জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা ফিরিয়ে দাও! ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলা থেকে নির্বৃত্ত হও!

বেশ কয়েকদিন ধরে জল্পনা জাগানো ও কৌতূহলী সংকেত দেওয়ার পর মোদী সরকার ৫ আগস্ট অবশেষে জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কে তার পরিকল্পনাকে সহসাই প্রকাশ করল। এটা সুচতুর ও চক্রীসুলভ পথে চালানো সংবিধানের উপর এক ঝটিকা আক্রমণ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সংবিধানের ৩৬৭ ধারার উপর ভর করে রাষ্ট্রপতির এক আদেশনামার মাধ্যমে সরকার ৩৭০ ধারার গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলোর ব্যাখ্যাকে পাল্টে দিল এবং এইভাবে ঐ ধারাকে প্রকৃতপক্ষে বাতিল করা হল, যদিও এই মর্মে সুনির্দিষ্ট কোনো সংশোধনী না এনেই তা করা হল। এরই সাথে বাতিল করা হল ৩৫ নং ধারাকেও, যে ধারায় জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের জন্য কিছু বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এই ধরনের সুরক্ষা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশেষ বর্গের কিছু রাজ্যের এবং প্রতিবেশী হিমাচল প্রদেশের জনগণও পেয়ে থাকেন।

মোদী সরকারের বুলডোজার কিন্তু এখানেই থামল না। তারা জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটাকেই ভেঙে ফেলার দিকে এগিয়ে গেল, তাকে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করা হল যেগুলোতে প্রশাসন চালাবে কেন্দ্র — লাদাখ এবং জম্মু ও কাশ্মীর। লাদাখের অবস্থা হবে চণ্ডিগড়ের মতন, যা এমন এক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হবে যেখানে কোনো বিধানসভা থাকবে না। আর জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা থাকলেও রাজ্যের প্রাপ্য ক্ষমতা তার থাকবে না, যা অনেকটা পুদুচেরি বা খুব বেশি হলে দিল্লীর মতন। কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মর্যাদাকে উন্নত করে রাজ্যে পরিণত করার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে, যেমন গোয়া; একটি রাজ্যকে ভেঙে দুটি রাজ্য গঠনের বেশ কয়েকটি দৃষ্টান্তও আমাদের রয়েছে, যার সর্বশেষ নিদর্শন হল পূর্বতন অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন। কিন্তু একটা রাজ্যকে ভেঙে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করার নজির এই প্রথম।

গোটা উদ্যোগটার মধ্যে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক রূপে যা দেখা দিয়েছে তা হল এর চক্রান্তমূলক, প্রতারণাময় ও ঔদ্ধত্যমূলক চরিত্র। জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের সহমত ছাড়া কাশ্মীর সম্পর্কে কোনো সংশোধনী সংবিধানগতভাবে আইনসিদ্ধ হতে পারে না। ৩৭০ ধারা নিয়ে যে কোনো সংশোধনীর সম্পাদন বর্তমানে ভেঙে দেওয়া জম্মু ও কাশ্মীর সংবিধান সভার সম্মতির দাবি জানায়। গতকালের রাষ্ট্রপতির আদেশনামার মধ্যে দিয়ে সংবিধান সভাকে রাজ্য বিধানসভা রূপে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভাকেও ভেঙে দেওয়ায় রাজ্যে কেন্দ্রের প্রতিনিধি রাজ্যপালের সম্মতিকে রাজ্যের সম্মতি বলে গণ্য করা হয়েছে। এখানেই রয়েছে সংবিধানের সঙ্গে মোদী সরকারের প্রশ্নহীন প্রতারণা। বিজেপি কেন প্রথমে রাজ্য সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে সরকারটাকে ফেলে দিল এবং তারপর লোকসভার সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন করতে অস্বীকার করল, তা বুঝতে এখন আর কারো বাকি নেই।

জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখার সাথে সাথে মোদী-শাহ জুটি কাশ্মীরের কন্ঠস্বরকে সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে রাখাটাকেও সুনিশ্চিত করল। এবং তা করা হল যখন রাজ্যের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অধিকারকেই শুধু কেড়ে নেওয়া হয়নি, ঘৃণ্য কৌশলের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের এক অঙ্গরাজ্য হিসাবে তার অস্তিত্বকেই নিশ্চিহ্ন করা হল। সন্ত্রাসবাদের জুজু তুলে ধরা এবং অমরনাথ যাত্রা বাতিল করার মধ্যে দিয়ে সরকার কাশ্মীরে ৩০,০০০ অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে। বিরোধী নেতাদের গৃহবন্দী করা হয়, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কাশ্মীরের কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে রাখার জন্য যথার্থরূপেই কার্ফু বলবৎ করা হয়। যে সাংবিধানিক এবং ঐতিহাসিক সেতু জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছিল তাকে ধ্বংস করা হল, কাশ্মীরি পরিচিতিকে রক্ষা করার যে পবিত্র সাংবিধানিক অঙ্গীকার কাশ্মীরের জনগণের কাছে করা হয়েছিল (এমনকি অটল বিহারি বাজপেয়ীও কাশ্মীরীয়ত, জামুরিয়ত ও ইনসানিয়াৎ, অর্থাৎ কাশ্মীরী পরিচিতি, গণতন্ত্র ও মানবতার কাঠামোর মধ্যে কাশ্মীরী জনগণের আকাঙ্খা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন) তাকে জঞ্জালের ঝুড়িতে চালান করা হল, ঠিক মোদী যেমন বিমুদ্রাকরণের মধ্যে দিয়ে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটকে আবর্জনায় পরিণত করেছিলেন।

কাশ্মীরী জনগণের সঙ্গে এই সাংবিধানিক প্রতারণাকে মোদী জাতীয় সংহতির বিজয় বলে বর্ণনা করছেন। এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর হতে পারে না। কাশ্মীরী জনগণকে ভারতের আরো কাছে নিয়ে আসা দূরে থাক, এই তঞ্চকতা কাশ্মীরী জনগণকে গভীরতর বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই ঠেলে দিয়েছে। সরকার যে রাজ্যটাকে পুরদস্তুর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল, এই ঘটনাটাই সুস্পষ্ট রূপে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সরকার কাশ্মীরকে এমন এক ভূখণ্ড মাত্র রূপে গণ্য করে যার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং রণনৈতিক তাৎপর্য রয়েছ; কিন্তু কাশ্মীর তাদের কাছে কখনই এক জাতি রূপে গণ্য হয় না যার নিজস্ব সভা এবং মর্যাদা ও গণতন্ত্রের আকাঙ্খা রয়েছে। রাষ্ট্র আদিবাসী ও গ্রামীণ দরিদ্রদেরও এই চোখেই দেখে যাকে তাদের ব্যাপকহারে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, লক্ষ্য হল, তাদের জমি ও সম্পদ সমূহ কর্পোরেট জমি হাঙ্গরদের গ্রাস করতে দেওয়া। জম্মু ও কাশ্মীরে যাদের স্বার্থ সবচেয়ে বেশি, রাজ্যের সেই জনগণকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে না।

জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে যে অন্যায় করা হল তা সারা ভারতের জ্ঞানচক্ষুকে খুলে দিক। আগামীদিন কী রূপ পেতে চলেছে এটা তার সংকেত দিচ্ছে। ৩৭০ ধারা সম্পর্কে সংবিধান যা বলা আছে তাকে অগ্রাহ্য করে মোদী সরকার এটা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সংবিধানকে তারা এমন একটা নথি রূপে গণ্য করে যাকে খেয়ালখুশি মতো ব্যাখ্যা করা এবং মর্জিমাফিক পাল্টানো যায়। আজ যদি জাতীয় সংহতির নাম নিয়ে ৩৭০ ধারাকে বিলকুল বাতিল করা যায়, তবে আগামী দিনে সামাজিক সমতাকে অছিলা করে তপশিলি জাতি/তপশিলি জনজাতি এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণীর জন্য বিদ্যমান সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে বানচাল করে দেওয়া যাবে। সংবিধান সংশোধন করে সাধারণ বর্গের মধ্যে থেকে তথাকথিত ‘অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের’ জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের মাধ্যমে এই লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ভোগ করা একটা রাজ্যকে যদি সরাসরি ভেঙে ফেলে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে মোদী সরকারের বিরোধিতা করা যে কোনো রাজ্যই কেন্দ্রীয় শাসনাধীনে আনার মোদী সরকারের দখল অভিযানের শিকার হয়ে উঠতে পারে। সরকার যদি ‘আশু প্রয়োজনীয়তার’ কথা বলে জম্মু ও কাশ্মীরে যথার্থই জরুরী অবস্থা বলবৎ করতে পারে, তবে কাল একইভাবে যে কোনো রাজ্যে বা সারা ভারতবর্ষেই গণতন্ত্রকে খারিজ করা হতে পারে।

আজ বিশ্বাসঘাতকতার এই লগ্নে প্রতিটি গণতন্ত্রপ্রেমী ভারতবাসীকেই কাশ্মীরের জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারের দাবি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাতে হবে। বিরোধী পক্ষের সমস্ত নেতাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সংযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থাকে অবিলম্বে পুনর্বহাল করতে হবে। মোদী সরকারের সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কখনই স্বৈর এবং চক্রান্তমূলক পথে ভারত শাসনের লাইসেন্স হতে দেওয়া যাবে না। ভারতের স্বাধীনতার ৭২তম বার্ষিকীর আগে আমাদের ভারত সরকারকে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যর সাংবিধানিক ভিত্তির প্রতি এবং ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারে দায়বদ্ধ করতে হবে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৬ আগস্ট ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-25