দুই শহীদের মা রত্নগর্ভা মাসিমা – মায়া রায়চৌধুরীর প্রয়াণে সত্তর দশকের আন্দোলনের সভ্য, সমর্থক, নেতা কর্মীরা শোকস্তব্ধ। সত্তরের দশকে তাঁর দুই মেধাবি পুত্র প্রদীপ ও প্রবীর রায়চৌধুরী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হয়েছিলেন। প্রদীপের মৃত্যু হয় ১৯৭১ সালে, তাঁকে যাদবপুর থানা লকআপে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। প্রদীপ ছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। প্রবীর (পাখি) ছিলেন কনিষ্ঠ পুত্র, প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার ছাত্র। প্রবীর এবং আরও চারজন যুব বিপ্লবীকে ১৯৭৫ সালের ৩ মে হাওড়া জেলে পিটিয়ে হত্যা করেছিল জেল কর্তৃপক্ষ। প্রদীপ-প্রবীর দুজনেই বসন্তের বজ্রনির্ঘোষে সাড়া দিয়েছিলেন। সন্তান হারানোর ব্যথা ভুলেছিলেন মাসিমা হাজারো প্রদীপ-প্রবীরদের মা হয়ে গিয়ে।
গত ২৭ ডিসেম্বর হাওড়ার বেলুড়ের শ্রমজীবী হাসপাতালে মাসিমার প্রয়াণ ঘটে অপরাহ্ন ২টো ৪০ মিনিটে।
স্বামী সদানন্দ রায়চৌধুরীও হয়ে ওঠেন সকলের মেসোমশাই। তাঁর প্রয়াণ ঘটে ২০০৫ সালে। সেই থেকে নরেন্দ্রপুর-রাজপুর সংলগ্ন এক বৃদ্ধাবাসে মাসীমা বাকি জীবন কাটিয়েছেন। ক’দিন আগে তাঁর মাইল্ড স্ট্রোক হলে তাঁকে বেলুড়ের শ্রমজীবী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার সিদ্ধার্থ গুপ্ত ও কুনাল দত্ত প্রমুখরা মাসিমাকে সেখানে ভর্তি করান। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না, ৮৬ বছর বয়সে হল তাঁর জীবনাবসান। মাসিমার বৃদ্ধাশ্রম থাকাকালীন তাঁর দেখভাল করতেন অজয়দা (বসু রায়), তাঁর ভাই মিঠু, জলার্ক পত্রিকা সম্পাদক মানব চক্রবর্তী। মাসীমা সন্তান স্নেহে অজয়দাকে, মানবদাকে ভালোবাসতেন। অজয়দার ও তাঁর স্ত্রীর জীবনাবসানের পর সবকিছু দেখতেন তাঁর ভাই মিঠু (যিনি কর্কট রোগে আক্রান্ত)। ক’দিন আগেই সস্ত্রীক দিলীপ সেন (বট), তার পুত্র ও এই প্রতিবেদক বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে মাসীমা খুব খুশি হয়েছিলেন। মাসীমার স্মরণ শক্তি ছিল, গরগর করে বলে দিতেন জন্মস্থান বরিশালের কথা, সেদিনের কথা ও পুত্রদের বন্ধুদের কথা। মীনাক্ষীদি ও রাজশ্রীদিকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। ব্যথা পেয়েছেন মীনাক্ষীর অকাল মৃত্যুতে ও অজয়দার স্ত্রীর মৃত্যুতে। অজয়দার জীবনাবসানের কথা তাঁকে বন্ধুরা জানাননি তিনি সেটি সহ্য করতে পারবেন না বলে। বহু বন্ধু এককালীন বা প্রতি মাসে কিছু পরিমাণ অর্থ নিয়মিত দিতেন তাঁর জীবন নির্বাহের জন্য। মাসীমা প্রত্যেকের খোঁজ খবর নিতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে আন্দোলনের প্রত্যেক যোদ্ধাকেই তিনি সন্তান স্নেহে ভালোবাসতেন।
গড়িয়া শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, আইসার হাওড়া জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ নীলাশিস, অঙ্কিত ও অন্য বন্ধুরা, ডাক্তার সিদ্ধার্থ গুপ্ত, কুনাল দত্ত বেলুড় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। মৃতদেহ নিয়ে আসেন মিঠুদার কনিষ্ঠ সন্তান, মাসিমার এক ভাইয়ের সন্তান ও আশীষ। শশ্মানে উপস্থিত ছিলেন মানব চক্রবর্তী, এই প্রতিবেদক ও মাসিমার বোনের মেয়ে ও তাঁর স্বামী এবং অর্জুন (যিনি মাসীমাকে দেখভালও করতেন)। জনগণের স্বার্থে সংগ্রামী সাথিদের উপস্থিতিতে মাসিমা প্রবীর-প্রদীপের অনুপস্থিতিকে ভুলে যেতেন। সত্তর দশকের আন্দোলনে মাসীমার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি রত্নগর্ভা।
- নিত্যানন্দ ঘোষ
“রাজপুরের বৃদ্ধাবাসে যাওয়ার প্রয়োজন আর রইল না। মাসিমা চিরকালের জন্য চলে গেলেন আজ। সত্তর দশকের শহিদ প্রবীর রায়চৌধুরী (পাখি) আর তার দাদা প্রদীপ রায়চৌধুরী – দুই সন্তানকে হারিয়ে আমাদের মা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তিন-চারদিন আগে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম রাজপুরে। মস্তিষ্কের স্ট্রোক সত্ত্বেও আধবোজা চোখে আমার মাথার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর চুলগুলি সব সাদা হইয়া গেছে। এই ছিল মাসিমার আমাকে বলা শেষ কথা। হয়তো তাঁর ছেলেদের কথা ভাবলেন তিনি তখন। বেঁচে থাকলে তাদেরও কি এই অবস্থা হত না? কতদিন কাছে টেনে নিয়ে তিনি আদর করেছেন বুড়োধাড়ি এই আমাকে, আমার ছোটছেলের বন্ধু, আমার পাখির বন্ধু তুই! আর আমার রাজপুরের বৃদ্ধাবাসে যাওয়ার প্রয়োজন রইল না!”
- মানব চক্রবর্তী