হাওড়া আদালতে পুলিশী সন্ত্রাস ও আইনজীবীদের নিগ্রহ

গত ২৪ এপ্রিল, ২০১৯ হাওড়া কোর্টে অকল্পনীয় ও অভাবনীয় পুলিশী সন্ত্রাসের নজির আইনজীবী সহ সারা দেশের মানুষ দেখলেন। ঘটনার সূত্রপাত খুবই সামান্য কারণে। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ১০টায় হাওড়া কোর্ট-চত্বরের উল্টোদিকে হাওড়া মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে একদল কর্মী ও সিকিউরিটি গার্ডের সাথে গাড়ি রাখা নিয়ে বচসা বাধে ও ঘটনাক্রমে এক আইনজীবী সুজন ভক্তের মাথায় বাঁশ দিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির কিছু কর্মী আঘাত করেন। সেই সঙ্গে কমবেশি একাধিক মহিলা আইনজীবী আহত হন। সুজন ভক্তের মাথায় সাতটি সেলাই পড়ে ও হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রক্তাক্ত সুজনকে হাওড়া কোর্টের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে দেখে কোর্ট-চত্বরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন থেকে একদল লোক আদালত চত্বরের কিছু উকিলবাবুদের সেরেস্তা ভাঙচুর করে। ক্রমশ আইনজীবীরা একত্রিত হয়ে মিউনিসিপ্যালিটির মূল ফটকের কাছে চলে এসে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন ও ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এই সময় বাদানুবাদ শুরু হয়। এরপর মিউনিসিপ্যালিটি ও হাওড়া আদালতের মাঝখানে মহাত্মা গান্ধী রোড কিছুক্ষণের জন্য রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মিউনিসিপ্যালিটির মূল ফটক থেকে ইঁট বৃষ্টি শুরু হয় এবং ইঁটের আঘাতে বেশকিছু আইনজীবী আঘাত পান ও হাওড়া হাসপাতালে ভর্তি হন। পুলিশ আসে, কিন্তু পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। পুলিশের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অল্প। প্রশাসনিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে পুলিশ যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে নিধিরাম সর্দার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মিউনিসিপ্যালিটির মূল ফটক বন্ধ হয়ে যায়। নিষ্ক্রিয় পুলিশের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট হয়ে আইনজীবীরা দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাস্তায় অবস্থান করতে থাকে। প্রশাসন ও পুলিশের দ্রুত হস্থক্ষেপের অভাবে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ বাড়তে থাকে। মিউনিসিপ্যালিটির গেটের ভিতর থেকে ক্রমাগত প্ররোচনামূলক হুমকি ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির কারণে আইনজীবীরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অচলাবস্থা চলতে থাকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। এরমধ্যে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে আর একদফায় ইঁট বৃষ্টি হয় এবং আবারও কিছু আইনজীবী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পুলিশ-প্রশাসন ঘন্টার পর ঘন্টা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এই সংযোগস্থলে না আসে উচ্চপদস্ত প্রশাসনিক কোন ব্যক্তি বা পুলিশের কোনো অভিজ্ঞ কর্তাব্যক্তি। ভাবনা গুপ্ত নামে এক অল্প বয়সী পুলিশ অফিসার সমস্যার মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। ঘটনাস্থলে যে দু’একজন আইপিএস অফিসার ছিলেন তারা প্রত্যেকেই হিন্দিভাষী এবং প্রচন্ড উত্তেজনার মধ্যে একটি বক্স নিয়ে এসে শান্তি বজায় রাখার আবেদন করতে থাকেন যা শেষ পর্যন্ত হাস্যকর এবং চুড়ান্ত অপদার্থতার নজির হয়ে দাঁড়ায়। ইত্যবসরে এলাকার এমএলএ তথা সমবায় মন্ত্রী এসে মিটমাটের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দ্রুত সরে পড়েন। বিক্ষোভ অগ্নিগর্ভ চেহারা নেয়।

যাই হোক, বিকাল পাঁচটার পর মিউনিসিপ্যালিটির ভেতর থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনের বড় বড় ঝান্ডা নিয়ে এক বিশাল জমায়েত হয়। নিষ্ক্রিয় পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে এবং মাঝে-মধ্যেই আইনজীবীদের দিকে তেড়ে আসতে থাকে। এরপর পুলিশ মিউনিসিপ্যালিটির গেট খুলে দিলে রাস্তার উপর দুই পক্ষের সংঘর্ষের উপক্রম হয়। আর একদফা ইট বৃষ্টির পরে শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার আসল রূপ ধারণ করে। এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক রাফ নামে। পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালায় আইনজীবীদের উপরে। মিউনিসিপ্যালিটির গেট খুলে দিলে ঝান্ডা হাতে একদল দুস্কৃতি পুলিশের সঙ্গ দেয়। হিংস্রমুখে অশ্রব্য ভাষা নিয়ে মাথায় হেলমেট পড়ে রাফ, পুলিশ ও সাধারণ পোষাকের কিছু মানুষ লাঠি হাতে আইনজীবীদের আক্রমণ করে এবং উত্তরদিকের বিভিন্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে এরা নির্বিচারে লাঠি চালাতে চালাতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি জেলা জজ কোর্টে প্রবেশ করে। আদালতের মধ্যে ঢুকে পুলিশ অশ্রাব্য গালিগালাজ, ভাঙচুর চালায়। কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটায় ও বেপরোয়া লাঠি চালানোর ফলে মহিলা সহ প্রচুর আইনজীবী আহত হন। পুলিশ ফৌজদারি আদালতের মাজিস্ট্রেটদের হুমকি দিতে থাকে। তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা জজের আদালতে কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটায়। আদালতের ভিতরে আইনজীবীরা, আদালতের কর্মী, বিচার প্রার্থীরা উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করতে থাকেন। আদালত চত্বরে এক নারকীয় ঘটনার সৃষ্টি হয়, যা ইতিহাসে বিরল। কমবেশি জনা পঞ্চাশের মতো আইনজীবী, ল-ক্লার্ক ও বিচার-প্রার্থী পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন। হাওড়া হাসপাতাল আহত আইনজীবীদের আর্তনাদে কেঁপে ওঠে। এরপরে পুলিশ সমস্ত আদালত চত্বরের গেট বন্ধ করে দেয়, যাতে আইনজীবীদের কেউ আদালত থেকে বেরোতে না পারে। ক্ষুব্ধ ও আহত আইনজীবীরা জেলা জজ সাহেবের ঘরে অবস্থান শুরু করেন। অনেক ডাকাডাকির পর হাওড়া পুলিশ কমিশনার আসেন। সেখানে আর একদফার উত্তেজনা শুরু হয়। পুলিশ ও একদল দুষ্কৃতী মিউনিসিপ্যালিটির ভিতরে এক মহিলা আইনজীবীকে আটকে রেখে মারধোর করে। পরে রাত্রির সাতটার সময় তাকে উদ্ধার করা হয়। সমস্ত ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয় প্রসাশনের চুড়ান্ত অযোগ্যতা, অক্ষমতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্য মানুষের অভাব। এই রাষ্ট্র মূলত নির্ভরশীল পুলিশের লাঠি ও গুলির উপর এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খন্ডিত, খর্বিত। কোনো অনুমতি ছাড়া আদালত চত্বরে প্রবেশ করে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, ল-ক্লার্ক ইত্যাদি মানুষজনকে নির্রিচারে প্রহার করে এখনও পর্যন্ত কোনো ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং-এর মুখোমুখি না হয়ে মজায় ক্ষমতা ভোগ করে চলা—এ একমাত্র ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গেই সম্ভব।

আশার কথা হলো আইনজীবীরা এরপরে পিছিয়ে যাননি। সারা বাংলা জুড়ে আজ আইনজীবীরা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করে চলেছেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা রাজ্যে আদালতের কাজকর্ম বন্ধ। জেলায় জেলায় আইনজীবী, ল-ক্লার্কস ও বিচার প্রার্থীদের নিয়ে সমাবেশ হচ্ছে। দোষী পুলিশ অফিসারদের শাস্তি ও গ্রেপ্তারের দাবিতে আন্দোলন চলছে। গত ২৬ এপ্রিল বিভিন্ন কোর্টের আইনজীবীরা হাওড়া কোর্টে সামিল হন এবং ধিক্কার মিছিল বের করেন। ঐদিন লইয়ার্স ফর সোশ্যাল জাস্টিস এন্ড হিউম্যান রাইটস -এর পক্ষ থেকে আইনজীবী সুজয় ভট্টাচার্জ, শৈবাল মুখার্জী, দিবাকর ভট্টাচার্জ, লিটন ভাদুরি, রাজীব দত্ত, সৌরভ, অভিজিৎ দত্ত প্রমুখ আন্দোলনরত আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করেন এবং একটি সংহতিপত্র দেন। আপাতত ২ মে, ২০১৯ পর্যন্ত রাজ্যের সমস্ত আদালতে কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। হাইকোর্ট স্বত:প্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করেছেন পুলিশ প্রশাসন এবং মিউনিসিপ্যালিটির বিরুদ্ধে। সবার কাছ থেকেই রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। অথচ প্রশাসন নির্বিকার, ভূমিকাহীন, উদ্যোগহীন। নেতারা ভোটের প্রচারে ব্যস্ত। স্বভাবত ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে ফ্যাসিস্ট শক্তি। কিন্তু এখনও একজোট হয়ে পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাধারণ আইনজীবীরা লড়ে যাচ্ছেন তাদের সম্মানরক্ষা ও উদ্ধারের সংকল্পে।

খণ্ড-26