খবরা-খবর
বাঁকুড়ায় উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় কৃষিমজুর ব্লক সম্মেলন

বাঁকুড়া জেলায় ওন্দা ব্লকের উর্বর শস্যক্ষেত্র পেরিয়ে বড়জোড়ার দিকে খানিক এগোলেই শুরু বনাঞ্চল। সোনামুখী হয়ে এখানে মাঝে মধ্যেই চলে আসে দলমার হাতির পাল। সেই বনভূমি লাগোয়া গ্রামের নাম খেমুয়া। এই গ্রামের “মুনিষখাটা” শতাধিক তপশীলি ভূমিহীন পরিবার আজ থেকে প্রায় ৪৫-৪৬ বছর আগে তীব্র বাস্তু সংকটের কারনে বাধ্য হয়ে গ্রাম সংলগ্ন বনের খালি জমিতে বসতি স্থাপন করেন। অনতিদূরেই রয়েছে আরও দীর্ঘ দিন ধরে বসবাসকারী শতাধিক আদিবাসী পরিবারের একটি গ্রাম। এদের সকলের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড আছে। রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। সরকারী আবাস যোজনায় ঘরও পেয়েছে দু-এক জন। এদের শ্রমেই লাগোয়া গ্রামের চাষির গোলায় ধান ওঠে,সব্জি বিক্রি হয় রোজকার হাটে। অনেকে আবার এক খন্ড খাস জমিতে ফসল ফলায়। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও এরা কেউ বাস্তু বা কৃষি জমির পাট্টা পায়নি।

বহু বিজ্ঞাপিত ভূমিসংস্কারের ফাঁপাপনা এভাবেই তৃণমূল স্তরে প্রকটভাবে ধরা পরে যায়৷ কয়েক দশক ধরে  এলাকার স্বাভাবিক বাসিন্দা বা নাগরিক এই মানুষদের সম্প্রতি তাদের ভিটে মাটি খেকে উচ্ছেদ করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। যাদের মদতে ঠিকাদার ব্যবসায়ীরা বনে ট্রাক ঢুকিয়ে আইন বহির্ভূত ভাবে মূল্যবান গাছ কেটে সাফ করে দিচ্ছে, সেই বনদপ্তর এবং গ্রামের বন কমিটির মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী মাতব্বররা “বনরক্ষা”র ভেক ধরে গ্রামের বসতির ধার ঘেঁসে গভীর গর্ত করে দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, বনের জমি থেকে এদের উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে। ওরা বন সুরক্ষার বুলি আউরে চলেছে, কিন্ত চেপে যাওয়া হচ্ছে বনাধিকার আইন ২০০৬-এর কথা। যে আইন অনুযায়ী চিরাচরিতভাবে বনাঞ্চলে বসবাসকারী অধিবাসীদের পাট্টা পাওয়ার অধিকার আইনসিদ্ধ। তাদের কোনোমতেই উচ্ছেদ করা চলবে না। এই দাবিকে সামনে রেখে, নিজেদের অধিকার আদায় করতে আক্রান্ত মানুষেরা তাই সংগঠিত আন্দোলন শুরু করেছেন। পার্টি ও কৃষিমজুর সংগঠনের নেতৃত্বে জেলা শাসকের দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত মানুষের মধ্যকার অগ্রণী কর্মীদের উদ্যোগে গোটা এলাকা জুড়ে শুরু হয়েছে প্রচার। উচ্ছেদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। কেবল  বাস্তুপাট্টাই নয়, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে দেওয়া, রেশন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার চক্রান্ত, আবাস যোজনায় বঞ্চনা-দুর্নীতি প্রভৃতি বিভিন্ন দাবীতে ঐ গরিব মানুষেরা মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ যেন প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বড় এলাকা জুড়ে প্রচার চালিয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর ওখানে অনুষ্ঠিত হলো কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির কোষ্ঠিয়া অঞ্চল সম্মেলন, অঞ্চলের ১২টি গ্রাম থেকে প্রায় ১০০ জন উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন স্থানীয় সমস্যার পাশাপাশি সোচ্চার হয়ে উঠলো সারা দেশের মানুষের উপর বিজেপি সরকারের হামলার বিরুদ্ধে। এনআরসি-নাগরিক আইন সংশোধন করে ধর্ম বা জাতের নামে গরিব মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা, রুটি-রুজির সংকট থেকে নজরকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে। এই বিষয়গুলি সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ তুলে ধরেন। আয়ারলার রাজ্য সভাপতি সজল পাল বলেন, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বনাঞ্চল সহ দেশের সমস্ত সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। বড় বড় রাস্তাগুলোকেও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। গরিবদের জন্য বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পগুলিতে কিভাবে বঞ্চনা চলছে সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রেশনে ২ টাকার চাল বাস্তবে দৈনিক মাথা পিছু মাত্র ১৬৬ গ্রাম! কৃষিতে সরকার ঘোষিত মজুরি ২৪৩ টাকা, অথচ ১০০ দিনের কাজে মজুরি ১৯২ টাকা!

তৃণমূল বলেছিলো ২০০ দিন কাজ দেবে। এখন প্রকল্পটাকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।  গরিবরা দলে দলে বাইরে চলে যাচ্ছে। এআইকেএম রাজ্য সম্পাদক জয়তু দেশমুখ বলেন, এ রাজ্যের গ্রামীণ জনসংখ্যার ২৫ ভাগ বাইরে চলে যাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি চরমে কিন্তু চাষিরা ফসলের লাভজনক দাম পায় না। বিজেপি দেশের নাগরিকদের ধর্মের নামে ভাগাভাগি করার যতই চক্রান্ত করুক, মানুষের জীবন জীবিকার প্রশ্নগুলি সামনে উঠে আসতে বাধ্য, শেষ বিচারে সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা জমির লড়াই শিক্ষা দেয়, উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলবেই। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জী বলেন, গরিব বনবাসী মানুষেরা বনাঞ্চলকে রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে, উচ্চবর্ণের মুষ্টিমেয় ধনীরাই বরং বনজ সম্পদ লূঠ করে মুনাফা করে, নানা সুবিধা ভোগ করে। অথচ গরিবদের উচ্ছেদের চক্রান্ত চলছে। সরকার আগামীতে বনাঞ্চলকে কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দিয়ে পার্শ্ববর্তী কৃষিজীবী গ্রামীণ মানুষের স্বাভাবিক ব্যবহার বন্ধ করে দিতে চাইছে। বাস্তুর অধিকারের পাশাপাশি কাজ-মজুরি-খাদ্যের দাবীতে ব্যাপক গরিবদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। এআইকেএম জেলা সম্পাদক সুধীর মুর্মু বলেন, সর্বত্রই অন্যায় উচ্ছেদের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধের লড়াই সরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছে। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন গ্রাম খেকে আগত কর্মীরা, যার মধ্যে ছিলেন সিপিএম দলের থেকে আসা কয়েকজন কর্মীরাও। এলাকার কৃষক নেতা বৈদ্যনাথ চিনা, আদিত্য ধবল, শ্যাম বাউরী বক্তব্য রাখেন।

১৭ জনের একটি অঞ্চল কমিটি গঠিত হয়। সভাপতি ও সম্পাদক হন যথাক্রমে অজিত রায়, দিলীপ বাউরী। আগামী ৮ জানুয়ারী গ্রামীণ ভারত বনধ্ সফল করে তোলার আহ্বান জানানো হয়। ২১ জানুয়ারী বাস্তু পাট্টার দাবিতে জেলা শাসকের দপ্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচী গৃহীত হয়।

খণ্ড-27
সংখ্যা-1