অসমে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও যথার্থ ক্ষতিপূরণের দাবিতে সোচ্চার

সমাচার গত সংখ্যায় ছিল সংক্ষেপে। পরে খবর মিলেছে আরও। অসমে চার লেনের রাস্তা ও জাতীয় সড়ক নির্মাণের নামে কৃষকদের থেকে জমি গ্রাস করে নেওয়া হচ্ছে যথার্থ ক্ষতিপূরণ না দিয়ে। বহু গরিব প্রান্তিক চাষিদের জমির পাট্টা নেই, দেওয়া হয়নি তাই নেই। সেই অজুহাতে তাদের ক্ষতিপূরণের দাবি অস্বীকার করা হচ্ছে।

এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে ২০১৩ সালে ডিব্রুগড়ে এবং২০১৫ সালে শোণিতপুরে গঠন করা হয়েছিল” ক্ষতিগ্রস্থ সুরক্ষা মঞ্চ”। এই কমিটিগুলি তখন থেকে আন্দোলন শুরু করে দেয়, লড়াই চালাতে থাকে জাতীয় সড়ক নির্মাণকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি সামনে রেখে। কেবল ডিব্রুগড় জেলাতেই ৫৭টি গ্রামের ১৭০০ পরিবারের থেকে ২০০০ একরেরও বেশি জমি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এনএইচ-৫২বি সড়ক তৈরির নামে। এর মধ্যে প্রায় ৫৫০ একর জমি ছিল সরকারের হাতে ন্যস্ত। সেখানে গরিব মানুষেরা বসবাস করতেন, কৃষির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সরকার জমি অধিগ্রহণ বাবদ ক্ষতিপূরণের আর্থিক মূল্য স্থির করে বিঘা প্রতি ১৭ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমির বিভিন্ন বর্গানুসারে। এইভাবে যে একটা আঞ্চলিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সেটা কিন্তু গড় মূল্যমানের চেয়ে অনেক নিচের স্তরের। আরও মারাত্মক বিষয় হল, বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে দেওয়া হয় সরকারি জমির অংশে যাঁরা রয়েছেন তাদের কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। ফলে তখন সেই গরিব অধিবাসীরা গঠন করলেন “এনএইচ-৫২বি ক্ষতিপূরণ দাবির যুক্ত কমিটি”।

প্রথম গেজেট বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করা হয় ১৯৫৬ সালের জাতীয় সড়ক আইন মোতাবেক ২০০৮ সালের ১৬ মে। যাই হোক, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন যখন উঠল তখন কিন্তু সরকার জমি নিল ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইনানুসারে। ১৯৫৬ সালের আইনে পরিষ্কার বলা রয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত একজন লোককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেই সময়ের জমির বাজার দরের অন্তত দশগুণ দাম দিতে হবে ।

আশ্চর্যের বিষয় হল, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ঘোষণা করা হল বিভিন্ন জেলায় বিভিন্নরকম। সরকারপক্ষের সমীক্ষক ডিব্রুগড় জেলায় কোথাও বহু ফসলি জমিকে দেখালো শস্যবিহীন জমি হিসেবে, আবার কোথাও নিদান দিল শস্য বাবদ কোন ক্ষতিপূরণ ধার্য হবে না। এর প্রতিবিধান পেতে “ডিব্রুগড়-শিবসাগর ক্ষতিপূরণ দাবি যৌথ কমিটি” টক্কর দিতে দীর্ঘলড়াই চালাতে চালু আইন অনুযায়ী জমির পূর্বতন মূল্য খতিয়ে দেখতে সরকারকে একজন কৌসূলী নিয়োগ করার দাবি করে। সেইসঙ্গে পদযাত্রা করে ৭০ কিলোমিটার, ধর্ণা ও অন্যান্য প্রতিবাদের রূপ সহ ৭০০ ঘণ্টা দীর্ঘ অনশন কর্মসূচী সংগঠিত করা হয়। তারা সরকারকে বাধ্য করে সরকারি জমিতে জীবন-জীবিকার নির্বাহে থাকা জনগণকেও ক্ষতিপূরণ দিতে।

শোণিতপুর জেলায়ও চার লেনের সড়ক নির্মাণের জন্য নেওয়া জমির হকে থাকা জনগণ একইরকম সমস্যার সম্মুখীন। শোণিতপুরে ক্ষতিপূরণ নির্ণয়ের প্রশ্নে সরকার আবার অদ্ভুত ব্যাপার ২০১৩ সালের ক্ষতিপূরণ আইন অনুসরণ করল না। রাস্তায় যারা বছরের পর বছর হকারি করে জীবিকার উপায় করে আসছে তাদেরকে প্রশাসন ক্ষতিপূরণের আওতায় বাইরে রাখার গোঁ ধরল। ফলে সেখানেও গড়ে উঠল “ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ”। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বেই এই উদ্যোগ শুরু হয়। আন্দোলনও শুরু হয়ে যায় ২০১৬ সাল থেকে। বেহালি লোকসভা কেন্দ্রের বরগাং এলাকায় বিজেপির নবনির্বাচিত বিধায়ক মায় মন্ত্রীসভা সদস্যের বাড়ি ঘেরাও করা হয়। শ্লোগান তৈরি হয়, “উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নয় তো রাস্তা সড়ক নির্মাণও নয়”। ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ নির্মাণ কাজ থামিয়ে দেয়, প্রশাসনকে বাধ্য করে জমির পুরানো অর্থমূল্যের মূল্যায়নের জন্য একজন কৌসূলী নিয়োগ করতে। প্রশাসন বাধ্য হয় রাস্তার হকারদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করতে।

বিজেপি বিধায়ক বিমল বোরা ক্ষতিগ্রস্ত জনতার আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং পুলিশের সাথে গাটছড়া বেঁধে আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। তবু সমস্ত বাধা মোকাবিলা করে আন্দোলনে সাফল্য এসেছে। বিজেপি বিধায়কটি মরীয়া হয়ে ষড়যন্ত্র করে আন্দোলনে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা সিপিআই(এমএল) নেতৃত্বের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করতে, আন্দোলনে অন্তর্ঘাত করতে সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য বলীন্দ্র শইকিয়ার বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করে। বিপরীতে জয়েন্ট ফোরামের নেতৃত্বে জনগণ ১৭ আগস্ট রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সংগঠিত করে। প্রতিবাদী জনতা মিছিল করার চেষ্টা করে। বলীন্দ্র শইকিয়ার বিরুদ্ধে চাপানো সমস্ত মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও কোনরকম বৈষম্য না করে সমস্ত বকেয়া ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দেওয়ার দাবি পেশ করতে। স্থানীয় সাব ডিভিশনাল কমিশনারের মাধ্যমে ডিব্রুগড় জেলা কমিশনারের উদ্দেশে ডেপুটেশন স্মারকলিপি পাঠাতে। কিন্তু এসডিসি-র অফিস থেকে প্রায় দু-কিমি দূরে মিছিল শুরু করার চেষ্টা হতেই পুলিশ বাহিনী তিন শতাধিক প্রতিবাদীকে গ্রেপ্তার করে রাজগড় থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে। পুলিশ পরিষ্কার কাজ করেছে বিধায়কের কথামতোই। প্রতিবাদীরা তবু হাল ছাড়েননি, থানা চত্বরে আটকে থাকা অবস্থায়ও প্রতিবাদ সভা করেছেন। জয়েন্ট কমিটির সদস্যরাই মিটিং পরিচালনা করেছেন। বক্তারা সকলেই প্রতিবাদীদের গ্রেপ্তার করার পদক্ষেপকে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছেন। তারা জোরের সাথে বলেছেন, “বিজেপি জমানা গণতন্ত্রকে হত্যা করছে”। তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করেন। বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া সহ সমস্ত বকেয়া দাবিতে সংগ্রাম চলছে চলবে ঘোষণা শুনিয়ে দেন।

খণ্ড-26
সংখ্যা-27