সম্পাদকীয়
সময় সংঘাতময়

মোদী সরকার যখন দেশজুড়ে ধিক্কার, প্রতিবাদ, প্রতিরোধে বিদ্ধ হচ্ছে তখন বিজেপি মোদীকে শিরোপা দিচ্ছে ‘কর্মোযোদ্ধা’! মোদী প্রসঙ্গে সদ্য বিজেপি প্রকাশিত এক পুস্তকের শিরোনাম ঐ ‘কর্ম ...’। নিশ্চিতভাবেই ওতে ছত্রে ছত্রে থাকবে মোদী বন্দনা। তার ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং। লিখেছেন শাহ সহ দল ও সরকারের একগুচ্ছ নেতা-মাথা-মন্ত্রীরা। ‘অচ্ছেদিন’ নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি যখন সমস্ত মানদন্ডে প্রতারণা ও বিপর্যয়ের পরিণতি বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে, তখন ‘মহান রাষ্ট্রনায়ক’ করে দেখানো মোদী মাহাত্ম প্রচারে নিশ্চয় কোনো কার্পণ্য রাখা হবে না। কিন্তু দলের চাটুকাররা যাই বলুন, তাতেও রেহাই পাওয়ার নয়। সদ্য যে ধর্মঘট সংঘটিত হল তা কেন্দ্রের মুখে রাশি রাশি থাপ্পর মেরে দিল। মানুষ নিছক একদিনের ধর্মঘট করার মধ্যেই সীমিত থাকেনি, থাকবে না, ক্রমশ জাগছে জনচেতনা, সংগঠিত হচ্ছে জনশক্তি, বহুরূপেই প্রস্তুত হচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে। যে দেশবিরোধী-জনবিরোধী অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা হননের নীতি, বিশেষত নাগরিকত্বের প্রশ্নে বিদ্বেষ-বিভাজনের এনআরসি-এনপিআর-সিএএ নীতিগুচ্ছ চলছে তা যদি প্রত্যাহারের পর্ব শুরু না করা হয় তাহলে মানুষও আন্দোলন থেকে বিরত হবে না, আগামীতে সংগঠিত হবে আরও বড় বড় আন্দোলন। প্রস্তুতি জারি আছে নানাভাবে, যেমন শাহীনবাগ থেকে পার্কসার্কাস, নারীশক্তি রয়েছেন যেখানে নিজস্ব উদ্যোগ আর হিম্মতের সাথে হাজারে হাজারে সামিল হয়ে লাগাতার অবস্থানে।

কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলন চলেছে সারা দেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গেও। ধর্মঘট সফল হয়েছে এখানেও। কিন্তু এ সাফল্য মনে হচ্ছে মমতা সরকারের সহ্য হল না। মুখ্যমন্ত্রী ধর্মঘটের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘গুন্ডামী হয়েছে’। আপাতদৃষ্টিতে এই প্রতিক্রিয়া অনভিপ্রেত, তলিয়ে দেখলে আশ্চর্য হওয়ার নয়। তার কারণ, তিনি গোড়া থেকেই ধর্মঘটের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর দল ও সরকারকে এধরনের মারাত্মক ভ্রান্ত অবস্থান থেকে সরে আসার বারবার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি শাসকের ঔদ্ধত্যের অবস্থান এতটুকু পরিবর্তনে ইচ্ছুক নন। তৃণমূলের অবস্থান হল, এনআরসি এ রাজ্যে করতে দেওয়া হবে না, এনআরসি-র বিরুদ্ধে ধর্মঘটও করতে দেওয়া হবে না। এই অবস্থান কি পরস্পর বিরোধী নয়? প্রশ্ন হল, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অনেক রূপ রয়েছে, তার মধ্যে ধর্মঘটও একটা রূপ। এবং তা সংবিধান স্বীকৃত। কোনো বিচারালয়ের রায় ধর্মঘটের অধিকারকে ‘না’ সূচক রুলিং দিতে পারে, কেউ অপছন্দও করতে পারে, কিন্তু ধর্মঘটের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করা হবে কেন?

মুখ্যমন্ত্রী ধর্মঘটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিপর্যস্ত আর্থিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, অর্থাৎ আবার এক দিনের রুজি নষ্ট হবে। আরে! যেখানে কোটি কোটি মানুষের কাজ নেই, বেকারি তুঙ্গে, সেখানে দেশজুড়ে এক সুরে বাকিরা যদি প্রতিবাদে একদিনের কাজ থেকে বিরত থাকেন, তাতে বিশেষ কষ্ট আর কি হবে! মোদী নীতিতে তলানিতে চলে যাওয়া ‘বৃদ্ধি’-রই বা কোন ‘মহা উদ্ধার’ ব্যাহত হবে! এসব ছেঁদো যুক্তি ধোপে টেঁকে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা নাম কিনতে চেয়েছেন তাঁদের সরকার সবার আগে এনআরসি-র বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। তাই নাকি! বরং দুর্নামই কি বেশি কিনল না! কারণ অন্য কোনো রাজ্য সরকার, এনআরসি বিরোধী ধর্মঘটের বিরোধিতা করেনি, যেটা করল মমতা সরকার। এই অগণতান্ত্রিক অবস্থান লক্ষ্য করে অলক্ষ্যে হেসেছে একমাত্র বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘এরাজ্যে এনআরসি বিরোধী অবস্থান নিয়েছে রাজ্য সরকার, আন্দোলন করছে শাসকদল, এখানে বামেদের আন্দোলন করার কি দরকার! দম থাকলে দিল্লীতে গিয়ে, অন্য জায়গায় করুক না!’ ইঙ্গিতটা কি মোদী-অমিত শাহদের মন্তব্যের মতো শোনাচ্ছে না, যারা বলছেন আন্দোলন করতে হলে পাকিস্তানে গিয়ে পীড়িত হিন্দু সংখ্যালঘুদের জন্য করুন!!

সারবস্তুতে দিদির অবস্থান হল, যখন আজকের পরিস্থিতিতে আন্দোলনের অনিবার্যতাকে একেবারে উপেক্ষা করা সম্ভবই নয়, তখন বাংলায় একদিকে কোন আন্দোলনকেই কর্পোরেট পুঁজির ব্যাঘাত সৃষ্টিতে গড়াতে না দেওয়া, বিকাশমান বাম ও গণতান্ত্রিক বিরোধী দলসমূহের সংগ্রামী উদ্যোগকে বাড়তে না দেওয়া, তার জন্য অন্যদিকে তার জন্য আন্দোলনের রাশ ধরে রাখতে বেশি বেশি করে শাসকদল তৃণমূলের তরফে কর্মসূচী নেওয়া এবং বাম-গণতান্ত্রিক ধারার আন্দোলনকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে আর হুমকি দিয়ে চলা। এই ধরনটি কি প্রধানতম বৈরী শাসক মোদী বিরোধী আন্দোলনের সামনে বিভাজন সৃষ্টির অপচেষ্টা নয়, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো নয়! জবাব দিন মুখ্যমন্ত্রী, জবাব দিক তৃণমূল।

খণ্ড-27
সংখ্যা-2