স্বাধীনতার ৭২ বছর


৯ আগষ্ট – ১৫ আগষ্ট, সপ্তাহব্যাপী স্বাধীনতার সন্দেশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বার্তা উপনিবেশবাদ, অধীনতা ও শোষণের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর ঐক্যের নয়া অঙ্গীকার

বিদেশী লগ্নি পুঁজির কাছে আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে ভারতের সার্বভৌমত্বকে উর্দ্ধে তুলে ধরো

বিভাজন করে শাসন করার নীতি ঔপনিবেশিক প্রভুদের শেষরক্ষা করতে পারেনি। আজকের কোম্পানিরাজকেও তা আড়াল করতে পারবে না।

এবারের ১৫ই আগষ্ট ভারত তার ৭২তম স্বধীনতা দিবস পালন করবে। লক্ষ কোটি ভারতবাসী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সেই সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছিল যা গর্ব করে বলত ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও অস্ত যায়না’! অধীনতা, বৈষম্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর অদম্য সংগ্রামের প্রতীক ১৯৪৭-এর ১৫ আগষ্ট।

আমরা যখন ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে চলেছি তখন অতীতের দিকে তাকিয়ে ঔপনিবেশিক যুগের হাল হকিকত একবার দেখে নেওয়া যাক। একবার দেখে নেওয়া যাক যে কিসের বিরুদ্ধে আমরা সেদিন সংগ্রাম করছিলাম, আমাদের জাতীয়তাবাদ কিসের দ্বারা নির্ণীত হয়, ইতিহাসের কোন উত্তরাধিকার নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি।

ঔপনিবেশিক শাসনের প্রকৃতি, ভারতীয়দের জাতিগত অধীনতা, বিরুদ্ধাচরণকে নৃশংস দমন এবং ‘বিভাজন করে শাসন’-এর রণনীতি:

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রক্তচোষা মুনাফাবাজির পথ বেয়ে ভারতে উপনিবেশবাদ এসেছিল। ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে ভারত ছিল সস্তা শ্রমের এক বিরাট ভান্ডার এবং বিশাল বাজার ও বিপুল সম্পদের উৎস।

উত্তর পূর্বাঞ্চল ও অন্যান্য উপনিবেশে বৃটিশ রাজের বাগিচা শিল্প ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ভারতীয় শ্রমিকদের রক্ত ও ঘামে। এইসব শ্রমিকদের ক্রীতদাস বানিয়ে রাখা হয়েছিল বাগিচা শিল্পে।

আমাদের কৃষি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ রাজের স্বার্থে। গায়ের জোরে ব্যবসায়ীকরণের মাধ্যমে ভারতীয় কৃষকদের অর্থনৈতিক সুস্থিরতা ও কৃষিতে অর্থলগ্নির স্বাধীন বিস্তারকে চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের প্রথাগত শিল্প ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল যাতে ভারত কেবল ইংল্যান্ডের শিল্পজাত পণ্যের বাজারে পর্যবসিত হয়।

ভারতের অর্থনৈতিক অধীনতা স্থায়ীভাবে বজায় রাখা হয়েছিল ব্রিটিশ রাজের কাছে ভারতীয় জনতার রাজনৈতিক অধীনতার মধ্যে দিয়ে। ব্রিটিশ রাজের এই জাতবিদ্বেষী শাসন বজায় রাখা হয়েছিল অসংখ্য কালা কানুনের মধ্যে দিয়ে। রাওলাট অ্যাক্ট, পাব্লিক সেফটি বিল ইত্যাদি কত কি।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম: আমাদের জাতীয়তাবাদকে রূপ দিয়েছিল ভারতীয় জনতার গৌরবোজ্জ্বল লড়াই:
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতভূমিতে তার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজাদের সাথে যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে ভারতবাসী প্রথমবার ব্রিটিশকে দেখিয়েছিল তাঁদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির নমুনা।

ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে পুনরুদ্ধার করার যে দিশা ১৮৫৭র বিদ্রোহের অন্তরাত্মা হিসেবে সামনে এসেছিল তা মূর্ত হয় আজিমুল্লা খানের লেখা “হাম হ্যায় ইসকা মালিক, ইয়ে হিন্দুস্তাঁ হামারা” গানে। এই মহাবিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। যদিও ১৮৫৭র বিদ্রোহকে ঔপনিবেশিক শাসকেরা শেষ পর্যন্ত নির্মমভাবে দমন করেছিল, কিন্তু লক্ষ কোটি ভারতবাসীর অন্তরে সেই বিদ্রোহ স্বাধীনতার যে আকাঙ্খা জাগিয়ে তুলেছিল তা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অন্তিম দিন পর্যন্ত লড়ে গেছে।

আমরা যখন ৭২তম স্বাধীনতা দিবসের সামনে এসে হাজির হয়েছি তখন এসো আরেকবার আমরা স্মরণ করি সেইসব অগণিত যোদ্ধাদের যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে। এসো আমরা উদযাপন করি অধীনতার বিরুদ্ধে আমাদের জনতার গৌরবোজ্জ্বল একতাকে। বাহাদুর শাহ জাফর, রানী লক্ষ্মীবাই, ক্ষুদিরাম বসু, বটুকেশ্বর দত্ত, বিনয়-বাদল-দীনেশ, চন্দ্রশেখর আজাদ, ভগৎ সিং, আসফাকুল্লা খান – এসব সেই হাজার হাজার শহীদদের কয়েকজনের নাম যারা নিজেদের জান কুরবান করেছিল স্বাধীনতার মহাসংগ্রামে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্মকথাকে উদযাপন করে ৯ আগষ্ট থেকে ১৫ আগষ্ট আইসা পালন করবে ‘স্বাধীনতার সন্দেশ’ সপ্তাহ।

৯ আগষ্ট ১৯৪২ শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। ভারতের জনতা ঘোষণা করেছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে শেষ যুদ্ধ।

১১ আগষ্ট ১৯০৮ আঠারো বছর বয়সী অকুতোভয় তরুণ ক্ষুদিরাম বোস “হাসি হাসি” ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়েছিল।

১৩ আগষ্ট ১৮৯১ টিকেন্দ্রজিৎ সিং ও থাঙ্গাল জেনেরালকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রভুরা, ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অপরাধে, ইম্ফলে।

১৫ আগষ্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে আপন মাতৃভূমির সংগ্রামে অগণিত ভারতবাসীর আত্মত্যাগ এনে দিয়েছিল বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা।

আজকের শাসকেরা কি সেই ব্রিটিশ রাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছে?

কত সংগ্রামে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও সংহতি। আজ যারা তাকে বিকিয়ে দিতে চলেছে সেইসব শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও।

মোদি-২ জমানার প্রথম সংসদীয় অধিবেশনে সরকার বেশ কিছু আইন পাশ করেছে, বেশ কিছু আইন সংশোধন করেছে। সেইসব নয়া আইন ও সংশোধনী ভারতীয় নাগরিক ও ভারতজাতির পক্ষে ভয়ঙ্কর।

মোদি-২ জমানার প্রথম বাজেটে বিমান চলাচল, বীমা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগকে খুল্লাম খুল্লা ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির নামে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন বিদেশী লগ্নিপুঁজি সংস্থা থেকে অবাধে ঋণ নেওয়ার। এই দুটি নীতি মিলে ভারতের অর্থনীতিকে বিদেশী লগ্নিপুঁজি সংস্থাগুলির অধীনস্ত করে ফেলবে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দিনগুলির মতোই আবার কোম্পানিরাজ ফিরে আসার এই প্রক্রিয়াকে আমাদের অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবময় উত্তরাধিকার বহন করি।

পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনে মোদি-২ সরকার তথ্য অধিকার আইন পাল্টে দিয়ে নাগরিক সমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি আড়াল করার পন্থা নিয়েছে। তারা ইউএপিএ আইনে এমন ভয়ানক পরিবর্তন এনেছে যাতে কেউ প্রশ্ন তুললেই সেই ব্যক্তি-নাগরিককে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা দিয়ে বিনা বিচারে জেলে পাঠানো যায়। আইনের এইসব সংশোধন আমাদের ব্রিটিশ যুগের নিপীড়নমূলক আইনগুলির কথা মনে করিয়ে দেয় – রাওলাট আইন বা পাব্লিক সেফটি বিল (ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীরা এই আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন) – ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে কোনও প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমন করার জন্য যে আইনগুলি লাগু করা হয়েছিল। দুটি ভয়ানক বিপজ্জনক শ্রমিক বিরোধী আইন পাশ হয়েছে – মজুরি বিধি ২০১৯ ও কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও কর্মপরিবেশ বিধি ২০১৯। এই দুটি আইন কর্পোরেট কোম্পানিগুলিকে ছাড়পত্র দিচ্ছে শ্রমিকদের অধিকার ইচ্ছেমতো খর্ব করার। সরকার এইসব কোম্পানিগুলিকে ন্যূনতম মজুরি ইত্যাদি শ্রম-অধিকার অগ্রাহ্য করার ছাড়পত্র দিচ্ছে। এই বিলগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় কীভাবে ইউনাইটেড কিংডমের সুপার প্রফিটের স্বার্থে ভারতীয় শ্রমিকদের শোষণ করা হত ব্রিটিশ জমানায়।

২০১৯-এর জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়াতে সরকারী স্কুল ও কলেজগুলি বন্ধ করে দেওয়ার ছক কষা হয়েছে। এই খসড়া বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এদেশে এসে ব্যবসা করার লক্ষ্যে উপযোগী আইন বানানোর প্রস্তাব রেখেছে। বেসরকারী স্কুল ও কলেজগুলিকে ‘শিক্ষা বিক্রি’ করার লক্ষ্যে যথেচ্ছ ফি বৃদ্ধির ছাড় দিচ্ছে। বিদেশী শিক্ষা মাফিয়ারা এদেশের বাজারে এসে কীভাবে মুনাফা করতে পারবে সেটাই বর্তমান শাসকদের চিন্তা, কীভাবে লক্ষ কোটি ভারতবাসীর গুণমানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ তৈরি হবে সে বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নাই।

ঔপনিবেশিক শাসকদের বড়ো প্রিয় ‘বিভাজন করে শাসন করো’ নীতি, বর্তমান শাসকদেরও খুব প্রিয়। বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে পেছন থেকে চালায় যারা সেই আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়েছিল। ভারতবাসী যখন ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করছে তখন আরএসএস প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশদের সাথে যোগ দিয়েছিল। ব্রিটিশদের প্রিয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি খুব স্বাভাবিকভাবেই আজকের বিজেপিরও প্রিয় স্ট্র্যাটেজি।

ভারতীয়রা বিপুল ক্ষমতাধর ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে লড়েছিল ধর্ম-ভাষা-আঞ্চলিকতা নির্বিশেষে সংহতি ও প্রতিরোধ গড়ে তুলে। আইসা ছাত্র-যুবাদের প্রতি আহ্বান রাখছে স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই সন্দেশ সেই শিক্ষা ঊর্দ্ধে তুলে ধরে ৯ আগষ্ট থেকে ১৫ আগষ্ট সপ্তাহব্যাপী প্রচার অভিযান সংগঠিত করতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই মর্মবাণী আরেকবার সোচ্চারে পরিস্ফুট করতে। এসো আমরা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিষাক্ত বিদ্বেষকে পরাস্ত করি। দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত স্বাধীনতা যে প্রতিশ্রুতি আমাদের এনে দিয়েছিল এসো তাকে আবার অধিকার করি।

(এআইএসএ প্রচারপত্র)

খণ্ড-26