বিরসার মরণ নাই ... উলগুলানের শেষ নাই

ওরা কেবল ভাঙতে শিখেছে, ভাঙতে শিখিয়েছে এবং ভাঙার জন্যই তৈরি হয়েছে। কারা ওরা? কারা আবার, ভারতকে আবারও ভেঙে ভাগ করতে চায় যে বুড়ো খোকারা – আরএসএস-বিজেপি এবং নানা রঙে ঢঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাদের বিচিত্র সব নামের আরো সব গুণ্ডা ও ধর্মের ষাঁড় বাহিনী। আম্বেদকর, পেরিয়ার, লেনিন, ভগৎ সিং, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগরের পরে ওদের আক্রমণের তালিকায় নতুন সংযোজন বীর বিপ্লবী ও উলগুলানের অবিসংবাদী নেতা বিরসা মুণ্ডা। সম্প্রতি গত ৯ জুন আমরা পার করে এলাম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল মাইল ফলক মুণ্ডা বিদ্রোহের নায়ক বিরসা মুণ্ডার শহীদ দিবস, আর তার মাত্র কয়েকদিনের মাথায় ঝাড়খণ্ডের রাঁচি শহরে মনুবাদী, দাঙ্গাবাজ, কর্পোরেট দালাল গেরুয়া দুর্বৃত্তদের হাতে ভাঙা পড়লো তাঁর মূর্তি। আর এই মূর্তি ভাঙা যে কেবল অবোধ শিশুর খেলনা ভেঙে ফেলার মতো কেবল একটা বস্তু ভেঙে ফেলা যে নয় তা যেকোনো সমাজ সচেতন, অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ মাত্রই বোঝেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা পর্যায় জুড়ে লড়াইয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্রিটিশ শাসকদের দালালি ও চরবৃত্তি করাকে যারা মজ্জাগত করেছিল সেই আরএসএস-এর মতো মৌলবাদী, ফ্যাসিবাদীরা যে উলগুলানের ইতিহাস, বিরসার দামাল লড়াই ও শাহাদাতের গৌরব ও ঐতিহ্যকে আসলে এই মূর্তি ভাঙার মধ্যে দিয়েই ধূলিসাৎ করতে চায় তাতে আর সন্দেহ কী? এমনিতেই বিনা বাধায় হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের যে বিষাক্ত লক্ষ্য ওদের রয়েছে তার পথ পরিষ্কার করতে দেশের কোণায় কোণায় প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো আদিবাসী, দলিত বা সংখ্যালঘু হত্যার ঘটনা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদিবাসীদের বাসস্থান, জঙ্গলের ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সাংবিধানিক অধিকার, মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক বিন্যাস, রুটি-রুজি, ধর্মবিশ্বাস সবকিছুই বৈদিক আর্যদের ভারতে প্রবেশ থেকে ব্রিটিশরাজ হয়ে আজকের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের উন্মাদনা ও উৎপাতের সময় অবধি তিলে তিলে বিপন্নতা ও ধ্বংসের পথে এগিয়েছে তাতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিতে সম্প্রতি মোদী সরকারের কেরামতিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গোটা ভারতবর্ষের প্রায় ২৩ লক্ষ আদিবাসী মানুষ ভিটেমাটি, জল-জঙ্গল-জমি থেকে উৎখাত হয়ে সম্পূর্ণনিরাশ্রয় ও সম্বলহীন হওয়ার অপেক্ষায় দিন গুণছেন। কিন্তু এত ঘটা করে আদিবাসীদের প্রতিনিয়ত প্রাণে ও ভাতে মারার আয়োজনের পথেই তো আজও জলজ্যান্ত বিভীষিকার মতো বাধা বিরসা, সিদহো, কানহোদের দুর্দমনীয় হুল, উলগুলানের স্পিরিট। সেই অনুপ্রেরণা আর আগুন বুকে নিয়েই এত আঘাতের মুখে রক্তাক্ত হতে হতেও আদিবাসীরা এখনও উড়িষ্যার নিয়ামগিরি থেকে ঝাড়খণ্ডের গ্রাম গ্রামান্তরে কিম্বা ছত্রিশগড়ের বায়লাডিলা বা গুজরাটের ভালসাদের মতো বহু জায়গায় মুনাফাখোর কর্পোরেট খনিমালিক ও তাদের হয়ে শাসকদের জঙ্গল, পাহাড় জবরদখলের বেয়াদবির চোখে চোখ রেখে ঝাঁঝসে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। তাই হনুমানের দৌরাত্ম্যের টার্গেট যে বিরসা হবেন তাতে আর আশ্চর্য কী। কিন্তু গোমাতার মল ভর্তি গেরুয়া খাজা মগজগুলোয় এটা না ঢোকাই স্বাভাবিক যে, বিরসার মরণ নেই, উলগুলানের শেষ নেই ... মূর্তি ভাঙার পরে পরেই রাঁচি শহর জুড়ে প্রতিবাদে নামে একজোটে সব বামপন্থী দলগুলি, রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন আদিবাসী সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সমানতালে সোচ্চার এমনকি আমাদের পশ্চিমবাংলায় যে জঙ্গলমহলে পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্যকে কেন্দ্র করে বাংলা দখলের ছক কষছে বিজেপি সেখানকার আদিবাসীরাও এই ঘটনায় যে পরিমাণ ফুঁসছেন, রাস্তায় নামছেন তাতে বিষাক্ত তীরের ফলার মুখে গেরুয়া উৎপাতের ফিউচার ডুম হয়ে যাওয়া আটকায় কার সাধ্যি।

ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তচিন্তার ছাত্রছাত্রীদেরকে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ তকমা দিয়ে দেশদ্রোহীতার মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসাতে চায় আর নিজেরা জিএসটি, নোটবন্দী করে অর্থনীতির কোমর ভাঙে, স্বাধীনতা সংগ্রামী, শহীদ, সংবিধান প্রণেতাদের মূর্তি ভাঙে, ধর্মে ধর্মে হানাহানি লাগিয়ে উস্কানি দিয়ে বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের ভারতবর্ষের অন্তরাত্মাকে ভাঙতে চায়, রাজপথে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে কৃষকদের প্রতিবাদ ভাঙার বর্বরতায় নামে, গণপিটুনি দিয়ে, আগুন লাগিয়ে ছলচাতুরী করে দলিত, সংখ্যালঘুর ঘর ও জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ও অধিকার চুরমার করে — ভারতবর্ষের এক ও একমাত্র টুকরে টুকরে গ্যাং আরএসএস, বিজেপি ছাড়া যে দ্বিতীয়টা আর কেউ নয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আসুন আগামী ৩০ জুন হুল মাহাতে আদিবাসী জনতার সাথে আমরা প্রত্যেকে এই টুকরে টুকরে গ্যাং-এর বিভাজন আর অত্যাচারের নকশা চুরমার করার শপথ নিই।

খণ্ড-26
সংখ্যা-18