অযোধ্যা মামলার রায় : ধর্মনিরপেক্ষ ভারত আইনি লড়াইটাতে হেরে গেছে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধটা তাকে জিততেই হবে

সাতাশ বছর আগে আধুনিক ভারত ধ্বংসোন্মাদনার এক মর্মভেদী দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিল। এল কে আদবানি, মুরলি মনোহর যোশী এবং উমা ভারতীর মতো বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের উস্কানিতে উজ্জীবিত হয়ে এবং উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিং-এর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতাধর হয়ে উঠে এক সংগঠিত বর্বর জনতা প্রকাশ্য দিবালোকে অযোধ্যায় ষোড়শ শতকের এক মসজিদকে ধূলিসাৎ করে। সারা দেশ টিভিতে এই ধ্বংসকাণ্ডকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করে আর পুলিশ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। মসজিদটি তৈরি করেছিলেন মোগল সম্রাট বাবর, কিন্তু সংঘ পরিবার ঐ স্থানটিকে রামের জন্মস্থান হিসেবে দাবি করে। একেবারে মসজিদের স্থানটিতেই এক রাজসিক রাম মন্দির গড়ে তোলার জিগির তুলে সম্মিলিতভাবে এক উন্মাদনাকে উস্কিয়ে তোলা হয়।

কাপুরুষোচিত ঐ ধ্বংসসাধনের সাতাশ বছর পর ধ্বংসের সংঘটকদের এখনও শাস্তি দেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে ধ্বংসকাণ্ডে নেতৃত্বদায়ী ঐ দল ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে মাঝে-মাঝেই ক্ষমতা ভোগ করতে থাকে এবং কালক্রমে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসে। আর সুপ্রিম কোর্টও এখন আবার যেমন মনে করা হয়েছিল সেরকম ভাবে মসজিদের স্থলেই রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়েছে, আর ক্ষতিপূরণ হিসাবে নতুন মসজিদ গড়ার জন্য বিকল্প স্থানে জমি দেওয়ার কথা বলেছে। ১৯৯২ সালের ধ্বংসকাণ্ড যদি চূড়ান্ত মর্মান্তিক হয়ে থাকে, ২০১৯-এর নভেম্বরে অযোধ্যা মামলার রায়ও কম শোচনীয় নয়। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বর্বরদের একটা দল সুপ্রিম কোর্টকে অমান্য করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল। আর এখন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বরিষ্ঠ বিচারপতির বেঞ্চ ন্যায়বিচারের নীতিতেই অন্তর্ঘাত হানল।

এই ধরনের রায় কদাচ দেখা যায় যাতে উল্লিখিত তথ্যের এবং ব্যক্ত নীতির বিপরীতে এমন সিদ্ধান্ত টানা হয় যার সঙ্গে ঐ সমস্ত তথ্য ও নীতির অসংগতি প্রকট হয়ে ওঠে। আমাদের তাই মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে কিভাবে ১৯৪৯ সালে চক্রান্তমূলকভাবে রামলালার মূর্তি ঢুকিয়ে মসজিদকে অপবিত্র করে তোলা এবং মসজিদে প্রার্থনা করার ন্যায্য অধিকার থেকে অযোধ্যার মুসলিমদের বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং মসজিদের ধ্বংস আইনের শাসনের বেপরোয়া লঙ্ঘন হয়েই দেখা দিয়েছিল। এ সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট ১৯৪৯ সালে শুরু হওয়া প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করার দিকেই প্রবলভাবে ঝোঁকে। রায়ে বলা হয়েছে, এটা জমির মালিকানা সম্পর্কিত মামলা এবং বিশ্বাসের পরিবর্তে তথ্য-প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই তার নিষ্পত্তি করতে হবে। এটা বলার পরও আবার একটা সংযোজনী জুড়ে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিতর্কিত স্থলের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছে!

১৯৯২-এর ডিসেম্বরের সঙ্গে—যখন বাবরি মসজিদকে ধূলিসাৎ করা হয়েছিল—২০১৯-এর নভেম্বর বা বিচার বিভাগের হাতে ধ্বংসের মুহূর্তের সবচেয়ে বড় ফারাকটা ধরা পড়ে এই দুটো মর্মান্তিক ঘটনায় ব্যক্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান জনগণের ভিন্নভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। ১৯৯২ সালে মোটের উপর সাধারণ ভারতবাসীর মধ্যে ব্যাপকতর স্তরে অবিশ্বাস ও ক্রোধ দেখা গিয়েছিল, আর মুসলিমদের মধ্যে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতার সুগভীর বোধের কথা না হয় ধরা নাই হল। এবার কিন্তু জনগণের প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়ভাবে অব্যক্তই থেকেছে। আজকের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতা গভীরতর হয়েছে, এবং প্রাধান্যকারী মিডিয়া শোচনীয়ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ও সংখ্যাগুরুবাদী হয়ে উঠেছে এবং সংঘ বাহিনী সর্বব্যাপী সন্ত্রাসের এক রাজত্ব কায়েম করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিরোধী স্বরকে অপরাধ বলে সাব্যস্ত করে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া অনুক্ত থাকছে কেন তা বুঝে ওঠা কঠিন নয়।

রায় যে মন্দিরের পক্ষেই হতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে সংঘ পরিবার যথেষ্ট নিঃসংশয় ছিল আর তাই আমরা দেখলাম আরএসএস, ভিএইচপি ও বিজেপির নেতারা সবাই ‘শান্তি’ বজায় রাখার আবেদন জানাচ্ছেন। যে নেতারা শবরিমালা মন্দিরে প্রবেশ সম্পর্কিত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে খোলাখুলিভাবে ধিক্কার জানায়, তারাই কিন্তু রায় ঘোষণার আগের গোটা পর্যায়টাতেই সুপ্রিম কোর্টের সমর্থনে দাঁড়িয়ে যায়। সংঘ পরিবার যখন অযোধ্যার রায় নিয়ে আনন্দে মাতছে, তখন দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল বিরোধী দলগুলোও মোটামুটি বিজেপির লাইনের প্রতিধ্বনি করতেই এগিয়ে এসেছে। কংগ্রেস বস্তুত কৃতিত্বের দাবিদার হতে বিজেপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, এবং এমনকি বামেদের একটা অংশও মিটমাটের পদক্ষেপ রূপে রায়ের প্রশংসা করছে। কিন্তু ন্যায়বিচার ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব?

এই রায় বিবাদের আইনি নিষ্পত্তিকে নির্দেশিত করতে পারে, তবে তা কিন্তু কখনই এমন সর্বাঙ্গীণ বা ন্যায্য সমাপন নয় যার ওপর ভিত্তি করে দেশ এগিয়ে যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট যে ১৯৪৯ এবং ১৯৯২ সালের অধিকতর সাম্প্রতিক সময়ের প্রশ্নহীন অপরাধকে উপেক্ষা করেছে এবং ১৮৫৭-র আগে মসজিদের উপর মুসলিমদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের তথাকথিত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবের উপর ভিত্তি করে তাদের রায় দিয়েছে, তার কারণ তারা ছাড়া আর কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। এটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছে এবং নিকটবর্তী কোনো স্থানে পাঁচ একর জমি বরাদ্দের কথা বলে ক্ষতিপূরণের যে হাবভাব দেখানো হয়েছে তা কখনই জটিল হয়ে ওঠা এই ক্ষতকে নিরাময় করতে পারবে না। বিতর্কিত স্থানে মন্দির নির্মাণের জন্য এক ট্রাস্ট গঠনের দায়িত্ব ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত করে আদালত ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিধৃত মহান ধারণাগুলোকে শূন্যগর্ভ করে তুলতেও অবদান যুগিয়েছে। এই সমস্ত কিছু তথাকথিত সামূহিক বিবেককে তুষ্ট করতে পারে, যার প্রসঙ্গ সুপ্রিম কোর্ট উদ্বেগজনকভাবে টেনেছিল সহজাত ন্যায়বিচারের সমস্ত রীতিকে অগ্ৰাহ্য করে আফজল গুরুর মৃত্যুদণ্ডে অনুমোদন দিতে, কিন্তু ভারতের অবরুদ্ধ সংবিধানের কাছে এটা আর একটা মারাত্মক আঘাত।

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের ক্রমবিকাশের পথে অযোধ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ছিল এবং আজও রয়েছে। দেশ বিভাগের বেদনাবহ বিপর্যয়কে কাটিয়ে উঠে ১৯৪৭-এর পর ভারত এই সংবিধানকে গ্ৰহণ করে এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে তার যাত্রা শুরু করে। আমরা যেন ভুলে না যাই, আরএসএস শুধু যে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকেই নিজেদের দূরে রেখেছিল তাই নয়, তারা আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের বীক্ষার বিরুদ্ধেই সক্রিয় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। গান্ধি হত্যা, পরিকল্পনাটা আসলে ছিল একগুচ্ছ প্রথম সারির নেতাকে হত্যা করা, এবং রাতের অন্ধকারে বাবরি মসজিদের ভেতরে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা—স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে এই দুটো সদ্য জন্ম নেওয়া প্রজাতন্ত্রকে বিপথগামী করার এমন মার্কামারা দৃষ্টান্ত ছিল যাতে সংঘীয় চক্রান্তের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের ধারণার সঙ্গে আরএসএস এতটাই বেমানান ছিল যে ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী—এবং তিনি আর কেউ নন স্বয়ং সর্দার প্যাটেল, যাকে আত্মসাৎ করতে মোদী মরিয়া প্রচেষ্টা চালান—গান্ধী হত্যার পরপরই আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

আজ সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান ১৯৪০-এর দশকে ব্যর্থ হয়ে যাওয়া তাদের চক্রান্তকে বাস্তবায়িত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলো, বিশেষভাবে অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক নীতিসমূহ ইতিমধ্যেই এমন অভিমুখে পাল্টানো হয়েছে যার ফলে দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের আত্মপ্রতিষ্ঠার ভারতের আকাঙ্খা সমস্ত দিক থেকেই বরবাদ হয়ে যায়। এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, এই দুয়ে মিলে আমাদের সংবিধান এবং নাগরিকত্বের বুনিয়াদি ভিত্তিকে পাল্টে সেগুলোকে নতুন করে রচনা করতে উদ্যত হচ্ছে। অযোধ্যা মামলার রায় এই দুরভিসন্ধিমূলক নকশার সঙ্গে নিখুঁতভাবে খাপ খেয়ে যায়, এবং সত্তর বছর ধরে লালন করা ষড়যন্ত্রটাকে ফলপ্রসূ করে তোলে। অপরাধজনক পথে একটা মসজিদ ধ্বংস এবং তার স্থানে মন্দির নির্মাণের আদালতের রায়ের উদ্দেশ্য হল ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের আনুষ্ঠানিক সাংবিধানিক বাহ্য রূপের মধ্যেই হিন্দু রাষ্ট্রের উত্থানকে জাহির করা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত অযোধ্যার আইনি লড়াইটায় হেরে গেছে, এই পরাজয়টাকে মিটমাট এবং শান্তি হিসাবে ধামাচাপা না দিয়ে আমাদের কিন্তু অঙ্গীকারকে দৃঢ়তর করে গণতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধটায় জয়ী হওয়ার ওপরই জোর দিতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ৩ ডিসেম্বর ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-40