২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ – শ্রমিকরা আসলে কী পেলেন?

কর্মচারি ভবিষ্যনিধি তহবিল থেকে শ্রমিকদের ২ শতাংশ অর্থ গায়েব

20 lakh

এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের নিয়ম অনুযায়ী কর্মীরা মূল বেতন ও মহার্ঘভাতা (বেসিক ও ডিএ) যুক্ত করে যে বেতন পান তার ১২ শতাংশ টাকা পিএফ খাতে জমা দেন। নিয়োগকারীও সমপরিমাণ টাকা জমা দেন। অবসরের সময় কর্মীরা পিএফ-এ জমা টাকা সুদ সমেত ফেরত পান। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ১৩ মে ঘোষণা করলেন, মাসিক ১৫০০০ টাকার উপর বেতন পান এমন বেসরকারী ক্ষেত্রের কর্মীদের এবং নিয়োগকর্তাকে প্রভিডেন্ট ফান্ডে মাসিক জমার হার ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হল। ১৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার ফের ঘোষণা করলো কর্মী চাইলে ১০ শতাংশের বেশি পিএফ ফান্ডে জমা দিতে পারেন। নিয়োগ কর্তার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়, তারা ১০ শতাংশ হারের জমা দেবেন। আগামী তিন মাস – জুন, জুলাই আগস্ট এই নিয়ম চলবে। প্রভিডেন্ট ফান্ড রুলস অনুযায়ী যেখানে ২০ জনের কম কর্মী কাজ করেন এমন সংস্থা, রুগ্ন সংস্থা (বিআইএফআর-এ আছে), এবং জুট, বিড়ি, ইটভাটা, ছোবড়া, গুয়ার গাম প্রভৃতি শিল্পে ১০ শতাংশ হারে প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা দেওয়ার রীতি আছে। স্বাভাবিকভাবে এই সব প্রতিষ্ঠানে ২ শতাংশ ছাড়ের গল্প নেই। সরকারী ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় কর্মীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়।

অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন নিয়োগকারী পিএফ জমার থেকে ২ শতাংশ ছাড় পাওয়ার ফলে শিল্প সংস্থার হাতে অতিরিক্ত ৬৭৫০ কোটি টাকা আসবে। ইপিএফ-এ কর্মীদের জমার হার কমিয়ে দেওয়ায় মানুষের নগদে আয় বাড়বে। এবার পিএফ জমার হিসাবটা দেখে নেওয়া যাক। প্রতিমাসে ১৫০০০ টাকা সিলিং ধরে নিয়োগকারী ১২ শতাংশ হারে পিএফ-এ জমা দেন, তার ভাগ হল –  পিএফ খাতে ৩.৬৭ শতাংশ হারে ৫৫০ টাকা এবং পেনশন খাতে ৮.৩৩ শতাংশ হারে ১৮০০ অর্থাৎ মোট ২৩৫০ টাকা এবং কর্মীরাও সম পরিমাণ ২৩৫০ টাকা জমা দেন। উভয় মিলে মোট অর্থের পরিমাণ ৪৭০০ টাকা যা ভবিষ্যতের জন্য প্রতিমাসে পিএফ দপ্তরে জমা পড়ে এবং প্রতিমাসে গড় আয়ের উপর চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ জুড়তে থাকে।

কর্মীরা নিজেদের উপার্জিত অর্থ থেকে সঞ্চয়ের জন্যে প্রতিমাসে পিএফ তহবিলে ১২ শতাংশ টাকা জমা করতেন, সরকার তাকে বাধ্য করলো ১০ শতাংশ করতে। সরকার এখানে পরের ধনে পোদ্দারি করলো। কর্মীরা উপার্জিত অর্থ থেকে ২ শতাংশ টাকা প্রতিমাসে সঞ্চয় করতেন, তা তিন মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। এই ২ শতাংশ অর্থ বেতনের সাথে নগদে যুক্ত করে হাতে দেওয়া হবে। আপনার অর্থ আপনাকেই দিয়ে সদম্ভে ঘোষণা করা হল আপনার আয় বেড়েছে এবং আপনি অতিরিক্ত খরচ করতে পারবেন। অন্যদিকে নিয়োগকর্তা যে ২ শতাংশ টাকা পিএফ-এ কম জমা দিচ্ছে তা বেতন বাবদ কর্মীদের হাতে তুলে দেওয়ার কোনো নির্দেশ সরকার দিল না। এর ফলে শ্রমিকের আয়ের ২ শতাংশ ছাঁটাই হল। এই আর্থিক ক্ষতি পূরণের জন্য কোনো দায় নিয়োগকর্তার থাকছে না। এক কথায় শ্রমিকদের আর্থিক ক্ষতি বাড়বে এবং শিল্পপতিদের আর্থিক যোগান বাড়বে।

শ্রমিকদের অর্জিত বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডে টাকা জমা পড়ে। শ্রমিকদের পিএফ থেকেই নিয়োগ কর্তাকে ২ শতাংশ ছাড় দেওয়া হল এবং শ্রমিককে ২ শতাংশ অতিরিক্ত ক্যাশ নিতে বাধ্য করলো। এখানে দেখা যাচ্ছে আমানত ও বেতনে সরাসরি ২ শতাংশ কমে যাচ্ছে। এর সাথে ঐ ২ শতাংশের উপর ৮.৫০ শতাংশ হারে সুদ বাবদ আয়ও কমে যাবে। অবসরের সময় পিএফ ও পেনশনে অনেকটাই কমে যাবে।

আবার এই অতিমারীকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিদের আর একবার প্রতারণা করা হল। বলা হল কর্মীরা ইচ্ছে করলে পিএফ-এ গচ্ছিত অর্থ থেকে অফেরতযোগ্য অগ্রীম হিসেবে ৭৫ শতাংশ টাকা তুলে নিতে পারবেন। লকডাউনে বেশিরভাগ শ্রমিক বেতন/মজুরি পাননি অনেকেই বাধ্য হয়ে পিএফ-এ জমা টাকা তুলে নিয়েছেন। সব কিছু হিসাব করলে দেখা যাবে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ শ্রমিক কর্মচারিদের জন্য অপেক্ষা করছে। তিন মাস ২ শতাংশ টাকা কম জমা হল, পিএফ থেকে জমানো ৭৫ শতাংশ টাকা আগেই তুলে নিলেন, ফলে সুদের টাকার পরিমাণও কমবে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনে খুব সামান্য টাকা অবসরের পর পিএফ থেকে হাতে পাবেন এবং পেনশনও অনেক কম পাবেন। কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনের সময়েও শ্রমিক কর্মচারিদের সঙ্গে প্রতারণা ও অমানবিক আচরণ করে চলেছে।

-- নবেন্দু দাশগুপ্ত

খণ্ড-27