মাস তিনেক আগে ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষের শেষ ত্রৈমাসিক ও সামগ্রিক বর্ষের দেশের আভ্যন্তরীণ আয় উৎপন্ন (জিডিপি) সংক্রান্ত তথ্য সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ওই ত্রৈমাসিকের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৩.১%, এবং পুরো বছরের বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪.২%। এগারো বছর আগে গত ২০০৮-২০০৯ সালের ৪র্থ ত্রৈমাসিক ও ওই বছরে সামগ্রিক বৃদ্ধি হার ছিল যথাক্রমে ০.২% ও ৩.৯%; তারপরে এই প্রথম ভারতীয় অর্থনীতির এমন দুরবস্থা হল। মনে রাখা দরকার ২০০৮-০৯ সাল ছিল বিশ্বজোড়া মন্দার বছর, যাকে গ্রেট ফিনান্সিয়াল ক্রাশ বলে অভিহিত করা হয়। অনেকে যদিও গত ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির শ্লথতার কারণ হিসেবে দেশের লকডাউনকে দায়ী করতে চাইছেন, তাদের মনে রাখতে হবে লকডাউন ওই সময়ে মাত্র এক সপ্তাহ চলেছিল। তাছাড়া ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হারের বিপরীতমুখি যাত্রা যে কেবল ২০১৯-২০ সালের শেষ ত্রৈমাসিকেই ঘটছে এমন নয়, ক্রমান্বয়ে তা গত ৮টি ত্রৈমাসিক ও দু বছর ধরে ঘটে চলেছে। যদিও পরিসংখ্যান নিবন্ধকে ভারী করে তোলে তবুও জিডিপি বৃদ্ধির শ্লথতাকে প্রতীয়মান করে তুলতে ১২টি ত্রৈমাসিক ও তিনটি বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হারকে একটি তালিকায় তুলে ধরলাম।
তালিকা-১ : ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত ত্রৈমাসিক ও বৎসরের জিডিপি বৃদ্ধির হার
লক্ষ্যণীয় যে ২০১৭-১৮ সালের জানুয়ারী মার্চের ত্রৈমাসিক পর্যন্ত ৪টি ত্রৈমাসিক (২০১৬-১৭ সালের শেষ ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৩%) বৃদ্ধির হার ক্রমাগত বেড়েছে। অবশ্য সেটা অনেকটাই মনে হয় তথ্যের কারচুপি, কারণ ওই সময়ে নোটবাতিল দেশের অর্থনীতিতে যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি তা দেখাতে দেশের রাজাধিরাজ মরিয়া ছিলেন ও পারিষদেরা তাকে তোষামোদে খুশি করেছিল। কিন্তু তারপরে ৮টি ত্রৈমাসিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নীচের দিকে নেমেছে। সেই হিসেবেও যে গরমিল আছে তাও বলাই বাহুল্য। মোদি সরকারের প্রথম অর্থনৈতিক মুখ্য উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামনিয়ানও তেমনটাই বলেছেন এবং দ্বর্থ্যহীন ভাষায় জানিয়েছেন সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় বৃদ্ধির হার প্রায় ২.৫% কম। এই যে জিডিপির বৃদ্ধির হারের ক্রমাগত কমতে থাকা তা দেশের অর্থনীতির মন্দার দিকে যাত্রার ইঙ্গিত অবশ্যই দিচ্ছে। কেবল তাই নয়, ২০১৮-১৯এর প্রথম ত্রৈমাসিক থেকে ২০১৯-২০ সালের শেষ ত্রৈমাসিক পর্যন্ত ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রের বৃদ্ধি ক্রমাগত কমছে। এবং গত তিনটি ত্রৈমাসিকে তা ঋণাত্মক, অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে উৎপাদন কমেছে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রের শিল্পগুলির দিকে তাকালে অর্থনীতির ছন্নছাড়া অবস্থা আরো প্রকট হচ্ছে। ওই ক্ষেত্রটি ৮টি শিল্প নিয়ে গঠিত -- কয়লা, অপরিশোধিত পেট্রোল, প্রাকৃতিক গ্যাস, শোধনাগারের উৎপাদন, সার, সিমেন্ট, ইস্পাত ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। মূল ক্ষেত্রটির গত এক বছরের মাসিক বৃদ্ধির হার নিয়েও একটি তালিকা দেওয়া হল। মনে রাখতে হবে বৃদ্ধির হার ধনাত্মক ও হ্রাসের হ্রার ঋণাত্মক, এবং উভয় হারই গত বছরের সংশ্লিষ্ট মাসের উৎপাদনের নিরিখে। অর্থাৎ জুন ২০২০-র -১৫% বৃদ্ধির অর্থ হল গত বছরের জুন মাসে যা উৎপাদন হয়েছে তার তুলনায় এ বছরের জুন মাসে ১৫% কম উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ, গত জুনে উৎপাদন ১০০ হলে এই জুনে উৎপাদন হয়েছে ৮৫। ওই হিসেবে দেখা যাবে (তালিকায় নেই) ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে মূল ক্ষেত্রের শিল্পগুলির কোনো বৃদ্ধিই হয়নি। আর ২০১৯এর এপ্রিল-জুনের তুলনায় ২০২০র এপ্রিল-জুনে উৎপাদন ২৪.৫% কমেছে। এবছরের এপ্রিল-জুনের ৩ মাসে ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদন ভয়াবহ কমেছে। ইস্পাত উৎপাদন গত বছরের তুলনায় অর্ধেকের কম হয়েছে, সিমেন্টের ক্ষেত্রে সেই কমতি ৪০%।
তালিকা-২ : জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত পরিকাঠামো ক্ষেত্রের (কোর সেক্টর) উৎপাদন বৃদ্ধির হার
যদিও অতিমারি ও লকডাউন জিডিপিকে যথেষ্ট ব্যাহত করছে কিন্তু বহু আগে থেকেই যে অর্থনীতি গতি মন্থরতায় ভুগছিল তা বোঝাই যাচ্ছে। যদি শ্রমজীবি মানুষের অবস্থার দিকে তাকানো যায় তাহলেও তা বেশ প্রকট হবে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০১৮-১৯ সালের তথ্য জানিয়েছিল যে বেকারির হার ৪৫ বছরের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল। অতিমারি সেই দুর্ভোগকে আরো বাড়িয়েছে, সিএমআইই-র তথ্য অনুসারে তা এখন ৮%-কে ছাড়িয়েছে, আর গত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত ১ কোটি ৯০ লক্ষ বেতনভোগি চাকুরিজীবি চাকরি হারিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০১৭-১৮ সালের যে সমীক্ষা সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি কিন্তু ছিদ্রপথে বেরিয়ে পড়েছে তার তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণ ভারতে ২০১১-১২ সালের তুলনায় মাথাপিছু প্রকৃত ভোগব্যয় ২০১৭-১৮ সালে, ৬ বছরে প্রায় ৯% কমেছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা ও খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১.৬% ও ১.৮%। তেমন খুব একটা তফাৎতো নয়। তাহলে গ্রামীণ ভারতের এতবড় জনসংখ্যার মাথাপিছু ভোগব্যয়ে এত বড় হ্রাস হল কেন?
কিন্তু বছরের পর বছর ভারতের খাদ্য নিগম (এফসিআই)-এর খাদ্যশস্য সংগ্রহের অনুাপাত (মোট উৎপাদনের নিরিখে) বাড়ছে এবং ২০০৮এর বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটের পরে তা অতি দ্রুত বাড়ছে। ওই অনুপাত ১৯৯১ সালে ছিল ১২.৭%, ২০১৭-তে তা বেড়ে ২৯.৬% হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সেই অনুপাতের গড় ছিল ২২.৪%, ২০১১ থেকে ২০১৭ এই ৬ বছরে গড় হয়েছে ২৮.৫%। কেবল তাই নয়, এফসিআইএ’র গুদামে পণ্যের ভাণ্ডারও বেড়েছে বছর বছর। যেমন ২০১৭-র জুন থেকে ২০২০-র জুন পর্যন্ত সেই ভাণ্ডার ছিল যথাক্রমে ৫৫৭ লক্ষ, ৬৮১ লক্ষ, ৭৪৩ লক্ষ ও ৬৩৫ লক্ষ মেট্রিক টন। উৎপাদনের তুলনায় ভাণ্ডার অতি দ্রুত বেড়েছে এবং প্রতি ক্ষেত্রেই জুনের ভাণ্ডার সেই বছরের উৎপাদনের তুলনায় ২৫% বেশি। ১৯৯০এর দশকের শেষেও তা ১৫% বেশি ছিলনা। এরমানে বাজারে একটি ‘আপাত’ অতিরিক্ত জোগান রয়েছে, অর্থাৎ যথেষ্ট চাহিদা নেই, যার ফলে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য কিনতে চাইছে না। সরকার শস্য ভাণ্ডার বজায় রাখতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতিতে খাদ্যশস্যের এরকম কম চাহিদার কারণ কী যখন জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ও খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির হারের মধ্যে তেমন তফাৎ নেই?
নয়া উদারনীতির ফলে যখন দ্রুত হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হচ্ছে তখন খাদ্যশস্যের চাহিদারও দ্রুত হারে বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল। একটা ছেঁদো যুক্তি দেওয়া হয় যে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটছে বলেই এমনটা হচ্ছে। খাদ্যশস্যের চাহিদার ধরণের পরিবর্তন হতে পারে; প্রক্রিয়াকৃত খাদ্যশস্য যেমন, বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, নুডলস, পাস্তা, ম্যাকারনি ইত্যাদি বা প্রাণীজ খাদ্য, দুধ, ডিম বা মাংসের ভোগ চাহিদা বাড়তে পারে, কিন্তু সেইসব দ্রব্য প্রস্তুতের জন্য এমনকি প্রাণীজ খাদ্যের জন্যও পরোক্ষ ভাবে খাদ্য শস্যের চাহিদা বাড়বে, যদি জীবনযাত্রার মান বাড়ে। ফলে মাথাপিছু খাদ্য শস্যের চাহিদা বাড়ার কথা। যেহেতু মাথাপিছু খাদ্যশস্যের উৎপাদন তেমন একটা বাড়েনি তাই দেশে ধারাবাহিক ভাবে অতিরিক্ত চাহিদা থাকার কথা। তাতো হয়ই নি, ভারত বিদেশে খাদ্যশস্যের নীট রফতানিকারক রয়ে গেছে। এই বৈপরীত্যের কারণ হল যে, যদিও নয়া উদারনীতির ফলে জিডিপি দ্রুত বেড়েছে শ্রমজীবি জনতার মাথাপিছু আয় বাস্তবে তেমন কিছু বাড়েনি, হয়তো বা সাম্প্রতিক কালে কমেছে, যখন খাদ্যশস্যের সরকারী ভাণ্ডার দ্রুত বেড়েছে।
১৯৯১ সালে মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল ৫১০ গ্রাম, ২০০৭ সালে ছিল ৪৪৩ গ্রাম, ২০১৮ সালে ৪৯৪ গ্রাম। নয়া উদারনীতির জমানায় অসাম্য প্রভূত বেড়েছে, ফলে ধনীর মাথাপিছু খাদ্যশস্যের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভোগের পরিমাণ বেড়েছে। তাই, শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব মাথাপিছু ভোগ কমেছে। যেহেতু ধরা যেতে পারে আয় বাড়লে খাদ্যশস্যের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভোগের যোগফল বাড়ে, কমলে কমে; তাই শ্রমজীবী জনতার মাথাপিছু বাস্তব আয় কমেছে। উদারনীতির সময়ের দুটি এনএসএসও তথ্য, ১৯৯৩ ও ২০১১-১২ সালে, এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিতই করেছে। ওই সময়ের মধ্যে ২২০০ ক্যালরি প্রতিদিন ভোগ করতে অক্ষম গ্রামীণ জনগণের অনুপাত ৫৮% থেকে ৬৮% হয়েছে; এবং ২১০০ ক্যালরি প্রতিদিন ভোগ করতে অক্ষম শহুরে জনগণের অনুপাত ৫৭% থেকে বেড়ে ৬৮% হয়েছে। মনে রাখা দরকার গ্রামে ২২০০ ক্যালরি প্রতিদিন ও শহরে ২১০০ ক্যালরি প্রতিদিনের সংস্থান দারিদ্র সীমা হিসেবে নির্ধারিত হয়। ২০১১-১২-র পরে অবস্থাটা পাল্টায়নি বলেই মনে হয়। কারণ প্রাপ্যতা বাড়লেও সরকারী ভাণ্ডারও আরো দ্রুত বেড়েছে।
নীতি আয়োগের তথ্যও তেমনটাই জানাচ্ছে। নীতি আয়োগের তথ্য বলছে যে, ২০১৮ সালের তুলনায় ভারতের দারিদ্র বেড়েছে, কারণ দারিদ্র দূরীকরণের যে ভিত্তিসূচক ২০১৮ সালে ছিল ৫৪, তা ২০১৯এ কমে ৫০ হয়েছে। ২২টি রাজ্য কিংবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সেই সূচক কমেছে (অর্থাৎ দারিদ্রের তীব্রতা বেড়েছে) সেগুলির মধ্যে সূচকের হ্রাস সব থেকে বেশি হয়েছে অরুণাচল প্রদেশে ১৮, বিহার ও ওড়িষায় ১২। ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই সংক্রান্ত সূচকেরও গতি নিম্নাভিমুখী। ফলে অভুক্ত অর্ধভুক্তের সংখ্যাও বেড়েছে। সূচকটি ৪৮ থেকে কমে ৩৫ হয়েছে: ছত্তিশগড়ে সূচকটি কমেছে ১৯ পয়েন্ট, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও কর্নাটকে ১৭ পয়েন্ট। আর্থিক বৈষম্যের সঙ্গে লড়াই-এর সূচকটিও সারা দেশে ৭ পয়েন্ট কমেছে। ২৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সূচক কমেছে। ত্রিপুরায় তা ৪৪ পয়েন্ট কমেছে, গুজরাটে ২০ পয়েন্ট কমেছে। আর্থিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে বহুচর্চিত অক্সফ্যামের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনটিও দেশে তুমুল আর্থিক বৈষম্যের অবস্থা তুলে ধরেছে। ২০১৭ সালে সৃষ্ট সম্পদের ৭৩% দখল করেছে ১% ধনীতম ব্যক্তিরা। দেশের ৭৭% সম্পদের মালিক ১০% ধনীতম ব্যক্তিবর্গ। অপরদিকে ৫০% দরিদ্রতমদের ভাগে পড়েছে সৃষ্ট সম্পদের ১%। ২০০০ সালে ভারতে শতকোটিপতি (বিলিয়নেয়ার)দের সংখ্যা ছিল ৯ জন; ২০১৭-তে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০১ জন। শতকোটিপতিদের সম্পদ ওই সময়কালে ১০গুণ বেড়েছে, এবং তাদের সামগ্রিক সম্পদ ২০১৮-১৯ সালের বাজেট বরাদ্দ ২৪ লক্ষ ৪২ হাজার ২২০ কোটি টাকার থেকে বেশি। অন্যদিকে কেবল স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় করতে গিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ২ জন মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছে।
সামগ্রিকে বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ভাল নেই। গত কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতিকে সামাল দিতে পারছে না শাসকেরা। উপরন্তু কোভিড ও লকডাউন সংক্রান্ত অদূরদর্শিতা ও অগণতান্ত্রিক নীতি দেশের জনগণের কাছে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। আত্মনির্ভরতার শ্লোগানের আড়ালে দেশের সরকারী সম্পদকে ব্যক্তি মালিকদের হাতে তুলে দিতে চাইছে সরকার। দোহাই দেওয়া হচ্ছে সরকারি ক্ষেত্রের অলাভজনক হওয়ার। কিন্তু তথ্য বলছে যে, প্রায় সাড়ে তিনশ কেন্দ্রীয় সরকারী উদ্যোগের মধ্যে কেবল গোটা ষাটেক লোকসান করেছে। সব মিলিয়ে ২০১৮-১৯ সালে নগদ লোকসান করেছে ২৩,৩৯৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে লাভজনক সংস্থাগুলি লাভ করেছে ১,৭৪,৫৮৭ কোটি টাকা। কেবল তাই নয়, সমস্ত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা মিলে কর, লভ্যাংশ মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষে তুলে দিয়েছে ৩,৬৮,৮০৩ কোটি টাকা। ওই সংস্থাগুলিতে কাজ করেন ১০.৩ লক্ষ কর্মচারি ও শ্রমিক, যাদের মধ্যে ১.৮১ লক্ষ তফশিলি জাতি, ১.০২ লক্ষ তফশিলি উপজাতি ও ১.৯৭ লক্ষ অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষ। আত্মনির্ভরতার নামে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের শিল্পগুলিকে যদি ক্রমাগত ব্যক্তিমালিকদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়, তাহলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বে অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পশ্চাদপদ শ্রেণীর মানুষদের জন্য সুযোগ আরো সঙ্কুচিত করা হবে।
যেহেতু স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় অর্থনীতি যাত্রা শুরু করেছিল পরিকল্পিত ধাঁচায় সমাজতন্ত্র কায়েম করার লক্ষ্যে ও মাঝপথে সেই লক্ষ্য পরিত্যাগ করে নয়া উদারনীতির বাজারি ব্যবস্থায় পা বাড়িয়েছে, আর বর্তমান সরকার সেই কর্পোরেট নির্ভর ‘আত্মনির্ভরশীল’ ভারত গড়তে কোভিড১৯-কে ধূর্ততার সঙ্গে কাজে লাগাচ্ছে, তাই প্রয়োজন সাম্প্রতিক অর্থনীতিকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালের নিরিখে যাচাই করা। সেই অর্ধসমাপ্ত বা অনান্তরিক অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও তার ফলাফলকে নিয়ে আলোচনা করেই মোদির আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির ধোঁকাবাজিকে উন্মুক্ত করা যেতে পারে। সেই লক্ষ্যে আলাপ আলোচনা, নিবন্ধ প্রবন্ধ, তর্ক-বিতর্কের অপেক্ষায় থাকলাম।
তথ্যসূত্র :
১) “অ্যানুয়াল এস্টিমেটস এন্ড কোয়ার্টারলি এসটিমেটস অফ জিডিপি অ্যাট কনস্টান্ট (২০১১-১২) প্রাইসেস”, মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিসটিকস এন্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন।
২) “ইনডেক্স অফ এইট কোর ইন্ডাসট্রিজ (বেস-২০১১-১২) ফর জুন ২০২০”, প্রেস রিলিজ বাই অফিস অব ইকোনোমিক এ্যাডভাইজার, ডিপার্টমেন্ট ফর প্রোমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রি এণ্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড, গভার্নমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া
৩) “ফুড কনজাম্পশন ট্রেণ্ডস পয়েন্ট এ্যাট রিয়াল ইনকাম ডিক্লাইন বিফোর প্যানডেমিক”, প্রভাত পট্টনায়েক ইন নিউজ ক্লিক,
১ আগস্ট ২০২০
-- অমিত দাশগুপ্ত