মমতার শাসনপ্রণালীর ভেতরেই নিহিত বিজেপির উত্থান

তৃণমূল কংগ্রেসের রাতের ঘুম কেড়ে বিজেপি এবার তার ঘাড়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। তৃণমূল পার্টির অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে লালিত পালিত হয়ে আসা অর্জুন সিং বিজেপিতে যুক্ত হওয়ার পর ভাটপাড়া – কাঁকিনাড়া অঞ্চলে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত একের পর এক রাজনৈতিক ক্ষমতার বৃত্তগুলোকে নিজের কব্জায় এনে তৃণমূল দলটাকেই ওই এলাকায় ভালোই সংকটে ফেলে দিয়েছে। বিজেপির ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক উস্কানির ফলে ওই এলাকায় ঘটেছে তীব্র মেরুকরণ। এলাকার শ্রমজীবী মানুষ, চটকল শ্রমিকদের মধ্যেও পড়েছে তার কুপ্রভাব। বিজেপিকে টেক্কা দিতে,তারই অ্যাজেন্ডায়, রামনবমী-হুনুমান পূজো প্রভৃতিকে রাজনৈতিক – প্রশাসনিকভাবে মদত দিয়ে মমতা দুধ-কলা খাইয়ে এতদিন যে অর্জুন সিং-এর মাধ্যমে কেউটে সাপকে সযত্নে পুষলেন, তারই ছোবলের আঘাতে বিরাট মাশুল আজ দিতে হচ্ছে তৃণমূলকে। অবস্থা এমনই যে, উত্তর ২৪ পরগনার দাপুটে তৃণমুলের হর্তা-কর্তা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে ও ওই এলাকা থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসতে হলো। গোটা এলাকা জুড়ে থমথমে পরিস্থিতি, পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ — এই শিল্পাঞ্চল যেন এখন অন্য অপরিচিত এলাকা।

অর্জুন সিং এর উত্থানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে লক্ষণ শেঠের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেই সময় হলদিয়ার বেতাজ বাদশা লক্ষণ শেঠের হরেক বেআইনী কান্ডকারখানা দেখেও সিপিএম নেতৃত্ব চোখ বন্ধ করে ছিল। এক্ষেত্রেও তাই। এতদিনে মুখ্যমন্ত্রীর নজরে এলো যে অর্জুন সিং বেআইনী ভাবে জুট মিল চালায়, যা এবার তিনি বরদাস্ত করবেন না। তিনি আরও কবুল করেছেন যে শিল্পের স্বার্থে (পড়ুন, অর্জুন সিং-এর স্বার্থে) তিনি ওখানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেননি। কোন‍‍ো শ্রমকানুনের তোয়াক্কা না করে অর্জুন সিং মেঘনা জুট মিলে যে স্বৈরাচার চালাতো তা শুধু স্থানীয় প্রশাসনই নয়, রাজ্য সরকারও এ ব্যাপারে তাকে পুরোপুরি মদত দিয়ে এসেছে। বামফ্রন্টের আমলেও ওখানকার প্রভাবশালী বাম সাংসদের সঙ্গে ছিল অর্জুন সিং-এর সন্দেহজনক বোঝাপড়া ও দহরম মহরম।

রাজ্যে বিজেপির এই উত্থান নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা মাধ্যমে বিস্তর বিশ্লেষণ চলছে। মমতা ও এই উত্থানকে মোকাবিলা করছেন আইন- শৃঙ্খলার বিষয় হিসাবে। নিজের শাসন ব্যবস্থার স্বৈরাচারী কার্যকলাপ, গণতন্ত্রকে নির্মমভাবে কন্ঠরুদ্ধ করার পেশীসর্বস্ব নীতির বিষাক্ত পাঁকে পদ্মফুলের পল্লবিত হওয়ার কারণ না খুঁজে বিজেপির উত্থানকে ‘বাইরের’ এক অ-বাঙালী পরিঘটনা হিসাবে দেখছেন যার সাথে এ রাজ্যের সংস্কৃতির নেই কোনো সংযোগ। বিগত নির্বাচনগুলোতে (পঞ্চায়েত বাদে) মমতার একচেটিয়া বিজয়লাভের পেছনে ‘সবুজশ্রী’-‘কন্যাশ্রী’র মতো হাজারো প্রকল্পগুলোর যাদুকরী প্রভাব সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত প্রচার করা হয়েছিল। এ রাজ্যে বিরোধী দলগুলোকে নির্মূল করার চরম স্বৈরাচারী প্রকল্প হাতে নিয়ে পঞ্চায়েতকে বিরোধীশূণ্য করা, লোকসভায় রাজ্যের ৪২টা আসনই দখলে আনতে যে অভিযান মমতা শুরু করেছিলেন, বাংলার সমকালীন ইতিহাস তা এবার কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নিচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বামেদের বিকল্প হয়ে উঠে না দাঁড়ানোর ব্যর্থতা, প্রধানতম বিপদ বিজেপির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত রাজনৈতিক সংগ্রামে শিথিলতা ইত্যাদি। এবারের নির্বাচন দেখিয়ে দিল মমতার ‘প্রবাদসম’ উন্নয়নের অভিঘাত তার জৌলুস হারাতে শুরু করেছে, জঙ্গলমহল-পাহাড়ের মুখে আর হাসি নেই, যে সিঙ্গুর থেকে মমতার বিজয়রথ শুরু হয়, দিনের শেষে সেই হুগলী আসনটিও এবার হাতছাড়া। সিপিএমও যেমন কোনেদিন তার সাম্রাজ্য পতনের নেপথ্য কারণগুলিকে আজ পর্যন্ত আত্মসমীক্ষা করল না, মমতাও একই পথে হেঁটে কটাক্ষের সুরে বলেই বসলেন যে “এতদিন মানুষের জন্য অনেক করেছি, এবার থেকে দলের জন্য সময় দেব’’। নিজের দম্ভ, ঔদ্ধত্য, স্বৈরাচারী আচরণ মমতাকে কঠোর সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে দিচ্ছে না, তাই বিজেপিকে বাইরের অবাঙালী পরিঘটনা হিসাবে ব্যাখ্যা করে প্রাদেশিক উগ্র বাঙালীয়নার জন্ম দিয়ে গোটা হিন্দী ভাষীদেরই ঠেলে দিচ্ছে বিজেপির খপ্পরে।

হিন্দু সংবাদপত্রে লোকনীতি — সিএসডিসি র এক সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, এ রাজ্যে বিজেপি পেয়েছে ৫৭% হিন্দু ভোট, উচ্চবর্ণের ৫৭%, পশ্চাদপদ স্তরের ৬৫%, তপশীলি জাতির ৬১%, আদিবাসীদের ৫৮% ভোট। বিপরীতে, এবার তৃণমূল মুসলিমদের ভেতর থেকে পেয়েছে ৭০% ভোট, ২০১৪ সালে যা ছিল ৪০%। অর্থাৎ, মুসলিম অধ্যুষিত আসনগুলিতে তৃণমূলের জয়ের পেছনে এটাই প্রধান কারণ। আবার, তীব্র মেরুকরণের ফলে, তৃণমুলের প্রাপ্ত হিন্দুভোট ২০১৪ র তুলনায় ৮% কমে এবার হয়েছে ৩২%। এবার, বিজেপির এ রাজ্যে ভোটের সামাজিক প্রোফাইল বামেদের কাছাকাছি। তাই, বিজেপির দিকে বাম ভোট স্থানান্তরিত হয়েছে স্বাভাবিকভাবে।

বলাই বাহুল্য, বিজেপি এ রাজ্যে এখন এক বহিরাগত শক্তি নয়, সে ক্রমে ক্রমে পায়ের তলায় খুঁজে পাচ্ছে শক্ত জমি।

এই বিজেপিকে মোকাবিলা করার জন্য মমতা দুটো পথ বাতলেছেন। একটি হল পুলিশপ্রশাসনগত ভাবে কঠোর হাতে মোকাবিলা, আর অন্যটি হল, দুটি বাহিনী গঠন — মহিলাদের নিয়ে ‘বঙ্গজননী বাহিনী’ এবং যুবদের নিয়ে ‘জয় হিন্দ বাহিনী’। ব্লকে ব্লকে এই বাহিনীগুলো সদা সজাগতা নিয়ে কাজ করবে। ‘বঙ্গজননী’র মেয়েরা পরবে গঙ্গা-যমুনা পাড় দেওয়া শাড়ি, এবং তাদের হাতে থাকবে শান্তিনিকেতনী ডান্ডা। জয় হিন্দ বাহিনীর যুবরা পরবে সাদা পায়জামার উপর হলুদ পাঞ্জাবি । মমতা তার ভাই কার্তিক ও গণেশকে এই যুব বাহিনীর দায়িত্ব দিয়েছেন। যিনি নিজে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি আবার এই ধরনের রাষ্ট্র বহির্ভূত নন্ স্টেট অ্যাক্টারদের জন্ম দিচ্ছেন কেন, এদের হাতে কি ধরনের ক্ষমতা থাকবে, কাজের এক্তিয়ার ও পরিধিই বা কতটুকু তা নিয়ে এখনও কোনো প্রশ্ন উঠল না।

তবে, ২০২১ এর আগেই তৃণমূলকে রাজ্যের মসনদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মরিয়া হয়ে যেভাবে তৃণমূল দলটাকে ভাঁঙ্গাতে বিজেপি চরম ধিক্কৃত নিন্দিত ব্যক্তিগুলোকে দলভুক্ত করছে তাতে নিজের দলের ভেতরেই দানা বেঁধে উঠছে বিক্ষোভ। ধীরে ধীরে আমজনতার সামনে উন্মোচিত হবে বিজেপির আসল স্বরূপ । যে পন্থায় মমতা প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে অন্য দল এমনকি বামেদের ও ভেঙ্গে নিজ দলের কলেবর বৃদ্ধি করেছিল, আজ বিজেপি সেই একই পথে ও দাওয়াইয়ে নিজের শক্তিবৃদ্ধি করছে। বর্তমানে রাজ্য সরকার নিজের বিপন্ন অস্তিত্ব নিয়ে জর্জরিত। অপরদিকে, বিজেপি মারাত্মকভাবে তার আগ্রাসন বাড়াচ্ছে। বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক রাজনৈতিক, মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন মুখর কর্মসূচি নিয়েই আজ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে রাস্তায় নামতে হবে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-15