দলিত, প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর হওয়ার ‘অপরাধে’—

১ জানুয়ারি ২০১৮। মহারাষ্ট্রের পুণেতে ভীমা কোরেগাঁও দলিত যুদ্ধজয়ের এটি ছিল দ্বিশতবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে লক্ষাধিক দলিত মানুষ উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন। এই দিনটিকে তারা যুগপরম্পরায় উচ্চবর্ণের শোষণ অত্যাচার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করেন। শান্তিপূর্ণ ভাবেই উৎসবসপালন চলছিল। হঠাৎ একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্ররোচনায় সংঘর্ষ বেধে যায়। সেটা দ্রুত এমন আকার নেয় যে একজনের মৃত্যু হয়। এরপর ব্যাপক তাণ্ডব চলে। ক্ষুব্ধ দলিতরা পুণে, মুম্বাই সহ মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষোভ দেখান। পরের দিন বন্ধ পালিত হয় ।

আর এই দলিত বিক্ষোভের সূত্রেই প্রায় ছ’মাস পরে নাগপুর বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোমা সেন, দিল্লির মানবাধিকার কর্মী রোনা উইলসনসহ পাঁচজনকে ২০১৮-র জুন মাসে গ্রেফতার করা হয় ।

এরপর ২০১৮-র ২৯ আগস্ট পুণে পুলিশ একই সঙ্গে মুম্বাই, দিল্লি, ফরিদাবাদ, রাঁচী ও গোয়ায় তল্লাশি চালিয়ে বিশিষ্ট অধ্যাপক ও কবি ভারভারা রাও, ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ ফেরেইরা, ভার্নন গনসালভেস ও গৌতম নওলখাকে গ্রেফতার করে। এরা সকলেই গরিব আদিবাসী দলিত ও প্রান্তিক মানুষদের অধিকারের জন্য লড়ছেন, স্ব স্ব পেশায় প্রতিষ্ঠিত বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী। এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সরব হন রোমিলা থাপার, রামচন্দ্র গুহ, অরুন্ধতী রায় সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। সারা দেশ জুড়েই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

বর্তমানে এরা পুণে সেন্ট্রাল জেলে বিনা বিচারে আটক রয়েছেন। এ বছরের জুন মাসে এই নয় জন মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালকে তাদের ক্ষোভ জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটি নিচে দেওয়া হল —

মাননীয় রাজ্যপাল
মহারাষ্ট্র, মুম্বাই

আমরা গত এক বছর ধরে বিচার বিভাগের হেফাজতে পুণের ইরাওয়াদা সেন্ট্রাল জেলে আটক রয়েছি। আমাদের মধ্যে পাঁচ জনকে গত ৬ জুন ২০১৮-তে শনিওয়ারওয়াদায় এলগার পরিষদ সংক্রান্ত তথাকথিত অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। আর অন্য চারজনকে ২৮ আগস্ট ২০১৮- তে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের নামে বিভিন্ন অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র যেমন ১ জানুয়ারি ২০১৮- তে ভীমা কোরেগাঁও-তে হিংসায় ইন্ধন যোগানো, দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উস্কে দেওয়া, রাষ্ট্রদ্রোহ, দেশদ্রোহিতা ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। এগুলো একেবারে মিথ্যা অভিযোগ।

দেশ বলতে যদি জনসাধারণকে বোঝায় তাহলে দেশের মানুষ যদি একটা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং অন্যদেরও সেই ভাবনায় অনুপ্রাণিত করে, সেটা কী করে দেশ বিরোধী কাজ হতে পারে!

এলগার পরিষদের সম্মেলনে পরিবেশিত বক্তব্য, প্রেরণা জাগানো গান, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রোতাদের সরকারের বিরুদ্ধে হিংসায় প্ররোচিত করা হয়েছিল — এটা একেবারেই সত্য নয়। বরং ‘সংবিধান, গণতন্ত্র এবং দেশকে বাঁচানোর’ জন্য শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে সংগ্রাম করা ও বিজেপি সরকার, যে সংবিধান বিরোধী কাজ করে চলেছে, তাকে ভোট না দেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল। এই কাজের জন্যই আমাদের সাজানো অপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এক ভয়ঙ্কর মিথ্যার ভিত্তিতে আমাদের প্রতি এক ভয়ঙ্কর অবিচার হচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্টের ‘জেল নয় জামিন’ রুলে স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও এই মামলায় আমাদের জামিনের আবেদনকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারি আইনজীবী এবং তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকরা যেমন আমাদের মামলাটিকে একটি মিডিয়া ট্রায়ালের মতো পরিচালনা করছেন, ঠিক তেমনই আমাদের জামিনের শুনানিকেও মিনি মিডিয়া ট্রায়ালে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

মামলায়, মাওবাদীদের সঙ্গে তথাকথিত বিনিময় হওয়া ই-মেল তথ্যগুলি সংবাদমাধ্যমে অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক বছরের ওপর হয়ে গেছে, সংশ্লিষ্ট ঐ বৈদ্যুতিন তথ্যগুলি আজও অভিযুক্তদের হাতে দেওয়া হয়নি। এতে মামলার অভিপ্রায় সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক বন্দিরা এখন এইভাবে বছরের পর বছর জেলে পচছেন — এতে ‘সকলের জন্য ন্যায়’ এবং ‘সময়ে বিচার’ — এই মৌলিক নীতিগুলি সরাসরি লঙ্ঘিত হচ্ছে। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ — নতুন সরকারের শ্লোগান হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুধু পূর্ববর্তী সরকারের কাজকর্মগুলো দেখেই, খুব সঙ্গত কারণে কারও মনে সন্দেহ জাগতে পারে,বাস্তবে এটা কতটা কার্যকরী হবে। সরকার যদি জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে চায়, তাহলে তাকে প্রথমে সংবিধানের প্রতি তার দায়বদ্ধতা প্রমাণ করতে হবে যেটি তার কাজের ভিত্তি। এবং তার জন্য তাকে সকলের জন্য সমান বিচারকে সুনিশ্চিত করতে হবে। সমস্ত মতপার্থক্য, সরকার বিরোধী অবস্থান, সমালোচনামূলক ভাবনাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং বিরোধীদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা — মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর এক নগ্ন আক্রমণ।

নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের সর্বত্র আবার গোরক্ষার নামে গণপ্রহার শুরু হয়েছে। সরকার শুধুমাত্র যে এই ধরনের হিংসার প্রতি উদাসীন তাই-ই নয়, ঘৃণা ও বিদ্বেষকে উস্কে দেওয়া ধর্মীয় উন্মাদনা বা প্রকাশ্যে নাথুরাম গডসের স্মরণ অনুষ্ঠানের মতো কাজকে প্রতিহত করার কোন চেষ্টাও করছে না। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ — একটা পরিষ্কার ধাপ্পাবাজি।

যদি গণতন্ত্রের অর্থ হয় সংবিধান মেনে চলা,তাহলে কেন দেশের প্রত্যেকে সমান বিচার পাবে না? কেন কিছু লোক জেলে পচবে আর কিছু লোক জেলের বাইরে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরবে? সত্যিই যদি ভারতে সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়,তবে তার পূর্বশর্তহিসেবে আমরা চাই সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি।

আপনার রাজনৈতিক বন্দিরা

১) সুধীর ধাওয়ালে, ২) সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, ৩) মহেশ রাউত, ৪) রোনা উইলসন, ৫) অরুণ ফেরেইরা, ৬) ভার্নন গনজালভেস, ৭) ভারভারা রাও, ৮) সুধা ভরদ্বাজ, ৯) সোমা সেন।

এই চিঠির কোনো প্রত্যুত্তর রাজ্যপালের দপ্তর থেকে না আসায়, ভারভারা রাওয়ের স্ত্রী হেমলতা গত ১৯জুলাই রাজ্যপালকে আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছেন। এই চিঠিতে ৮৯ বছর বয়স্ক ভগ্নস্বাস্থ্য ভারভারা রাও ও তার সহবন্দীদের জামিন প্রক্রিয়ার অহেতুক দীর্ঘবিলম্ব ও জেলে অমানবিক পরিবেশের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি রাজ্যপালের কাছে নিম্নলিখিত বিষয়ে আবেদন জানিয়েছেন —

জেলে সুযোগ সুবিধা বাড়ানো, তেলুগু ভাষার বইপত্র ও সংবাদপত্র পড়ার সুযোগ, লেখা ও পড়ার সুযোগ, নিকট আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ ও বিচার অথবা জামিন প্রক্রিয়া দ্রুততর করা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন বর্তমানে যে দুরবস্থার মধ্যে এই বর্ষীয়ান মানুষটি রয়েছেন তা বিচারের আগেই শাস্তিভোগের সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ত্রিশ জন শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, শিক্ষক প্রমুখ বিশিষ্ট জন হেমলতাকে সমর্থন জানিয়ে চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।

খণ্ড-26
সংখ্যা-22