বিপ্লবী জননেতা মুকুর সর্বাধিকারীর জন্মশতবর্ষ উদযাপন
Mukur Sarvadhikari

মানুষের মধ্যে কাজ করে মানুষের মন জয় করে জননেতা হয়ে উঠেছিলেন মধ্য কলকাতা নিবাসী মুকুর সর্বাধিকারী। এবছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। তাঁর জন্ম ১৯২১ সালে। তিনি প্রয়াত হয়েছেন ১৯৯০ সালে। তাঁর শুভানুধ্যায়ী কজন মিলে তাঁর জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের শুভসূচনা করলেন গত ২২ মার্চ কলকতা কফি হাউসের ওপর তলায় “বই-চিত্র” সভাঘরে। ভাবগম্ভীর পরিবেশে অনেকেই স্মৃতিচারণ করলেন নানা দিক থেকে। উদ্যোক্তাদের পক্ষে আলোচনার মুখ খোলেন পবিত্র কুমার সরকার। বিদ্যাসাগর চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি বলেন বিদ্যাসাগর ও সর্বাধিকারী পরিবারের আন্তসম্বন্ধ বিষয়ে। স্মৃতিচারণ করেন কালান্তর সহ সম্পাদক ও শ্রমিক নেত্রী সোনালী বিশ্বাস, প্রখ্যাত ক্যান্সার চিকিৎসক ডাঃ শংকর নাথ, মুকুর সর্বাধিকারী প্রতিষ্ঠিত ডিরোজিও স্মরণ সমিতির স্বর্ণময় মুখোপাধ্যায়, “প্রচেষ্টা” সংস্থার পবন মুখোপাধ্যায়, প্রতিবেশী জয়শ্রী সরকার, বাসুদেব লাহিড়ী এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষে অনিমেষ চক্রবর্তী। বক্তাদের বক্তব্য থেকে মুকুর সর্বাধিকারীর জীবন ইতিহাসের বহু শিক্ষামূলক দিক উঠে আসে, বিশেষত আজকের পশ্চিমবাংলায় ফ্যাসিবাদী শক্তি যখন দখল নিতে আগ্রাসী হচ্ছে তখন তাঁর জীবন থেকে পাওয়া মূল্যবোধকে মানবসমাজে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা সামনে আসে। সঙ্গীত পরিবেশন করেন অরণি খ্যাত অমিতেশ সরকার। কর্মসূচীগত প্রস্তাব রাখেন বিজন মৈত্র। জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখেন পবিত্র কুমার সরকার এবং সেই ভিত্তিতে গঠন হয়েছে কমিটি, স্থির হয়েছে পরবর্তীতে নানা জায়গায় নানাভাবে শতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচী নেওয়া হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্নিগ্ধা সেন।

আজকের প্রজন্মের কাছে বিপ্লবী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠক মুকুর সর্বাধিকারীকে পরিচিত করাতে হবে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। এক শিক্ষিত ও সম্পন্ন পরিবারের সুসন্তান। তাঁর পিতা নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের জনক। পিতামহ ছিলেন ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনের ডীন। তুতো এক দাদা বেরী সর্বাধিকারী ছিলেন ষাটের দশকে খেলার ইংরাজিতে ধারাবিবরণীর প্রখ্যাত ভাষ্যকার। কিন্তু মুকুর সর্বাধিকারী কোনোদিন বংশকৌলীন্য প্রকাশ করতেন না। তাঁর জীবন বয়েছে অন্য খাতে। ১৯৫৫ সাল থেকে গোয়ার মুক্তি আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। তারপরে ১৯৫৬ সালে বাংলা-বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬০-এর দশক থেকে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্মদিন উদযাপন, কবিকে সম্বর্ধনা দেওয়ার রীতি প্রচলন করা, ১৯৬৯ সালে পার্ক সার্কাসে সমাধিস্থলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিফলক স্থাপন, বিনয়-বাদল-দিনেশ বাগ নামকরণের প্রস্তাব উত্থাপন করা, ডিরোজিও স্মরণ সমিতি গঠন, প্রেসিডেন্সী কলেজের বেকার হলের ডিরোজিও নামকরণ; এরকম বহু কাজে বিরামহীন বলিষ্ঠ উদ্যোগী কর্মযোগী পুরুষ ছিলেন মুকুর সর্বাধিকারী। সমঝদার ছিলেন শিল্পকলা-সাহিত্য ও ধ্রুপদী সঙ্গীতের, প্রবল উৎসাহী ছিলেন খেলাধূলোর। সখ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ক্রিকেটার মুস্তাক আলির সঙ্গে।

মধ্য কলকাতার ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের মোট ১৩ বছর যাবত কাউন্সিলর ছিলেন তিনি। প্রাচী সিনেমা হলের অদূরে ১৩-সি ফরডাইস লেনে একটা চৌকি পাতা এক কামরা ঘরে থাকতেন একা, এবং আহার সারতেন নিজের হাতে তৈরী খাবারে, হাত পাখা ছিল সম্বল। স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাতা গ্রহণ করেননি। এমন কষ্টকর জীবন কাটানোর বিরল জনপ্রতিনিধির দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

১৯৬৯ সালে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে আসে বিপ্লবী পরিবর্তন। যতদিন কাউন্সিলর ছিলেন সেই পদের ভূমিকাকে বরাবর ব্যবহার করেছেন জনমুখী সংগ্রাম ও সংস্কারের স্বার্থে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাবে তিনি কাউন্সিলরের পদ ত্যাগ করে বিপ্লবী অন্বেষণে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবী যুবছাত্রদের সংযোগ সেতু। তাঁর ঘর ছিল যুব কর্মীদের গোপন ডেরা। সেই সন্দেহে পুলিশ তাঁকে ১৯৭২ সালে গ্রেপ্তার করে, লালবাজার লক আপে প্রচন্ড অত্যাচার করে, কারাবন্দী করে রাখে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭।

১৯৭৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে তিনি যে কোনো কারণে হোক রাজনৈতিক জীবনে আর ফিরতে পারেননি, তবে নানা প্রগতিশীল উদ্যোগে আগের মতই ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপরে আরও তেরটি বছর বেঁচে ছিলেন। যতদিন বেঁচেছেন মানুষের পাশে থেকেছেন। আজীবন নিরহঙ্কারী থাকা ও পরার্থে নিরলস কাজ করে যাওয়া মুকুর সর্বাধিকারীর কথাকাহিনী অবশ্যই জনারণ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দাবি রাখে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-11