বোধহয় এই প্রথমবার এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে এক দুর্নীতির ‘তদন্ত হবে’ শোনা গেল। তাও আবার মন্ত্রী পর্যায়ে দুর্নীতির। রাজ্য সরকারের বন দপ্তরে সহায়ক পদে নিয়োগ নিয়েই দুর্নীতির অভিযোগ। যে দপ্তরের মন্ত্রী সম্প্রতি মন্ত্রীপদ ও দল ছেড়ে বিজেপিতে গেছেন। প্রশ্ন হল, এই দুর্নীতির অভিযোগ যখন অনেক আগের, তখনই কেন তদন্তের পদক্ষেপ করা হয়নি, উপরন্তু মন্ত্রীপদে রেখে দেওয়া হয়েছিল কেন? দুর্নীতির খবর বাইরে চাউর হয়ে যাওয়ার ভয়ে! ইতিপূর্বে ফাঁস হয়ে যাওয়া সারদা চিটফান্ড ও নারদ ঘুষ খাওয়া নিয়ে তৃণমূল জেরবার বলে! আবার স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয়ে গেলে বেসামাল অবস্থায় পড়তে হবে আরও, চেপে বসেছিল কি সেই আতঙ্ক! দলে যতদিন সমঝোতায় সহাবস্থানের ভারসাম্য থাকছে, ভাঙছে না, ততদিন সব চেপে থাকো, সম্পর্ক ভেঙে গেলে মুখ ছোটাও! এভাবেই কি ‘রাজনৈতিক দিক থেকে সঠিক থাকা’র ঘুঁটির চাল আজ ফাঁস হয়ে যাচ্ছে না!
পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলছুট বনমন্ত্রী। ‘বড়গলা’য় তাঁর দাবি, তিনি ‘নির্দোষ’ এবং কোথা কোথা থেকে আসা কোন্ কোন্ সুপারিশের কারণে তিনি নিয়োগে দলীয় স্বজনপোষণ কার্যকরি করণে বাধ্য হয়েছিলেন, গুছিয়ে রেখেছেন সেসব তথ্য। তিনি মুখ খুললে নাকি তৃণমূলী ‘বটগাছ’ নড়ে যাবে! মুখ্যমন্ত্রী ‘কেচোঁ খুড়তে গেলে নাকি কেউটে বেরোবে’! প্রশ্ন উঠেছে, এতই যদি নৈতিকতার বালাই, বুকের পাটা, তাহলে যখন ‘সুপারিশ’ এসেছিল তখন কেন বিরোধিতায় সরব হননি? মন্ত্রীর স্বীকারোক্তি – মন্ত্রগুপ্তি নিয়েছিলেন বলেই দলে যতদিন ছিলেন মুখ খোলেননি। কি চমৎকার! মন্ত্রগুপ্তির মর্মার্থকে ক্ষমতার ভাগীদারির স্বার্থে কি অবলীলায় দুর্নীতির তথ্য গোপনের আঁতাতের সংস্কৃতিতে পরিণত করা যায়! কিন্তু পরিহসের ঘটনা হল, তারপরেও ভাগ্যের চাকা সশব্দে ফেটে যাওয়া ঠেকানো যায়নি। ক্ষমতার খাস স্বার্থকে কেন্দ্র করে সংঘাতে যখন ভাঙন অনিবার্য হয়েছে, পাশাপাশি কথা পাকা হয়েছে বিজেপিতে ভিড়ে যাওয়ার, আর নির্বাচনের পরিস্থিতি আসন্ন, তখন দল ছাড়া বা বহিস্কৃত হওয়া নেতারা আর অপেক্ষায় থাকেননি তৃণমূলকে কামড়াকামড়িতে লিপ্ত হতে। তাদের কাছে কোনো অসঙ্গত নয় এই খেয়োখেয়ির রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
অন্যদিকে, দলত্যাগী তৃণমূলী নেতাদের বিজেপি যত দলে ঢোকাচ্ছে, তত লেলিয়ে দিচ্ছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ব্যবহার করছে কত কি করতে হবে সেই প্রমাণ দিতে। তাছাড়া বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কাউকে পুরছে গারদে, কাউকে পাইয়ে দিচ্ছে জামিন। নয়া তৎপরতায় নামাচ্ছে নানা ইডি-সিবিআই তল্লাশী। তৃণমূলের উত্তরপ্রদেশীয় এক প্রাক্তন রাজ্যসভা সদস্যকে আচমকা গারদে পোরা হল, নারদ কান্ডের তথ্য বার করার হাবভাব দেখাতে। তার পরপরই রোজভ্যালি চিটফান্ড কেলেঙ্কারীতে ভুবনেশ্বর জেলে বন্দী করে রাখা একদা তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এক টলিউড প্রযোজককে পাইয়ে দেওয়া হল জামিন। কিছুদিনের মধ্যেই গ্রেপ্তার করা হল একদা টলি-অভিনেত্রী তথা রোজভ্যালি মালিকের স্ত্রীকে, যাঁর সাথে তথ্য লোপাটে সাহায্যকারী এক ইডি অফিসারের যোগসাজশ থাকার তথ্য আছে দাবি করেছিল সিবিআই। প্রযোজক সাহেবকে ফাটক থেকে বার করার পেছনে বিজেপির রয়েছে অন্য সমীকরণ, তাকে টলিউডে গেরুয়া শিবির বানাতে ব্যবহার করা। মেদিনীপুরের ‘অধিকারী জমিদারীর’ মেজো যুবরাজ এক টেলি-মিডিয়ায় ‘ঘন্টাখানেক’ সাক্ষাতে বুক বাজিয়ে দাবি করলেন ২০১১-র নির্বাচনে ঢালা হয়েছিল সারদার টাকা। প্রার্থী পিছু দেওয়া হয়েছিল সত্তর লাখ করে। ঐ পদত্যাগী পরিবহনমন্ত্রী তথা ‘বিদ্রোহী’ নেতার কথা হল, সেই তদন্ত ঠিকঠাক করতে হলে ক্ষমতায় পরিবর্তন আনা চাই! প্রাক্তন বনমন্ত্রী থেকে শুরু করে গেরুয়া ঘরে ঢোকা আধা নাম ফাটানো নেতা-ফেতা সবারই মুখে এক বুলি! তৃণমূল আমলে সমস্ত দুর্নীতির তদন্ত করতে হলে বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা দরকার। পাশাপাশি শুরু হয়েছে একের পর এক গোয়েন্দা হানা। গরু পাচার, কয়লা পাচার, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী ঘটানো কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারের কারবারের তালাশের কারণ দেখিয়ে। তার সাথে গোপনে জড়িত সন্দেহে শাসকদলের নেতাগুচ্ছ সমেত পুলিশ অফিসার ও সরকারী আমলাদের খোঁজে। বিজেপিতে যোগ দেওয়া কালনার তৃণমূল ছুট এক চাঁই প্রকাশ্যে কবুল করলেন, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘটেছে ‘টেট’ কেলেঙ্কারী। দুর্নীতি হয়েছে দু’ভাবে – কিছু স্বজনপোষণের কোটায়, কিছু কাটমানির বিনিময়ে। দল দুষছে দলত্যাগীকে, দলত্যাগী দুষছে দলতন্ত্রকে। যত হচ্ছে পর্দা ফাঁস, তত চড়ছে চাপান উতোর। সিবিআই নাকি আবার সারদা তদন্তের ফয়সালা করতে তৃণমূল ভাঙার পয়লা নম্বরের মূল পান্ডাকে ‘রাজসাক্ষী’ করতে চায়! এই সবের লক্ষ্য বিজেপির সপক্ষে ‘সাধুতা’র মোহ বিস্তার করা। তবে সিবিআইয়ের উপরোক্ত দাবি মানা বিজেপির পক্ষে এই নির্বাচনী বাজারে কিছুতেই সম্ভব নয়। যে রাজনৈতিক জুয়াখেলায় বিজেপি নেমেছে, তার জেরে পড়ছে উভয় সংকটে। নিজের বৃদ্ধির স্বার্থে তৃণমূলের ঘর ভাঙানো ডাকাবুকো নেতাদের নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই, অথচ বহিস্কৃত সেইসব তৃণমূল নেতাদের কেউই দুর্নীতির দূর্গন্ধমুক্ত নন। এইসব নেতা-আধা নেতাদের অন্তর্ভুক্তির সাফাই দিতে তিলক কাটা নেতারা চালবাজীর ধরণ-ধারণেও পাল্টি খাচ্ছেন। প্রথম প্রথম বলতেন, ‘আইন আইনের পথে চলবে’। আর এখন বলছেন, ‘বিজেপিতে এসেছে বলেই দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে যত দোষ’। স্বাভাবিক ভাবেই এটা একরকম সংকটদীর্ণ অবস্থা।তৃণমূল আমলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাঁকে জড়ানোর অভিযোগের যথেষ্ট বাস্তবতা আছে। তবে এ প্রসঙ্গে বিজেপির তুলনা একমাত্র বিজেপি। একটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল ডুবেছে দুর্নীতির পুকুরে। অন্যদিকে, কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি ডুবেছে দুর্নীতির সাগরে। মধ্যপ্রদেশে ‘ভ্যাপম’ (মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত) কেলেঙ্কারী, তার তদন্ত চাপা দিতে প্রায় অর্ধশত হবু সাক্ষীদের গুম করে দেওয়া, কর্ণাটকে খনি বন্টণ কেলেঙ্কারী, ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা ‘ঋণ নেওয়ার’ নামে বিদেশে পাচার হতে দেওয়া, পাচারকারী কুবেরদের প্রশ্নে রহস্যপূর্ণ ‘মোদী-মোদী’ সম্পর্ক থাকা, রাফাল কেলেঙ্কারী, মোদীর ‘পি এম কেয়ারস্’ ফান্ডকে ক্ষমতার জোরে হিসাব বহির্ভূত করে রাখা ইত্যাদি আরও নমুনা রয়েছে। বিশেষ করে এই যে এত ঘটা করে আম্বানী-আদানি-কোম্পানিরাজ ডেকে নিয়ে আসা, এর পিছনেও ‘কাটমানি-কমিশন’-এর গোপন লেনাদেনার আঁতাত না থেকে পারে! তাই বিজেপি ‘বাংলায় ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির প্রকৃত তদন্ত হবে’ – এটা একটা ছদ্মবেশী প্রচার মাত্র। এরাজ্যের ছোটবড় যে কোনো দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারীর তদন্ত ও বিচার নিশ্চয় চাই, নতুন করে দুর্নীতি যাতে মাথা তুলতে না পারে সেই চ্যালেঞ্জও রাখতে হবে, থাকতে হবে লড়ে বিহিত আাদায় করার সংকল্প। কিন্তু কোনোভাবেই বিজেপিকে তার সুযোগ নিতে দেওয়া যায় না। কারণ, বিজেপি সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত।