আজকের দেশব্রতী : ২৭ আগস্ট ২০২০ -- (অনলাইন সংখ্যা)
hd

এর ঠিক উপরে অনলাইন সংখ্যায় ক্লিক করুন প্রত্যেক লেখার আলাদা ফাইল পাওয়া যাবে
(যে কোনো লেখার হেডিং-এ ক্লিক করলে নির্দিষ্ট লেখাটিও খুলবে)

 

handlcok

পাঁচ মাস হয়ে গেল লকডাউন-আনলকের অবিরাম প্রক্রিয়া চলছে। লকডাউন বলবৎ রাখতে কত অর্থনৈতিক মূল্য চোকাতে হচ্ছে তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হল। অর্থনীতির গতি এমনিতেই মন্থর হয়ে আসছিল, এখন লকডাউনের ফলে সরাসরি সংকোচন শুরু হয়েছে যা প্রান্তিক মানুষদের কাছে বেঁচে থাকার সংকট হিসেবে নেমে আসছে।

এর সঙ্গে, কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বেড়ে চলা স্বাস্থ্য সংকট, ভয়, উদ্বেগ এবং সামাজিক অস্পৃশ্যতার বিষয় যুক্ত হয়ে, আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে এক গভীর সামাজিক ও মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু সেই বিপর্যয়ের অন্তরালে চুপিসারে ঘনিয়ে আসছে আরও এক বিপজ্জনক সংকট – ভারতীয় গণতন্ত্রের সংকট।

অর্থনীতির মতোই গণতন্ত্রও বিগত কয়েকবছর ধরে নিরন্তর আক্রমণের মুখে। গণতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তিকে কার্যনির্বাহী বিভাগ ক্রমাগত প্রহসনে পর্যবসিত করে চলেছে এবং বিধানিক ও বিচার বিভাগীয় অঙ্গ তাকে নিয়ন্ত্রণের কোনও সদর্থক ইচ্ছা বা সক্ষমতা দেখাচ্ছে না। রাষ্ট্রের পীড়নমূলক হাতিয়ারগুলি প্রতিবাদকে এমনভাবে অত্যাচারিত করছে যা দেখলে আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভুরাও গর্ববোধ করতেন।

গণতন্ত্র এখন লকডাউন মোডে চলে গেছে। কাশ্মীরে দীর্ঘদিন ধরেই এই মোড স্থায়ী ছিল, এবং শেষ এক বছরে তা ঘোষিতভাবেই আছে, এখন গোটা দেশ জুড়েই ছড়িয়ে গেছে এই লকডাউন। এই লকডাউন মোডে সংসদে আলাপ আলোচনা বা পর্যালোচনা ছাড়াই বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি মন্ত্রীসভা, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে যেভাবে ঘোষিত হচ্ছে তা সংসদকে এক প্রতীকসর্বস্ব বাহুল্যে পর্যবসিত করার হুমকির মুখে এনে ফেলেছে ।

প্রতিবাদ ও অভিযোগ জানানোর স্বাভাবিক রাস্তাগুলিও এই লকডাউন মোডে বন্ধ। সাধারণ জনগণকে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার অনুশীলন থেকে আটকে রেখে রাষ্ট্র এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছে মানুষকে গৃহবন্দী বা কারাবন্দী করে, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে, বিরোধিতার 'অপরাধের' শাস্তি প্রদানের জন্য।

সরকার ইতিমধ্যেই এক আগ্রাসী বেসরকারীকরণ অভিযানের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে যা “আত্মনির্ভর ভারত”-এর ছদ্মবেশে কর্পোরেটদের সামনে খুলে দেবে গোটা অর্থনীতির দরজা, একাধিক রাজ্য সরকার শ্রমিকের জরুরি অধিকারগুলিকে সংকুচিত করছে, পরিবেশ মন্ত্রক পরিবেশ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতি পর্যালোচনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মতামত গ্রহণকেই নাকচ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, কৃষি উৎপাদন ও তা বাজারজাতকরণের সমগ্র প্রক্রিয়ার ওপর কর্পোরেটদের নিরঙ্কুশ কব্জা কায়েম করতে একটার পর একটা অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, এবং একটি নতুন শিক্ষা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে যা শিক্ষায় প্রবেশ ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করার বদলে শিক্ষা জগত থেকে ছাত্রছাত্রীদের বেরিয়ে যাওয়া ও বহিস্কার করার রাস্তা খুলে দেবে।

কোভিড-১৯ প্রতিহত করবার প্রোটোকল অনুযায়ী সকল প্রকার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জমায়েত নিষিদ্ধ। অথচ অযোধ্যায় ভূমি পূজনে গিয়ে যোগ দিল সরকার। একে সরকারি অনুষ্ঠানে পরিণত করা হল এবং এই প্রথমবার একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ঊর্দ্ধে তুলে ধরার শপথ নিয়েছেন তিনি গেলেন একটি মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে।

গুরুতর শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত যেসব বয়স্ক নাগরিক জেল বন্দী রয়েছেন (যেমন ভারাভারা রাও, জি এন সাইবাবা, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ – অনেকের মধ্যে চারটি নাম) তাঁদের মুক্তি দেওয়ার বদলে আরো তিনজন শিক্ষাবিদ ও লেখককে (আনন্দ তেলতুম্বড়ে , গৌতম নভলাখা, হানি বাবু) গ্রেপ্তার করা হয়েছে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় এবং আরো অনেকের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, যদিও ঘটনার প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীরা শাস্তি পাওয়ার বদলে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

একইভাবে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হিংসার সমগ্র তদন্তকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে পর্যবসিত করা হয়েছে। যেসব বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে হিংসা উসকেছিল তারা তদন্তের আওতার বাইরে, আর গ্রেপ্তারি ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, শিক্ষাবিদ ও সুপরিচিত রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের।

এই সময়কালে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলিতে সাধারণ মানুষকে চরম অন্যায়ের শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করতে পারত। ভারতের পরিযায়ি শ্রমিকদের যে নির্মমতার শিকার হতে হল, লকডাউনের মধ্যে যেভাবে পুলিশের নৃশংস আঘাতের মুখে পড়ল অসহায় মানুষ, ইউপি পুলিশের ঝুটা সংঘর্ষ-হত্যার মনগড়া কাহিনী — এসব প্রশ্নে আমরা সুপ্রীম কোর্টকে মুখ খুলতে দেখিনি, কিন্তু জনস্বার্থ রক্ষাকারী বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের দুটো ট্যুইটে সেই সুপ্রিম কোর্টই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল এবং তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা হল। সমালোচনা এবং অবমাননার মধ্যেকার পার্থক্য যদি সুপ্রীম কোর্ট বুঝতে না চায় তাহলে বিরোধিতার অধিকার বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর বিরোধিতার অধিকার বিপন্ন হওয়া মানেই গণতন্ত্র তার অর্থ হারাবে।

যখন সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে, রাজনৈতিক জমায়েতের উপর কোভিড সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা জারী রয়েছে, মানুষ কোনোভাবে মহামারী, বন্যা এবং লক ডাউনের ত্রিমুখী আঘাতের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, তখন ছাত্রদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষার মুখে আর বিহারের মতো রাজ্যে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন সম্ভবত মনে করেন একটি মহামারীও হয়তো নির্বাচন পেছানোর জন্য যথেষ্ট বিপর্যয় নয়, সুতরাং মহামারীর এই ভীষণ পরিস্থিতির মধ্যেও ডিজিট্যাল পোলিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে বিহারকে।

সংসদীয় ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে বেড়ে চলা স্বৈরাচারী শাসন, শাসক দলের নির্দেশে বল্গাহীন পুলিশী সন্ত্রাস, প্রকৃত অন্যায় ও সাংবিধানিক বিধিলঙ্ঘনের ঘটনাগুলি থেকে চোখ সরিয়ে রাখা বিচার ব্যবস্থা, এবং জনগণের বেঁচে থাকা বা অংশগ্রহনের কোন তোয়াক্কা না করে চাপিয়ে দেওয়া পরীক্ষা বা নির্বাচন — এইসবই ভারতীয় গণতন্ত্রের লকডাউন মোডের নিশ্চিত লক্ষণ।

সরকার যে সানন্দে এই লকডাউন অনন্তকাল প্রসারিত করতে চাইবে তা স্বাভাবিক। প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া আমাদের বলছে জনগণও নাকি এতে বেজায় খুশী। একটি প্রখ্যাত মিডিয়া হাউস এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী আগের থেকেও অনেক বেশি জনসমর্থন (৭৮%) ভোগ করছেন বলে ওপিনিয়ন পোল তুলে ধরেছে।

মিডিয়া প্রচারের এই ঢক্কানিনাদের বাইরে প্রতিবাদ ও গণতন্ত্র কিন্তু যথেষ্ট মাত্রায় সজীব রয়েছে আজও। জনগণ তাকে আগলে রেখেছেন। রাষ্ট্রের বলে দেওয়া ‘বাড়িতে থাকুন’ এবং পুঁজির বলে দেওয়া ‘বাড়িতে থেকে কাজ করুন’-এর সঙ্গে ভারতবর্ষের মানুষের নতুন সৃজনশীল সংযোজন ‘বাড়িতে থেকে প্রতিবাদ করুন’।

কয়লা খনিগুলি বেসরকারী মালিকের হাতে তুলে দেওয়ার সরকারী ঘোষণার বিরুদ্ধে কয়লা খনির শ্রমিকরা তিন দিন ব্যাপী ধর্মঘটে নেমেছে। কৃষিতে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর অর্ডিন্যান্সগুলির বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে শক্তিশালী কৃষক প্রতিবাদ। ‘আশা’ কর্মীরা, যারা পিপিই কিট এবং নূন্যতম সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ছাড়াই ভারতবর্ষে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন, অন্যান্য প্রকল্প কর্মীদের সঙ্গে মিলে দুদিনের স্ট্রাইক সংগঠিত করেছেন।

মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলির সুদে জর্জরিত মহিলারা সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আন্দোলন করছেন ঋণের ফাঁদ থেকে মুক্তির দাবিতে। ৯ আগস্ট ও ১৫ আগস্ট শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রছাত্রীরা হাতে হাত ধরে শপথ নিয়েছেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ঐতিহ্য এবং গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোকে বাঁচিয়ে রাখার, দেশকে বাঁচিয়ে রাখার।

মাস্ক ও স্যানিটাইজার হয়তো সর্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর পরিচয়চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বিরোধিতাকে স্যানিটাইজ করে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করার জন্য মাস্ক পরানো অনির্দিষ্ট লকডাউন জনগণ কখনোই মেনে নেবেন না। গণতন্ত্রকে আনলক করতেই হবে।

-- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য   

(ন্যাশনাল হেরাল্ড ওয়েব পোর্টালে ২২ আগস্ট ২০২০ প্রকাশিত, বাংলা অনুবাদ: অত্রি)  

bombom

অবশেষে শোনা গেল প্রকৃত সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের এক বিচারের বাণী। প্রত্যাশার পারদ বোধহয় ছিল না। কারণ চারপাশে ঢল এখন বিচারের নামে প্রহসন ও পীড়নের। এই পরিস্থিতিতে বম্বে হাইকোর্টের এক রায় ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত দেখালো। রায় প্রসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, তবলিঘি জামাতের মারকেজ জমায়েতকে কোভিড ছড়ানোর জন্য দায়ি করা অন্যায়ই হয়েছিল। তার পেছনে কাজ করেছিল ক্ষমতার রাজনীতিপ্রসূত এক অসূয়া, এক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বিদ্বেষ প্রণোদিত পরিকল্পনা। বিপর্যয়কর অতিমারী অবস্থা দেখা দিতে থাকে। প্রথাগত জমায়েতটিও ছিল সরকারের জানা বিষয়, পূর্ব নির্ধারিত। তাতে বিদেশ থেকেও কিছু মুসলিম এসেছিলেন। সরকার বিদেশীদের আসা বন্ধ করেনি, জমায়েতেরও অনুমোদন দেয়। তবু ঊনত্রিশ জনের বিরুদ্ধে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। আগস্ট মাসে যখন রায় বেরোচ্ছে ততদিনে ভারত কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ত্রিশ লক্ষ। আক্রান্তের মধ্যে রয়েছে শ্রেণী, জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। অন্যদিকে বিগত মার্চ মাসে তবলিঘি জমায়েতে মোট লোকসংখ্যা ছিল দুই সহস্রাধিক, তার বেশি নয়। অতি সামান্য কিছু সংখ্যক বিদেশী ছাড়া তারা সব এসেছিলেন দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে। এক বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত এত সীমিত সংখ্যক লোকজনের পক্ষে সর্বব্যাপী এত ব্যাপক লোকের করোনা আক্রান্তের কারণ হয়ে ওঠা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার ছিল না, আদালতে তার প্রমাণও মেলেনি। গুজব ছড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং এক শ্রেণীর মিডিয়া মিলে। কোভিডের আগমন ঘটেছিল বিদেশ থেকে আসা বিমান যাত্রীদের মাধ্যমে। সে সময়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ভুক্ত অনেক লোকজনও বিদেশ থেকে আসছিলেন, এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করেছেন, পরীক্ষা না করিয়ে গন্তব্যে চলে গেছেন, পরে তাদের বহুজনেরই কোভিড পজিটিভ চিহ্নিত হচ্ছিল, কিন্তু সরকার কখনই তার জন্য সম্প্রদায়ের কথা তুলে তুলোধোনা করেনি, হল্লা করেনি। ডিভিশন বেঞ্চ শাসকের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দৃষ্টিকোণ উন্মোচিত করতে সিএএ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গের অবতারণা করেছে। এই আইনগত সংশোধনীর মুসলিম বিরোধী সারবিষয়ের বিরুদ্ধে মুসলিম জনগণ উত্তাল হন। নাগরিকত্ব প্রদানে ধর্মীয় বৈষম্য প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনে পথে নামেন। এর প্রতিশোধ নিতেই ঐ পুলিশী-প্রশাসনিক সন্ত্রাস সৃষ্টির পদক্ষেপ করা হয়েছিল। এটা বুঝিয়ে দেওয়ার কুৎসিত প্রয়াস চালানো হয়েছিল যে, মুসলিম জনগণের ওপর যে কোনও সময়ে যে কোনো অজুহাতে এরকম দমন নামিয়ে আনা হতেই পারে। ঘটনা হল, ধৃত বিদেশীদের বিরুদ্ধে ভিসার সময়সীমা লঙ্ঘনের ভূয়ো অভিযোগ সহ ভারতীয় ফৌজদারী আইন, অতিমারী সংক্রমণ আইন ও বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের মতো দমনমূলক আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। ডিভিশন বেঞ্চ আরও মন্তব্য করেছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যে অপরাধ করেছে সরকার, তার কোনও পরিবর্তনের মানসিকতা এখনও লক্ষ্যণীয় নয়, তবে তার চূড়ান্ত সময় কিন্তু পার হয়ে যাচ্ছে। এই হুঁশিয়ারী যাদের বিশেষ উদ্দেশ্য করে দেওয়া, সেই মহারাষ্ট্র সরকার ও তার পুলিশের এহেন ‘কাজ’ দেখানোর কোনও অজুহাত ধোপে টেঁকে না, কারণ উপলক্ষের উৎসস্থল ছিল মুম্বাইয়ে নয়, দিল্লীতে। তবু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযানে নামে মহারাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ। তার পেছনে বিশেষ কারণ হল সাম্প্রদায়িক গাত্রদাহ। মহারাষ্ট্র সরকারের কুকীর্তির শেষ নেই। বরাবর সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের স্বার্থবিরোধী; মানবাধিকার বিরোধী। ‘ভীমা কোরেগাঁও’ মিথ্যা মামলা সাজিয়েছে, আর সেই অজুহাতে দেশের বিভিন্ন অংশে কর্মরত বেশ কিছু সমাজবিজ্ঞান কর্মী ও মানবাধিকার আন্দোলনের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের বন্দী করে রেখেছে।

বম্বে হাইকোর্টের রায় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ জনগণের দেওয়াল লিখন ও বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনের কথার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। মহারাষ্ট্রের শিবসেনার শরিকানার সরকার পন্থা নেয় কেন্দ্রের মোদী সরকারেরই। আর, গোটা দেশের অসংখ্য ঘটনা সাক্ষী, আরএসএস পরিচালিত বিজেপি জমানা করোনার অতিমারী পরিস্থিতিতেও কীভাবে ফ্যাসিস্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে আসছে। কীভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণকে আর্থ-সামাজিক জীবন থেকে কোণঠাসা জীবন্মৃত করে রাখার অপরাধ করে আসছে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। প্রতিবাদে প্রতিরোধে গড়ে উঠছে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার এক নতুন দেশচেতনা জনচেতনা। একে সংগঠিত ও সর্বব্যাপী করার চ্যালেঞ্জ থাকছে। এই চলার পথে বম্বে হাইকোর্টের রায় অবশ্যই এক সহায়তা পাওয়া।

edsadi

এক মহামারীর প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই ভারত স্বাধীনতার ৭৩তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। অনেক দেশই এখন যেখানে কোভিড-১৯ অতিমারীর বিপর্যয়কে কাটিয়ে উঠছে, ভারতে এর লেখচিত্র ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে, নতুন সংক্রমিতদের সংখ্যা প্রতিদিনই ৬০,০০০-এর বেশি করে বাড়ছে। সংক্রমিতদের মোট সংখ্যা ২৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে এবং এই ব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যাও প্রায় ৫০,০০০ ছুঁয়েছে। অতএব, ২০২০-র স্বাধীনতা দিবসের পরিমণ্ডল যে যথেষ্ট বিষাদময় তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে না। অত্যন্ত এলোমেলোভাবে পরিকল্পিত এবং চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত লকডাউন এই বিষণ্ণতাকে তীব্রতর করে তুলেছে, কেননা, এই লকডাউনের পরিণামে ভরতীয় জনগণের বড় অংশকে প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে, আর সামাজিক বিন্যাসের একেবারে প্রান্তসীমায় থাকা বহু মানুষের কাছে এটা অস্তিত্বের সংকট হয়েই দেখা দিয়েছে।

তবে স্বাধীনতার প্রাণসত্তাকে সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন করে তুলছে ক্ষমতার তখতে থাকা আজকের সরকার, যে প্রতিদিনই সংবিধান এবং ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও সৌভ্রাতৃত্বের সাংবিধানিক নীতিমালাকে প্রহসনে পরিণত করছে। এক কথায়, আমরা এটাকে ভারতের স্বাধীনতার সংকটই বলতে পারি যখন আজকের শাসকরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস, কর্যক্রম ও স্বপ্নের বিপর্যয় ঘটিয়ে তাকে বিকৃত ধারায় লেখার চেষ্টা করছে। স্বাধীনতার সাত দশক পর অধিকাংশ ভারতবাসীর কাছেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস আজ সুদূর অতীতের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। আজ সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান এই অসংলগ্ন অবস্থাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে সম্মিলিতভাবে পরিকল্পিত আক্রমণ নামিয়ে আনছে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং তার ফসল সংবিধানের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ভারতের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ওপর।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের রয়েছে এক সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় ইতিহাস যা জাতীয় ঐক্য এবং সাংবিধানিক কাঠামোর ভিত্তি রচনা করে দেয়, যে বিষয়টাকে এখন আমরা প্রশ্নাতীত বলেই মেনে নিয়ে থাকি। আমাদের রয়েছে ১৮৫০-র দশকের সাঁওতালদের হুল বিদ্রোহ এবং অন্যান্য কৃষক-আদিবাসী বিদ্রোহ থেকে শতক কাল ব্যাপী বিস্তৃত জনগণের গৌরবজনক প্রতিরোধের এক বহুমুখী আখ্যান যা শেষ পর্যন্ত বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উৎখাতে পরিণতি পায়। গোড়ার দিকের কৃষক বিদ্রোহগুলো থেকে গান্ধীর সত্যাগ্ৰহ এবং তেভাগা, তেলেঙ্গানা ও পুনাপ্রা-ভায়লার’র মতো কমিউনিস্ট নেতৃত্বে চালিত কৃষক বিদ্রোহ সমূহ ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভারতের কৃষক জনগণের দীর্ঘস্থায়ী শক্তিশালী আত্মঘোষণা বলেই প্রতিপন্ন করে। পুরোনো ধারার জমিদারি এবং মহাজনী প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত না হলেও আগের চেয়ে অবশ্যই অনেক দুর্বল হয়েছে, তবে আজ কর্পোরেট আগ্ৰাসন জমি, জল ও জঙ্গলের ওপর অধিকারের কৃষকের স্বপ্নকে প্রবলভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ভারতের শ্রমিক শ্রেণী আকারে তেমন বড় ছিল না, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণী এবং তাদের সংগ্ৰাম স্বাধীনতার জন্য জনগণের আত্মঘোষণাকে শক্তিশালী এবং উদ্দীপিত করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন প্রধানত কমিউনিস্ট এবং সোশ্যালিস্টদের নেতৃত্বেই চালিত হত, তবে লালা লাজপত রাই এবং জওহরলাল নেহরুর মতো কংগ্ৰেসের নেতারা ‘সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্ৰেস’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন (১৯২০ সালে এআইটিইউসি প্রতিষ্ঠার সময় সভাপতি ছিলেন লাজপত রাই এবং নেহরু তার সভাপতি হন ১৯২৮ সালে)। শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার এবং শ্রমিক স্বার্থের অনুগামী আইন প্রণয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ডঃ আম্বেদকর কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। মহারাষ্ট্রের বস্ত্র শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর আইএলপি-র (ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি) শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল এবং আইএলপি ব্রাহ্মণ্যবাদ/মনুবাদ এবং পুঁজিবাদ এই দুটি বিষয়কে তাদের নিশানা বানিয়েছিল। জাতপ্রথা নিছক শ্রমবিভাজন নয়, বরং হল শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন – তাঁর এই বিখ্যাত উক্তি জাতপাতবাদী উৎপীড়ন ও জাতের উচ্চ-নীচ ভেদ এবং পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্ৰামের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে শ্রেণী হিসাবে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তাকেই সামনে এনেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে অর্জিত শ্রমিকদের অধিকার ও শ্রম আইনগুলো এবং জাতীয়করণের লক্ষ্যে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নির্মিত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে প্রণালীবদ্ধভাবে চূর্ণ করার উদ্যোগ এখন সক্রিয়ভাবে চলছে।

স্বাধীনতা আন্দোলন কৃষক ও শ্রমিকদের আন্দোলন হওয়ার সাথে যথার্থ অর্থেই সাধারণ ভারতবাসীর আন্দোলনও ছিল। স্বাধীনতার আকাঙ্খা যখন তীব্রতর হয়ে উঠল, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্র থেকে আপামর ভারতবাসী তখন ওই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আর সর্বোপরি এটা ছিল তরুণ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, উজ্জীবিত ভারতবাসীর আন্দোলন যাতে পুরুষদের সঙ্গে নারীরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়েছিলেন। আমরা যখন স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বলব তখন আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে যে বেশিরভাগ মানুষ একই সাথে বহুবিধ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন – জাতপাতবাদী উৎপীড়ন এবং অন্যায় থেকে মুক্তি যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, সেরকমই ছিল সমতা এবং পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির জন্য নারীদের সংগ্ৰাম। একইভাবে, রাজন্য শাসিত রাজ্যগুলোতেও জনগণ লড়াই করছিলেন একই সাথে নিজ-নিজ সামন্ততান্ত্রিক-রাজন্য শাসকদের কবল থেকে এবং ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য। রাজন্য শাসিত রাজ্যগুলোর মধ্যে স্বাধীনতার জন্য এই লড়াই ছাড়া ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে শতাধিক রাজন্য শাসিত রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি এত অনায়াস ও দ্রুত হতে পারত না।

সংগ্ৰাম এবং জনগণকে সমাবেশিত করার রূপ ও পন্থার কথা বিচার করলে দেখা যাবে স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল বিভিন্ন ধারার সংমিশ্রণ, যে ধারাগুলো নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান চালিয়ে একে অপরকে প্রভাবিত করেছিল। কংগ্ৰেস অবশ্য প্রধান মঞ্চ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং গান্ধী মাঝে-মধ্যেই যে গণ আন্দোলনের ডাক দিতেন তাতেই সারা দেশে সবচেয়ে বেশি জনগণ সাড়া দিতেন। তবে স্বাধীনতা আন্দোলন আকারে বড় হলেও তা কখনই অভিন্ন রূপের ছিল না। ১৯৪০-র দশকের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এটা ছিল আন্দোলনের কয়েকটা বড় রূপের একটা বুনট যেখানে গান্ধী ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেও তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জনগণের স্বতস্ফূর্ত আত্মঘোষণা -- সুভাষ বোসের আইএনএ অভিযান, কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে চালিত তেভাগা-তেলেঙ্গানা ও অন্যান্য কৃষক অভ্যুত্থানের উদ্যোগুলো, নৌ-বিদ্রোহ এবং শ্রমিক শ্রেণীর শক্তিশালী আন্দোলনসমূহ, এ সবই স্বাধীনতার লক্ষ্যে দেওয়া চূড়ান্ত ধাক্কাটায় অবদান যুগিয়েছিল।

কোনো মতাদর্শগত ধারা যদি স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে থেকে থাকে এবং এমনকি ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতা করে ও নিজেদের সাম্প্রদায়িক এজেণ্ডা দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে শুধু বিভেদ সৃষ্টি ও তাকে বিপথে চালিত করতে সহায়তা করে থাকে, তবে সেটা ছিল সাভারকারের হিন্দু মহাসভা এবং হেডগেওয়ারের আরএসএস-কে নিয়ে গঠিত হিন্দু বাহিনী। হিন্দুত্ব ধারা এবং মুসলিম লিগ পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক চ্যুতি-রেখাকে বিস্তৃত করে চলেছিল, এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের সুচতুর হস্তক্ষেপ ওই ফাটলকে আরও বাড়িয়েই তুলেছিল। এর পরিণামে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হল যার মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক রক্তস্নানে কলঙ্কিত হয়ে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের উচ্ছেদের মর্মঘাতী যন্ত্রণা ও দেশান্তরী হওয়ার বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত দেশভাগের মধ্যে দিয়েই স্বাধীনতার আসা সম্ভব ছিল।

ইতিহাসের এক পরিহাসময় বিকাশে ভারতের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী আন্দোলনে কোন শিকড় না থাকা এই হিন্দুত্ব ধারাই আজ প্রাধান্যকারী মতাদর্শগত-রাজনৈতিক ধারা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এরাই কেন্দ্রে এবং ভারতের মোট রাজ্যের প্রায় অর্ধেকগুলোতে শাসন ক্ষমতার তখতে বসে আছে এবং আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর ওদের শক্তিশালী কবজাও রয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং দেশভাগের মর্মবেদনা, এবং ঔপনিবেশিক শাসনের নিপীড়ন কৌশলের ভাণ্ডারই হল সেই পরম্পরা যা সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান ভারতের ঔপনিবেশিক অতীত থেকে আহরণ করেছে। কর্পোরেট শাসনের রূপেই পুনরুজ্জীবন ঘটানো হচ্ছে কোম্পানি রাজের, রাষ্ট্রের শাসন পদ্ধতির বুনিয়াদি আইনি পরিকাঠামো রূপে পুনরায় তুলে আনা হচ্ছে দানবীয় আইনগুলোকে, কেন্দ্রীভবনের স্টিমরোলার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বৈচিত্র্য ও যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারকে এবং সংখ্যাগুরুবাদী আধিপত্যের ও সংখ্যালঘুদের প্রণালীবদ্ধভাবে কোণঠাসা করার রূপেই জাতীয়তাবাদের নতুন ভাষ্য হাজির করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তুষ্ট করতে ভারতের বিদেশ নীতি যখন প্রতিবেশী দেশগুলো এবং পূর্বেকার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঘটাচ্ছে, তখন নিজেদের বেছে নেওয়া সাম্রাজ্যবাদী নির্দেশ মুক্ত পথে চলার অধিকারকে ক্রমেই আরও বেশি করে বন্ধক দেওয়া হচ্ছে মার্কিন-ইজরায়েল রণনৈতিক অক্ষের স্বার্থের কাছে। এবং অর্থনৈতিক নীতিমালা ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর ভেক নিয়ে আড়াল করছে বিশ্ব পুঁজি এবং বিদেশী কর্পোরেশনগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতাকে।

বাস্তবের যে রূপের মুখোমুখি আজ আমরা দাঁড়িয়ে, সে সম্পর্কে কোন ধরনের সতর্কবার্তা স্বাধীনতা আন্দোলন কি আমাদের দিয়েছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই দিয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়া ভগৎ সিং আমাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন যে, স্বাধীনতার অর্থ হতে হবে ঔপনিবেশিক শাসনধারা এবং জমিদার ও পুঁজিপতি শ্রেণীর শাসনের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে ছেদ ঘটানো, অন্যথায়, স্বাধীনতা শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের শাসন থেকে তাদের উত্তরাধিকারী বাদামি সহেবদের শাসনভার অধিগ্ৰহণের পর্বান্তরে অধঃপতিত হবে। সে সময় ডঃ আম্বেদকরও ছিলেন, যিনি ওপর-ওপর রাজনৈতিক সমতা এবং প্রচ্ছন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত চাপা উত্তেজনার দিকে, ব্যক্তিপূজার চোরাবালির মধ্যে স্বৈরাচারের খাঁচায় গণতন্ত্রের বন্দী হওয়ার বিপদ সম্পর্কে এবং সামাজিক দিক থেকে উৎপীড়িত ও সংখ্যালঘুদের ন্যায় ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতে হিন্দুরাজের জাতপ্রথা আরও শক্তিশালী করে তোলার সম্ভাব্য বিপর্যয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টিকে নির্দেশিত করেছিলেন।

নরেন্দ্র মোদী আমাদের বলে চলেছেন যে গত সত্তর বছরে ভারতে ভালো কিছুই ঘটেনি। তিনি প্রকৃতই কী করতে চাইছেন এই মন্তব্য সে সম্পর্কে আমাদের একটা সুস্পষ্ট ও অকপট ধারণা দেয় -- সাংবিধানিক গণতন্ত্র থেকে যেটুকু সুবিধা আমরা পেয়েছি তিনি সেটাকে ধ্বংস করতে চাইছেন এবং আমাদের পিছিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন দেশভাগের মর্মবেদনা এবং সাম্প্রদায়িক সন্দিগ্ধতা ও ঘৃণার পরিস্থিতির মধ্যে, যার ধাক্কাকেই কাটিয়ে উঠে ভারত সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। আর এজন্য তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্ন ও মূল্যবোধ তথা সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘোষিত দায়বদ্ধতার সাপেক্ষে পূর্ববর্তী সরকারগুলোর পাহাড়প্রমাণ বিশ্বাসঘাতকতাকেই পুঁজি করছেন। আমাদের তথা ভারতের জনগণের কাছে বার্তাটা জোরালো ও সুস্পষ্ট হয়েই পৌঁছচ্ছে। গণতন্ত্রের বিস্তার এবং জনগণের অধিকার ও অংশগ্ৰহণের ব্যাপারে যে সুবিধাগুলো আমরা অর্জন করেছি সেগুলোকে ধরে রাখতে এবং তাদের আরও সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। এই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদী হিন্দু রাষ্ট্রে অধঃপতিত হওয়া থেকে -- যা হলে কর্পোরেটরাজ এবং অত্যাচারী প্রশাসনিক ধারা আমাদের সমস্ত সম্পদ ও অধিকারকে পদদলিত করবে -- রক্ষা করতে হবে। ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্তি চাই -- এটাই হোক ২০২০’র স্বাধীনতা দিবসের রণধ্বনি।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৮ আগস্ট ২০২০)  

31ad3as
  • # গণ আন্দোলনে লাঠি-গুলি-কালাকানুন জারি করার সেই ধারাবাহিকতা আজও চলছে। প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার শপথ নাও।
  • # জনবিরোধী অর্ডিন্যান্স জারি করে দেশের খাদ্য সুরক্ষা-খাদ্য নিরাপত্তা জলাঞ্জলি দেওয়া চলবে না।
  • # অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সংশোধন করে মজুতদারী কালোবাজারিকে বৈধ করে তোলা মানছি না, মানবো না।
  • # রেশন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষ এক হোন।
  • # লকডাউনে কর্মহীন গরিব মানুষদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা হচ্ছে না কেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার জবাব দাও।
  • # করোনা সময়কালে সরকারকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পূর্ণ রেশন দিতে হবে,প্রতি মাসে ইউনিট পিছু ১৫ কেজি চাল/আটা, ১ কেজি তেল, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি চিনি দিতে হবে।
  • # রাজ্যের রেশন গ্রাহকদের একাংশের ( আরকেএস ওয়াই-২) বরাদ্দ অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হলো কেন জবাব দাও।
  • # মূল্যবৃদ্ধি রোধে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চরম ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষ এক হোন।

রাজ্য সরকার ২৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করবে বলে ঘোষণা করলো। তারপরই আলুর দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে কেন জবাব চাই।

mnndree

প্যানডেমিক পর্বে গ্রামাঞ্চলে কাজের জন্য চলছে তীব্র হাহাকার। প্রবাসী শ্রমিকরা গ্রামে ফিরেছেন। মনরেগার উপর নজরদারী চালানো সমাজকর্মীদের তুলে ধরা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে এই অর্থ বর্ষের প্রথম চার মাস, এপ্রিল থেকে জুলাই-এর মধ্যেই ১০০ দিনের প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের ৪৮ শতাংশ অর্থ খরচ হয়ে গেছে! দেখা যাচ্ছে, ৪.১৭ লক্ষ পরিবার ইতিমধ্যেই তাঁদের বরাদ্দ ১০০ দিনের কাজ করে ফেলেছেন! বছরের বাকি দিন এদের তবে চলবে কিভাবে?

কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের ওয়েবসাইটের উপর ‘মনরেগা ট্র্যাকার’ নামে নজরদারি অভিযান চালাচ্ছে সমাজকর্মীদের সংগঠন ‘পিপলস অ্যাকশন ফর এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি’। এঁদের দেওয়া তথ্য অনুসারে মনরেগায় এপ্রিল থেকে কাজ বৃদ্ধি যেমন বাস্তব, তেমনি দেখা যাচ্ছে যে, এবছরে ৭ জুলাই পর্যন্ত ২২% আবেদনকারী কাজ পাননি।

জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুসারে ২০১২ থেকে ২০১৮ এই সময়ের মধ্যে গ্রামীণ পুরুষদের মধ্যে কর্মহীনতা বেড়েছে ৩ গুণ, মহিলাদের মধ্যে ২ গুণ। এর উপর প্যানডেমিকের অভিঘাত। দলে দলে প্রবাসী শ্রমিকদের গ্রামে ফিরে আসা। কাজের চাহিদা এতোটাই যে মনরেগায় ১ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ (গত অর্থবর্ষের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মনরেগায় মোটামুটি যা খরচ হয়েছিল) সে চাহিদা সামাল দিতে বেশ কম। উড়িষ্যা সরকার ইতিমধ্যেই সে রাজ্যের বেশ কয়েকটি ব্লকে ১০০ দিনের পরিবর্তে ২০০ দিনের কাজ চালু করেছে। দেশজুড়েও উঠেছে মনরেগায় পরিবার ভিত্তিকের বদলে ব্যক্তি ভিত্তিক ২০০ দিনের কাজের দাবি।

কাজের জন্য হাহাকার শুধুমাত্র প্রবাসীদের গ্রামে ফেরায় নয়, ট্রেন না চলা, প্যানডেমিকের কারণে মেহনতিদের গ্রামেই আটকে যাওয়াও এর বড় কারণ। ঋণমুক্তির দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন ঋণ না শোধ করতে পারা নিয়ে কখনো শোনা যাচ্ছে, ‘স্বামী নিউ টাউনে পাথরের/পালিসের কাজ করতেন দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরিতে। সেই ভরসায় এককালীন বড় লোন নিয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে শোধ করা যেত। এখন কাজ বন্ধ, ট্রেনও বন্ধ। যেটুকু হচ্ছে ১০০ দিনের কাজে, তাতে পেট চলছে’। কেউ বলছেন, বড়বাজারে কাজ করতাম। ট্রেন বন্ধ, যেটুকু কাজ ১০০ দিনের। সেটাই বা কতটুকু! শুধু যারা লোকাল ট্রেন ধরে কাজে যেতেন তাঁরাই নন, গ্রামের আশেপাশেও যারা রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রির কাজ করতেন তাঁদেরও কাজ প্রায় নেই। বেহাল অর্থনীতি আর সংক্রমণের ভয়ে ব্যাপক কাজ কমেছে।

অর্থনীতির নানান টানাপোড়েনে খেতমজুর পরিবারে এসেছিল পেশার ধরনে বৈচিত্র্য/ডাইভারসিফিকেশন। খেতমজুরি ছেড়ে পরিবারের নতুন প্রজন্মে এসেছে নতুন নতুন পেশা -- রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি , ড্রাইভিং, ফেরি ব্যবসা, গহনার মিস্ত্রি -- প্যানডেমিকে সব পেশাই সংকটে।

এই প্রেক্ষাপটেই নতুন করে বুঝতে হবে ‘১০০ দিনের কাজ’-কে। যা কেবল শাসক দলগুলির ভোট বাক্স আর মিটিং মিছিল ভরানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, কর্মনিশ্চয়তার সেই আইনকে গ্রামীণ মেহনতিদের শ্রেণীস্বার্থে ঘুরে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনাকে বুঝতে হবে।

প্রবাসীরা যখন ঘরে ফিরছেন, তখন শুরু করা গিয়েছিল নতুন জবকার্ডের আন্দোলন। জবকার্ড পরিবার ভিত্তিক। ২০০৬ পরবর্তীতে বছর ১২/১৪ আগে যখন জবকার্ড হয়, তখন অবিবাহিত সন্তানের নাম ছিল বাবা/মা’র জবকার্ডে। এখন সন্তানের আলাদা সংসার, নাম কিন্তু বাবার জবকার্ডে। ১০০ দিনের পরিবার ভিত্তিক কাজ বাস্তবে ভাগাভাগি করে পাচ্ছে ২/৩টি পরিবার।

প্রবাসীরা কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরলে, সরকার পরিস্থিতির চাপে এঁদের জবকার্ড দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা দাবি তুলি, কর্মনিশ্চয়তা আইন অনুযায়ী, কোনো পরিবার জবকার্ড চাইলে, সেই পরিবারকে অবশ্যই আলাদা জবকার্ড দিতে হবে। আমাদের আন্দোলনের চাপে জেলার ১০০ দিনের কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্য সরকারী আধিকারিক মেনে নেন, আইনানুসারে নতুন পরিবার জবকার্ড চাইলে, সরকার দিতে বাধ্য।

beee

 

আমাদের উদ্যোগে নতুন করে চাওয়া জবকার্ড সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত থেকে প্রশাসন দিতে থাকে। প্রথমেই ধনেখালি ২নম্বর পঞ্চায়েতে ৫০-এর অধিক নতুন জবকার্ড তুলে দেয়। শাসকদল টিএমসির একাংশ চিরাচরিত অভ্যাসবশত নতুন জবকার্ড হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে টাকা নেওয়ার মতলব করে, পঞ্চায়েতে নতুন জবকার্ডগুলি কিছুদিন আটকে রাখে। ঋণমুক্তি ছাড়াও কাজ ও জবকার্ড, আমফান ক্ষতিপূরণ চেয়ে ১০ আগষ্ট ধনেখালি ব্লকে ব্যাপক জমায়েত সহ বিক্ষোভ দেখানো হয়। এই গণবিক্ষোভের পর শাসক দলের একাংশের অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। প্রসঙ্গত, এই পঞ্চায়েতে আমরা ভালো জমায়েত সহ জবকার্ড দাবি করে ফর্ম পূরণ করে ডেপুটেশনও দিয়েছিলাম জুনের শেষে।

ইতিমধ্যে এই ইস্যুগুলিতে সংগঠিত হয় ১৭ আগষ্ট জেলাশাসক ডেপুটেশন, কোভিড পরিস্থিতিতেও শতশত মানুষের সমাবেশে। এরপরও বেলমুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত জবকার্ড দিতে গড়িমসি করলে ২৪ আগষ্ট জয়হরিপুরে সংগঠিত হয় অবস্থান কর্মসূচী। ব্লক প্রশাসন দ্রুতই হস্তক্ষেপ করে। পরবর্তীতে ধনেখালি ১ নম্বর পঞ্চায়েতেও আমাদের আবেদন করা জবকার্ড দিতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। এখন বেলমুড়ি পঞ্চায়েত দিচ্ছে জবকার্ডগুলি। এখানে আমাদের দাবি ছিল শতাধিক। এখনো নতুন করে জবকার্ডের দাবি জানানো চলছে।

ধনেখালি ২নম্বরে নতুন জবকার্ড ও পুরানো জবকার্ড, দুই মিলিয়ে কাজের দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে।

গত ১৬ আগস্ট সংগঠিত হল আয়ারলা সংগঠক শ্যামাপদ শীটের গ্রামে ৪ক ফর্ম পূরণের ক্যাম্প; নির্দিষ্ট ফর্মে এবং সাদা কাগজেও। এক একটি কাগজে জবকার্ড নম্বর সহ কাজ চেয়ে ১০ জন করে স্বাক্ষরিত/টিপসই সহ আবেদন, প্রধানের উদ্দেশ্যে।

এরপর পরপর দুদিন শ্যামা শীট, জয়দেব বাগ, ছায়া মান-এর নেতৃত্বে সকলে পঞ্চায়েত অফিসে গেলেন এনআরইজিএ-তে কাজের লিখিত দাবি ৪(ক) জমা দিতে। প্রধান নেই, এই অজুহাতে কেউ জমা নিলেন না। পরদিন ওঁরা গেলেন বিডিও অফিসে। বিডিও আয়ারলার চাপে ফোন করলেন প্রধানকে। পরদিন ৪(ক) জমা নিলেন প্রধান। সোমবার, ২৪ আগস্ট ধনেখালি ১ নম্বর পঞ্চায়েতেও কাজ চেয়ে ৪(ক) পূরণ করে জমা দিলেন রুমা আহেরি, প্রতিমা আহেরিরা। সাথে ছিলেন আরো অনেক কর্মপ্রার্থী মহিলা।

এ লড়াই বাঁচার লড়াই, লড়তে হবে একসাথে।

- সজল অধিকারী  

leesdde

লকডাউন কেড়ে নিল ১০০ দিন প্রকল্পে গ্রামীণ মহিলাদের কাজ। সরকারি তথ্যই জানাচ্ছে, এই অর্থ-বর্ষের প্রথম পাঁচ মাসে ১০০ দিন প্রকল্পে গ্রামীণ মহিলাদের সমগ্র কর্মদিবস (টোটাল পার্সন ডে) নেমে দাঁড়িয়েছে ৫২.৪৬ শতাংশে, যা গত আট বছরে সর্বনিম্ন।

এনআরইজিএ-র সরকারি পোর্টালে যে তথ্যপঞ্জি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে (২৪ আগস্ট পর্যন্ত) ২০১৩-১৪-র অর্থ-বর্ষে সমগ্র কর্মদিবস বা পার্সন ডে ছিল ৫২.৮২ শতাংশ। তারপর থেকে বর্তমানে যে অবস্থাটা এসে দাঁড়িয়েছে তা সর্বনিম্ন।

প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৩-১৪’র পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত গ্রামীণ মহিলাদের অংশগ্রহণ ভালোই বৃদ্ধি পেয়ে ৫৬.১৬ শতাংশে পৌঁছেছিল। গতবছরের তুলনায় বর্তমানে যে সংখ্যাটা সামনে এসেছে তা ২.২৪ শতাংশ বিন্দু কম। মোট ১৩.৩৪ কোটি কর্মশীল ব্যক্তি নারেগার সাথে যুক্ত ছিলেন। যার মধ্যে ৬.৫৮ কোটি বা ৪৯ শতাংশ মহিলা।

অতিমারীর ফলে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসায় অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে ১০০ দিনের কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

তথ্য থেকে আরও যে বিষয়টা জানা যাচ্ছে তা হলো, চলতি অর্থ-বর্ষে ২৮০.৭২ কোটি কর্মদিবসের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তারমধ্যে ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে ১৮৩ কোটি কর্মদিবস, যা গ্রামাঞ্চলে চরম আর্থিক দুর্দশাকেই প্রতিবিম্বিত করে।

গ্রামীণ মহিলাদের হ্রাসপ্রাপ্ত কর্মদিবসের জাতীয় গড় ২.২৪ শতাংশ। অন্ধ্র প্রদেশে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার জাতীয় হারের তুলনায় সবচেয়ে বেশি কমেছে (৩.৫৮), গতবছর যা ছিল ৬০.০৫ তা এবছরে নেমে এসেছে ৫৬.৪৭ শতাংশে। এরপরই রয়েছে বাংলার স্থান। পশ্চিমবাংলায় তা ৩.৩২, তেলেঙ্গানায় ২.৬২, হিমাচল প্রদেশে ২.৮৮।

ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, মেঘালয়, তামিল নাড়ু, উত্তরাখন্ড, সিকিম, বিহার, রাজস্থান, জম্মু-কাশ্মীর, আন্দামান নিকোবর এবং অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে এই প্রবণতা নিম্নগামী।

চলতি বছরে কেরলে মহিলাদের মোট কর্মদিবসে অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি, ৯১.৩৮ শতাংশ। আর জম্মু-কাশ্মীরে মহিলাদের অংশগ্রহণের গড় সবচেয়ে কম, ৩০.৭২ শতাংশ। তারপরেই স্থান উত্তর প্রদেশ, ৩৩ শতাংশ।

শুধু গ্রামীণ ভারতে মহিলাদের এই দুরাবস্থা নয়, অতিমারীতে সবচেয়ে বেশি কাজ খুইয়েছেন শ্রমজীবী মহিলারা, তারমধ্যেও বিশেষ করে যারা দাঁড়িয়ে আছেন প্রান্তসীমায়, সেই সব তপশিলি জাতি উপজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলারা।

(তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৫ আগস্ট ২০২০)

- অতনু চক্রবর্তী  

veeaiar

১ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের ব্লকে ব্লকে ডেপুটেশন
১৫ সেপ্টেম্বর জেলায় জেলায় জেলাশাসক দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশন ও মানব বন্ধন

করোনা মহামারীর সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রের সরকার ও রাজ্য সরকারগুলো গ্রামীণ জনগণের জীবন-জীবিকার প্রশ্নে দায়িত্ব থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন। উল্টো দিকে প্রতিনিয়তই জনগণের উপর নামিয়ে আনা হচ্ছে নতুন নতুন দমনমূলক আইন ও অর্ডিন্যান্স। দেশের জনগণের রক্ত ঘামে তৈরি জাতীয় সম্পত্তির বিলগ্নীকরন করছে। কয়লা, রেল, বিমান, ব্যাংক, কৃষি-বাণিজ্য ও জীবন বীমার মতো গুরুত্বপুর্ণ লাভজনক সংস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া দেশদ্রোহিতা ছাড়া আর কী! গ্রামীণ গরিবরা ঋণ ফাঁদে জর্জরিত, কাজ নেই, মনেরেগা প্রকল্পের কাজ অপ্রতুল, অনেক জায়গাতেই দেওয়া হচ্ছে না, জবকার্ড নেই, তার উপর দলবাজি দুর্নীতি। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর ও শৌচাগার নিয়ে দুর্নীতি-দলবাজি, গ্রামোন্নয়ন স্তব্ধ, দ্রব্যমূল্য বেড়ে চলেছে। কিন্ত বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের নামে মানুষের মতামত ও প্রতিবাদ জানানোর অধিকারকে দমন করছে। আর শাসকরা সংবাদ মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগিয়ে সরকারী খরচে নিজেদের ঢোল বাজিয়ে চলেছেন। তাই মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে গ্রামে বৈঠক করে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের মধ্যে প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। শাসকদের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরির কাজ চালাতে হবে।

তাই সারা দেশের সাথে সাথেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রচার চলছে। ঘরে ঘরে যাওয়ার পদ্ধতি হিসেবেই নেওয়া হয়েছে প্রধান মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে গণ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে স্মারক পত্র বিডিও মারফত মন্ত্রীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। গ্রামের মানুষকে নিয়ে  বৈঠক। ইতিমধ্যেই পুর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন ব্লক, পুর্বস্থলী ২নং ব্লক, মন্তেশ্বর, মেমারী ১নং ব্লক, সদর ১নং ব্লক ও কালনার আটটি গ্রামে বৈঠক হয়েছে। বাঁকুড়ার আদিবাসীদের বনের জমির দাবিতে প্রচার বৈঠক চলছে। নদীয়ার নাকাশিপাডার কর্মীদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের গ্রামে ঋণ মুক্তির দাবির প্রচার হচ্ছে। ব্লক ডেপুটেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের গ্রামে কর্মীদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। মালদহের কালিয়াচকে বৈঠক করে প্রচার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, দার্জিলিং ও হুগলী জেলার গ্রামাঞ্চলে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান ও বৈঠক শুরু হয়েছে। মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম ব্লকের ঝিল্লী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ৩০০ লোকের জমায়েত করে সভা অনুষ্ঠিত হল। নতুন নতুন গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে উৎসাহপূর্ণ সভা হয়। ব্লক ডেপুটেশনের প্রস্তুতি চলছে। এই প্রচার অভিযানকে সফল করার জন্য আয়ারলার জেলা কমিটির সদস্য ও রাজ্য কমিটির সদস্যদের সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে।

apwadd
  • সবাইকে ১০ কেজি খাদ্যশস্য অন্তত ৬ মাস দিতে হবে;
  • অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন বাতিল করা চলবে না;
  • আয়করের আওতার বাইরে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে প্রতি মাসে ১০০০০ টাকা দিতে হবে;
  • মনরেগার পরিধি বাড়িয়ে গ্রাম-শহর সর্বত্র বছরে ন্যূনতম ২০০ দিন কাজের গ্যারান্টি করতে হবে, মজুরি বাড়াতে হবে;
  • লকডাউনকে হাতিয়ার করে শ্রম আইন বদলে দেওয়া চলবে না;
  • রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র গুলিকে বেসরকারীকরণ করা চলবে না;
  • বেকারদের কাজ দাও;
  • সমস্ত শূন্য পদ অবিলম্বে পূরণ করতে হবে;
  • মিড ডে মিলের বরাদ্দকৃত অর্থ কমানো যাবে না;
  • লকডাউন পর্বে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ঋণ ও সুদ মকুব করতে হবে;
  • মহিলাদের ওপর সমস্ত রকম হিংসা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে;
  • এসসি-এসটি-ওবিসি ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে;
  • সাম্প্রদায়িক হিংসা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে;
  • *ইউএপিএ-এনএসএ সহ সমস্ত দেশদ্রোহ আইনে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে;
  • জনস্বাস্থ্য খাতে অন্তত জিডিপির তিন শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে;
  • গর্ভবতী মহিলাদের চিকিৎসার জন্য সরকারকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে;
  • বারবার বলা সত্ত্বেও কোভিড টেস্ট এর পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে না কেন রাজ্য সরকার জবাব দাও;
  • বিনা পয়সায় সরকারকে অতিরিক্ত টেষ্টের ব্যাবস্থা করতে হবে;
  • চিকিৎসক, নার্স, সাফাই কর্মী সহ কোভিড ফ্রন্টলাইনারদের পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন রাজ্য সরকার জবাব দাও;
  • কোভিড রোগীর ভর্তির নিয়মে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে;
  • কোভিড নয়, এমন রোগীদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে;
  • হাসপাতালে ভর্তির সময় রোগীকে হয়রানি করা চলবে না;
  • PM কেয়ার্স তহবিলের সমস্ত অর্থ, সব রাজ্যের মধ্যে বণ্টন করতে হবে;
  • স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে চূড়ান্ত পর্যায়ে পরীক্ষার ফলাফল বিগত সেমিস্টার-এর ফলাফলের ভিত্তিতে প্রকাশ করতে হবে;
  • জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল করতে হবে;
  • এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট-২০২০ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
aevar

চলতে থাকা কোভিড অতিমারী কালে লকডাউন পরিস্থিতিতে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তাদের সঞ্চিত অর্থও আজ শেষের মুখে। এরকম দারুণ সংকট কালে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে। এই আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে ছেলেমেয়েরা কিভাবে টাকা জোগাড় করে ভর্তি হবে বা তাদের পড়াশোনার খরচ যোগাবে তা আজ সমজে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। লকডাউন পর্বে ইতিমধ্যেই এক বড় অংশের গরিব ছাত্রছাত্রীরা স্কুলছুট হয়েছে। আর্থিক অভাবে পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হয়ে শিশু শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। তায় আমরা এআইএসএ-র পক্ষ থেকে দাবি করছি;

সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে অ্যাডিমিশনের ফি মকুব করো।
এক শিক্ষা-বর্ষের সমস্ত ফি মকুব করো।

আজ রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ দিবসে পথে নেমেছে এআইএসএ। বিকেল ৫ টায়, রবীন্দ্র স্ট্যাচু মোড়, বিষ্ণুপুরে প্রতিবাদ প্রদর্শন ও বক্তব্য রাখেন বিষ্ণুপুর এআইএসএ ইউনিটের সদস্যগণ।

#NoFeesInCovid

seeqele

অস্বাভাবিক বিদ্যুত বিল আদায়ের প্রতিবাদে শিলিগুড়ি শক্তিগড় ব্রাঞ্চ কমিটির পক্ষ থেকে মিলনপল্লি বিদ্যুত দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ ও দপ্তর আধিকারিককে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। দপ্তর আধিকারিক আশ্বাস দেন যে অবিলম্বে সমস্ত অস্বাভাবিক বিল সংশোধিত করে দেওয়া হবে।

se

যাদবপুরের টিবি হাসপাতালে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মদিনে, তাঁর আবক্ষ মুর্তিতে বর্ষীয়ান কমরেড প্রণব মুখার্জী ১৫ আগস্ট মাল্যদান করেন। উপস্থিত সকলে তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন হাসপাতালের প্রতিনিধিবৃন্দ, ‘সংযোগ’ সংস্থার কর্মীবৃন্দ।

এরপর, সুকান্ত সেতু মোড়ে কবি সুকান্তের আবক্ষ মুর্তিতে মাল্যদান করে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।

muzbhr

গত ১০ ও ১১ আগস্ট সিপিআই (এমএল)-এর মুজাফ্ফরপুর পার্টি অফিসের ওপর দুর্বৃত্তরা ভয়াবহ আক্রমণ চালালেও পুলিশ দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারের কোন চেষ্টা তো করেই না, বিপরীতে তাদের মদত যোগায়। পার্টির বিহার রাজ্য সম্পাদক কুনাল পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তাকে ধিক্কার জানিয়েছেন। আক্রমণের এই ঘটনার তদন্তে পার্টির তরফে তিন সদস্যের এক কমিটি গঠন করা হয় -- দলে ছিলেন পলিটব্যুরো সদস্য ধীরেন ঝা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীনা তেওয়ারি এবং দারাউলি কেন্দ্রের বিধায়ক সত্যদেও রাম। তদন্তকারীরা তাঁদের রিপোর্টে জানিয়েছেন, জল জমা সমস্যার সমাধান না হওয়ায় পার্টির নেতৃত্বে নগর উন্নয়ন মন্ত্রী এবং বিজেপি বিধায়ক সুরেশ শর্মার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ পরিচালিত হচ্ছিল। এছাড়া পার্টি অফিস সংলগ্ন স্থানে একটি রাস্তার দাবিতেও স্থানীয় জনগণ আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ আগস্ট পার্টি অফিসে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় জনগণের সমস্যা সমাধানে ৫ ফুট চওড়া একটা রাস্তা তৈরি হবে। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাতেই ৩৫-৪০ জন বিজেপি সমর্থক ও গুণ্ডা মদ্যপ অবস্থায় অফিসে ঢুকে ভাঙচুর ও মারধর চালাতে থাকে। ওরা বলে রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত মানা হবে না, আর সেখানে সিপিআই (এমএল)-এর পতাকা না তুলে বিজেপির পতাকা ওড়াতে হবে। অফিসে উপস্থিত পার্টি নেতা ঋষি ঠাকুরের ১৫ বছরের ছেলে সুরেশ ঠাকুরের গলাটিপে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে, ঋষি ঠাকুরকেও রড দিয়ে মারা হয়। অফিসে উপস্থিত অন্যরাও ওদের হামলা থেকে রেহাই পায় না। স্থানীয় মিঠনপুর থানায় অভিযোগ জানানো হলেও পুলিশ কোনো সক্রিয়তা দেখায় না। পরদিন ১১ আগস্ট মধ্যরাতে স্থানীয় মিঠনপুর থানার পুলিশ, বজরং দলের সদস্য এবং দুর্বৃত্তরা মিলে পার্টি সমর্থকদের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে পরিবারের লোকজনদের মারধর করতে থাকে।

পুলিশি বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি মহিলারাও। মাঝরাতে পুলিশ লাইন কানহাউলির বিভিন্ন বাড়িতে ১০-১২ জন পুরুষ পুলিশ ঢুকে এআইপিডব্লিউএ-র সদস্যা এবং ছাত্রছাত্রী সংগঠন এআইএসএ-র সঙ্গে যুক্ত ছাত্রীদের মারধর করে, গালগালি দেয় ও দুর্ব্যবহার করে, ছাত্রীদের এবং তাদের বাড়ির লোকজনদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে।

apw

 

এই পুলিশি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মুজাফ্ফরপুর জেলা শাসকের অফিসের সামনে আইপোয়া-র নেতৃত্বে ধর্ণা সংগঠিত হয়। আইপোয়া বিভিন্ন দাবি জানিয়ে জেলা শাসক এবং এসপির কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। ওই স্মারকলিপিতে মিঠনপাড়া থানার প্রধান অফিসার ভগীরথ প্রসাদকে সাসপেন্ড করা ও তার অপকর্মের জন্য তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া, আহত মহিলাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, আইসার সঙ্গে যুক্ত ছাত্রীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা অভিযোগ তুলে নেওয়া এবং আইপোয়া-আইসা-সিপিআই(এমএল) অফিসে আক্রমণ চালানো দুর্বৃত্তদের অবিলম্বে গ্ৰেপ্তারের দাবি জানানো হয়।

সিপিআই(এমএল)-এর ওপর এই আক্রমণের পিছনে যে বিজেপির রাজনৈতিক আক্রোশ কাজ করেছে তা নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। বিজেপি নেতা ও মন্ত্রী সুরেশ শর্মাই এই হামলার মূল চক্রী। নীতীশ কুমার দাবি করে থাকেন যে “বিহার মে বাহার হ্যায়”, অর্থাৎ, বিহারে সবকিছুই অত্যন্ত ভালোভাবে চলছে। কিন্তু তা যে সর্বৈব মিথ্যা তা পরের পর ঘটনায় প্রমাণিত হচ্ছে। প্রশাসন-দুর্বৃত্ত গাঁটছড়া যে বিহারে এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সিপিআই(এমএল)-এর ওপর হামলা তাকে আরও একবার প্রকট করে তুলল।

fde31

ফ্যাসিবাদের চায় মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করতে। তাই তার অন্যতম হাতিয়ার বিস্মরণ। মানুষকে তার ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে পারলেই তার উদ্দেশ্য সফল। বিশেষত সেই ইতিহাস যদি হয় অবদমিতের অস্তিত্বের লড়াই; তাহলে সেই ইতিহাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই ফ্যাসিবাদ টিকে থাকতে চায়। ক্ষমতা এবং বিস্মরণের এই গাঁটছড়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের হাতিয়ার হল স্মৃতি-আমাদের ইতিহাস। বর্তমানে যখন আরও একবার দিকে দিকে শোনা যাচ্ছে অভুক্ত মানুষের মৃত্যুর খবর, মাইলের পর লাইল হেঁটে রাস্তাতেই পড়ে থাকছে মায়ের লাশ আর তার আঁচল ধরে অভুক্তসিশুর আকুতি যখন গোটা দেশকে এই ঠুনকো “আচ্ছে দিন”এর দিকেই সবথেকে বড়ো প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মুল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, তখন আরেকবার স্মৃতির পটে জমা ধুলো ঝেড়ে দেখে নেওয়া যাক আমাদের অতীত লড়াকু ইতিহাসের সোনালি পাতাকে। শাসক সংস্কৃতির বিস্মরণের বিরুদ্ধে আমাদের এই স্মৃতিই হবে আমাদের প্রতিরোধ।

১৯৫৯ সাল-বাংলায় খাদ্যহীন বুভুক্ষু জনতার মিছিল কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেদিনের শাসকের ভিতকে। বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় চাল, গমের মতো অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য। গ্রাম বাংলায় পরিস্থিতি দুর্ভিক্ষের আকার নেয়। শুরু হয় খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন। বামপন্থী দল এবং গনসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে “মূল্যবৃদ্ধি এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি” গঠন করে বাংলা জুড়ে শুরু হয় ব্যপক আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ওপর বর্বরোচিত দমন নামিয়ে আনে তৎকালীন বিধান রায়ের সরকার। ৩১ আগস্ট শহীদ মিনারে জমায়েত হন কয়েক লক্ষ মানুষ। তারপর সেখান থেকে মহাকরণ অভিমুখে যাওয়ার সময় শুধুমাত্র লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে পুলিশ। এই জোয়ারে আঠারোর বজ্রনির্ঘোষ সেদিন গর্জে উঠেছিল কলকাতার রাজপথে। ৩১ আগস্টের গণহত্যার বিরুদ্ধে পরেরদিন ১ সেপ্টেম্বর হাজারে হাজারে ছাত্র-যুবরা অবরুদ্ধ করে দেয় তামাম কলকাতা, ঘেরাও করে গণহত্যার কুশীলবদের বাড়ি। সেই মিছিলেও গুলি চলে। প্রাণ হারান আটজন ছাত্র, আহত হলেন সাতাত্তর জন। এই দুই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ৩ সেপ্টেম্বর রাজ্যজুড়ে পালিত হয় সাধারণ ধর্মঘট। সেইদিনও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গুলি চালানো হয়, প্রাণ হারান ১২ জন, আহত হন ১৭২ জন। অপরদিকে জেল উপচে পড়ছে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনরতদের নির্বিচার গ্রেপ্তারির ফলে। এইসব গণহত্যার বিরুদ্ধে ৮ সেপ্টেম্বর রাজ্য জুড়ে ছাত্রদের ডাকে পালিত হয় শহীদ দিবস। পরবর্তীকালে ৩১ আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবস এবং ১ সেপ্টেম্বর ছাত্র শহীদ দিবস পালন করে আসছে বামপন্থীরা।

দিবসগুলো পালন করা আসলে আরেকবার শপথ সানাইকে শানিয়ে নেওয়ার জন্য। আজ যে ফ্যাসিস্ট বিভেদকামী শক্তি বাংলার বুকে তাণ্ডব চালাচ্ছে, বিভেদ বিষে ভরিয়ে দিতে চাইছে বাংলার আকাশ-বাতাস-জল-মাটি; তাদের দিকে দৃপ্ত কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য আরেকবার ফিরে যেতে হবে ১৯৬৬ সালের দ্বিতীয় পর্বের খাদ্য আন্দোলনের দিকে। ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী একদিকে বসিরহাট অন্যদিকে কৃষ্ণনগর দুই শহরে খাদ্যের অধিকারের দাবিতে মিছিলে গিয়ে শহীদ হন দুইজন স্কুলছাত্র। একজনের নাম নুরুল ইসলাম আরেকজনের নাম আনন্দ হাইত। যারা বিভেদ বিষে জর্জরিত করতে চাইছে নুরুল-আনন্দের মাটিকে, তাদের সামনে ব্যরিকেড হয়ে দাঁড়াবে ৩১ আগস্টের খাদ্য আন্দোলনের শহীদরা, ১ সেপ্টেম্বরের ছাত্র শহীদরা, আনন্দ হাইত-নুরুল ইসলামের সংগ্রামী স্পর্ধা সেই ব্যারিকেডের সামনের সারিতে থাকবে।

আমরা ভুলতে পারি না ৯১ সালের ৩১ আগস্ট মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী মিছিলে গুলি চালিয়ে ‘নিরামিশ আন্দোলনকে আমিষ’ করে দেওয়া শাসকের ঔদ্ধত্যকেও।

দেশজুড়ে এই খাদ্য সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানির আকাশ ছোঁয়া দাম মানুষের পেটে লকডাউনকে জোরদার করছে। বিশ্ব খাদ্য সূচকে ভারত ইতিমধ্যেই ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। এই সংকটকে ঢেকে রাখার চেষ্টা চলছে সাম্প্রদায়িক তাস খেলে। এই ছক ভাঙতে হলে আরেকবার স্মৃতির হাতিয়ারকে শানিয়ে নিতে হবে আমাদের। ৩১ আগস্ট এবং ১ সেপ্টেম্বর শহীদ দিবসে ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইকে জোরদার করার শপথ নিতে হবে সম্মিলিতভাবেই।

-- নীলাশিস বসু   

24dis

(গত সংখ্যায় কয়েকটি জেলার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। এই সংখ্যায় বাকি কয়েকটি দেওয়া হল)

দক্ষিণ ২৪ পরগণা

১৫ আগষ্ট সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও কর্মসূচীর অঙ্গ হিসাবে দঃ ২৪ পরগণা জেলা অফিসের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, লক্ষীকান্ত অধিকারী, অঞ্জন ঘোষ, দেবাশীষ মিত্র সহ আরো অনেকে। জেলা সম্পাদক তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন যে আরএসএস গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে, তারা আজ দেশপ্রেমের নামে দেশের সংবিধান-গণতন্ত্র ধ্বংস করছে। এদের পরাস্ত করতে হবে, গণতন্ত্র রক্ষার্থে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

নদীয়া

নদীয়া জেলার ধুবুলিয়ায় নেতাজি পার্কে গত ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা হয়। স্বাধীনতার ৭৪ বছরে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম তাকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার যে বিষয়গুলি ছিলো আজ তাকেও সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচী পালন করা হলো। সিপিএম, আরএসপি সহ বামপন্থী দলগুলির যৌথ উদ্যোগে এই কর্মসূচী সংগঠিত হয়। জাতীয় কংগ্রেসও এতে অংশগ্রহণ করে।

ঐ দিন নাকাশীপাড়া ব্লকের যুগপুর বাজারেও পার্টির পক্ষ থেকে স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়।

deeess

৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসে ‘সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও এবং দেশ বাঁচাও’ কর্মসূচী বেলঘরিয়ায়

১৫ আগস্ট ২০২০ বেলঘরিয়া, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে কর্মসূচির সূচনা করেন। বেলঘরিয়া আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক অশোক সাহা উপস্থিত সবাইকে সমবেতভাবে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করিয়ে সংবিধান রক্ষা করার শপথ গ্রহণ করান। সোমা দাশগুপ্তের রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনা, অয়ন গুহ রায়ের স্বরচিত কবিতা পাঠ এবং করোনা জয়ী কমরেড সুবীর দাশগুপ্তের উপস্থিতি সভাকে অন্য মাত্রা দেয়। সুবীরকে পুষ্পস্তবক দিয়ে সম্বর্ধিত করা হয়। তিনি তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে চিকিৎসা পাওয়া ও সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় নার্সিং হোমের অকর্মণ্যতা, সরকারি হাসপাতালে ভর্তির হয়রানির কথা উল্লেখ্য করেন। বাঙ্গুর কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। এই হাসপাতালের রোগী পরিচর্যা ও নার্সিং পরিষেবা সন্তোষজনক বলে তিনি জানান। তার বার্তা, ‘ভয় পাবেন না, পরস্পরকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসুন’, যে সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন তার পরিবার, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের থেকে।

vee

 

রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ তাঁর হৃদয়গ্রাহী বক্তব্যে, সিদো কানহুর লড়াই, ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার বিস্তৃত প্রেক্ষাপট এবং স্বাধীনতা পরবর্তী গণসংগ্রামের উজ্জ্বল মুহূর্তগুলি তুলে ধরেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কোথাও ছিল না গেরুয়া বাহিনীর পূর্বসূরীরা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালি আর ভারতীয় জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজও তা অব্যাহত -- সে কথাই তিনি তথ্যসহ তুলে ধরেন। বিপরীতে কমিউনিস্টদের মানুষের পাশে থাকার, উজ্জ্বল ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সমস্ত সম্পদ ও সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়ে অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে, ভারভরা রাও সহ বহু প্রতিবাদী কণ্ঠকে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করছে, কাশ্মীরে মানবাধিকার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। নিজেদের কলঙ্কিত অতীতকে আড়াল করা এবং হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়ে রাম মন্দিরের ভূমি পূজনের দিনকে স্বাধীনতা দিবসের সাথে তুলনা করছে। এই মূঢ় স্পর্ধায় তারা অসংখ্য স্বাধীনতা সেনানীর আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদানের অবমাননা করেছে। শেষে তিনি ফাসিবাদী বিজেপিকে রুখতে ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান রাখেন।

মনোবিদ গোপাল শেঠিয়া তার বক্তব্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশুদের চাপমুক্ত রাখার ও তাদের সময় দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেন, এই সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সতর্কতা নিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়াই সুস্থ থাকার উপায়। শিবশঙ্কর গুহরায় স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের বিপ্লবী ভূমিকা নিয়ে তথ্যপঞ্জি রাখেন। এআইএসএ এবং এআইপিডাব্লিউএ থেকে বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে সায়ন্তন মিত্র ও অর্চনা ঘটক। সভার সঞ্চালক ছিলেন নবেন্দু দাশগুপ্ত।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত  

sredasa

প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে ‘আদালত অবমাননা’র রায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এযাবৎ সবচেয়ে উদ্ভট রায় হিসেবে পরিগণিত হবে। সর্বোচ্চ আদালত প্রশান্ত ভূষণের দুটি ট্যুইটের বিরুদ্ধে স্বতপ্রণোদিত হয়ে মামলা শুরু করল এবং শেষে শতাধিক পৃষ্ঠার এক রায় ঘোষণা করল যে রায়ে তাঁকে কেবলমাত্র ‘অবমাননা’র অপরাধেই নয়, এমনকি গণতন্ত্র ও ন্যায়ের সাংবিধানিক ভিত্তিকেই টলিয়ে দেওয়ার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হল।

বছরের পর বছর, এমনকি দশকের পর দশক যেখানে হাজার হাজার মামলা পেণ্ডিং পড়ে আছে, শুনানি পর্যন্ত হয়না, সেখানে যে দ্রুততায় এই বিচারটি সম্পন্ন হল তা লক্ষ্যনীয়। ‘আদালত অবমাননা’ বিধিটি আসলে ঔপনিবেশিক শাসনের মতবাদ থেকে আসা, যাকে ১৯৭১ সালে আইনে পরিণত করা হয়। এই আইনটির চরিত্র কতদূর অযৌক্তিক ও স্বৈরতান্ত্রিক তা বোঝার জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ২০০৬ সালে আইন সংশোধন করে অবমাননার অভিযোগের বিরুদ্ধে সত্যকে এক গ্রহণযোগ্য যুক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় (না হলে আইনের চোখে সত্যকথনও ছিল অবমাননাকর)।

আইনটি নিজেই যেখানে স্বেচ্ছাপ্রসূত ও অবাধ তখন কেবল বেছে বেছে প্রয়োগ হলে তা আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস সবচেয়ে প্রকট একটি ক্ষেত্র যেখানে একটি সরকার এবং একটি রাজনৈতিক দল ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে তাদের প্রতিশ্রুত দায়বদ্ধতাকে অবমাননা করে। আঠাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও সেই মামলা চলছে, আর সেই আদালতই ওই জমিকে মন্দির নির্মাণের জন্য ধার্য্য করেছে, তার ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপিত হয়ে গেছে। সমকাজে সমমজুরিকে বাধ্যতামূলক করেছে আদালত, কিন্তু একের পর এক সরকার তা অমান্য করে চলেও কখনও আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয় না। অথচ মাত্র দুটি ট্যুইটকে ভারতের বিচার বিভাগের অখণ্ডতা ও সুনাম ধ্বংস করার চরম আঘাত হিসেবে গণ্য করা হল।

প্রশান্ত ভূষণের ট্যুইটগুলিই অবশ্য আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সর্বপ্রথম চর্চিত ঘটনা নয়। ২০০২-র ৬ মার্চ লেখক অরুন্ধতী রায় এই একই ‘অপরাধে’ অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ২০১৭-র ৯ মে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক সিএস কারনানকে একই অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করেছিল সুপ্রিম কোর্ট এবং এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি, ছয় মাসের কারাবাসে, দণ্ডিত করেছিল। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের উচিৎ এই অবমাননা আইন ও তার অন্যান্য ঔপনিবেশিক দোসর সিডিশন ও মানহানির মতো আইনগুলি বিলুপ্ত করা। এইসব আইন কেবলমাত্র বিরোধী কণ্ঠস্বরকে অপরাধ বানাতে ও সমালোচনার স্বাধীনতাকে খর্ব করতেই প্রযুক্ত হয়।

প্রশান্ত ভূষণের জারি করা বিবৃতি, যাকে বিচারক অরুণ মিশ্র নিছক ‘তাঁর অপরাধকেই বাড়িয়ে তুলেছে’ বলে মনে করেন, তা গণতন্ত্রকে বিরোধিতাশূন্য বানানোর এবং সংবিধান লাগাতার আক্রান্ত হওয়ার এই দুঃসময়ে সত্য ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে জনতার বিবৃতি হিসেবে দেশজুড়ে অনুরণিত হয়েছে। প্রশান্ত ভূষণের প্রতি অভূতপূর্ব জনসমর্থন ভারতে প্রতিবাদ ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের পক্ষে সবচেয়ে ভরসা-জাগানো লক্ষণ।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য   

pragase

আমি মহামান্য আদালতের রায় পড়েছি। আমি ব্যথিত যে আমাকে সেই আদালতের অবমাননার দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, যার মহিমা আমি একজন অনুগত রক্ষী হিসাবে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে -- দরবারী হিসাবে নয়, হাততালি দেওয়ার লোক হিসাবে নয়। এই কাজ করার জন্য আমাকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছে -- ব্যক্তিগত মূল্য এবং পেশাগত মূল্য। আমাকে শাস্তি দেওয়া হতে পারে বলে আমি ব্যথিত নই, আমি ব্যথিত কারণ আমাকে একেবারেই ভুল বোঝা হয়েছে।

ন্যায়বিচারের ব্যবস্থাকে “বিদ্বেষপূর্ণ, রুচিহীন, সুচিন্তিত আক্রমণ” করার দোষে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে দেখে আমি হতচকিত। আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি যে এরকম আক্রমণ করার পিছনে আমার কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রমাণ না দিয়েই আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। স্বীকার না করে উপায় নেই, যে অভিযোগের ভিত্তিতে এই সুয়ো-মোতো নোটিশ দেওয়া হয়েছে, আদালত তার কোন কপি আমাকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি দেখে আমি হতাশ। এমনকি আমার উত্তরের হলফনামায় আমি যে মন্তব্যগুলো করেছি, বা আমার কৌঁসুলির অসংখ্য সাবমিশনেরও, আদালত কোনো জবাব দেননি।

আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত যে কোর্টের মতে আমার ট্যুইট “ভারতীয় গণতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের ভিতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে”। আমি শুধু আবার বলতে চাই যে ঐ দুটো ট্যুইট আমার প্রকৃত বিশ্বাসেরই প্রতিফলন, এবং তার প্রকাশ যে কোন গণতন্ত্রে অবশ্যই অনুমোদনযোগ্য হওয়া উচিৎ। যথাযথ কাজ করার জন্য বিচার বিভাগের নিজের কাজকর্ম নিয়েও প্রকাশ্যে আলাপ আলোচনাই প্রার্থনীয়। আমি বিশ্বাস করি যে সাংবিধানিক কাঠামো বজায় রাখার জন্য গণতন্ত্রে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের খোলামেলা সমালোচনা আবশ্যিক। আমরা আমাদের ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি যখন উচ্চতর আদর্শকে রুটিন দায়িত্বের ঊর্দ্ধে স্থান দিতেই হবে, যখন সাংবিধানিক কাঠামোকে রক্ষা করা ব্যক্তিগত এবং পেশাগত ভদ্রতা রক্ষার চেয়ে বেশি জরুরি, যখন বর্তমানের কথা ভেবে ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালনে পিছপা হওয়া চলবে না। এই সময় চুপ করে থাকা কর্তব্যে অবহেলার সামিল, বিশেষ করে আমার মতো আদালতের একজন অফিসারের পক্ষে।

আমার ট্যুইটগুলো আর কিছুই নয়, আমাদের গণতন্ত্রের ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আমি যে কাজকে সর্বোচ্চ দায়িত্ব বলে মনে করেছি, তা পালন করার সামান্য প্রয়াস মাত্র। আমি অন্যমনস্ক হয়ে ট্যুইটগুলো করিনি। যা এখনো আমার প্রকৃত বিশ্বাস তাই ট্যুইট করে প্রকাশ করার জন্য যদি আমি ক্ষমা চাই তাহলে সেটাই হবে কপট এবং অবমাননাকর। অতএব, জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী তাঁর বিচারসভায় যা বলেছিলেন, আমি কেবল সেটুকুই সরল করে বলতে পারি -- আমি ক্ষমা ভিক্ষা করছি না। আমি বিশালত্বের কাছে কোনো আবেদন করছি না। সুতরাং আমি সানন্দে সেই শাস্তি প্রার্থনা করছি যা আমার প্রাপ্য, আমার সেই কাজের জন্য পাওয়া উচিৎ যাকে আদালত অপরাধ বলে রায় দিয়েছেন, আর আমার কাছে যা নাগরিকের সর্বোচ্চ কর্তব্য।

kooopras

এআইপিএফ-এর পক্ষ থেকে চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে প্রতিবাদী কর্মসূচী পালিত হলো ২৪ আগস্ট। এই কর্মসূচীতে ‘সেভ ডেমোক্রেসি’ সংগঠন যোগদান করে। কবি সাধন বসু কবিতা পাঠ করেন, আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা ও শাস্তিদানের এই দ্রুত ও অনভিপ্রেত প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন আইনের ছাত্র পার্থ বসু, ‘সেভ ডেমক্রেসি’র জ্ঞানেন্দ্রলাল চক্রবর্তী, এপিডিআর-এর সনৎ রায়চৌধুরী, ও এআইপিএফের পক্ষ থেকে কল্যাণ সেন, সুদর্শন বসু প্রমুখ। উপস্থিত সকলের বুকে ঝুলছিল, ‘Critisism is not contempt, #WeStandWithPrasantaBhushan’ লেখা পোস্টার!

chu

 

২৫ আগস্ট কলকাতায় বউবাজারে ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার মোড়ে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভ সভা থেকে দাবি করা হয় প্রশান্ত ভূষণের উপর থেকে মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। এর পাশাপাশি দাবি করা হয়, ডাঃ কাফিল খান, ভারভারা রাও, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজসহ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে এবং ইউএপিএ সহ বিভিন্ন পীড়নমূলক ‘বিনা বিচারে আটক’ আইন প্রত্যাহার করতে হবে৷ সভায় বক্তব্য রাখেন বন্দীমুক্তি কমিটির পক্ষ থেকে বাসুদেব বোস, আইসার পক্ষ থেকে সৌমেন্দু মিত্র, মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র, সিআরপিপির পক্ষ থেকে সোমা মুখার্জী, ভীম আর্মির পক্ষ থেকে রবিরাম। সভায় বক্তারা তাঁদের জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে বারংবার দেশের ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীকে জানিয়ে দেয়, যতবার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হামলা নামাবে, দেশের নাগরিকদের সমালোচনা ও মতপ্রকাশের মতো মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হবে, ততবার সাধারণ মানুষ এইসমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদে একজোট হয়ে রাজপথের দখল নেবে।

var

 

২৫ আগস্ট বারাসাত জেলা আদালত চত্তরে এআইপিএফ এবং এপিডিআর বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ব্যস্ত সময়ে এই বিক্ষোভ সভা থেকে দাবি করা হয় প্রশান্ত ভূষণের উপর থেকে মামলা প্রত্যাহার কর। ঔপনিবেশিক ধারায় তৈরি করা আদালত অবমাননা আইন বাতিল কর।সংবিধান এবং বাক স্বাধীনতা রক্ষায় সমস্ত মানুষ এক হোন। বারাসাত আদালতের আইনজীবী মল্লিনাথ গাঙ্গুলি সভায় বক্তব্য রাখেন। এআইপিএফ-এর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন জেলার আহ্বায়ক নির্মল ঘোষ।

vessared

“প্রাচীরের আকার ধরে আকাশের জ্যোতি আচ্ছন্ন করতে উঠবে
তখন সেই প্রাচীর ধুলোয় লুটিয়ে দিতে হবে।”

এই কথা অচলায়তনে আছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চরিত্র বলছেন। সম্প্রতি বিশ্বভারতীর মেলার মাঠের চারপাশে পাঁচিল তৈরি করছিলেন কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ না বলে উপাচার্য ও তার বাহিনী বলা ভাল। সেই পাঁচিল ভেঙে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। কিছু কাল আগে পরিবেশ আদালতে বিশ্বভারতী বলেছিল, তারা মেলা প্রাঙ্গনের সীমানা নির্ধারণ ও ব্যারিকেড করবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ওই মাঠ ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘিরতে হবে। বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত আমাদের মতো অনেকেই জানেন, মেলার মাঠ একটি উন্মুক্ত জায়গা। সেই জায়গাকে ঘিরে ফেলা মানে বিশ্বভারতীর বুকের উপর পাঁচিল তোলা। তাছাড়া, স্থানীয় যুবক যুবতীরা এখানে খেলাধূলা করতে আসেন। আসবেনই। বিশ্বভারতীতে বাইরের পর্যটকদের ঘোরাঘুরিও বৈধ। হঠাৎ মেলার মাঠকে ঘিরে ফেলে উপাচার্য কোন বার্তা দিতে চাইছেন, বোঝা বেশ সহজ। তবে স্থানীয় লোক তাঁকে সমুচিত জবাব দিয়েছেন। পৌষমেলা, বসন্ত উৎসবের মতো ঐতিহ্যশালী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ঐতিহ্যবিরোধী কাজ করেছেন।

উপাচার্যের এ হেন ক্রিয়াকলাপ শান্তিনিকেতনকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা। এমনিতে বিশ্বভারতী জাতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বেশ নিম্ন মানের। উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর গেরুয়া সন্ত্রাসের কথা সুবিদিত। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়ার উপর যে বর্বর আক্রমণ চালানো হয়েছে, বিশ্বভারতীতেও অনুরূপ হামলা করে উপাচার্য গেরুয়া হুকুম পালন করছেন মাত্র। মুক্ত শিক্ষাঙ্গনটিকে তাঁরা বদ্ধ করতে চাইছেন। রবীন্দ্রনাথ যে উন্মুক্ত প্রতিষ্ঠানের বীজ বপন করে গিয়েছেন, তাকে বদ্ধ করতে না পারলে গেরুয়া স্বার্থ সিদ্ধ হবে না। তাই উপাচার্যের কাছে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘বিশ্বভারতীতে বহিরাগত’। সে কথা উপাচার্য নিজেই বলেছেন। নারী লাঞ্ছনার অভিযোগে অভিযুক্ত এই উপাচার্য আরও বলেছেন, মেলার মাঠে নাকি দেহ ব্যবসা হয়, মাঠে ব্যবহৃত কণ্ডোম পড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। একই অভিযোগ করা হয়েছিল জেএনইউ ও জামিয়ার ক্ষেত্রে। এই সব মিথ্যে অভিযোগে এরা বেশ পটু।  

এই উপাচার্যই আবার বিশ্বভারতীর গোলমাল নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁর সেই দাবি খারিজ হয়েছে কিন্তু ইতিমধ্যে সেখানে ইডি নাক

গলিয়েছে। কিন্তু কেন ইডি? এর আগে মেটিয়াবুরজে ত্রাণ বিলি নিয়ে গোলমালের সময়ও ইডি নাক গলিয়েছিল। স্বতস্ফূর্তভাবে জড়ো হয়ে বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ যখন পাঁচিল গুঁড়িয়ে দেন, তখন বুঝতে হবে, এই অচলায়তন তাঁরা সমর্থন করছেন না। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের অতি সক্রিয়তা তাই যুগপৎ হাস্যকর ও দুঃখজনক। এই সব কাণ্ডে স্পষ্টত বোঝা যায়, এই কাণ্ডের পেছনে কেন্দ্রের শাসক দল প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের এই সব কাজকে সমর্থন করছেন না। স্মরণে রাখা দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব চেয়ে বড় স্টেক হোল্ডার ছাত্রছাত্রীরা, সেখানে তাঁদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা ওই পাঁচিল চাইছেন না। আশ্রমিকদের মতামত নেওয়াও অত্যন্ত দরকারি। আশ্রমিকরাও প্রাচীরের নিন্দা করেছেন। কিন্তু উপাচার্য সে সবের ধারকাছ দিয়ে যাচ্ছেন না, তিনি ক্ষমতা ও পদের স্পর্ধা দেখাচ্ছেন বার বার।

যে দুই রাজনৈতিক দল বিশ্বভারতীর পাঁচিল নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বোঝা উচিত — তাঁদের মতামত নয়, ছাত্রছাত্রী ও আশ্রমিকদের মত নিয়ে যা করার করতে হবে। সীমানা নির্ধারণ আর ইটের পাঁচিল তোলা এক কথা নয়। সত্যিই বিশ্বভারতী এখন কুস্তির আখড়া হয়ে উঠেছে।

আবার বিশ্বভারতীর পাঁচিল ভাঙা নিয়ে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় বিজেপি পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। তাঁরা এখন সকলে রবীন্দ্র ভক্ত হয়ে উঠতে চাইছে, ভোট বড় বালাই। তাঁদেরই চালিকাশক্তি আরএসএস স্কুলের পাঠ্যবই থেকে বাদ দিতে চায় ইংরেজি, উর্দু শব্দ, উঠিয়ে দিতে চায় রবীন্দ্রনাথ ও মির্জা গালিবকে। আরএসএস-এর শিক্ষা শাখা বিদ্যাভারতীর প্রাক্তন প্রধান দীননাথ বাত্রা পাঁচ পাতার প্রস্তাবে দাবি করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মতো লোকজনের সাহিত্য না পড়িয়ে রাণা প্রতাপ, শিবাজীদের জীবনী পড়ানো হোক। রবীন্দ্রনাথের কবিতা নাকি মানবতাবিরোধী!

তাঁরা বিশ্বভারতীকে পাঁচিল দিয়ে অবরুদ্ধ করবেই। এবং মানুষই ভাঙবে সেই অবরোধ। কয়েক দিন আগে যেমন ভেঙেছেন।

-- শামিম আহমেদ  

vvcerew

ব্লুমসবারি নামে একটি ইংরেজি বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা ২২ আগস্ট সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা Delhi Riots 2020: The Untold Story (বাংলায়, দিল্লী দাঙ্গার অকথিত কাহিনী) নামক বইটি প্রকাশ করবে না। এই বইটির লেখিকা মোনিকা অরোরা, প্রেরনা মালহোত্রা, এবং সোনালি চিতলকার। তারা তিন জনে দিল্লী দাঙ্গার ওপর একটি তথ্য সংগ্রহকারী টিমে ছিলেন। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী “আর্বান নক্সাল” এবং “ইস্লামি জিহাদী” দের দ্বারা এই দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। এই বইটি প্রকাশ করার আগে বইটি নিয়ে একটি আলোচনা সভা ডাকা হয় যেখানে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, ভুপেন্দ্র যাদব, ‘অপ ইন্ডিয়া’ পোর্টালের সম্পাদক নুপুর শর্মা, এবং হিন্দুত্ববাদী চলচ্চিত্র পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল।

এই মানুষগুলি কারা সেটা জেনে নেওয়া যাক। কপিল মিশ্রের উস্কানিমূলক ভাষণের পরেই দিল্লীর দাঙ্গা শুরু হয়। ‘অপ ইন্ডিয়া’ হচ্ছে এমন একটি নিউজ পোর্টাল যাদের একমাত্র কাজ হল বিজেপির পক্ষে বাজারে বিভিন্ন মিথ্যা খবর ছড়ানো। বিবেক অগ্নিহোত্রি এমন একজন লোক যিনি ‘আর্বান নক্সাল’ শব্দবন্ধটির জন্মদাতা। এই ধরণের সভার অয়োজন দেখে লোকের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে আলোচ্য বইটিতে কি আছে। ফলত সাধারণ পাঠকপাঠিকা মহল থেকে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় তা এমন চেহারা নেয় যে চাপে পড়ে প্রকাশক সংস্থা ‘ব্লুমসবারি’ বইটি প্রকাশ করা থেকে পিছিয়ে আসে।

এর ফলে বিজেপি সমর্থক মানুষেরা এবং বেশ কিছু বিশিষ্টজনও বলেন যে প্রকাশকের বইটি প্রকাশ করা উচিত কারণ বাকস্বাধীনতার অধিকার খর্ব হচ্ছে। যারা প্রকাশক সংস্থাকে সমালোচনা করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধেও এই এক অভিযোগ তোলেন তাঁরা। এই অভিযোগ অর্থহীন, কারণ শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বহু মানুষ যে প্রকাশক সংস্থাকে সমালোচনা করলেন এবং শেষ পর্যন্ত সংস্থাটি যে সেই সমালোচনাকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হল তা সত্যের প্রতি সাধারণ মানুষের দায়বদ্ধতা ও সত্য প্রতিষ্ঠায় ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তাকেই প্রকাশ করে এবং মত প্রকাশ তথা সমালোচনার অধিকারকে তা শক্তিশালী করে। অন্যদিকে, কেবল সত্য কথা বলে ফেলার জন্য বহু মানুষ বহুভাবে যাদের দ্বারা নির্যাতিত, কারারুদ্ধ এমনকি খুন হয়ে যাচ্ছেন তাদেরই মুখে বাকস্বাধীনতার কথা শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু ফ্যাসিবাদীদের সংগঠিত অপপ্রচার ও হুমকির রাজনীতি বিভিন্ন সময়েই এই বাকস্বাধীনতার যুক্তির আশ্রয় নেয়।

ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রধান অস্ত্র হল তার প্রচার যন্ত্র এবং তার দ্বারা তৈরি করা অবাস্তব এক সামাজিক অবস্থা। প্লেটো লিখেছিলেন, বাকস্বাধীনতার অবাধ অধিকার যদি দেওয়া হয় তাহলে মাঝে মাঝেই এমন বক্তৃতাবাজের উদ্ভব হবে যারা মানুষের ভয় এবং ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রই শেষ করে দেবে। ফ্যাসিবাদীরা গণতন্ত্রের এই দুর্বলতার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। নাৎসি প্রচার মন্ত্রী গোয়েবেলস বলেছিলেন যে, সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে গণতন্ত্র তার নিজের শত্রুর হাতে গণতন্ত্র নষ্ট করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ারটা তুলে দেয়। আজকে যখন হাজার হাজার ইন্টারনেট ট্রোলরা সরকারের বিপক্ষের লোকেদের চুপ করানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তারা নিজেদের পক্ষে বাকস্বাধীনতার যুক্তি দেয়। গোদি মিডিয়ার টিভি নিউজ এংকররা যখন বিরোধীদের ওপর চেঁচায় তখন তারা একই যুক্তি দেয়। লক্ষ্য করুন যে এসব ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো যুক্তি তর্ক হচ্ছে না তবু আসছে বাকস্বাধীনতার যুক্তি।

এই ব্যাপক প্রচার অভিযান চালানোর লক্ষ্য হল সমাজের জ্ঞান বা সত্য খোঁজার সামর্থ্য নষ্ট করে দেওয়া। তার বদলে প্রধান বক্তৃতাবাজের কথা চুড়ান্ত সত্যের আসনে স্থাপন করা। এর জন্যে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব। এরকম নিশ্চয় শুনেছেন যে “৫০ বছরের মধ্যে মুসলমানরা সংখ্যা গড়িষ্ঠ হয়ে যাবে। সেই লক্ষ্যে মুসলমান যুবকেরা হিন্দু মেয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্মান্তরণ করে বিয়ে করছে”। সঙ্ঘীরা এর নাম দিয়েছে “লাভ জিহাদ”। এটি একটি জনপ্রিয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। দিল্লীর দাঙ্গার পেছনে যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি কাজ করছিল তা হল “সিএএ-এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন দেশকে ভেঙে ফেলার একটা চেষ্টা। এর পেছনে রয়েছে আর্বান নক্সাল আর ইস্লামিক স্টেট”। একইভাবে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার সময় ছড়িয়ে দেওয়া হল যে মুসলমানরা করোনা ছড়াচ্ছে। যার ফলে হুগলিতে মুসলমানদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হল। মাঝে মাঝেই শোনা যায় যে পশ্চিমবাংলায় নাকি “দু কোটি” বাংলাদেশী ঢুকে পড়েছে। নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাটে ভোটে জেতানোর জন্যে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসবাদীরা মোদীকে মারার জন্যে ঢুকে পড়েছে। তারপর তাদেরকে পুলিশ মারলো। পরে জানা গেল সবক’টা ফেক এনকাউন্টার, পুলিশের সাজানো সংঘর্ষ। আজকের ভারতে এরকম আরো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদাহরণ একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবেন।

এই ভুয়ো তত্ত্বগুলো ফেসবুক এবং ওয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বারবার তা মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া হয়। বিজেপির বিরোধীরা এগুলোকে পাত্তা না দিলে বলা হয় যে তারা হিন্দু বিরোধী এবং দেশদ্রোহী। তাদের ওপর ভুয়ো ধর্ম নিরপেক্ষতার অভিযোগ চাপানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সত্যের জন্যে গবেষণা চলে, সেগুলোকে বলা হয় দেশদ্রোহীদের আখড়া। মানুষ সত্য এবং মিথ্যের ফারাক করতে পারেনা। চাটুকার মিডিয়া চ্যানেলগুলো প্রতিনিয়ত সত্যকে ঝাপসা করে তোলে।

সমাজের এই অবাস্তব অসত্যের অবস্থাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। ব্লুমসবারির পশ্চাদপসরণ এই অবাস্তব অসত্যের বেড়াজাল ভেঙ্গে সত্যবদ্ধ সক্রিয়তার বিজয়ের সম্ভাবনার প্রতি মানুষের আস্থাকেই জোরালো করবে।

- প্রত্যুষ নন্দী  

wwcare

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পের প্রথম দৃশ্যেই মৃত্যুঞ্জয় প্রথমবার রাস্তায় একজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল, যা তাকে উত্তেজিত করে তোলে, তাকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সে মৃত্যুর সর্বোচ্চ ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পায়; চিত্র পরিচালক জন আব্রাহামের ‘আম্মা আরিয়ান’ সিনেমাটিতে পুরুষাণ নামের একটি ছেলে স্কলারশিপ পেয়ে দিল্লি যাওয়ার পথে রাস্তায় একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে, মুখটা বেশ চেনা চেনা। সে জানতে পারে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে, কাজেই সেই মুহূর্তের পর পুরুষাণের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করতে থাকে, তাকে যেন কিছু একটা করতেই হবে, মৃত ছেলেটির মা-কে বিষয়টা জানাতেই হবে, না হলে শান্তিতে থাকা যেন কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। পুরুষাণ বেরিয়ে পড়ল।

ভারতবর্ষে বেশ কিছু সময় ধরে শিক্ষার বেসরকারীকরণের বিরোধিতায় এক বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন চলছে। এই সিনেমাটির একটি দৃশ্যে দেখানো হয় মেডিকেল স্টুডেন্টদের আন্দোলন চলছে, সেখানে একটি পোস্টারে লেখা “আমরা শিক্ষাব্যবস্থার বাণিজ্যকরণের বিরুদ্ধে, আমাদের লড়াই সেই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে যা পুঁজিবাদকে সাহায্য করে”- এ থেকে বোঝা যায় এই লড়াই সমগ্র দেশজুড়ে বহুকাল ধরেই চলছে। আর একদিকে পুরুষাণ লড়াই চালিয়ে যায় যদি মৃত ছেলেটির পরিচয় জানা যায় -- এক-দুজন যাকে সম্ভব তাকেই ধরেই মর্গে নিয়ে যাচ্ছে, কারণ ছেলেটি কে তা জানতেই হবে!

নাম জানা গেল। ছেলেটির নাম হরি, তবলা বাজায়, বেশ লম্বা ছিপছিপে চেহারা, শান্ত প্রকৃতির। নাম যখন জানা গেছে এবার তার মাকে খবরটাও দিতে হবে।

“ফ্রি! ফ্রি! নেলসন ম্যান্ডেলা!” বলে শ্লোগান দিতে দিতে বেশ কিছু ছেলের দল একটি কামরার ভেতরে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ফিজিক্যাল অ‍্যাক্ট করে যাচ্ছে এবং আরেকজন একটি টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের সাথে গলা মেলাচ্ছে। একের পর এক আরো কিছু মানুষ জড়ো হলো পুরুষাণের সাথে, যারা কমবেশি যেটুকু জানে হরির ব্যাপারে। তারপর তারা ছোট একটা ডকে আরো একজনের কাছে গেল, সেখানে জেলেরা পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার মারছে জায়গায় জায়গায়, প্রতিটা বর্গ এক একটা আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে যেন।

জন আব্রাহাম হলেন চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র, ‘অডিসা কালেক্টিভ’ নামক একটি মুভমেন্ট শুরু করেন এক উন্নত সমাজ ব্যবস্থার লক্ষ্যে, ঘটকের মতন তিনিও মার্কসবাদে বিশ্বাস রাখতেন, তাঁর এই ‘আম্মা আরিয়ান’ ছবিটির দৃশ্য, দৃশ্যে ব্যবহৃত শব্দ, দ্বন্দ্ব তাঁর এই ফিলোসফির প্রতিফলন মাত্র। সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশের অত্যাচার কি পর্যায়ে চলে গেলে একজন মহিলা অচেনা কাউকে দেখলেই নিজের ভাইকে আর ঘর থেকে বেরোতে দেয়না, ভয় পায় যদি পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলে, ভয় পায় যেটুকু মানসিক ভারসাম্য রয়েছে সেটুকুও যদি সে হারিয়ে ফেলে! কাজেই তার ভাইয়ের আর পুরুষাণ ও অন্যান্যদের সাথে মিলে ‘আম্মি’কে খুঁজতে বেরোনো হলো না।

হরিকে পুলিশ তার এক পরিচিতের বাড়িতে গ্রেপ্তার করতে এলে এক মহিলার ব্যাপারে কু-মন্তব্য করে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখে একটা সপাটে থাপ্পড় মারলে ঠিক যে রকম আওয়াজ হয়, তেমনিই আওয়াজ হয়েছিল যখন হরি ওই পুলিশ অফিসারটিকে থাপ্পর মারে, যার ফলস্বরূপ তার সমস্ত আঙ্গুলগুলো ভেঙে দেওয়া হয়।

স্টেট সবসময় মানুষের সেটুকুই স্বাধীনতা পছন্দ করে, যতটুকুতে তাদের কোনো ক্ষতি হয় না। এই ভারত বর্ষ ৭৪% শ্রমিকশ্রেণীর দেশ, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এখানে শ্রমিকদের হাতে কোনো ক্ষমতাই নেই, তাদের জীবনের সুরক্ষা বলেও কিছুই নেই, দুবেলা ঠিকমতো পেট ভরে খেতে পারবে কিনা সেটাও জানেনা, আর নিজেদের অধিকারের কথা বললে বা প্রশ্ন করলে নকশাল-আদিবাসী বলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জেলে ভরে দেওয়া হয়, নির্মম অত্যাচার করা হয়। ঠিক এরকম ঘটনাগুলোই জন তাঁর সিনেমাটিতে সোজা সাপটাভাবে দেখিয়েছেন, তাদের সংগ্রাম, আন্দোলনের কথা বলেছেন। একটি দৃশ্যে দেখা যায় শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলছে আর অপরদিকে স্টেটের পুলিশ এবং গুন্ডারা তাদের ওপর কিভাবে হামলা চালাচ্ছে। তবে সংগ্রাম থামানো কোনদিন যায়নি।

আমার মনে আছে ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ সিনেমাটির একটি সংলাপ ঘটক বলছে, “We are confused, utterly confused”. এই হরি চরিত্রটিও আলাদা কিছু ছিল না- একদিকে রক মিউজিক চলছে, আর ও হাতে চে-র বই নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে -- ক্যামেরা ধীরে ধীরে প‍্যান করল চলে থেকে মার্ক্স, মার্ক্স থেকে চেয়ারম্যান মাও-এর দিকে, যা স্পষ্ট করে দেয় তখনকার র‍্যাডিক্যাল লেফট পলিটিক্সের কথা।

থানায় বোম পড়ল, পুলিশ তো ভয়ে আর থানা থেকে বেরোচ্ছে না, হরি এবং তার সাথীরা বন্দুক লুট করেছে। বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে তখন এই একই চিত্র।
‘আম্মা আরিয়ান’এ বইয়ের পাতা খুলে প্রশ্ন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বুদ্ধিজীবীগণ কী লেকচার দিয়েছে, কে কত দামি জামা কাপড় পরেছে তা কেউ জিজ্ঞেস করবে না; কিন্তু এই দেশের পরবর্তী প্রজন্ম একদিন জিজ্ঞেস করবে যে তারা কোথায় ছিল, যখন দেশের গরিব মানুষদের উপর অত্যাচার হচ্ছিল, তাদের সমস্ত স্বপ্নকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছিল- কোথায় ছিল তারা!

সিনেমা হল একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যম, যেখানে একটা দৃশ্যে দুর্ভিক্ষের ছবি পরপর স্ক্রিনে ভেসে উঠছে, হরি যেন আমাদের প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছে, যেন বলছে রাস্তায় নেমে সংগঠিত আন্দোলনই মুক্তির একমাত্র পথ। এই দুর্ভিক্ষের সময় যখন পুঁজিবাদীরা চড়া দামে খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করে দিচ্ছে, তখন অন্যদিকে আরেকজন মানুষ, যারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে, তারা মার্চেন্টের কাছ থেকে চাল লুট করে সবার মধ্যে বিলিয়ে দেয় -- এ যেন রাষ্ট্রের একরূপ হার! তারপর সেই লড়াকু মানুষগুলোকে কি আর আটকানো যায়, তারা সব মশাল হাতে বেরিয়ে পড়ল, তারা যেন বলছে -- যত হামলা করো সব সামলে নেব, চ্যালেঞ্জ তোমায় যদি মারতে পারো!

সিনেমাটিতে প্রতিবার একজন বিভিন্ন মুখশ্রী নিয়ে এসে বলতে থাকে -- আমিই সেইই হাজার চুরাশির মা, আমিই গোর্কির উপন্যাসের সেই মাদার, নকশাল আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি শহীদের মা আমিই- আমি আজও অপেক্ষা করছি আমার সন্তানের। এই অপেক্ষা ততদিন চলতে থাকবে যতদিন না আমার সন্তানদের স্বপ্ন পূরণ না হয়। বর্তমানের সাথে তুলনা করে বললে সিনেমাটিতে রোহিত ভেমুলা বা সারজিল বা নাজিবের মায়েদের দেখা যাচ্ছে, তাঁরাও একইভাবে রাষ্ট্রের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে -- ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’!

এই লড়াই মুক্তির লড়াই, এই লড়াই লিবারেশানের লড়াই। আর ‘আম্মা আরিয়ান’এর অর্থ হল -- আমি আমার মাকে বিষয়টা জানাতে চাই।

--- আকাশ ভট্টাচার্য  

swwe

মিনিয়াপোলিসে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনা স্মৃতি থেকে এখনও ফিকে হয়নি। আবারও আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলি গেলেন জ্যাকব ব্লেক নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ। একটা নয়, পর পর সাতটা। অপারেশন সফল হওয়ায় তিনি মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছেন, কিন্তু আমেরিকায় আবার শুরু হয়েছে ব্যাপক বিক্ষোভ। ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স আন্দোলনের এই নতুন তরঙ্গ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে। গাড়িতে ওঠার সময় কেনোশা পুলিশ পিছন থেকে গুলি করে ওই কৃষ্ণাঙ্গকে। ব্লেক ছিলেন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। তাও এভাবে তাকে গুলি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হল। এ খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র দাবানলের মতো বিক্ষোভের আগুন ছড়ায়। সম্প্রতি পুলিশের হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর জেরে একবার উত্তপ্ত হয়েছিল আমেরিকা। রবিবার রাতে আমেরিকার কেনোশা শহরের ঘটনা সেই নিভে আসা আগুন ঘৃতাহূতি দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা ট্রাক-সহ একাধিক গাড়িতে আগুন দেওয়াই শুধু নয়, রাস্তায় একাধিক জিনিস ভাঙচুর করেন। রাস্তার ধারের বহু ভবনের জানালার কাচ ঢিল মেরে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের নিরস্ত্র করতে গেলে, সংঘর্ষ বেধে যায়। বিক্ষোভ আন্দোলন ক্রমশ ছড়াচ্ছে।

-- সৌভিক ঘোষাল  

raree

মাস তিনেক আগে ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষের শেষ ত্রৈমাসিক ও সামগ্রিক বর্ষের দেশের আভ্যন্তরীণ আয় উৎপন্ন (জিডিপি) সংক্রান্ত তথ্য সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ওই ত্রৈমাসিকের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৩.১%, এবং পুরো বছরের বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪.২%। এগারো বছর আগে গত ২০০৮-২০০৯ সালের ৪র্থ ত্রৈমাসিক ও ওই বছরে সামগ্রিক বৃদ্ধি হার ছিল যথাক্রমে ০.২% ও ৩.৯%; তারপরে এই প্রথম ভারতীয় অর্থনীতির এমন দুরবস্থা হল। মনে রাখা দরকার ২০০৮-০৯ সাল ছিল বিশ্বজোড়া মন্দার বছর, যাকে গ্রেট ফিনান্সিয়াল ক্রাশ বলে অভিহিত করা হয়। অনেকে যদিও গত ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির শ্লথতার কারণ হিসেবে দেশের লকডাউনকে দায়ী করতে চাইছেন, তাদের মনে রাখতে হবে লকডাউন ওই সময়ে মাত্র এক সপ্তাহ চলেছিল। তাছাড়া ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হারের বিপরীতমুখি যাত্রা যে কেবল ২০১৯-২০ সালের শেষ ত্রৈমাসিকেই ঘটছে এমন নয়, ক্রমান্বয়ে তা গত ৮টি ত্রৈমাসিক ও দু বছর ধরে ঘটে চলেছে। যদিও পরিসংখ্যান নিবন্ধকে ভারী করে তোলে তবুও জিডিপি বৃদ্ধির শ্লথতাকে প্রতীয়মান করে তুলতে ১২টি  ত্রৈমাসিক ও তিনটি বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হারকে একটি তালিকায় তুলে ধরলাম।

তালিকা-১ : ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত ত্রৈমাসিক ও বৎসরের জিডিপি বৃদ্ধির হার

ttn1

 

লক্ষ্যণীয় যে ২০১৭-১৮ সালের জানুয়ারী মার্চের ত্রৈমাসিক পর্যন্ত ৪টি ত্রৈমাসিক (২০১৬-১৭ সালের শেষ ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৩%) বৃদ্ধির হার ক্রমাগত বেড়েছে। অবশ্য সেটা অনেকটাই মনে হয় তথ্যের কারচুপি, কারণ ওই সময়ে নোটবাতিল দেশের অর্থনীতিতে যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি তা দেখাতে দেশের রাজাধিরাজ মরিয়া ছিলেন ও পারিষদেরা তাকে তোষামোদে খুশি করেছিল। কিন্তু তারপরে ৮টি ত্রৈমাসিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নীচের দিকে নেমেছে। সেই হিসেবেও যে গরমিল আছে তাও বলাই বাহুল্য। মোদি সরকারের প্রথম অর্থনৈতিক মুখ্য উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামনিয়ানও তেমনটাই বলেছেন এবং দ্বর্থ্যহীন ভাষায় জানিয়েছেন সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় বৃদ্ধির হার প্রায় ২.৫% কম। এই যে জিডিপির বৃদ্ধির হারের ক্রমাগত কমতে থাকা তা দেশের অর্থনীতির মন্দার দিকে যাত্রার ইঙ্গিত অবশ্যই দিচ্ছে। কেবল তাই নয়, ২০১৮-১৯এর প্রথম ত্রৈমাসিক থেকে ২০১৯-২০ সালের শেষ ত্রৈমাসিক পর্যন্ত ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্রের বৃদ্ধি ক্রমাগত কমছে। এবং গত তিনটি ত্রৈমাসিকে তা ঋণাত্মক, অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে উৎপাদন কমেছে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রের শিল্পগুলির দিকে তাকালে অর্থনীতির ছন্নছাড়া অবস্থা আরো প্রকট হচ্ছে। ওই ক্ষেত্রটি ৮টি শিল্প নিয়ে গঠিত -- কয়লা, অপরিশোধিত পেট্রোল, প্রাকৃতিক গ্যাস, শোধনাগারের উৎপাদন, সার, সিমেন্ট, ইস্পাত ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। মূল ক্ষেত্রটির গত এক বছরের মাসিক বৃদ্ধির হার নিয়েও একটি তালিকা দেওয়া হল। মনে রাখতে হবে বৃদ্ধির হার ধনাত্মক ও হ্রাসের হ্রার ঋণাত্মক, এবং উভয় হারই গত বছরের সংশ্লিষ্ট মাসের উৎপাদনের নিরিখে। অর্থাৎ জুন ২০২০-র -১৫% বৃদ্ধির অর্থ হল গত বছরের জুন মাসে যা উৎপাদন হয়েছে তার তুলনায় এ বছরের জুন মাসে ১৫% কম উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ, গত জুনে উৎপাদন ১০০ হলে এই জুনে উৎপাদন হয়েছে ৮৫। ওই হিসেবে দেখা যাবে (তালিকায় নেই) ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে মূল ক্ষেত্রের শিল্পগুলির কোনো বৃদ্ধিই হয়নি। আর ২০১৯এর এপ্রিল-জুনের তুলনায় ২০২০র এপ্রিল-জুনে উৎপাদন ২৪.৫% কমেছে। এবছরের এপ্রিল-জুনের ৩ মাসে ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদন ভয়াবহ কমেছে। ইস্পাত উৎপাদন গত বছরের তুলনায় অর্ধেকের কম হয়েছে, সিমেন্টের ক্ষেত্রে সেই কমতি ৪০%।

তালিকা-২ : জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত পরিকাঠামো ক্ষেত্রের (কোর সেক্টর) উৎপাদন বৃদ্ধির হার

yt2

 

যদিও অতিমারি ও লকডাউন জিডিপিকে যথেষ্ট ব্যাহত করছে কিন্তু বহু আগে থেকেই যে অর্থনীতি গতি মন্থরতায় ভুগছিল তা বোঝাই যাচ্ছে। যদি শ্রমজীবি মানুষের অবস্থার দিকে তাকানো যায় তাহলেও তা বেশ প্রকট হবে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০১৮-১৯ সালের তথ্য জানিয়েছিল যে বেকারির হার ৪৫ বছরের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল। অতিমারি সেই দুর্ভোগকে আরো বাড়িয়েছে, সিএমআইই-র তথ্য অনুসারে তা এখন ৮%-কে ছাড়িয়েছে, আর গত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত ১ কোটি ৯০ লক্ষ বেতনভোগি চাকুরিজীবি চাকরি হারিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০১৭-১৮ সালের যে সমীক্ষা সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি কিন্তু ছিদ্রপথে বেরিয়ে পড়েছে তার তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণ ভারতে ২০১১-১২ সালের তুলনায় মাথাপিছু প্রকৃত ভোগব্যয় ২০১৭-১৮ সালে, ৬ বছরে প্রায় ৯% কমেছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা ও খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১.৬% ও ১.৮%। তেমন খুব একটা তফাৎতো নয়। তাহলে গ্রামীণ ভারতের এতবড় জনসংখ্যার মাথাপিছু ভোগব্যয়ে এত বড় হ্রাস হল কেন?

কিন্তু বছরের পর বছর ভারতের খাদ্য নিগম (এফসিআই)-এর খাদ্যশস্য সংগ্রহের অনুাপাত (মোট উৎপাদনের নিরিখে) বাড়ছে এবং ২০০৮এর বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটের পরে তা অতি দ্রুত বাড়ছে। ওই অনুপাত ১৯৯১ সালে ছিল ১২.৭%, ২০১৭-তে তা বেড়ে ২৯.৬% হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সেই অনুপাতের গড় ছিল ২২.৪%, ২০১১ থেকে ২০১৭ এই ৬ বছরে গড় হয়েছে ২৮.৫%। কেবল তাই নয়, এফসিআইএ’র গুদামে পণ্যের ভাণ্ডারও বেড়েছে বছর বছর। যেমন ২০১৭-র জুন থেকে ২০২০-র জুন পর্যন্ত সেই ভাণ্ডার ছিল যথাক্রমে ৫৫৭ লক্ষ, ৬৮১ লক্ষ, ৭৪৩ লক্ষ ও ৬৩৫ লক্ষ মেট্রিক টন। উৎপাদনের তুলনায় ভাণ্ডার অতি দ্রুত বেড়েছে এবং প্রতি ক্ষেত্রেই জুনের ভাণ্ডার সেই বছরের উৎপাদনের তুলনায় ২৫% বেশি। ১৯৯০এর দশকের শেষেও তা ১৫% বেশি ছিলনা। এরমানে বাজারে একটি ‘আপাত’ অতিরিক্ত জোগান রয়েছে, অর্থাৎ যথেষ্ট চাহিদা নেই, যার ফলে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য কিনতে চাইছে না। সরকার শস্য ভাণ্ডার বজায় রাখতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতিতে খাদ্যশস্যের এরকম কম চাহিদার কারণ কী যখন জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ও খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির হারের মধ্যে তেমন তফাৎ নেই?

নয়া উদারনীতির ফলে যখন দ্রুত হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হচ্ছে তখন খাদ্যশস্যের চাহিদারও দ্রুত হারে বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল। একটা ছেঁদো যুক্তি দেওয়া হয় যে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটছে বলেই এমনটা হচ্ছে। খাদ্যশস্যের চাহিদার ধরণের পরিবর্তন হতে পারে; প্রক্রিয়াকৃত খাদ্যশস্য যেমন, বিস্কুট, পাউরুটি, কেক, নুডলস, পাস্তা, ম্যাকারনি ইত্যাদি বা প্রাণীজ খাদ্য, দুধ, ডিম বা মাংসের ভোগ চাহিদা বাড়তে পারে, কিন্তু সেইসব দ্রব্য প্রস্তুতের জন্য এমনকি প্রাণীজ খাদ্যের জন্যও পরোক্ষ ভাবে খাদ্য শস্যের চাহিদা বাড়বে, যদি জীবনযাত্রার মান বাড়ে। ফলে মাথাপিছু খাদ্য শস্যের চাহিদা বাড়ার কথা। যেহেতু মাথাপিছু খাদ্যশস্যের উৎপাদন তেমন একটা বাড়েনি তাই দেশে ধারাবাহিক ভাবে অতিরিক্ত চাহিদা থাকার কথা। তাতো হয়ই নি, ভারত বিদেশে খাদ্যশস্যের নীট রফতানিকারক রয়ে গেছে। এই বৈপরীত্যের কারণ হল যে, যদিও নয়া উদারনীতির ফলে জিডিপি দ্রুত বেড়েছে শ্রমজীবি জনতার মাথাপিছু আয় বাস্তবে তেমন কিছু বাড়েনি, হয়তো বা সাম্প্রতিক কালে কমেছে, যখন খাদ্যশস্যের সরকারী ভাণ্ডার দ্রুত বেড়েছে।

১৯৯১ সালে মাথাপিছু খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল ৫১০ গ্রাম, ২০০৭ সালে ছিল ৪৪৩ গ্রাম, ২০১৮ সালে ৪৯৪ গ্রাম। নয়া উদারনীতির জমানায় অসাম্য প্রভূত বেড়েছে, ফলে ধনীর মাথাপিছু খাদ্যশস্যের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভোগের পরিমাণ বেড়েছে। তাই, শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব মাথাপিছু ভোগ কমেছে। যেহেতু ধরা যেতে পারে আয় বাড়লে খাদ্যশস্যের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভোগের যোগফল বাড়ে, কমলে কমে; তাই শ্রমজীবী জনতার মাথাপিছু বাস্তব আয় কমেছে। উদারনীতির সময়ের দুটি এনএসএসও তথ্য, ১৯৯৩ ও ২০১১-১২ সালে, এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিতই করেছে। ওই সময়ের মধ্যে ২২০০ ক্যালরি প্রতিদিন ভোগ করতে অক্ষম গ্রামীণ জনগণের অনুপাত ৫৮% থেকে ৬৮% হয়েছে; এবং ২১০০ ক্যালরি প্রতিদিন ভোগ করতে অক্ষম শহুরে জনগণের অনুপাত ৫৭% থেকে বেড়ে ৬৮% হয়েছে। মনে রাখা দরকার গ্রামে ২২০০ ক্যালরি প্রতিদিন ও শহরে ২১০০ ক্যালরি প্রতিদিনের সংস্থান দারিদ্র সীমা হিসেবে নির্ধারিত হয়। ২০১১-১২-র পরে অবস্থাটা পাল্টায়নি বলেই মনে হয়। কারণ প্রাপ্যতা বাড়লেও সরকারী ভাণ্ডারও আরো দ্রুত বেড়েছে।

নীতি আয়োগের তথ্যও তেমনটাই জানাচ্ছে। নীতি আয়োগের তথ্য বলছে যে, ২০১৮ সালের তুলনায় ভারতের দারিদ্র বেড়েছে, কারণ দারিদ্র দূরীকরণের যে ভিত্তিসূচক ২০১৮ সালে ছিল ৫৪, তা ২০১৯এ কমে ৫০ হয়েছে। ২২টি রাজ্য কিংবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সেই সূচক কমেছে (অর্থাৎ দারিদ্রের তীব্রতা বেড়েছে) সেগুলির মধ্যে সূচকের হ্রাস সব থেকে বেশি হয়েছে অরুণাচল প্রদেশে ১৮, বিহার ও ওড়িষায় ১২। ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই সংক্রান্ত সূচকেরও গতি নিম্নাভিমুখী। ফলে অভুক্ত অর্ধভুক্তের সংখ্যাও বেড়েছে। সূচকটি ৪৮ থেকে কমে ৩৫ হয়েছে: ছত্তিশগড়ে সূচকটি কমেছে ১৯ পয়েন্ট, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও কর্নাটকে ১৭ পয়েন্ট। আর্থিক বৈষম্যের সঙ্গে লড়াই-এর সূচকটিও সারা দেশে ৭ পয়েন্ট কমেছে। ২৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সূচক কমেছে। ত্রিপুরায় তা ৪৪ পয়েন্ট কমেছে, গুজরাটে ২০ পয়েন্ট কমেছে। আর্থিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে বহুচর্চিত অক্সফ্যামের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনটিও দেশে তুমুল আর্থিক বৈষম্যের অবস্থা তুলে ধরেছে। ২০১৭ সালে সৃষ্ট সম্পদের ৭৩% দখল করেছে ১% ধনীতম ব্যক্তিরা। দেশের ৭৭% সম্পদের মালিক ১০% ধনীতম ব্যক্তিবর্গ। অপরদিকে ৫০% দরিদ্রতমদের ভাগে পড়েছে সৃষ্ট সম্পদের ১%। ২০০০ সালে ভারতে শতকোটিপতি (বিলিয়নেয়ার)দের সংখ্যা ছিল ৯ জন; ২০১৭-তে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০১ জন। শতকোটিপতিদের সম্পদ ওই সময়কালে ১০গুণ বেড়েছে, এবং তাদের সামগ্রিক সম্পদ ২০১৮-১৯ সালের বাজেট বরাদ্দ ২৪ লক্ষ ৪২ হাজার ২২০ কোটি টাকার থেকে বেশি। অন্যদিকে কেবল স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় করতে গিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ২ জন মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছে।

সামগ্রিকে বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ভাল নেই। গত কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতিকে সামাল দিতে পারছে না শাসকেরা। উপরন্তু কোভিড ও লকডাউন সংক্রান্ত অদূরদর্শিতা ও অগণতান্ত্রিক নীতি দেশের জনগণের কাছে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। আত্মনির্ভরতার শ্লোগানের আড়ালে দেশের সরকারী সম্পদকে ব্যক্তি মালিকদের হাতে তুলে দিতে চাইছে সরকার। দোহাই দেওয়া হচ্ছে সরকারি ক্ষেত্রের অলাভজনক হওয়ার। কিন্তু তথ্য বলছে যে, প্রায় সাড়ে তিনশ কেন্দ্রীয় সরকারী উদ্যোগের মধ্যে কেবল গোটা ষাটেক লোকসান করেছে। সব মিলিয়ে ২০১৮-১৯ সালে নগদ লোকসান করেছে ২৩,৩৯৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে লাভজনক সংস্থাগুলি লাভ করেছে ১,৭৪,৫৮৭ কোটি টাকা। কেবল তাই নয়, সমস্ত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা মিলে কর, লভ্যাংশ মিলিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষে তুলে দিয়েছে ৩,৬৮,৮০৩ কোটি টাকা। ওই সংস্থাগুলিতে কাজ করেন ১০.৩ লক্ষ কর্মচারি ও শ্রমিক, যাদের মধ্যে ১.৮১ লক্ষ তফশিলি জাতি, ১.০২ লক্ষ তফশিলি উপজাতি ও ১.৯৭ লক্ষ অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষ। আত্মনির্ভরতার নামে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের শিল্পগুলিকে যদি ক্রমাগত ব্যক্তিমালিকদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়, তাহলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বে অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পশ্চাদপদ শ্রেণীর মানুষদের জন্য সুযোগ আরো সঙ্কুচিত করা হবে।  

যেহেতু স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় অর্থনীতি যাত্রা শুরু করেছিল পরিকল্পিত ধাঁচায় সমাজতন্ত্র কায়েম করার লক্ষ্যে ও মাঝপথে সেই লক্ষ্য পরিত্যাগ করে নয়া উদারনীতির বাজারি ব্যবস্থায় পা বাড়িয়েছে, আর বর্তমান সরকার সেই কর্পোরেট নির্ভর ‘আত্মনির্ভরশীল’ ভারত গড়তে কোভিড১৯-কে ধূর্ততার সঙ্গে কাজে লাগাচ্ছে, তাই প্রয়োজন সাম্প্রতিক অর্থনীতিকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালের নিরিখে যাচাই করা। সেই অর্ধসমাপ্ত বা অনান্তরিক অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও তার ফলাফলকে নিয়ে আলোচনা করেই মোদির আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির ধোঁকাবাজিকে উন্মুক্ত করা যেতে পারে। সেই লক্ষ্যে আলাপ আলোচনা, নিবন্ধ প্রবন্ধ, তর্ক-বিতর্কের অপেক্ষায় থাকলাম।

তথ্যসূত্র :
১) “অ্যানুয়াল এস্টিমেটস এন্ড কোয়ার্টারলি এসটিমেটস অফ জিডিপি অ্যাট কনস্টান্ট (২০১১-১২) প্রাইসেস”, মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিসটিকস এন্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন।
২) “ইনডেক্স অফ এইট কোর ইন্ডাসট্রিজ (বেস-২০১১-১২) ফর জুন ২০২০”, প্রেস রিলিজ বাই অফিস অব ইকোনোমিক এ্যাডভাইজার, ডিপার্টমেন্ট ফর প্রোমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রি এণ্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড, গভার্নমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া
৩) “ফুড কনজাম্পশন ট্রেণ্ডস পয়েন্ট এ্যাট রিয়াল ইনকাম ডিক্লাইন বিফোর প্যানডেমিক”, প্রভাত পট্টনায়েক ইন নিউজ ক্লিক,

১ আগস্ট ২০২০    
-- অমিত দাশগুপ্ত   

jaffjaf

২০০১ সালের ২৪ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কালনা লোকাল কমিটির তৎকালীন সম্পাদক কমরেড জগন্নাথ মন্ডলকে মিটিং থেকে ফেরার পথে রাতের অন্ধকারে সেই সময়ের শাসক দল সিপিআই(এম)-এর মদতপুষ্ট গুন্ডাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংস ভাবে খুন করে। পরের দিন ভোরবেলা কালনা থানার তামাসাপুর গ্রামে তাঁর নিজের বাড়ির অনতিদুরে ঝোপের মধ্যে থেকে কমরেড মন্ডলের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। প্রতিবছর এই দিনটিতে কালনা লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে স্মরণ সভা করা হয়। তামাসাপুর গ্রামের পাকা রাস্তার মোড়ে কমরেড জগন্নাথ মন্ডলের মুর্তি স্থাপিত হয়েছে। এই বছর করোনা মহামারীর মধ্যেও ভাল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে স্মরণ সভা পালন করা হল। শহীদ কমরেডের মূর্তিতে মাল্যদান করার পর এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পুর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদক সহ লোকাল কমিটির কমরেডগণ।

rad

নদীয়া জেলার ধর্মদা মুড়াগাছা লোকাল কমিটির বর্ষিয়ান সদস্য কমরেড রহিম সেখ ২০ আগস্ট প্রয়াত হয়েছেন। দুদিন ধরে তাঁর জ্বর ছিল। তারপরে আকস্মিকভাবে হার্ট এ্যাটাক হয় এবং তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কমরেড রহিম শেখ ছিলেন পার্টির দীর্ঘদিনের একজন লড়াকু কমরেড। ৮০-র দশক থেকেই কমরেড সুবোধ মজুমদারের সাথে পার্টির কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ধর্মদা-মুড়াগাছা এলাকায় জমির লড়াই থেকে শুরু করে বহু জঙ্গী কৃষক সংগ্রামের সামনের সারিতে থেকেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পার্টির প্রতিটি কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছেন। শেষ দিকে অশক্ত শরীরেও মিটিংয়ে চলে আসতেন। পঞ্চায়েত অফিস থেকে শুরু করে যে কোনো প্রশাসনিক দপ্তরে টেবিল চাপড়ে গলা উচুঁ করে লড়াকু মেজাজে গরিবের অধিকারের কথা তুলে ধরতেন। সমগ্র এলাকায় তিনি বিশেষ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, যাঁকে সকলে নাম বললেই চিনতেন। নানাবিধ গণকাজে ও সমস্ত জায়গায় দ্বিধাহীনভাবে পার্টির কথা তুলে ধরতে তাঁর ছিল অদ্ভূত সাবলীলতা। তাই তিনি ছিলেন সর্বসাধারণের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত মানুষ, সকলের শ্রদ্ধার ব্যক্তিত্ব। প্রয়োজনে পার্টির দায়িত্বশীলদেরও সামনা-সামনি সমালোচনা করতে দ্বিধা করতেন না, একজন বরিষ্ঠ অভিভাবকের মতো।

লকডাউনের সময়কালেও তাঁর বাড়িতে গেলে দেখা হয়েছে। গেলেই বলতেন পত্রিকা এনেছো? পত্রিকা হাতে পেলে খুব খুশি হতেন। খুঁটিয়ে পড়তেন। বছরের শুরুতেই গ্রাহকের টাকা দিয়ে দিতেন। গতবছর অসুস্থ শরীরেও অটো করে ধুবুলিয়া অফিসে গিয়ে গ্রাহকের টাকা জমা দিয়ে এসেছিলেন। নদীয়ায় তিনি ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা ও পার্টি স্পিরিটে ভরপুর কমরেড।

কমরেড রহিম সেখের স্মৃতি বেঁচে থাকবে চিরকাল, তাঁকে জানাই লাল সেলাম।

- জয়তু দেশমুখ

খণ্ড-27
সংখ্যা-30