আর্থিক মন্দা ও ক্রমবর্দ্ধমান ছাঁটাই থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই কি কাশ্মীর দাওয়াই ?

বুকের ছাতি ফুলিয়ে, রাজ্য সভায় অমিত শাহ যখন স্বৈর শাসকের ভূমিকায় চূড়ান্ত ঔদ্ধত্ব্যে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার বিলোপ করে তাকে দু টুকরো করার বিল পেশ করল, ঠিক ওইদিন, সোমবার, এক ধাক্কায় টাকার দাম হুহু করে পড়ল ১১৩ পয়সা! গত ছ’ বছরে যা একদিনে এতো নীচে গড়ায়নি।

এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। বেশ কিছুদিন যাবৎ ভারতীয় অর্থনীতি গভীর সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, তবে কী আমাদের দেশ নিঃশব্দে আরেকটা মন্দার কবলে এগিয়ে চলেছে? একের পর এক যে সব তথ্য-পরিসংখ্যান সামনে আসছে, তা একবার দেখে নেওয়া যাক।

যে বিদেশী পুঁজিকে সরকারি অরশ্থাস্ত্রিরা আর্থিক বৃদ্ধির এক অন্যতম চাবিকাঠি হিসাবে মনে করে, এই আগস্ট মাসের শুরুতেই বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ভারতের মলুধনী বাজার থেকে তুলে নিল তাদের নীট ২,৮৮১ কোটি টাকা। দেশের বাজারে ক্রমহ্রাসমান চাহিদা, আন্তর্জাতিক বাজারে দিনের পর দিন ঘনিয়ে ওঠা অনিশ্চয়তা, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ, কয়েক সপ্তাহ আগে আইএমএফ-এডিবি-আরবিআই ভারতের আনুমানিক আর্থিক বৃদ্ধির হার আগে যা করেছিল তার তুলনায় বেশ কিছুটা কমিয়ে দেওয়ায় বিদেশী পুঁজির ভারত ছাড়ার ধুম লেগেছে। প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মনিয়াম তো বর্তমান সরকারি পরিসংখ্যানবিদদের প্রচারিত জিডিপির হারকে ‘ ফোলানো ফাঁপানো’ ছবি হিসাবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, প্রকৃত বৃদ্ধির হার হবে ৩.৫ শতাংশ থেকে ৫.৫ শতাংশ।

এই জুলাই মাসে, কেন্দ্রের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রনালয় একটি রিপোর্টে জানাচ্ছে, যে পণ্যগুলো বিদেশী মুদ্রা আমদানি করে, যেমন, পেট্রোলিয়াম, চাল, রত্নালংকার, পোষাক, ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রি, সেগুলোর রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়েছে। মোট ৩০টি রপ্তানিযোগ্য পণ্য সামগ্রীর মধ্যে মাত্র ৯টির চাহিদা রপ্তানীর বাজারে উর্ধমুখী।

এপ্রিল-জুন মাসে ৮ টি কোর সেক্টারের বৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ০.২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। বাধ্য হয়ে, সরকার ৩১ জুলাই তারিখে, ওই ৮টা সেক্টরের বৃদ্ধির পূর্বাভাস (মে মাসের জন্য) আগের ৫.১% থেকে কমিয়ে ৪.৩% করেছে। এই ৮ টি কোর সেক্টর হলো, কয়লা-অপরিশোধিত তেল-প্রাকৃতিক গ্যাস-সার-ইস্পাত-সিমেন্ট-বিদ্যুত এবং রিফাইনারি পণ্য। এই সেক্টারগুলো দেশের শিল্প উৎপাদনের সূচক (আইআইপি)-কে নির্দ্ধারণ করে, যা সমগ্র অর্থনীতির মধ্যে ফ্যাক্ট্রির মোট উৎপাদনের সূচক। অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ-ম্যানফেু কচারিং, কৃষিক্ষেত্র, বিত্তীয় পরিষেবা বা ফিনান্সিয়াল সার্ভিস মারাত্মক শ্লথতার কবলে। দেখা যাচ্ছে, জুন ত্রৈমাসিকে ১২৫টি সংস্থার মধ্যে ৬০ শতাংশের ও বেশি লাভের মুখ দেখেনি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অটোমোবাইল সেক্টর। এই সেক্টরে মন্দার ঝাপ্টায় শুধুমাত্র জামশেদপুরে ৩০-র উপর ইস্পাত সংস্থা বন্ধের কবলে। টাটা মোটরস্ তো চালু করেছে ‘ব্লক’ ক্লোজার। গত কয়েক মাস ধরে মাসে ১৫ দিন উৎপাদন বজায় থাকায় বিপুল সংখ্যক অস্থায়ী শ্রমিক কাজ হারাচ্ছেন। বিগত দু’ দশকের মধ্যে বর্তমানে যাত্রিবাহী গাড়ির বাজার সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে। মারুতি-সুজুকি, যারা গাড়ি শিল্পে সিংহভাগ বাজার দখল করে রয়েছে, তারা জানাচ্ছে যে বিগত ৭ বছরের মধ্যে ওদের এখন গাড়ি বিক্রি সবচেয়ে কম। বৃহত্তম এই গাড়ি উৎপাদক সংস্থাটির বিক্রি কমেছে ৩৭ শতাংশ। দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক হুন্ডাই মোটর ইন্ডিয়া এবং মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রার বিক্রি কমেছে যথাক্রমে ১০ ও ১৬ শতাংশ। মোট ৫টি সংস্থা, যারা সম্মিলিতভাবে গাড়ির বাজারের ৮৫% ধরে রেখেছে, বিগত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় এ বার জুলাই মাসে ৩১ শতাংশ কম বিক্রি করতে পেরেছে। গাড়ি শিল্পে নেমে আসা এই মন্দার ফলে শুরু হয়েছে কর্মীছাঁটাই। এই প্রথম মারুতি কর্তৃপক্ষ জানালো যে তারা ৬% ‘অস্থায়ী কর্মীকে ‘কাজ থেকে বসিয়ে দিতে’ বাধ্য হয়েছে। বিরাট ধাক্কা লেগেছে গাড়ির শো-রুমগুলোতে। একের পর এক শো-রুম বন্ধ হওয়ায় গোটা দেশে ইতিমধ্যেই কর্মচ্যুত হয়েছে ২ লক্ষ কর্মী। এ কথা জানিয়েছে ফেডারেশন অফ অটোমোবাইল ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশ। গত জুন মাস থেকে শুরু হয়েছে এই ছাঁটাই। গাড়ির মলূ উৎপাদন বিন্দুথেকে শুরু করে ব্যাপক কর্মী সংকোচনের এই প্রভাব পড়েছে সহায়ক শিল্প সহ শো-রুমগুলোতে। অত্যাধিক জিএসটি-র হার, গাড়ির বিমা প্রিমিয়ামে বিরাট বৃদ্ধি, অ-ব্যাঙ্কিং সংস্থার কাছ থেকে ঋণ না পাওয়া, আভ্যন্তরীণ বাজারের ঘাটতি প্রভৃতি এক গুচ্ছ কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে এখন কালো মেঘের ঘনঘটা।

শুধু বেসরকারি ক্ষেত্রই নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, যেগুলোকে এতদিন গণ্য করা হতো সুরক্ষিত ক্ষেত্র হিসাবে, সেখানেও নেমে এসেছে বিরাট হামলা। প্রায় তিন লক্ষাধিক কর্মীকে স্বেচ্ছা অবসর দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে রেল। ৫৫ বছর অতিক্রান্ত এমন কর্মীদের চিহ্নিত করে তাঁদের চলে যাওয়ার জন্য তালিকা তৈরি করার নির্দেশ রেলমন্ত্রক এবং রেল বোর্ড সমস্ত জোনাল কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে। রেলের সাতটি উৎপাদন কেন্দ্রকে কর্পোরেশন বানানোর যে প্রস্তাব রয়েছে, তার ফলে ঘটবে ব্যাপক কর্মচ্যুতি। প্রতিরক্ষা শিল্পের বেসরকারিকরণ, কর্পোরেশনের যে কর্মকান্ড কেন্দ্র নিয়েছে তা কর্মী সংকোচনের দরজাকে হাটখোলা করবে।

বিএসএনএল-এমটিএনএল-কে তো তিলে তিলে গলা টিপে হত্যা করল কেন্দ্রীয় সরকার। এবার, প্রায় ১,৭৬,০০০ কর্মীকে ৫৫ বছর বয়সেই অবসর দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কোমর বাঁধছে।

২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার পর দেশের শিল্পমহল কে সাহায্য করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর ১.৮ লক্ষ কোটি টাকা স্টিমুলাস প্যাকেজ হিসাবে দিয়ে আসছে। দশ বছরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ লক্ষ কোটি টাকা! এতো বিপুল অর্থসাহায্য নিয়েও বেসরকারি সংস্থাগুলো ঘরেু দাঁড়াতে পারলো না। এখন তারা কেন্দ্রর কাছ থেকে আরও ছাড়, অর্থ সাহায্য, অতি ধনীদের উপর এবারের বাজেটে যে নাম-কা-ওয়াস্তা বাড়তি কর বসেছে, তা তুলে দেওয়ার জন্য চাপ বাড়াচ্ছে। এদিকে, লোকসানে চলার যুক্তি খাঁড়া করে, একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে তুলে দেওয়া হচ্ছে সেই সমস্ত বেসরকারি সংস্থার হাতে, যারা কেন্দ্রের আর্থিক সাহায্য ছাড়া এক পাও এগোতে পারে না। আবার, সাহায্য নিয়ে ও মজবুত হতে ব্যর্থ হয়েছে।

আর্থিক সংকট আজ বিশ্ব অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে। আইবিএম গোটা বিশ্বে তাদের সংস্থার বিপুল সংখ্যক কর্মীকে কর্মচ্যুত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। ইউরোপের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক জার্মানির ড্যয়েস একইভাবে নামিয়েছে ছাঁটাইয়ের কোপ। এই সোমবার অর্থাৎ, ৫ই আগস্ট, বিশ্বের ৫০০ জন ধনীতম ব্যক্তিদের সম্মিলিত সম্পদের হার ২.১ শতাংশ কমেছে, যা এ বছরে সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি কমেছে বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি আমাজনের কর্ণধার জেফ বেজশ-এর সম্পদ। অনলাইনে তার শেয়ারের পতন হয় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার।

তীব্র আর্থিক সংকটে নাভিশ্বাস ওঠা ভারতীয় অর্থনীতি, ইতিমধ্যেই ৪৫ বছরে, ৬.১ শতাংশ হারে বেড়ে ওঠা অকল্পনীয় বেকারত্বের দীর্ঘ লাইনে যুক্ত হওয়া বর্তমানের ছাঁটাই, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উপর নামিয়ে আনা নজিরবিহীন হামলার বিরুদ্ধে জমাটবদ্ধ ক্ষোভ-বিক্ষোভকে বেপথু করতে তাই এবার মোদী-অমিত শাহ জুটি নামিয়ে আনলো মোক্ষম এক কাশ্মীর দাওয়াই। হিন্দুত্ববাদের মিশেলে আরও একবার উগ্র দেশপ্রেমের পালে দমকা হাওয়া লাগিয়ে পার হতে চাইছে সংকটের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পারাবার।

নতুন এই চ্যালেঞ্জকে নতুন পথেই মোকাবিলা করতে হবে ভারতের মানুষকে, শ্রেণীঐক্য বজায় রেখে।

খণ্ড-26