ভারতবর্ষ খরা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর, কিন্তু সরকার আক্রান্ত এলাকাগুলিকে খরা কবলিত স্বীকার করতে নারাজ

২০১৯ সালের গ্রীষ্মকাল বিদায় নেবার মুখে এইরকম একটা সময়ে ভারতবর্ষের কৃষি উৎপাদন, যা সারা বছরের খাদ্য সরবরাহ করবে তার অবস্থা গভীর সংকটে। এই মুহূর্তে ৪৪ শতাংশ ভারতবর্ষ খরা কবলিত, ২০১২ সালের পর যা ৬৫ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অন্ধ্র, বিহার, গুজরাট, ঝাড়খন্ড, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তর পূর্বের বেশ কিছুটা অংশ, তামিলনাড়ু, কেরল এবং তেলেঙ্গানা-র খরা পরিস্থিতি ভয়ানক। রাজ্যগুলিতে ৫০ কোটি লোক বাস করে, মোট জনসংখ্যার ৪০% মানুষ। (রিয়েল-টাইম ড্রট মনিটারিং প্ল্যাটফর্ম) বা তাৎক্ষণিক প্রকৃত খরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে এই ৪৪ শতাংশ এর মধ্যে ১৭.৩৩ শতাংশ অস্বাভাবিক শুষ্ক থেকে অতি শুষ্ক অবস্থায় পৌঁছেছে। ব্যাপকভাবে বর্ষা আসতে এখনো দেরি, এই পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। যেখানে বর্ষার আগের তিন মাসে গড় বৃষ্টিপাত হয় ১৩১.৫ মিমি সেখানে এ বছর ৩১ মে পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৯৯ মিমি। জুন মাসের প্রথম ৯ দিনে বৃষ্টি ঘাটতির পরিমাণ ৪৫ শতাংশ বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। শেষপর্যন্ত বৃষ্টির এই অপ্রতুলতা ৪০ শতাংশ গিয়ে দাঁড়াতে পারে। গতবছর ২০১৮ সালে এই অপ্রতুলতা ৪৪ শতাংশ এ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা এই খরা পরিস্থিতিকে বহন করছে। বর্ষা আসতে ৭ থেকে ১২ দিন দেরি করার ফলে মধ্য ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলির অবস্থা আরো খারাপ হতে চলেছে। জলাধারের জলের পরিমাণও ব্যাপকভাবে কমেছে। ২০ জুন ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী ৯১টি জলাধারের মধ্যে ২৩টিতে ৫০ শতাংশ কম জল জমা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে কমে গেছে, দেশের অন্তত ১০০টি জেলা ১৫ বছর ধরে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর দুর্বলতায় বারবার খরা পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। যার প্রভাব সারা ভারতবর্ষের মানুষের জীবনে ব্যাপক ভাবে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় পশুপালকদের পশুগুলি মরতে শুরু করেছে। বৃদ্ধ বৃদ্ধারা অনেকেই প্রাণে বাঁচতে এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছেন। শয়ে শয়ে গ্রাম থেকে মানুষ জলের সন্ধানে পৈতৃক ভিটে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে তাপমাত্রার পারদ একটানা অস্বাভাবিক উচ্চতায় উঠছে। রাজস্থানের চুরুতে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের বিরাট সংখ্যক গ্রাম এইমুহূর্তে পরিতক্ত্য। নোংরা জল খেয়ে পেটের রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে, গত এক-দেড় মাসেই স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলিতে ডি-হাইড্রেশন, ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রাইটিসের রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নলকূপ ও হ্যান্ডপাম্পগুলি ৪৫ সেলসিয়াস তাপপ্রবাহে সম্পূর্ণ শুষ্ক হয়ে গেছে

 জলের ব্যবস্থা না করেই স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প কার্যকরী করার চেষ্টা আগেই ব্যর্থ, এখন সাধারণভাবে শৌচকর্মের জলও নেই। আধিকারিকেরা বলছেন মহারাষ্ট্রে ৭২ সালে যে খরা হয়েছিল যাতে ২৫ কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এবারের পরিস্থিতি তার থেকেও খারাপ। কর্ণাটকের ৮০ শতাংশ এবং মহারাষ্ট্রের ৭২ শতাংশ জেলায় কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। শুধু এই দুটো রাজ্য মিলিয়ে ৮০ লক্ষ কৃষক বাঁচার লড়াই করছেন। মহারাষ্ট্রের পল্লীগ্রামগুলিতে প্রতিদিন ৬০০০টি জলের ট্যাঙ্কার পাঠাতে হচ্ছে, না হলে জলাভাবে মৃত্যু শুরু হয়ে যেতে পারে। দুটি রাজ্যের মধ্যে জল ভাগাভাগি নিয়ে গন্ডগোলও শুরু হয়ে গেছে। মহারাষ্ট্রর ৩৫টি মুখ্য বাঁধে একফোঁটা জল নেই, ১০০০ ছোট বাঁধে জল স্বাভাবিকের থেকে ৮ শতাংশেরও নীচে। মহারাষ্ট্রের “মহা পড়াও” যাত্রা মূলত এই এলাকার কৃষকদের যাত্রা, তারা অনেক আগেই এই বিপর্যয়ের আভাস দিয়েছিলেন।

১৫ বছরে ৯টি খরা পরিস্থিতির মধ্যে ৪টি খরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। কৃষক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বারবার খরা মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেয়ার দাবী করা হয়েছে। গত দুই বছর ধরে দেশের বড় বড় কৃষক বিক্ষোভগুলি এবং বামপন্থী সংগঠনগুলির সমাবেশ এই দাবিতে সোচ্চার ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারগুলি খরা মোকাবিলায় কোনো পরিকল্পনাই নেয়নি বরং তারা কর্পোরেটদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সবুজ বনাঞ্চল ধ্বংসের পরিকল্পনা করছিলো । গত মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে উপরোক্ত রাজ্যগুলির প্রায় প্রতিটিতেই জলস্তর বিপজ্জনকভাবে নীচে নেমে যাবার পরেই পরিস্থিতি সামাল দিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে, আর এই জুন মাসের ১০ তারিখে এই ভয়াবহ খরার মাঝেই দেশের জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত দাবি করছেন – দেশে কোনো জল সংকট নেই। সবটাই ‘মিডিয়া হাইপ’। বুঝুন কেন্দ্রীয় সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কতটা ঐকান্তিক!

এই বছরে যে রাজ্যগুলো বেশিরভাগ খাদ্যশস্য উৎপাদন করে তার দুই তৃতীয়াংশ ভয়ঙ্কর খরার কবলে, খাদ্যাভাব নিশ্চিত। সরকার জানতোই যে দেশ অনাবৃষ্টির সমস্যার মুখোমুখি হতে চলেছে, চলতি খরা পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। জলের অভাবে কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকা দুর্দশার মধ্যে পড়বে। তাই এই পরিস্থিতি শুরু হওয়ার মুখেই খরাপ্রবণ এলাকাগুলিতে জলের ট্যাঙ্কার পাঠানোর কাজ শুরু করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা করাই হয়নি, তাই রবি ও খরিফ দুটো শস্যের উৎপাদনই ব্যাপক বিপর্যয়ে পড়েছে। এখন তা পাঠানো হচ্ছে । চার-পাঁচ মাসের জলাভাবে ভোগার পর মে-র প্রথম সপ্তাহে মহারাষ্ট্র সরকার অবশ্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ট্যাঙ্কার সরবরাহ গত বছরের থেকে বাড়িয়ে এমজিএনআরইজি এ-র কাজকে আরো একটু বাড়ানো। কিন্তু ইতিমধ্যে সময় পেরিয়ে গেছে। ভোটের ব্যস্ততার মাঝে কখন দেশ খরা সমাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে কেউ খেয়াল করেনি। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি অনেকেই জানিয়েছিলেন যে পয়সা দিয়েও তারা জলের ট্যাঙ্কার পাচ্ছেন না। এই অনাবৃষ্টি তো বাৎসরিক চক্র, কিন্তু এই বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারি তথা প্রশাসনিক উদাসীনতা তো মনুষ্যসৃষ্ট ! এর ফল কিন্তু সমগ্র দেশকে বইতে হবে। অবশ্য প্রাকৃতিক ভাবে কৃষককুল ও পশুপালকেরা ধ্বংস হলে তো তাদের ধ্বংস করার দায় থাকে না, স্বাভাবিক নিয়মেই কৃষি বাজার সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় !

এই পরিস্থিতি মাটির উর্বরতা হ্রাস প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা, মৃত্তিকা স্বাস্থ্য কার্ড, মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখা, প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চায় যোজনা, প্রতিটি জলের ফোঁটায় আরও বেশি ফসলের মতো নেয়া প্রকল্পগুলির অন্তঃসার শূন্যতাকে প্রমাণ করে দিয়েছে।

সরকার ক্যাশলেস ইকোনমি নিয়ে মাথা ঘামায়, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা অস্ত্রসম্ভার কিনতে বিনিয়োগ করে, কর্পোরেটদের ঋণ মাফ করে দেয়। অথচ এখনো দেশের ৬৮% কৃষিবপন বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল, সরকার এই অবস্থা পরিবর্তনের কথা ভাবে না, জলসেচ এলাকা বাড়ানোর কথাও ভাবে না। এভাবেই বুঝি ২০২১ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে ? সবচেয়ে হাস্যকর ১৭ জুন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী শ্রী প্রকাশ জাভড়েকর দিল্লিতে “মরু অঞ্চলের বিস্তার রোধ ও খরা পরিস্হিতি মোকাবিলা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন” এর ঘোষণা করছেন, আর সেখানে বলছেন “মরু অঞ্চলের সম্প্রসারণ রুখতে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।”

জনবিরোধী কেন্দ্রীয় সরকার দেশে খরা পরিস্হিতি ঘোষণা করতে নারাজ। এই পরিস্থিতিতেও যদি তা ঘোযণা না হয় তবে কি মারাঠাওয়াড়া থেকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে কেরল মরুভূমি হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ?

সূত্র সৌজন্যে : দি গার্ডিয়ান, ইকোনমিক টাইমস, ব্লুমবার্গ কুইন্ট, স্ক্রল.কম, বিজনেস ওয়ার্ল্ড, ডাউন টু আর্থ, লাইভ মিন্ট, মানি কন্ট্রোল।

খণ্ড-26
সংখ্যা-18