গত ৩০ অক্টোবর সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি এক প্রেস বিবৃতিতে বলে, রাজ্যে নারী সুরক্ষার বিষয়টি আজ অর্থহীন হয়ে পড়েছে। নারীদের উপর লাগাতর যৌন হিংসা, গণধর্ষণ, খুন বেড়েই চলেছে। আইনের শাসন শিকেয় উঠেছে। মা-বোনেরা আজ সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন। শিশুকন্যা, নাবালিকা, গৃহবধূ, সব বয়সের নারীরা কেউই মানুষরূপী হায়নার হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না। এমনকি নব্বই বছরের বৃদ্ধাও গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। দশমীর রাতে এক প্রতিভাবান মহিলা বাউল শিল্পীকে যেভাবে যৌন হেনস্থা করা হয়েছে এবং তাঁর সম্ভ্রম নিয়ে হায়নার দলের পৈশাচিক উল্লাস সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হতে দেখে রাজ্যের মানুষ ভয়ে আঁতকে উঠেছেন। একে সাধারণত আমরা একটি সামাজিক ব্যধি হিসাবে দেখি। কিন্তু তার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত রয়েছে চলমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা। পুঁজিবাদী কর্পোরেটমুখী অর্থনীতিতে নগ্ন নারীদেহকে আজ যেমন পণ্য হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনি তার সাথে যুক্ত হয়েছে মধ্যযুগের মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক দর্শন ও মূল্যবোধ। যাতে নারীর স্থান পুরুষের নীচে। নারী সর্বকালের পরাধীন, ভোগ্য পণ্য, সন্তান উৎপাদনের মেশিন। তাই মনুবাদীদের মডেল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে একের পর এক উন্নাও কান্ড, গিরিরাজ কান্ড, হাথরাস কান্ড আমরা দেখতে পাচ্ছি। ধর্ষণকারীদের পক্ষে দল ও সরকার সরাসরি পক্ষ নেয় ও মদত যোগায়। তাই যোগীরাজ জঙ্গলরাজে পরিণত হয়েছে।
ঠিক একইভাবে ত্রিপুরায় আরএসএস-বিজেপি আশ্রিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী উন্মাদ ও সমাজবিরোধীদের সরকার ও পুলিশ প্রশাসন সরাসরি মদত দিচ্ছে। ফলে সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংবিধান ও আইনের শাসন ভেঙ্গে পড়েছে। নারীদের উপর পৈশাচিক যৌন হিংসায় যুক্ত আসামীরা গ্রেপ্তার হয় না। লোক দেখানো গ্রেপ্তার করা হলেও সরকারী মদতে জামিন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে যায়। আদালতে আইনজীবিরা আক্রান্ত হচ্ছেন। পুলিশের উপরমহলের চাপে তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিক আদালতে আসামীর বিরুদ্ধে ফরোয়ার্ডিং জমা দিতে পারেন না। কে কি খাবে? কে কি পড়বে? কে কাকে বিয়ে করবে? আইনজীবীরা কে কোন মামলায় আসামী পক্ষে পেশাগত কাজ করবে? তা পর্যন্ত ঠিক করে দেবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের ঠিকাদারেরা। সরকারী অফিসে, আদালতে, থানায়, সব ক্ষেত্রে সমাজবিরোধীদের অবাধ দৌরাত্ম কায়েম হয়েছে। আমরা নাগরিকের অধিকার হারিয়ে আজ প্রজা হয়ে পড়েছি। নাগরিক অধিকার বিপন্ন। মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ, সভা, সমিতি করার অধিকার নেই।
বিরোধী দলের কর্মীদের উপর প্রতিদিন দুর্বৃত্তদের হামলা, সন্ত্রাস চলছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হুমকির মুখে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা আক্রান্ত। প্রেস ক্লাবের নির্বাচন ঘিরে নজিরবিহীন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। পুলিশ ও গুন্ডা দিয়ে সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে বলে প্রকাশ। গণতন্ত্রের প্রতিটি স্তম্ভ আজ আক্রান্ত ও বিপন্ন। মনুবাদের মডেল রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মতো গুন্ডারাজ ও পুলিশরাজ কায়েম করা হচ্ছে ত্রিপুরায়। আরএসএস-বিজেপি ত্রিপুরাকে উত্তরপ্রদেশ বানাতে চায়। কিন্তু তা কখনো সফল হবে না। কারণ বিহারের ছাত্র-যুবরা ও সাধারণ জনগণ এবার ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক মহাজোট গঠন করে বিহারের বুক থেকে বিশ্বাসঘাতক নীতিশ কুমার ও মনুবাদী বিজেপির অপশাসনকে ছুঁড়ে ফেলার সংকল্প গ্রহণ করেছে। বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এবার রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিকাশে মুখ্য ইস্যু যেমন সবার জন্য রোজগার, জনস্বাস্থ্য, সর্বজনীন শিক্ষা ও অন্যান্য জ্বলন্ত ইস্যুর উপর নির্ভরশীল সামাজিকভাবে নতুন গতিশীলতায় প্রথাগত জাতপাত, ধর্মীয় বিভাজন ভিত্তিক মেরুকরণের রাজনীতি স্থান পায়নি। বিজেপি তার রাজনৈতিক এজেন্ডাই সেট করতে পারেনি। এনডিএ জোট ভেঙ্গে পড়েছে। এই রাজনৈতিক শিক্ষা উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও সারা দেশের মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তাই নারীদের সুরক্ষা আজ সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুরক্ষার সাথে যুক্ত। তাই গণতন্ত্রপ্রিয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের এই সমাজবিরোধী দুর্বৃত্ত রাজ, পুলিশ রাজ ও মনুবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং একে পরাস্ত করতে হবে। সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রাজ্যে পুন:প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।