গুরু রবিদাস মন্দির ধংস — দলিতদের উপর আক্রমণ

সম্প্রতি দিল্লির তুঘলকাবাদে গুরু রবিদাসের মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর আগেও ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছিল। নানাভাবে তা প্রতিহত করে দলিতরা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মন্দির ভেঙে দেওয়া হল। তার ফলে গুরু রবিদাসের অনুগামী দলিতদের প্রবল ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। কোথাও কোথাও খণ্ডযুদ্ধ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। ভীম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ সহ ৯৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছেন। তবে রাজধানী দিল্লিতেই এই বিক্ষোভ আটকে থাকেনি, তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, অন্ধ্র ও পঞ্জাবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সর্বত্র দলিতরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। রবিদাসের মন্দির ভাঙা মানে তাঁদের আদর্শকে অপমান, তাঁদের দর্শন ও রাষ্ট্রভাবনার উপর আক্রমণ। ঋষি রবিদাসের দলিত অনুগামীরা ক্রোধে-শোকে অস্থির হয়ে পড়েছেন। যার ফলাফল এই বিক্ষোভ।

কেন ভাঙা হল রবিদাসের এই মন্দির? দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভেঙেছে প্রাচীন এই মন্দিরটি। মন্দিরটির অবস্থান ছিল তুঘলকাবাদের এক ঘন জঙ্গলের মধ্যে। ২৭ বছর আগে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি দাবি করে যে ওই মন্দিরের জমি সরকারের। ফলে তা ভেঙে দিতে হবে। দলিতদের বিশ্বাস বলে কিছু হয় নাকি! প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, যে বছর রবিদাসের মন্দির ভাঙার তোড়জোড় করা হয়, সেই বছরেই, ১৯৯২ সালে, ভাঙা হয় বাবরি মসজিদ। এর প্রতিবাদে রবিদাস জয়ন্তী সমারোহ সমিতি আদালতে যায়। সরকারের তরফে মামলায় জানানো হয়, মন্দিরের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে, ভেঙে ফেলতে হবে মন্দিরের ভবন, কাঠামো সমেত বিদ্যালয় প্রভৃতি। দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এই মামলার একটি পক্ষ (বিবাদী) হয় সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে। মামলার অন্য দিকে রয়েছে যারা (বাদী পক্ষ), সেই রবিদাস জয়ন্তী সমারোহ সমিতি জানায় যে মন্দিরের জমি তাদেরই, সরকারের নয়। পাঁচশো বছর আগের এই জমি দিল্লির সুলতান তাদের গুরু সন্ত রবিদাসজিকে দান করেছিলেন। অর্থাৎ, ইতিহাসের যুগেই। কিন্তু সে কথা মানা হয়নি। অত কাগজপত্র দেখাতে পারেননি মন্দির কর্তৃপক্ষ। এখানে উল্লেখ করা দরকার, হরকি-দুন উপত্যকায় দুর্যোধনের যে মন্দির আছে, সেটি নিষ্কর। পুরাণ মতে, অন্ত্যজ এক মহিলার হাতে জল পান করেছিলেন দুর্যোধন। সেই মহিলাকে বিশাল জমি দিয়ে যান ধৃতরাষ্ট্রপুত্র। সেখানে গড়ে উঠেছে দুর্যোধনের মন্দির, অন্ত্যজরা তাঁকে শিবের অবতার হিসাবে পূজা করে। সেই জমি আজও নিষ্কর।

এর পেছনের কারণ কী? জঙ্গলের ভিতর ওই মন্দির ও বিদ্যালয়ের জায়গা কি তবে নজরে আছে কোনও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর? বনজঙ্গলে বনবাসী দলিতদের মন্দির থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তাঁরা কি বনে বাস করে শহরে আসবেন পূজা করতে? আর লোদি সাম্রাজের সুলতানের কাগজ না থাকাই স্বাভাবিক ব্যাপার। বনবাসী দলিতদের মহাফেজখানা নেই। সুলতানের মুখের কথাই সেই সময়ে যথেষ্ট ছিল। লোদি সাম্রাজ্যের পতনের পর মুঘল, ব্রিটিশ কোনও সময়ে মন্দিরের জমির মালিকানা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলল না, অধিকার করা তো দূর অস্ত; আর আজ হঠাৎ রবিদাসের মন্দিরের জায়গার মালিকানা নিয়ে এত প্রশ্ন। প্রশ্নতেই শেষ নয়, শেষ পর্যন্ত দলিতদের মন্দির ভেঙে দেওয়া হল। এমন একটি সংবেদনশীল বিষয়ে কি আরও সতর্কতার দরকার ছিল না!

রবিদাস তাঁর সময়ে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে তাঁর বাগ্মীতা ও বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে সিকান্দার লোদি তাঁকে এই জমি দান করেন। সুলতান সিকান্দার লোদি ছিলেন লোদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাহলুল লোদির পুত্র ও শেষ শাসক ইব্রাহিম লোদির পিতা। সিকান্দার লোদি নিজে কবি ছিলেন এবং ‘গুলরুক’ ছদ্মনামে লিখতেন। বহু সংস্কৃত গ্রন্থ তাঁর সময়ে ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়, বিশেষত চিকিৎসা-সম্পর্কিত বই। রবিদাসের কবিতায় মুগ্ধ সিকান্দার লোদি যে জমি তাঁকে দান করেন, সেই জমির উপর গড়ে ওঠে মন্দির। পরে তা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়। তবে সেখানে শুধু মন্দিরই নয়, আছে তিনটি সমাধিও। ১৯৫৯ সালে মন্দির চত্বরে একটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয় যার উদ্বোধন করেছিলেন বাবু জগজীবন রাম। রবিদাসের শিক্ষা, দর্শন ছিল গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। তিনি হিন্দু রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন। তাঁর যে রাষ্ট্রভাবনা তা ভয় ও দুঃখহীন এক দেশের স্বপ্ন ছিল। বেগমপুর — রবিদাসের সেই আদর্শ রাষ্ট্র। যেখানে কোনও দুঃখ নেই। প্রেম ও সম্প্রীতির বার্তাবাহক রবিদাসের মন্দির কি তাই তড়িঘড়ি ভাঙা হল?

কেউ বলতেই পারেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ শিরোধার্য। নিশ্চয়। কিন্তু রবিদাসের ভক্তরা প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে কেন শবরীমালার সময় তোমরা সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মানোনি? রাষ্ট্রের আইন কি শুধু দলিতদের জন্য? রবিদাসের অনুগামীদের বলা হয়েছে, তোমরা অন্যত্র মন্দির গড়ো। প্রতিবাদে তাঁরা উত্তর দিয়েছেন, আপনারাও অযোধ্যার বাইরে কোথাও রাম মন্দির বানান না!

rally dalit

 

সন্ত রবিদাস কে? কেন তাঁর অনুগামীরা এত সাহসী, কী ছিল সেই মহান ব্যক্তির দর্শন?

এক আশ্চর্যমানুষ ছিলেন সন্ত রবিদাস। জন্ম নিয়ে অনেক মতান্তর থাকলেও একটি প্রতিষ্ঠিত অভিমত হল, রবিদাস জন্মেছিলেন ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে, বারাণসীতে। তখন দিল্লিতে চলছে লোদি সাম্রাজ্য। রবিদাস ছিলেন নানক ও কবীরের সমসাময়িক ভক্তিসাধক। ভারতবর্ষের ভক্তি সাধনার জগত রবিদাসকে ছাড়া ভাবাই যায় না, এমন ছিল তাঁর দর্শন। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন মুচি, চর্মকার, অন্ত্যজ। তাঁদের জন্ম নিয়েও আছে নানা পৌরাণিক গল্প। যেখানে তাঁদের ‘নীচ’ হিসাবেই দেখানো হয়েছে।

ছোটোবেলা থেকেই রবিদাস বুঝতে পারেন, মুচি মেথর ছোটলোকেদের উপর ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অত্যাচারের অযৌক্তিকতা। তিনি ফুঁসে উঠেছিলেন। পিতা ভয় পান। বারণ করেন। ছেলেকে লুকিয়ে রাখেন। অল্প বয়সে বিয়ে দেন, যাতে ওই সব বিপ্লবের কথা সে মুখে না আনে, সংসারী হয়। সংসারজীবন করেও রবিদাস বুঝেছিলেন — দলিতদের উপর ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের এই অত্যাচার ও অনাচারের অবসান হওয়া উচিত। সেই লক্ষ্যে তিনি সারা জীবন অবিচল ছিলেন।

তিনি বলছেন,
রবিদাস চামারু উসততি করে।
হরি কীরতি নিমখ ইখ গায়ি।।
পতিত জাতি উতমু ভাইয়া।
চারু বরণ পএ পগি আয়ি।।

রবিদাস তাঁর জীবদ্দশায় ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিবাদের মূর্ত দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রের আদর্শছিল ‘বে-গম পুর’। এই সেই পুর বা অঞ্চল যেখানে কোনও গম অর্থাৎ দুঃখ নেই। বস্তুত দলিতদের দুঃখকষ্টের সীমা-পরিসীমা ছিল না। বেশির ভাগ দলিত মনে করতেন, এটাই তাঁদের নিয়তি — অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করা। ভগবান তাঁদের এমনভাবেই তৈরি করেছেন। তাঁদের জন্ম হয়েছে উচ্চ বর্ণের সেবা করার জন্য। রবিদাস তাঁদের অত্যাচারহীন জীবনের সন্ধান দিয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে রবিদাসীরা আজও লড়াই করে চলেছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সন্ত রবিদাসের প্রভাব বাবাসাহেব আম্বেদকরের জীবনেও ছিল। এখন যে ‘ভীম আর্মি’ দলিতদের নানা অধিকারের প্রশ্নে লড়াই করছে, তাঁরাও সন্ত রবিদাসকে অন্যতম আদর্শ বলে মানেন।

রবিদাস তাঁর কবিতায় এবং ভজনে জাতপাত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বলেছিলেন সাম্যের বাণী। তাঁর রচনায় পাওয়া যায় শ্রমের মর্যাদার কথা। সরলতা ও নৈতিকতার প্রতিমূর্তি ছিলেন সন্ত রবিদাস। বর্ণব্যবস্থা, অস্পৃশ্যতা নিয়ে সারা জীবন লড়াই করে গিয়েছেন। অনেকাংশে সফলও হয়েছিলেন।

রবিদাস বলছেন,
মেরী জাতি কুট বাণ্ডলা ঢোর ঢোবন্তা
নিতহি বানারসী আস পাসা।
অব বিপ্র পরধানু তিহি করহি ডঁডউতি
তেরে নাম সরণায়ি রবিদাসু দাসা।।

অর্থঃ আমার জন্ম সেই মানুষদের মধ্যে হয়েছে, যারা বানারসের নিকটে রোজ মৃত পশুদের নাড়াচাড়া করে। কিন্তু আমি, প্রভুর নামে স্মরণ নিলাম আর আজ বিপ্রদের প্রধান লোকেরা আমাকে দণ্ডবৎ হয়ে নমস্কার করে।

কিন্তু সেই বিপ্ররা যে তাঁকে খুন করে ফেলতে পারে, সে কথা ঘুণাক্ষরে কল্পনাও করতে পারেননি সন্ত রবিদাস। এখান থেকেই বোঝা যায়, এই সময়ের দলিত-বহুজনদের উপর যে অত্যাচারের ইতিহাস তার শুরুয়াৎ অনেক প্রাচীন। শম্বুককে হত্যা করা হয়েছিল পৌরাণিক যুগে। ইতিহাসের সময়ে সময়ে একের পর খুন করা হয় দলিত নেতা ও ভাবুকদের। সন্ত হরিদাসকে খুন করা হয়। যে সব অন্ত্যজ তাদের কণ্ঠ তুলে ধরতে চায়, জানাতে চায় অধিকারের কথা, যুগে যুগে তাদের হত্যা করেছে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। গুরু নামদেবের উপর প্রচণ্ড অত্যাচার হয়েছে, তাঁকে মহারাষ্ট্র ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সন্ত তুকারাম, সন্ত চোখাকে হত্যা করা হয়েছে। মহাত্মা ফুলের উপর বার বার আক্রমণ নেমে এসেছে। তাঁকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়। আর চিতোরগড়ে খুন হন সন্ত রবিদাস। সন্ত রবিদাস ২০১৯ সালে আরও একবার খুন হলেন।

খণ্ড-26
সংখ্যা-26