সহমরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথিকৃৎ রামমোহন

‘ভাব সেই একে/জলে স্থলে শূন্যে যে সমানভাবে থাকে’। প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘যৎকিঞ্চিৎ’-এর প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে রাজা রামমোহন রায়ের একটি ব্রহ্ম সঙ্গীতের প্রথম দুই কলি দিয়ে। একেশ্বরবাদের পক্ষে আজীবন সওয়াল করেছিলেন আর এর প্রেরণা পেয়েছিলেন ইসলাম থেকে। একেশ্বরবাদী ধারণা সম্বলিত উপনিষদের নির্বাচিত অংশসমূহের ওপর ভিত্তি করেই তিনি ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস পুনর্নিমাণের প্রয়াস নিয়েছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের সংশোধিত মতবাদটি ১৮৫০ সালে ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ অথবা ‘একসত্য ঈশ্বরের পূজারীদের ধর্ম’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। রামমোহন আজীবন সত্যান্বেষী ও যৌক্তিকতাপন্থী।

‘রাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন দিল্লির মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের কাছ থেকে, ও রায় পদবী দিয়েছিলেন বাংলার নবাব। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসকদের আনুকূল্যে নয়। পরন্তু, ইংল্যান্ডের চতুর্থ জজের কাছে চিঠি তিনি দিল্লির বাদশাহর ভাতা বাড়াতে সক্ষম হ’ন। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে মাত্র ১৩ বছর কর্মরত। ইচ্ছে করলেই বেশীদিন থাকতে পারতেন ও উচ্চপদে উন্নীত হতে পারতেন। কেন না সেই সময় তাঁর মত বহুবিদ্যাবিশারদ ও বহভাষাবিদ অত্যন্ত বিরল ছিল। ইংরেজী, ফরাসী, গ্রিক, হিব্রু, জার্মাণ, ওলন্দাজ, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষায় তাঁর শুধু বুৎপত্তিই ছিল না, এ সব ভাষাতেই তিনি সুলেখক ছিলেন। প্রথমেই একথা লিখলাম এজন্যে যে বলিউডের পার্শ্বচরিত্রাভিনেত্রী পায়েল রোহাতগি কিছুদিন আগে রামমোহন রায়কে ব্রিটিশের ‘চামচা’ আখ্যা দিয়েছেন। সতীদাহ প্রথা নাকি ভালোই ছিল। ‘মুঘল’ খিলজিদের হাত থেকে বাঁচতেই নাকি স্বামীহারারা পদ্মাবতীর মতো জহরব্রত নিতেন, নচেৎ তাঁদের অনেকে নাকি ‘বেশ্যা’ হয়ে যেতেন। প্রথমেই বলি এই গর্দভেতর অভিনেত্রী জানেন না যে পদ্মাবতী ও আলাউদ্দিন খিলজি এক সময়ের মানুষ/মানুষী ছিলেন না, এটা আজ প্রমাণিত। আলাউদ্দিন খিলজির যৌন লালসা থেকে বাঁচতে পদ্মাবতী জহরব্রত গ্রহণ করেছিলেন এটা সর্বতোভাবে মিথ্যা, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের খয়ের-খাঁ ইতিহাস-লিখিয়েদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইতিহাস বিকৃতি।

একথা সুবিদিত, রামমোহনের নেতৃত্বে সতীদাহ প্রথা রদ ভারতবর্ষের প্রথম সমাজসংস্কার আন্দোলন, যার বিরুদ্ধে ছিলেন সহমরণপন্থী গোঁড়া হিন্দু জমিদারদের একাংশ, বিশেষত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের দয়ায় ফুলে- ফেঁপে ওঠা জমিদারেরা। যেমন রাজা রাধাকান্ত দেব, যাঁর পূর্বপুরুষ নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭ সালের ১ মে রবার্ট ক্লাইভের পক্ষে ও বাংলা-বিহারউড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের অন্যতম প্রধান চক্রী ও সেই ষড়যন্ত্রের লিখিত বয়ানের খসড়াপ্রণেতা। এজন্য পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধবিজয়ের পরে ক্লাইভ ইনাম স্বরূপ বিপুল পরিমাণ জমি উপহার ও রাজা উপাধি দেন। রাধাকান্ত দেব (যার একটি প্রশংসনীয় দিক স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন), কাশীনাথ তর্কবাগীশ, রামকমল সেন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি সতীদাহ প্রথা রদের বিরুদ্ধে শোরগোল তোলেন। বিশিষ্ট রামমোহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস লিখেছেন সেই সময় অনেক বনেদী পরিবারে সহমরণ প্রথার প্রচলন ছিল না, তাঁদের অন্যতম রামকমল সেন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার (দিলীপ কুমার বিশ্বাস : রাম মোহন সমীক্ষা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, জানুয়ারি ১৯৯৪, পৃ ৪৭১)। রামমোহন ও তাঁর অনুগামীরা সতীদাহ-বিরোধীজনমত গড়ে তোলার আগে এক হাজার বছরেরও বেশি সতীদাহ-প্রথাচালু ছিল, কিন্তু অনেক পরিবারে এইপ্রথা মানা হত না, এটাও ঠিক। সে হিসেবে তা ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু কদাচিৎ কোনো নারী স্বেচ্ছায় সহমরণে যেতেন। ব্রিটিশ রাজত্ব শুরু হওয়ার পর থেকে এই মুত্যুর হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। একটি তত্থ্যানুসারে ১৮১৫ থেকে ১৮১৮ চার বছরে প্রায় আড়াই হাজার মেয়েকে স্বামীর সাথে পোড়ানো হয়েছিল। এমনই ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের তান্ডব।

পিতার মৃত্যুর আট বছর পর ১৮১১ সালে রামমোহনের বড় ভাই জগন্মোহনের জীবনাবসানের পরে তাঁর বৌদির সহমরণ তাঁকে সতীদাহ-বিরোধী করে তোলে। জগন্মোহন তখন এক তরতাজা যুবক। স্ত্রীও যুবতী। যুবতী স্ত্রী স্বামী ছাড়া থাকবে কিভাবে, এই অজুহাতে স্বামীর সাথে তাঁকেও পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করা হয়। রামমোহন তাঁর বৌদিকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কেউ রামমোহন বা জগন্মোহনের স্ত্রীর পাশে দাঁড়াননি। বৌদির জ্যান্ত দগ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেবর রামমোহনের মনে গভীর যাতনার জন্ম দেয়। তথন থেকেই সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার মানসিকতা গড়ে ওঠে। বৌদিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্যটি নন্দকিশোর বসু তাঁর পুত্রের কাছে বর্ণনা করেন। সেই পুত্রের না রাজনারায়ণ বসু। তিনি রামমোহনের প্রয়াণের পরে এক স্মরণসভায় পিতার বর্ণিত কথাগুলো তুলে ধরেন।

রামমোহনের চিত্তে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প রচিত হয় ১৮২৫-এর অক্টোবরে। কলকাতায় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তার স্ত্রীকেও সহমরণে যেতে বাধ্য করা হয়। সেই ঘটনা কলকাতার কিছু সচেতন মানুষ এবং ইংরেজদের ক্ষুব্ধ করে। এই সময় রামমোহনের অনুসারীরা এর জোরালো প্রতিবাদ করে। তখন বাংলার গভর্নর ছিলেন, লর্ডহামহাস্ট। তার স্ত্রী ছিলেন একজন মনস্বিনী এবং সংস্কৃতিমনা। তিনিও এর প্রতিবাদ করেন। জনরোষ এড়াতে এবং একই সাথে ধর্মবিশ্বাসে (আসলে অত্যন্ত অমানবিক কুসংস্কার) আঘাত না হেনে গভর্ণর সতীদাহ প্রথা পুরোপুরি রহিত না করে কৌশলে কিছু নিয়ম চালু করলেন। এক, কোনো সহগমনার্থীনি বিধবাকে স্বামীর দেহের সঙ্গে ছাড়া অন্য কোনোভাবে দগ্ধ করা যাবে না। দুই, সহগমনার্থীনি বিধবাকে সহমরণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এসে অনুমতি নিতে হবে। অন্যের দ্বারা দরখাস্ত দিয়ে অনুমতি নিলে চলবে না। তিন, কেউ সতীর সহমরণে সহায়তা করলে সরকারি চাকরি পাবে না। চার, সতী হওয়া রমণীর কোনো সম্পত্তি থাকলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করবে।

সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রকাশিত রামমোহনের প্রথম প্রবন্ধ “সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ” ( ১৮১৮)। সেই লেখায় তিনি সতীদাহের সমর্থক ও সতীদাহের বিরোধী উভয় মত তুলে ধরেন ও যুক্তি দিয়ে দেখালেন যে সতীদাহ শাস্ত্রসম্মত নয় এবং তাই ধর্মবিরুদ্ধ। একবছর পর প্রকাশ করলেনদ্বিতীয় প্রবন্ধ — “সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তকও নিবর্তকের দ্বিতীয় সংবাদ।” এইপ্রবন্ধ প্রকাশের সাথে সাথে হিন্দুসমাজ আলোড়িত হয়েছিল।

রামমোহন রায় ‘কৌমুদী’ গ্রন্থে তাঁর সতীদাহ বিরোধী অবস্থান দৃঢ়তরভাবে ব্যাখ্যা করলেন। সতীদাহ প্রথা খন্ডন করে লিখলেন, ‘শাস্ত্রানুসারে সহমরণ হিন্দুবিধবাদের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য নয়’। সেই লেখাটি ইংরেজমহলেও প্রচারিত হতে থাকলো। লর্ডবেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা বাতিলের আইন করেন। প্রগতিশীল হিন্দুগোষ্ঠী এই আইনকে অভিনন্দন জানালেও এর বিরুদ্ধে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ গণস্বাক্ষর করে তা ইংল্যান্ডে পাঠায় প্রিভি কাউন্সিলের কাছে। রামমোহন ইংল্যান্ডে গিয়ে হিন্দুদের উক্ত আবেদনের বিরুদ্ধে পাল্টা আবেদন করেন। প্রিভি কাউন্সিল রক্ষণশীল হিন্দুদের আবেদন খারিজ করে দেয়। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহনের লেখা বই বিলেতে প্রকাশিত হলে ইংল্যান্ডেও সতীদাহ প্রথা বাতিলের দাবি ওঠে।

রামমোহন-প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভায় শুধু সতীদাহ প্রথা রদ নয়, বাল্য বিবাহ,জাতপাত দূরীকরণ, যৌতুক প্রথার বিলোপ, প্রভৃতিও আলোচিত হ’ত। তিনি স্বাধীন ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার পক্ষে ছিলেন। সেজন্য ব্রাহ্ম সমাজ নামক একটি ধর্মীয় সংঘও গড়ে তোলেন, যেখানে স্বাধীন চিন্তাধারার বিষয়ে আলোচনা করা হ’ত। এমনকি তিনি যখন দিল্লির সম্রাটের পক্ষ থেকে ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ডে বক্তৃতা দিতে যান, তখন তার কথা এবং আলোচনার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশ যে জ্ঞান-বিজ্ঞান সমৃদ্ধ দেশ, তা অবহিত করেন। সে নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই এই ছোট লেখায়। সম্ভব হলে বারান্তরে লিখব।

খণ্ড-26