কলকাতায় জাক্তারদের আন্দোলন : জড়তি ইস্যুগুলি এবং প্রাপ্ত শিক্ষা

এক সপ্তাহ ধরে আন্দ‍োলন চালিযে যাওয়ার পর আন্দ‍োলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা অবশেষে ১৭ জুন সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পেলেন। আন্দোলনকারী ডাক্তারদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের আল‍োচনা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল এবং তার পরিণতি সদর্থক হয়েছিল। ডাক্তাররা তাঁদের আশু দাবিগুলো পেশ করেন এবং সরকারও একগুচ্ছ ঘোষণা করে এবং সুরাহার অশ্ৱাস দেয়। আন্দোলনকারী ডাক্তাররা যখন কাজে ফিরে যাবেন তখন সরকার তার প্রতিশ্রুতির প্রতি কতটা অন্তরিক হয় সেটাও সকলে নজরে রাখবেন। পশ্চিমবাংলার জনগণ স্ৱস্তির নিঃশ্ৱাস ফেলেছেন এবং আশা করছেন যে, গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে “স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে”। আন্দোলনকারী ডাক্তাররা এই জন্য ধন্যবাদও পাবেন যে, পশ্চিমবাংলার অস্থিতিশীল এবং চূড়ান্ত উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে তাঁরা তাঁদের ঐক্য বজায রেখেছেন, নিজেদের বুনিয়াদী দাবিগুলোর প্রতি অবিচল থেকেছেন এবং ঘটনায় সাম্প্রদায়িক রং চড়ানোর বিজেপির ন্যক্কারজনক প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দিয়েছেন।

কলকাতার এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে বয়স্ক এক রোগীর মৃত্যু হলে ঐ রোগীর পরিজনরা এক ডাক্তারের ওপর আক্রমণ চালায় এবং তার পরিণামে ডাক্তারদের আন্দোলন শুরু হয়। ঠিক কী ঘটেছিল এবং কীভাবে ঘটেছিল তা নিয়ে বিভিন্ন ভাষ্য সামনে এসেছে, কিন্তু যা স্পষ্টতই পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে তা হল মুখ্যমন্ত্রীর মমতাহীন প্রতিক্রিয়া। মুখ্যমন্ত্রী যদি একটু তৎপর হয়ে আক্রমণের নিন্দা করতেন, আহত ডাক্তারকে দেখতে যেতেন এবং ডাক্তার ও হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিতেন, সে ক্ষেত্রে শুরুতেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে উঠত বলে মনে হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এর বিপরীতটাঈ করলেন এবং আন্দোলন প্রত্যাশিতভাবে ক্রমেই আরও বিস্তৃত এবং সোচ্চার হয়ে উঠল, সিনিয়র ডাক্তারারও প্রতিবাদে যোগ দিলেন এবং এমনকি গণ-পদত্যাগের কথা ঘোষণা করলেন এবং সারা দেশেই আন্দোলনরত ডাক্তারদের প্রতি সংহতি কর্মসূচী দেখা গেল। গোটা এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চলা এবং টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচালিত আলোচনার পরই মুখ্যমন্ত্রী যে আহত ডাক্তারকে দেখতে যেতে পারলেন, সেটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক! জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এবং প্রশাসনিক প্রধানরা যখন সীমাহীন ঔদ্ধত্য এবং অনুভূতিহীনতা দেখান, তার মধ্যে অবশ্যই বড় ধরনের গলদ থাকে।

রাজ্য সরকারেরে সঙ্গে ডাক্তারদের আলোচনায় ডাক্তারদের আন্দোলনের সূচনা ঘটানোর জন্য দায়ী ঘটনার আংশিক বিচার বিবেচনা হয়েছে বলেন মনে হয়। ডাক্তার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীদের এই ধরনের আক্রমণ থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে, শান্তিপূর্ণ এবং মর্যাদাসম্পন্ন কাজের পরিবেশ পাওয়ার সমস্ত অধিকার তাঁদের রয়েছে এবং হিংসার কোনো ঘটনা ঘটলে তাঁদের কার্যকরী সুরাহা দিতে এবং ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণালীবদ্ধভাবে দুর্বল করে তোলা এবং প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ঘটানোর ফলে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তৎপরতার সঙ্গে ক্ষোভের সুরাহা পাওয়ার বদলে আমাদের রাজনৈতিক মদতপুষ্ট গণ-গুণ্ডামির মুখে পড়তে হচ্ছে। ডাক্তারদের নিরাপত্তাহীনতার সমস্যাটা পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র মাত্রা পেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু অন্যান্য রাজ্যগুলো থেকে পাওয়া রিপোর্টগুলোর দিকে একটু তাকালেই ধরা পড়ে যে দেশের অনেক অংশেই এটা এক সাধারণ সমস্যা। এবং শাসক দলের নেতা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নানা রাজ্যের বহু স্থানেই ঘটেছে। তবে ডাক্তারদের ওপর আক্রমণের ঘটনা নিছক আইন ও শৃঙ্খলার সমস্যা নয় এবং হাসপাতালগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এই সমস্যার সমাধানও করা যাবে না। ডাক্তারদের নিরাপত্তাহীনতার উৎস রয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবার বিস্ফোরক সংকট এবং কাজের চরম দুরূহ পরিস্থিতির মধ্যে। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের অত্যাধিক ভিড়, কর্মী সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামও যথেষ্ট অপ্রতুল – অধিকাংশ সরকারী হাসপাতালেই জুনিয়র ডাক্তারদের এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি করা এবং সাধারণ জনগণকে দেয় পরিষেবার মান বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হলে তবেই পরিস্থিতির মূলগত উন্নতি ঘটতে এবং রোগীদের সঙ্গে ডাক্তারদের সংঘাত এবং ডাক্তারদের উপর আক্রমণের সম্ভাবনার হ্রাস ঘটতে পারে। ভারতের জটিল এবং চ্যালেঞ্জ ভরা সামাজিক বাস্তবতার প্রতি ডাক্তারদের সংবেদনশীল করে তোলার প্রশ্নটাও রয়েছে। ভারতে প্রশাসক, পুলিশের কর্তাব্যক্তি এবং ডাক্তারদের প্রতিদিনই প্রচুর মানুষের মুখোমুখি হতে হয় এবং গণতান্ত্রিক ধারায় জনগণের সঙ্গে আচার-আচরণ করার ব্যাপারে তাঁদের বিশেষভাবে সংবেদনশীল হতে হবে। নানান সামাজিক সুবিধা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং গভীরে বদ্ধমূল হয়ে থাকা উচ্চ পদমর্যাদার বোধ ক্ষমতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের আচার ব্যবহারের চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে চাওয়ায় ‘জনগণের সেবা করার’ মন্ত্র বাস্তব জীবনে হারিয়ে যায়।

সাম্প্রতিক অতীতে ডাক্তারদের যে আন্দোলনগুলো হয়েছে তার অনেকগুলোরই কেন্দ্রে থেকেছে ডাক্তারদের নিরাপত্তা এবং মর্যাদার ইস্যুটি। ডাক্তারদের বিভিন্ন সমিতি প্রায়শই সংহতি জানিয়ে সাড়া দিয়েছে এবং ডাক্তাররা স্ৱাস্থ্য় ক্ষেত্রের পেশাদার কর্মীর সমষ্টিবদ্ধ সংস্থা রূপে নীতিসম্মত অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু সমষ্টিবদ্ধ এই প্রতিক্রিয়া শুধু ডাক্তার-র‍োগী  অথবা ডাক্তার-জনগণের পারস্পরিক বৈরিতার মোকাবিলার ক্ষেত্রে হলেই চলবে না। বিদ্বেষপরায়ণ প্রশাসনের ক্রোধের মুখোমুখি হলেও ডাক্তারদের ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, যেমন ছত্তিশগড়ে হতে হয়েছিল ডাঃ বিনায়ক সেনকে  অথবা উত্তরপ্রদেশে ডাঃ কাফীল খানকে। সহ ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়া সহপাঠীদের হাতে অন্য ডাক্তার বা সহপাঠীদের হেনস্থার ক্ষেত্রেও ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, যেমনটা ঘটেছিল ডাঃ পায়েল তদভির মর্মন্তুদ এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া ঘটনার ক্ষেত্রে। এরই সাথে ডাক্তারদের আন্দোলনকে গণস্ৱাস্থ্যের বৃহত্তর এবং বুনিয়াদি ইস্যুগুলোর প্রতিও নজর দিতে হবে। একটা জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। কলকাতার ডাক্তারদের আন্দোলন যখন চলছিল এবং সারা দেশের নজর ঐ আন্দোলনের ওপর পড়েছিল ও সারা দেশের সংহতি ঐ আন্দোলন পেয়েছিল, তখনই বিহারে জনস্বাস্থ্যে ঘটছিল এক জরুরি অবস্থা, প্রতিদিনই এনসেফেলাইটিস রোগে মারা যাচ্ছিল বহু শিশু। এই ঘটনায় যতটা প্রশাসনিক এবং মিডিয়ার মনোযোগ পড়া উচিত ছিল তা কিন্তু পড়েনি। আজ সময়ের দাবি জনগণের শক্তিশালী জাগরণ এবং ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’র লক্ষ্যের বাস্তবায়নে তার অত্মপ্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চমকদার বীমা কর্মসূচীর বদলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার নিশ্চয়তা। এই লক্ষ্যে ডাক্তার, সংশ্লিষ্ট নাগরিক এবং সাধারণ জনগণ সবাইকেই হাত মিলিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ জুন ২০১৯)

খণ্ড-26