ভিড় জমিয়ে পেটানো বন্ধ করো তবরেজ আনসারীর ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করো
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ২ জুলাই ২০১৯)

মোদি সরকার আবার ক্ষমতায় এসেছে ভিড় জমিয়ে পেটানোর ঘটনাও শুরু হয়ে গেছে। আগের মতোই পিটিয়ে মারার ঘটনাকে ভিডিও করে করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে আরো বেশি বেশি মানুষকে এই কাজে উৎসাহিত করা যায় এবং যাদের ওপর আক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে তারাও তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে। অজুহাতের বহর ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে — গরু সম্পর্কিত অজুহাত ও ভিন্ন ধর্মের নর-নারীর মধ্যে ভালোবাসা ও বিবাহ ছাড়াও চুরির অভিযোগ বা এমনকি এ সম্পর্কে সন্দেহ ও গুজবও যথেষ্ট কারণ হতে পারে। এটাই আমরা ঝাড়খন্ডে সাম্প্রতিকতম পিটিয়ে মারার ঘটনায় দেখতে পেলাম। খুবই লক্ষ্যনীয় যে যারা পেটাচ্ছে তাদের একটা শ্লোগানও আছে। জয় শ্রী রাম হল সেই সাধারণ সিংহনাদ যা রাস্তায় পিটিয়ে মারা থেকে সংসদের মধ‍্যেও এক সুরে উঠতে শোনা যায়।

সংঘ বাহিনী মনে করে যে ভাঙচুর ও দাঙ্গা থেকে শুরু করে সমস্ত ঘৃণাবর্ষী অপরাধ রামের নামে বৈধতা পেয়ে যাবে। এবং বিজেপি ক্ষমতায় থাকায় এই বাহিনী বিশ্বাস করে যে জয় শ্রী রাম শ্লোগান হল তাদের নিশ্চিত রক্ষাকবচ। উত্তর ভারতের সাধারণ নাগরিকেরা যারা বহু পুরুষ ধরে সামাজিক শুভেচ্ছা জানাতে রামের নাম ব্যবহার করে আসছেন তাঁরা প্রচন্ড আঘাত পান যখন দেখেন যে অসহায় মানুষকে পেটানোর জন্য এই একই রামের নাম ব্যবহার হচ্ছে। খুঁটিতে বেঁধে এক অসহায় যুবককে জয় শ্রীরাম জয় হনুমান শ্লোগান তুলতে বাধ্য করতে এক নাগাড়ে পিটিয়ে যাবার ভিডিও সমস্ত ভারতীয় জনগণের কাছে এক ভয়ংকর সতর্কবার্তা যাঁরা আইনের শাসন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সৌহার্দ্যপূর্ণ বসবাসে বিশ্বাসী।

তথাপি মোদী সরকার ও সংঘবাহিনী নির্লজ্জের মতো ঝাড়খন্ডে সাম্প্রতিকতম পিটিয়ে মারার ঘটনাকে নগণ্য হিসেবে দেখাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। মোদী এমনকি এই মাত্রায় গিয়ে তাবরেজকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় যারা বিরোধীতা করছেন তাদের বিরুদ্ধে ঝাড়খন্ডকে অপমানিত করার, রাজ্যের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার জন্য অভিযোগ করেন। পাঠকেরা স্মরণ করতে পারেন যে মোদী এই একই কৌশল গুজরাটের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেছিলেন। যখন সমগ্র বিশ্ব গুজরাটে গোধরা পরবর্তী গণহত্যার নিন্দা করেছিল এবং আক্রান্তদের প্রতি ন্যায়বিচারের, অপরাধীদের শাস্তি ও মুখ্যমন্ত্রী মোদী রাজ্য সরকারের জবাবদিহির দাবি জানিয়েছিল মোদী একে গুজরাট বিরোধী চক্রান্ত হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন এবং সমালোচকদের কালিমালিপ্ত করতে ও তাদের থামিয়ে দিতে গুজরাট গৌরবের কথা তুলে ধরেন। ঘটনা হল ঝাড়খন্ডে রঘুবর দাস সরকারের সময়কালে এক ডজনের বেশি পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। এই উম্মত্ততার শিকার হলেন মুসলিম আদিবাসী, দলিত, অদলিত-হিন্দু সকলেই। দু’বছর আগে এই রাজ্যে এক বিহ্বলদায়ক ঘটনা ঘটতে দেখা যায় যখন একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পিটিয়ে মারার অভিযুক্তরা জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এলে তাদের মালা পরিয়ে অভিনন্দন জানায়। প্রশ্নের মুখে পড়া মন্ত্রী গর্বের সঙ্গে এটাও বর্ণনা করেন যে, বেল নিশ্চিত করতে তিনি কি ভাবে আইনি লড়াই চালিয়েছেন। এই মন্ত্রীকে সেন্সর করতে মোদী সরকার কিছুই করেনি। প্রকৃৃতপক্ষে পিটিয়ে মারার ঘটনা হল মোদী জমানার শাসনের এক বৈশিষ্ট্য; এবং নতুনভাবে রক্ষাকবচের নিশ্চিতি পেয়ে এই ধারা অব্যাহতই আছে।

পিটিয়ে মারার ঘটনা অব্যাহত থাকাটা আমাদের এটাও দেখিয়ে দেয় যে মোদী সরকার সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশের প্রতি কি নগণ্য মাত্রায় মান্যতা দিয়ে থাকে। মাত্র এক বছর আগে সুপ্রীম কোর্টভিড় জমিয়ে পেটানোর মতো ভয়াবহ ঘটনা বন্ধের লক্ষ্যে নিবারক, প্রতিকারমূলক ও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে এক সুসঙ্গত নির্দেশনা জারি করে। সুপ্রিম কোর্ট পিটিয়ে মারার ঘটনাকে মোকাবিলা করতে প্রতিটি জেলায় একজন নোডাল অফিসার নিয়োগের কথা বলে। ছয় মাসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য সুপ্রীম কোর্টও প্রস্তুতি নেয় এবং ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠা এই ভয়ঙ্কর ঘটনার মোকাবিলার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে এক বিশেষ আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেয়। ১৭ জুলাইএর নির্দেশের পর ২৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট আরও সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশিকা জারি করে যাতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশকে এক মাসের মধ্যে পালন করা হয়।

ভারতের পুনর্নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর সংসদকে এবং ভারতীয় জনগণকে জানানো দরকার যে, সরকার এ পর্যন্ত সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তিনি এ প্রশ্নে সন্দেহজনক ভাবে নীরব। প্রকৃত পক্ষে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায় জানান যে ভিড় জমিয়ে পিটিয়ে মারা সম্পর্কে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো কোন নির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ করেনি। কেন্দ্রীয় সরকার যা করেছে তা হল পিটিয়ে মারার ঘটনায় রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশিকা পাঠায় যে ভুয়ো খবর প্রচারের ওপর নজর রাখতে, যা উচ্ছৃঙ্খল মানুষদের হিংসাত্মক করে তুলতে পারে। দেখা যাচ্ছে যে ভিড় জমিয়ে পিটিয়ে মারার ইস্যু এলে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলে। এর পরে প্রধানমন্ত্রী ঝাড়খন্ডকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বলেন যে বিরোধীরা ভিড় জমিয়ে পিটিয়ে মারার ঘটনায় ঝাড়খন্ড রাজ্যকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। মোদী ক্ষমতায় আসায় ভিড় জমিয়ে পিটিয়ে মারা বন্ধ করার ও আক্রান্তদের সুবিচার নিশ্চিত করার লড়াই আরও কঠিন হয়ে পড়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষের জনগণ এ লড়াই থামাবেন না। আমরা অবশ্যই জয়ী হব।

খণ্ড-26
সংখ্যা-20