পাওয়া, উদারতা ও দুর্নীতি বিষয়ে ধারণা।

এই সব ধরে ১৫৩টি দেশের মধ্যে মোদীর ভারত স্থান পেয়েছে ১৪০ নম্বরে। ২০১৩ সালে ছিল ১১৭ নম্বরে। মানুষের সর্বনাশ করায় মোদীজীর এটা সেরা কীর্তি বলতে পারেন। যে পাকিস্তানের ভরসায় মোদীজীর অস্তিত্বের অনেকটা টিকে আছে সেই পাকিস্তান রয়েছে ৬৭ নম্বরে। আমাদের দ্বিগুণের বেশি স্বস্তিকর অবস্থায়। আর, ভারতের সাধারণ জনজীবন থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে চাকরি, স্বাধীনতা ও আনন্দ সবকিছু।

Letter from Visva Bharati

সাথী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজেপি-আরএসএসের অঙ্গুলিহেলনে চলা উপাচার্যের নেতৃত্বে নেমে আসছে একের পর এক আক্রমণ। এর বিরুদ্ধে মুখ খুললেই ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী, আধিকারিকদের উপর চাপানো হচ্ছে মুচলেকা, শোকজ অথবা সাসপেনশনের ফতোয়া। ইতিমধ্যেই প্রায় ১৫০ জনকে করা হয়েছে শোকজ, সাসপেন্ড হয়েছেন ২০ জনেরও অধিক।

গত ১৪ জানুয়ারী উপাচার্যের এহেন অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে ৩ জন ছাত্রছাত্রীকে সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী ভঙ্গিতে মিথ্যা অভিযোগে কোনরকম নোটিশ ছাড়াই ৩ মাসের জন্য সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়। বিগত ১৪ এপ্রিল এই সাসপেনশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল অথচ ১৯ এপ্রিল উপরোক্ত ছাত্রছাত্রীদেরকে একটি অজ্ঞাতপরিচয় মেইলের মাধ্যমে জানানো হয় তাদের সাসপেনশন পুনরায় আগামী ৩ মাসের জন্য বহাল করা হচ্ছে। আমরা আইসা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে এই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছি। পুনরায় সাসপেনশন বহাল রেখে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাক্ষেত্রে ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের মুখে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্তকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। এই নোটিশে কর্তৃপক্ষের তরফে কোন সাক্ষর না থাকা, এবং অজ্ঞাতপরিচয়ে মেইল আসা আদপে এই নোটিশের বৈধতাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। এরই সাথে অন্যান্য অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী, আধিকারিকদের উপর নেমে আসা ফতোয়াগুলির বাতিলের দাবিও আমরা রাখছি।

ইতিমধ্যেই এই অগণতান্ত্রিক নোটিশের বিরুদ্ধে সাস্পেনডেড ছাত্রছাত্রীরা অবস্থান আন্দোলন শুরু করেছেন শান্তিনিকেতন কাঁচমন্দিরের সামনে। আমরা আইসার পক্ষ থেকে এই আন্দোলনকে সংহতি জানাই এবং বাংলার সমগ্র ছাত্র-ছাত্রী সমাজকে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান জানাই। এর পাশাপাশি শিক্ষা সম্বন্ধিত রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সম্পুর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে বিশ্বভারতীর আদর্শকে, তার মুক্তচিন্তার পরিসরকে সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী কায়দায় বিনষ্ট করার যে চক্রান্ত উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে চলছে, তা রুখতে অবিলম্বে আমরা বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি।

সংগ্রামী অভিনন্দন সহ,
আইসা, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট

Why talk

এক একটা সময় আসে যখন অন্ধকারের জলকল্লোল এক কুৎসিত আনন্দে মেতে ওঠে। সময় চমকিত হয়। বাতাস গতিহীন হয়। স্তব্ধবাক হয়ে পড়ে বিপন্ন বনস্থলী। এমনই এক একটা সময় আসে। যায়। আমরা দিশাহীন আর্তনাদে অন্ধকারে হাত-পা ছুঁড়ি আর এমন সব সাবেগ উচ্চারণ করতে থাকি যা অন্তঃসারশূন্য বাক্যপুঞ্জের মহাকাব্য হয়ে আমাদেরই একটা সময় ব্যঙ্গ করতে থাকে। আমরা বিস্মৃত হই কবি শঙ্খ ঘোষেরই সেই অবিস্মরণীয় পংক্তি : চুপ করো/শব্দহীন হও…’

একটা সময় আমাদের প্রতিবাদের শব্দ, উচ্চারণ যোগাতেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজে আন্দোলনের ডাক দিতেন, নিজে মিছিলে সামিল হতেন। তাঁকে ঘিরে থাকতো নকশালবাড়ির   আলোকোদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণীরা। বিগত শতকের সত্তরের সেই কালবেলায় আমরা কবি বীরেন্দ্রকে পেয়েছিলাম। ১৯৮৫-তে তাঁর প্রয়াণোত্তরকালে আমরা পেয়েছিলাম কবি শঙ্খ ঘোষকে, ঠিক বীরেন্দ্রর মতো করে নয়, একটু অন্যভাবে, অন্য মাত্রাযুক্তভাবে, শব্দসচেতনতায় অথচ প্রতিবাদের নিবিড় উচ্চারণে। এক এক সময় তো তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে প্রতিবাদের সতপ্ত উচ্চারণ, পথে নামা, শাসকের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই। কবি কমলেশ সেন ছিলেন প্রতিবাদী মিছিলের সংগঠক। তাঁকেও ঘিরে থাকতো তরুণ এবং প্রবীণ বামপন্থী, নকশালপন্থী এবং অসংখ্য আনকোরা মুখ। প্রতিবাদের লিপিতে সই সংগ্রহ করতে তিনি নিজেই বেরিয়ে পড়তেন। কবি শঙ্খ ঘোষ এই কবিকেও অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কবি কমলেশ যখন সল্টলেকের আনন্দলোক হাসপাতালে অপারেশনের জন্যে ভর্তি, সেসময় একদিন নিমাই ঘোষের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম কমলেশদাকে দেখতে। সেসময় শঙ্খবাবুও আসেন। আমি যখন কবিকে দেখতে যাচ্ছি তখনি তিনি আসেন। আমি নিজে না গিয়ে তাঁকেই যেতে বলি, একটু ইতস্তত করে তিনি গিয়েছিলেন কবি কমলেশ সেনকে দেখতে। কবির চিকিৎসার জন্যে শঙ্খবাবু কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি স্বশাসিত সংস্থার নিকট আর্থিক সাহায্যের আবেদন রেখেছিলেন। এই তথ্যই কবি শঙ্খের হৃদয়ের প্রসারতার প্রমাণ দেয়।

কবি বীরেন্দ্র প্রয়াত হওয়ার পর থেকে শঙ্খবাবুই কবি বীরেন্দ্রকে নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকেন তাঁর লেখাপত্রে, বক্তৃতায়। কবি বীরেন্দ্রর প্রতিবাদী কবিসত্তার প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। মনে হয় একারণেই বীরেন্দ্রর প্রয়াণের পর সেই দায়িত্ব তিনি নীরবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে প্রতিবাদপত্রের শব্দচয়নে তাঁর অতিসতর্কতা অনেকের কাছেই অনেকসময় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠতো। তিনি অবলীলায় প্রতিবাদপত্রের শব্দের পরিবর্তন করে দিতেন। সবাই অবশ্য তাঁর এই অভিভাবকত্ব মেনে নিয়েছিলেন। এমনও দেখেছি যথার্থ এবং সংগত কারণে অন্যের লেখা প্রতিবাদপত্রে তিনি সহমত পোষণ করেও স্বাক্ষর করতে রাজি হননি সেই শব্দচয়নের শুচিতা এবং বাহুল্য অবর্জনের কারণেই।

শঙ্খবাবু রাজনীতি সচেতন থেকেছেন তাঁর যৌবনের প্রত্যুষলগ্ন থেকেই। কিন্তু কোনোদিন কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি। একবার তাঁর বাড়িতে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম গত শতকের চল্লিশের দশকে আমাদের বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি-শিল্পীরা তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ কিম্বা ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘে নির্দ্বিধায় সামিল হয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আবার এইসব সংগঠন থেকে উত্তরকালে বেরিয়ে গিয়েছিলেন — এর জন্যে এই লেখক-কবি-শিল্পীরাই দায়ী না পার্টি দায়ী? এপ্রশ্ন অনেককেই করে লিখতে বলেছি, কিন্তু কেউই রাজি হননি। ‘অনীক’-সম্পাদক দীপংকর চক্রবর্তী লিখতে রাজি হয়েও শেষপর্যন্ত আর লেখেননি। তিনি আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন পঞ্চাশের দশকে তখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূতের বেগার’ বইটি নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিমহলে খুবই সমালোচনা হচ্ছে, বইটি পার্টি থেকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নিবিষ্ট কর্মী সুভাষ এসময় এঘটনায় খুবই মানসিক আঘাত পান। এমনই সময় সাংস্কৃতিক কর্মিদের এক সভায় গিয়েছিলেন তিনি (শঙ্খ ঘোষ)। সেসময় কবি সুভাষ তাঁকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন : ‘শুনলাম তুমি নাকি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ নিচ্ছ?’ শঙ্খবাবু বলেছিলেন কবি সুভাষকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন কী হয়েছে? তখন উত্তেজিত সুভাষ বলেছিলেন তিনি তাঁর প্রশ্নের সরাসরি উত্তর চান। শঙ্খ ঘোষ তখন তাঁকে জানিয়েছিলেন : ‘না, তেমন কোনও ইচ্ছেই তাঁর নেই।’ সেইকথা শুনে সুভাষ তাঁকে বলেছিলাম : ‘নিশ্চিন্ত হলাম।’ — একথাগুলো বলার মধ্যে দিয়ে আসলে তিনি আমার কথার জবাব দিয়েছিলেন।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তিনি ‘সুভাষদা’ বলেই সম্বোধন করতেন এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন।  সুভাষের আন্দোলন-সম্পৃক্ততা তাঁকে প্রাণিত করেছিল কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্সান্নিধ্যে আসতে উৎসাহী করেনি। চিরকালই তিনি ‘বাম’মনস্ক রাজনীতির সম্পৃক্ততায় থেকে উত্তাপ সংগ্রহ করেছেন এবং প্রতিবাদ্য বিষয়ে কখনও কবিতা লিখে কখনও সরাসরি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে কুচবিহারে ‘স্বাধীন’ ভারতের পুলিশের গুলিচালনায় খাদ্যের দাবিতে মিছিলে সামিল হওয়া এক কিশোরীর মৃত্যু তাঁকে উত্তেজিত করেছিল, আর এর প্রতিক্রিয়ায় আমরা পেয়েছিলাম তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা ‘যমুনাবতী’। এই কবিতায়  তিনি লিখেছিলেন : ‘... যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে/ যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে ...।’ কবির এই প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া সাময়িক প্রক্ষোভের প্রকাশ ছিল না, আর তা ছিলনা বলেই উত্তরকালেও তিনি প্রতিবাদ্য ঘটনার প্রতিবাদে তাঁর প্রতিক্রিয়াকে কবিতার আয়ুধে সজ্জিত করেছিলেন। সত্তরের দশকে ইন্দিরা জমানায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বাবরের প্রার্থনা’। এই কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতায় তিনি লিখেছিলেন : ‘ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর/আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’ চুয়াত্তরে কলকাতার কার্জন পার্কে নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তের পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ তিনি করেছিলেন। প্রতিবাদ করেছিলেন নকশালপন্থী কবি তিমিরবরণ সিংহের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার মতো দানবীয় ঘটনারও। তিনি এইসময় তাঁর যন্ত্রণার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছিলেন : ‘শৃঙ্খলার অজুহাতে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের নামে যখন একটা প্রজন্মকে বিকৃত বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয় পুলিশের অন্ধকার গুহায়, তখন তার বিরুদ্ধে যদি আমরা সরব হতে নাও পারি, তার সপক্ষে যেন আমরা কখনো না দাঁড়াই।’ এখানে তাঁর কিছুটা দ্বিধাচিত্ততা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেছেন এভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যদি ‘সরব’ না-তে পারি, তবু যেন এর পক্ষে অবস্থান না নেই! আসলে সেই সময় তাঁকে অন্য অনেকের মতো আক্রান্ত করেছিল, পীড়িত করেছিল, উচ্চারণকে অনুক্ত করার প্রয়াস অব্যাহত ছিল। তবু অন্ধকারে ফুলের প্রস্ফূটনের মতোই তাঁর প্রতিবাদের আকুতি কিন্তু অবদমিত থাকেনি। তিনি অন্ততপক্ষে খুনীকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ ছিলেন। বন্দিমুক্তি আন্দোলনে তিনি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করে তাঁর অবস্থানকে সুচিহ্নিত করেছিলেন।

সাতাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় বামফ্রন্ট আসীন হওয়ার পর শঙ্খবাবু আপ্লুতচিত্তে তাঁর প্রতিবাদীসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে বসেননি। এই বামজমানার শেষপর্যায়ে এই সরকারের তীব্র জনবিরোধী ভূমিকায় তিনি বিচলিত হন। তিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-নেতাইয়ে বাম সরকারের নিন্দনীয় ভূমিকার প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করেননি। এসময় পরিবর্তনের ডাক দিয়ে যে জনকল্লোল নিনাদিত হয়েছিল, তিনি সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। সেইসময় ‘বাম’ সরকারের দম্ভোক্তি, ক্ষমতার আস্ফালন তাঁকে ক্রমশই প্রতিবাদমুখর হতে উৎসাহী করেছিল। তিনি এসময় তাঁর সক্রোধ মননের প্রকাশ ঘটাতে লেখেন : পুলিশ কখনো অন্যায় করেনা যতক্ষণ তারা আমার পুলিশ — শাসকশ্রেণীর এই পুলিশনির্ভরতা এবং পুলিশের অত্যাচারের সাফাই গাওয়া তাঁর কাছে অসহ্য বিবেচিত হয়েছিল। এক সিপিএম নেতার উদ্ধত কথাবার্তার প্রেক্ষিতে তিনি লিখেছিলেন : ‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি/অক্ষরে অক্ষরে/যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন/ দিয়েছি নরক করে!’

২০১১ খ্রিস্টাব্দে বামফ্রন্টের দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের শাসনক্ষমতার অবসানের পরে ক্ষমতাসীন নতুন সরকারের প্রতিও তিনি এতটুকু মোহযুক্ত হননি। আর একারণেই এই তৃণমূল জমানায় কামদুনি-ঘটনার প্রতিবাদে স্বয়ং প্রতিবাদী মিছিলে সামিল হতে দ্বিধান্বিত হননি। এছাড়া কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশদের হত্যার প্রতিবাদেও তিনি সরব হয়েছিলেন। এনআরসি-সিএএর নামে বিজেপির ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও তিনি নীরব থাকেননি। একদিকে তিনি যেমন মাওবাদী-আখ্যায়িত কারাবন্দি কবি ভারভারা রাওয়ের মুক্তির দাবিতে সহমত পোষণ করেছেন, তেমনই তিনি চেরাবান্ডা রাজু এবং ভারভারা রাওয়ের অনেক কবিতার বাংলা অনুবাদ করে বাংলার পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। এসব কারণে তিনি সবসময় শাসকশ্রেণীর কর্তাব্যক্তিদের কাছে সমালোচনার পাত্র হয়েছেন, তবু তিনি কখনও তাঁর প্রতিবাদীসত্তার সঙ্গে আপস করেননি।

আজ আমাদের সামনে বিজেপির ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন মূর্তিমান দানবের মতো এসে হাজির হয়েছে। মিথ্যে, গুজব, সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং বিভেদের অপরাজনীতির সংমিশ্রণে এই ফ্যাসিস্ত শক্তি তার ভয়ংকর রূপটিকে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছে। সর্বাত্মক আক্রমণের লক্ষ্যে তারা ক্রমশ আমাদের জাতীয় জীবনে বিপর্যয় সূচিত করে চলেছে। এমত অশুভ সময়ে আমরা হারালাম কবি শঙ্খ ঘোষের মতো কবিকে যিনি অনেকের কাছেই আশ্চর্য নির্ভরতার নিশ্চিত আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর এই প্রয়াণ এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে আমাদের আক্ষেপে রোরুদ্যমান না করে প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হতে উদ্বুদ্ধ করুক। কে আর মিছিল ডাকবে, আমরা নিরাশ্রয় হলাম জাতীয় হা-হুতাশ করার সময় এখন নয়। এখন সময় আরও বেশি ঘনবদ্ধ হওয়া, বেঁধে বেঁধে থাকা আর আগ্রাসী ফ্যাসিবাদের প্রতিরোধে সাহসে বুক বেঁধে পথে নামার। মনে রাখতে হবে কবি শঙ্খ ঘোষেরই সেই অমোঘ পংক্তি :

পুব থেকে পশ্চিমের থেকে উত্তরে বা দক্ষিণে কে
অক্ষৌহিনী ঘিরবে বলে ফন্দি করে আসছে ঝেঁপে ?

--অশোক চট্টোপাধ্যায়

Poet Shankha Ghosh

কানোরিয়া জুট মিলে যখন তীব্র আন্দোলন চলছে সেখানে চলে গিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। সেটা ১৯৯৪ সাল। কানোরিয়া পাটকলের শ্রমিকদের সমর্থনে অনেকেই যাচ্ছেন সংহতি জানাতে। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রেললাইন পেরিয়ে সিং পাড়াতে গেলেন। শাসকের রঙ দেখেননি কোনও দিন। শাদাকে শাদা, কালোকে কালো বলার নম্র হিম্মত তাঁর ছিল। পরবর্তীকালে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে ভাঙ্গড় সর্বত্র তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট, সেই অবস্থানের সঙ্গে কেউ একমত না হতে পারেন। সঙ্ঘপরিবারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা আমরা জানি। বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় গর্জে উঠেছিল তাঁর কলম। বিহারে রণবীর সেনার আক্রমণে যখন কমিউনিস্টরা খুন হচ্ছেন তখনও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন না।

যদিও বধির, তবু ধ্বনিরও তো ছিল কিছু দেনা
সবই কি মিটিয়ে দিয়ে গেল তবে রণবীর সেনা?
আরওয়াল গণহত্যার পর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে লিখছেন -
‘ওদের ব্রহ্মর্ষি সেনা, ওদের চক্রের ব্যূহ ঘেরা
ওদের রাইফেলে গুলি ওদের পুলিশ সুপারেরা’

ইদানীং ‘সালোয়া জুড়ুম’ শব্দটি শুনতে শুনতে সেই আরওয়ালের কথা মনে পড়ে। গুজরাত দাঙ্গার পরে লেখা তাঁর বিখ্যাত লাইন -

‘নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা।
যতদূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসেনা কোন কূটতর্ক নিয়ে,
ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায়। যদি বলি দিন বলে দেয় দিন
যদি বলি রাত, বলে রাত’।

শঙ্খ ঘোষের প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। মা অমলাবালা, পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ। শঙ্খবাবু বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার তাঁর উল্লে‍খযোগ্য গদ‍্য রচনা “বটপাকুড়ের ফেনা”র জন্য। তাঁর বিশেষ গ্রন্থগুলি হল : মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, উর্বশীর হাসি, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি।

মনে পড়ে ১৪ এপ্রিল, ২০০২ সালে গুজরাত গণহত্যার প্রতিবাদে তাঁর কলম গর্জে ওঠে। তিনি লিখেছিলেন, “না, ধ্বংসকে বিধিলিপি ভেবে আমরা চুপ করে থাকব না আর … গুজরাত জ্বলছে। শিশুঘাতী নারিঘাতী কুৎসিত বীভৎসার এক নারকীয় তাণ্ডব চোখের সামনে আমাদের দেখতে হচ্ছে আজ। কোন ভাষায় আমরা জানাব আমাদের ধিক্কার আমাদের ক্রোধ আমাদের লজ্জা আমাদের অপমান? ... শুধু গুজরাত নয়, ভিতরে ভিতরে জ্বলছে গোটা দেশটাই?”
২০০৬ সালে নন্দীগ্রামে গণহত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষ নেমে এলেন রাজপথের মিছিলে। কলকাতার সেই মিছিল এখনও অনেকের মনে আছে। সেদিনও শঙ্খবাবু পথে নেমেছিলেন নিজের বিবেকের তাগিদে। রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী থাকলে তিনি হাঁটবেন না। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁটা হয়নি সেই মিছিলে।

একজন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা শঙ্খ ঘোষ নিজের কাজ দিয়ে বার বার প্রমাণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু বলা দরকার। কেননা, এক শ্রেণির উচ্ছিষ্টভোগীকে বাংলার মানুষ বুদ্ধিজীবী ভেবে প্রায়শই গালাগালি দেন।

বুদ্ধিজীবীরা কেন তাঁদের মতামত জানান? এর উত্তর প্রথাগতভাবে দুটো। এক, ব্যক্তিগত প্রবণতা। দুই, পেশাগত ভূমিকার দায়বদ্ধতা। কোনও একজন বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে এই দুটো কারণ একই সঙ্গে কাজ করতে পারে, আবার কোনও একটি একক বোধ তাঁকে সিদ্ধান্ত গঠনের পথে নিয়ে যেতে পারে। বৌদ্ধিক প্রবণতা অথবা আগ্রহ বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার। বৌদ্ধিক প্রবণতার তীব্রতা অনুসারে এই পার্থক্যের জন্ম। জরুরি কথা হল, যাঁরা তথাকথিত অবৌদ্ধিক পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের ভেতরেও বিভিন্ন মাত্রায় বৌদ্ধিক ভূমিকা পালন করার প্রবণতা দেখা যায়। এখানে ‘অবৌদ্ধিক পেশা’ কথাটায় আপত্তি থাকতে পারে। কেননা সেই অর্থে কোনও পেশাকে অবৌদ্ধিক বলা যায় না। সুতরাং গতানুগতিক ধারণাকে বিসর্জন দিয়ে সব মানুষকে বুদ্ধিজীবী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।

কিন্তু সত্যিই কি সব মানুষ বুদ্ধিজীবী? এই প্রশ্নের দুটো উত্তর পাওয়া যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর দু জন চিন্তাবিদ এর ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। একজন অ্যান্টনিও গ্রামশি, অন্যজন জুলিয়েন বেন্দা। গ্রামশি ইতালীয় মার্কসবাদী, সক্রিয় কর্মী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দার্শনিক। মুসোলিনি তাঁকে ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি করে রাখেন। ‘প্রিজন নোটবুকস’-এ গ্রামশি বলেছিলেন, “সব মানুষ বুদ্ধিজীবী, সুতরাং একজন বলতে পারেন : কিন্তু সমাজে সকল মানুষের কাজ বুদ্ধিজীবীর নয়।” গ্রামশির এই কথা থেকে বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে দ্বান্দ্বিক ধারণাটি ধরা পড়ে। যে কোনও কাজ, তা সে কায়িক পরিশ্রম হোক, আর বৌদ্ধিক কাজ—সব মানবিক কাজেই বুদ্ধির দরকার হয়। এই কথাটা আমরা প্রায়ই বিস্মৃত হই এবং কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিরোধিতার মুখোমুখি হই। একজন লেখক শুধু বুদ্ধির জোরে লিখতে পারেন না, তাঁকেও কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। তেমনি যে মানুষটি মাছ ধরেন অথবা লোহা পেটান তাঁকেও নির্ভর করতে হয় বুদ্ধির উপর। গ্রামশি সব মানুষকে বুদ্ধিজীবী বললেও তিনি এই কথাটায় জোর দেন— “সমাজে সকল মানুষের কাজ বুদ্ধিজীবীর নয়।” বুদ্ধিজীবীর একটা ভূমিকা থাকা দরকার, সামাজিক ভূমিকা। ইতিহাস পর্যালোচনা করে গ্রামশি বুদ্ধিজীবীর কাজ ভূমিকাকে দু’ভাবে দেখেছেন। একদলকে তিনি বলছেন গতানুগতিক, চিরাচরিত বা ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবী — যাঁদের মধ্যে শিক্ষক, ধর্মপ্রচারক, প্রশাসকরা রয়েছেন। তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই ভূমিকা পালন করে আসছেন। এই বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ কোনও শ্রেণির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নন। দ্বিতীয় ধরনের বুদ্ধিজীবীদের গ্রামশি বলছেন অর্গ্যানিক বা সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবী, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে কোনও শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা উঠতি সামাজিক শ্রেণির মুখপাত্র। ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীদের থেকে বিকাশের উত্তরণে সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবীরা উদ্ভূত হতে পারেন। আবার শ্রেণির ভাঙনে বা বিশৃঙ্খলায় অর্গ্যানিক বুদ্ধিজীবী চিরাচরিত বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হতে পারেন। প্রতিটি সামাজিক শ্রেণি যখন পূর্বের অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে জন্ম নেয় তখন সেই শ্রেণি ট্রাডিশনাল বুদ্ধিজীবীদের পেয়ে থাকে। তাঁরা শত জটিলতা ও পরিবর্তনের মধ্যেও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। একজন পুরোহিত একটা সময়ে সাংগঠনিক বুদ্ধিজীবী ছিলেন, কিন্তু ধনতন্ত্রের বিজয় অভিযানে তাঁদের এই ভূমিকা বাতিল হয়ে যায়। গ্রামশি বিশ্বাস করতেন অর্গ্যানিক বুদ্ধিজীবীরা সমাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন, তাঁরা মানসিকতার পরিবর্তন এবং বাজার প্রসারণে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যান। অন্যদিকে শিক্ষক বা পাদ্রি এই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নন, তাঁরা বছরের পর একই ধরনের কাজ করে যান; একই জায়গায় অবস্থানকে অপরিবর্তনীয় রেখে।

শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ, কবি শঙ্খ ঘোষ সব সময় ঝুঁকি নিয়েছেন। ঝুঁকিহীন আরামের জীবন, অন্যায়কে মেনে নিয়ে ঘরে বসে থাকার জীবন যা তিনি চাইলেই পেতে পারতেন, তাঁর শিক্ষক-খ্যাতি, কবি-খ্যাতি তাতে কমতো বা বাড়তো না। কিন্তু তিনি শঙ্খ ঘোষ। তিনি সময়ের ট্রাডিশনকে গড়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বা মহাকবি ইকবালের যথার্থ উত্তরসূরি শঙ্খ ঘোষ।

২০১৮ সালে ভাঙড় আন্দোলনের সময় তিনি রাজ্য সরকারকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার আর্জি জানান। তিনি লেখেন, স্থানীয় গ্রামবাসীরা আজ ধারাবাহিক সংঘর্ষ, খুন, কারাবাস আর পুলিশি নির্যাতনের শিকার। স্বাভাবিক জীবন সেখানে (ভাঙড়ে) আজ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। তাঁর কথায়, ‘আমাদের গোটা দেশের দুর্ভাগ্য, যে কোনও সঙ্গত দাবি বা বিক্ষোভের প্রকাশকেও সরকার পক্ষ যেন ধরে নেন কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্র।’

নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দিল্লির সীমান্তে লড়ছেন লক্ষ লক্ষ কৃষক। নতুন কৃষি আইন চালু হলে চুক্তি চাষ হবে, কৃষকের জমির অধিকার থাকবে না। ফসলের মূল্য লাগামছাড়া হবে। রেশন ব্যবস্থা উঠে যাবে, উঠে যাবে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। এই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রশক্তির চাপিয়ে দেওয়া সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিল করার দাবিতে গোটা দেশের কৃষক সমাজ কিছু দিন ধরে এক দুঃসাহসিক আন্দোলনে রত। রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে, নেতা-কর্মী ছাত্র-যুবা শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে মিলিত ভাবে আমিও চাই যে, সর্বতোভাবে সফল হোক এই আন্দোলন’।

বাবর তাঁর আয়ু দিয়ে দিয়েছিলেন অসুস্থ উত্তরসূরিকে। তাঁর আর্জি ছিল আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। বাবরের জবানিতে কবির সেই প্রার্থনা যেন সত্য হয়।

এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত —
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন
কোথায় কুড়ে খায় গোপন ক্ষয়!
চোখের কোণে এই সমুহ পরাভব
বিষায় ফুসফুস ধমনী শিরা!

জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের আজান গান ;
পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

না কি এ শরীরে পাপের বীজাণুতে
কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে?

না কি এ প্রসাদের আলোর ঝল্ সানি
পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়
এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে
লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের?

আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
জীর্ণ ক’রে ওকে কোথায় নেবে?
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

সে ছিল জরুরি অবস্থার কাল। এখনও কি তা নয়?

- শামিম আহমেদ
২২ এপ্রিল ২০২১

In memory of poet Shankha Ghosh

তর্জনী তুলেছ, রাজা রক্তচোখ হ'লে
সাহসী প্রত্যয় ছিল বিনম্র বাচনে
তোমার স্মৃতি কেন জায়মান
আমার দুঃখ তথাগত কেন?
কেন যাও অনির্দেশে, এতখানি অভিমান বয়ে
অভিযান কেন আজ মানুষী বাঁধন ছেড়ে?

কবি যদি ক্রান্তদর্শী হয়
শঙ্খসুরে আজানু স্পন্দিত দেশ
বাবরের প্রার্থনায় জাতিস্মর
লোকস্মৃতি বেয়ে লোকায়ত যেন

তাঁর মর্মবাণী ধ্বনিময়।

তোমার জেহাদ অফুরাণ
অনির্বাণ তোমার শব্দবেধ
ঋজুরেখ চেতনার সাথে
চারণ কবির পদক্ষেপে
হিম্মত চারিয়ে দিয়ে গেলে।

অভিজিৎ মজুমদার
২১ এপ্রিল ২০২১

Vira Sathidar

মহারাষ্ট্রের গণ আন্দোলনের প্রবীণ কর্মী, আম্বেদকরপন্থী বিপ্লবী, অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মী, ‘বিদ্রোহী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ভিরা সাথিদরকে হারিয়েছি আমরা। প্রয়াত সাথিকে শ্রদ্ধা জানাই। জয় ভীম, লাল সেলাম।

Red salute to comrades

কমরেড রঞ্জিত দে গত ১৭ এপ্রিল হাওড়া জেলা হাসপাতালে মারা যান। তিনি প্লুরোসি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। ৭০ দশকের উত্তাল সময়ে তিনি পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন, পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, পার্টির গোপন অবস্হায় আইপিএফ গঠনের পর মধ্য হাওড়ার সম্পাদক ও পার্টির মধ্য হাওড়া লোকাল কমিটির সদস্য হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। আমৃত্যু পার্টি সদস্য এই কমরেড রেখে গেলেন তাঁর জীবনসাথী কমরেড কৃষ্ণা দে সহ মধ্য হাওড়ার সহযোদ্ধাদের।

কমরেড রঞ্জিত দে'র মৃত্যু পার্টির কাছে অপুরণীয় ক্ষতি। পার্টির জেলা কমিটি প্রয়াত কমরেডের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে।

কমরেড রঞ্জিত দে লাল সেলাম।

এই পর্বে আমরা হারিয়েছি বহরমপুরের প্রবীণ কমরেড শুক্রাচার্য ভট্টাচার্য্য ও কৃষ্ণনগরের কমরেড শঙ্কর সান্যালকে। কমরেড শুক্রাচার্য ভট্টাচার্য, সকলের প্রিয় শুকুদা, ৭৩ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন গত ১৮ এপ্রিল রাতে। বহরমপুরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশেষ পরিচিত ও প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি।

অন্যদিকে কৃষ্ণনগরের সঙ্কর সান্যাল অকালেই চলে গেলেন বলা যায়। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম নেতৃত্ব, সমান নাগরিকত্ব আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। চলতি পর্বে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচারাভিযানেও তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়ন ছিলেন। এই কমরেডদের চিরতরে হারিয়ে পার্টি শোকাহত। তাঁদের লাল সেলাম জানিয়ে তাঁদের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিচ্ছে পার্টি।

- সমাপ্ত -

খণ্ড-28
সংখ্যা-15