বিজেপি নেতারা প্রয়োজন হলেই একবার করে শুনিয়ে দিচ্ছেন, করোনা সংক্রমণ এমন একটা ইস্যু যেটার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে হলে রাজনীতিকে দূরে রাখতে হবে, গোটা জাতিকে এক হয়ে লড়তে হবে। যেমন বিজেপির উত্তরপ্রদেশ মুখপাত্র মনোজ মিশ্র বললেন – “করোনাভাইরাস একটা মহামারী; এটা রাজনীতির কোনো ইস্যু হতে পারে না। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।” কিন্তু বিজেপি নেতারা, বিজেপি চালিত কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই কি লকডাউন পর্বে রাজনীতি পরিহারকে মান্যতা দিচ্ছে? বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্রীয় টিম পাঠানোর কথাই ধরা যাক। লকডাউনের গোড়ার দিকে অমিত শাহকে তেমন চোখে না পড়া নিয়ে যখন জল্পনা চলছিল, তখন সহসাই তাঁর মন্ত্রককে প্রভূত সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা গেল। লকডাউন বলবৎ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা তা সরেজমিনে তদন্ত করতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিভিন্ন রাজ্যে দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল। প্রথম পর্বে কেন্দ্রীয় টিম পাঠানোর জন্য যে ছটা রাজ্যকে বেছে নেওয়া হল তার মধ্যে চারটে অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য : পশ্চিম বাংলা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা; এর সাথে বেছে নেওয়া বিজেপি শাসিত রাজ্য দুটো হল মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাট। কিন্তু কেন্দ্রীয় টিমগুলো যেভাবে পর্যবেক্ষণ করল ও রিপোর্ট দিল তার মধ্যে একটা ছক যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল। পশ্চিমবাংলায় যে দুটো দল এল তাদের কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, এখানকার সরকারকে ভর্ৎসনা করতে, তার ছিদ্রান্বেষণ করতে, তাকে এক হাত নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের লম্বা হাত এখানে পৌঁছে গেছে। সংবাদে প্রকাশ কেন্দ্রীয় দল যে এখানে আসছে সে খবর রাজ্য সরকারকে দেওয়া হল দল এ রাজ্যে পৌঁছানোর পরই। সংবাদে আরও প্রকাশ, রাজ্যে লকডাউন বলবৎ নিয়ে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে রাজ্য সরকার সম্পর্কে কড়া রিপোর্টই এখানে আসা দুটো দল কেন্দ্রের কাছে জমা দিয়েছে। মমতা সরকারের করোনা সংক্রমিতদের সংখ্যা এবং কোভিড-১৯ থেকে মৃত্যু নিয়ে তথ্যের কিছু কারচুপি, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ত্রুটিবিচ্যুতি, রেশন নিয়ে কিছু দুর্নীতি যে কেন্দ্রীয় দলকে তাদের অভিপ্রেত রিপোর্ট তৈরির জন্য অনুকূল জমি যুগিয়েছে তা অবশ্য বাস্তব সত্য। কিন্তু যেভাবে কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে আসার সাথে-সাথে বিজেপি নেতারা গলা চড়াতে শুরু করলেন, যেভাবে রাজ্যপাল সাংবিধানিক গণ্ডি অতিক্রম করে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কামান দাগতে লাগলেন তাতে করোনা ইস্যু ছাপিয়ে অন্য একটা নকশার রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। এ রাজ্যে ২০২১-এর লড়াইয়ে বিজেপির পালে হাওয়া লাগানোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় দলের সফরের যোগ আর তেমন অস্পষ্ট রইল না।
এর সাথে বিজেপি শাসিত দুটো রাজ্যের করোনা পরিস্থিতির বিচার করুন – মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ। মধ্যপ্রদেশে করোনা সংক্রমণ ইস্যুতে রাজ্যের নাজেহাল অবস্থা নিয়ে চারদিক থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ হচ্ছিল। বিধায়ক ভাঙ্গিয়ে কংগ্ৰেস নেতৃত্বাধীন সরকার ফেলে দিয়ে লকডাউনের মধ্যেই মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকার গঠন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ছাড়া মন্ত্রীসভায় আর কোনো মন্ত্রী নেই, বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অভাব (লকডাউনের মধ্যেই মন্ত্রীসভার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ হয় অনেক দেরিতে)। হিন্দুস্তান টাইমসের ১১ এপ্রিল সংখ্যার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হল, “শুক্রবার মধ্যপ্রদেশেই কোভিড-১৯ রোগীদের মৃত্যু হার ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বলে দেখা গেল, যেখানে গোটা স্বাস্থ্য দপ্তর হয় কোয়ারান্টিনে আর না হয় হাসপাতালে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন মৃত্যুর বেশি হার এবং সংক্রমণের সংখ্যায় বৃদ্ধি ভয়াল ভাইরাসটার মোকাবিলায় রাজ্য গৃহীত ব্যবস্থার করুণ হালকেই দেখিয়ে দেয়।” তথ্যের কারচুপির অভিযোগ, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা এবং প্রাপ্ত রিপোর্টের মধ্যে গরমিলের অভিযোগও রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে উঠেছে। আর করোনা পরিস্থিতির বিচারে মধ্যপ্রদেশের স্থান এই মুহূর্তে দেশের মধ্যে ষষ্ঠ, সংক্রমিতর সংখ্যা ২৯৪২ এবং কোভিড-১৯ থেকে মৃত্যু হয়েছে ১৬৫ জনের। পশ্চিম বাংলা রয়েছে মধ্যপ্রদেশের অনেক পরে। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় দলের রিপোর্ট যেন আগে থেকেই তৈরি ছিল। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব পুণ্য সলিলা শ্রীবাস্তব সাংবাদিকদের সামনে বললেন – “কেন্দ্রীয় দল দেখতে পেয়েছে বর্মবস্ত্র, কিটস, মাস্ক এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম যথেষ্ট সংখ্যায় রয়েছে, এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাও সুনিশ্চিত করা হচ্ছে।” একেবারে যেমনটি চাই তেমন রিপোর্ট, অমিত শাহর অসামান্য কীর্তিতে কংগ্ৰেস নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটানোর ফলে করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কোন ছায়া যেন রিপোর্টে না থাকে!
এবার উত্তরপ্রদেশের কথা ধরা যাক, বিশেষভাবে বিচার করা যাক ‘আগ্ৰা মডেল’-এর কথা, সারা বিশ্বেরই যে মডেল অনুসরণ করা উচিৎ বলে যোগী আদিত্যনাথ মন্তব্য করেছিলেন। এই মডেল নিয়ে প্রচারের বন্যা বওয়ানোর নির্দেশও নাকি তিনি দিয়েছিলেন। ইকনমিক টাইমসকে দেওয়া ১৬ এপ্রিলের সাক্ষাৎকারে যোগী বললেন, “আগ্ৰা দেশের মধ্যে একটা মডেল হয়ে উঠেছে। সর্বপ্রথম এক ঝাঁক করোনা সংক্রমণের খবর ওখানে পাওয়ার পর রাজ্য সরকার পুরোদস্তুর নজরদারি চালিয়ে ব্যবস্থা নেয় এবং উৎকৃষ্ট কৌশল গ্ৰহণ করে যার ফলে জেলার সমস্ত হটস্পটগুলোকে (বেশি সংক্রমণের জায়গা) চিহ্নিত করা হয়, দ্রুত ব্যবস্থা গ্ৰহণের দল গড়া হয়, গুচ্ছ-গুচ্ছ নমুনা পরীক্ষা করা হয়, কল সেন্টার স্থাপন করা হয়, ঘরে জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয় এবং সমস্ত ঘর জীবাণুমুক্ত করা হয়।…” কেন্দ্রীয় যুগ্ম স্বাস্থ্য সচিব লব আগরওয়ালও ‘আগ্ৰা মডেল’-এর প্রশংসা করে তাকে অনুসরণ করার কথা বললেন। কিন্তু এই মডেলের পরিণতি কী দাঁড়াল তা আগ্ৰার বিজেপি মেয়র নবীন জৈন-এর কাছ থেকে শোনা যাক – “আগ্ৰা দেশের উহান হয়ে উঠতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন অযোগ্য রূপে দেখা দিচ্ছেন। হটস্পটগুলোর কোয়ারান্টিন কেন্দ্রগুলোতে অনেকদিন ধরে কোন নমুনা পরীক্ষা হয়নি। রোগীদের জন্য খাবার, জলের কোনো ব্যবস্থা নেই। ... পরিস্থিতি বিস্ফোরক।” যোগী আদিত্যনাথকে লেখা নবীন জৈনের যে চিঠি সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গেছে, তাতেই এই কথাগুলো রয়েছে। ২৯ এপ্রিল আগ্ৰা জেলায় সংক্রমিতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০৪ আর কোভিড-১৯ প্রাণ নিয়েছে ১২ জন আগ্ৰাবাসীর। এই মুহূর্তে উত্তরপ্রদেশেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি রেড জোন, মোট ১৯টা। এই রাজ্যে কেন্দ্রীয় টিম পাঠানোর কথা অমিত শাহর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একবারও ভাবতে পারল না। গত ৩ মে কেন্দ্রের তরফে যে ২০টা জেলায় টিম পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশের আগ্ৰা এবং লক্ষ্ণৌও রয়েছে। কিন্তু এই দলগুলোতো যাচ্ছে করোনা নিয়ন্ত্রণে জেলাগুলোকে সাহায্য করতে। তবে, রাজ্য বিশেষে ‘সাহায্য’র ধরন পাল্টে যেতেই পারে। যোগী আদিত্যনাথ হিন্দুত্বের এক প্রতাপশালী মুখ, কম্যুনাল ভাইরাসের কারবারি হয়ে সংখ্যালঘু বিরোধী ঘৃণার উদগিরণে অকুণ্ঠ, করোনা নিয়ন্ত্রণে মোদীর প্রশংসায় অকৃপণ, মোদীর আরোগ্য সেতু অ্যপকে ডাউনলোড করা এবং ‘পিএম কেয়ারস’ তহবিলে অনুদান আদায়ে রাজ্যের আমলাদের ওপর চাপ সৃষ্টিতেও পিছিয়ে থাকেননি। প্রকাশিত সংবাদ থেকে এও জানা গেছে যে, করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য তিনি জামাতীদের দায়ী করেছেন এবং তাদের জেলে পোরার জন্য নাকি ৩৪টা অস্থায়ী জেল বানিয়েছেন। মোদী-শাহ ঘনিষ্ঠ, আরএসএস-এর মতাদর্শের ও ফ্যাসিস্ট এজেণ্ডার এই বাহক চূড়ামণির রাজ্যের পরিস্থিতি যাই হোক, তা কেন্দ্রের কাছে কখনোই ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হতে পারে না। বিজেপি এমন একটা দল যে কোনো পরিস্থিতিতেই ফ্যাসিস্ট এজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, করোনা মহামারীর মতো পরিস্থিতিতেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলে মেরুকরণের পথে এগিয়ে যেতে একটুও দ্বিধা দেখায় না। করোনা পরিস্থিতিতে কেউ রাজনীতি করবেন না, এই আহ্বান আসলে বিজেপিকে বাদ দিয়ে আর সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।