নির্বাচনের পরেই নদীয়ায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও নির্বাচনী প্রচার নিয়ে কিছু কথা

“ওরা পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে মিছিল করছে”, ‘‘ওরা মন্দিরে বোম পটকা ফাটাচ্ছে” “হিন্দুদের উপর আক্রমণ করছে”— হাওয়ার বেগে এ জাতীয় গুজব রটিয়ে দেওয়া হল। “তুমি যদি হিন্দু হও এখনই পথে বসে পড়ো, অবরোধে সামিল হও” কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল উন্মত্ত মানুষ ৩৪ নং জাতীয় সড়ক অবরোধে বসে গেল। পুরো ঘটনার নেতৃত্বে ছিল এলাকার বিজেপির কয়েকজন হবু নেতা ও কর্মীরা। ঘটনাস্থল নদীয়ার ধুবুলিয়া। নির্বাচনের দু’দিন পর গত ১ মে এভাবেই দাঙ্গা লাগানোর মরিয়া প্রচেষ্টা চালানো হলো। ঘটনার সূত্রপাত সম্ভাব্য নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তির মধ্যে বচসা। যারা চায়ের দোকানের বা ‘গেলাসের বন্ধু’ও বটে। তর্ক থেকে শুরু হয়ে হাতাহাতি-মারামারি, আক্রান্তদের ঢিল ছোড়া — তারপর মাথা ফাটাফাটি পর্যন্ত গড়ায়। এই আপাত ছোট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করেই “তিল কে তাল” বানানো হলো। আড়াই ঘণ্টা ধরে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়ক অবরূদ্ধ হয়ে রইলো। পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে রইলো। পশ্চিমবাংলায় তৃণমূলের রাজত্বে বিভিন্ন দাঙ্গার ঘটনায় সাধারনত এমনটাই ঘটে থাকে। শুরুতে অপেক্ষা করা হয়,যাতে উন্মাদনার পারদ চড়তে থাকে, গুজবের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাময়িক উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে “দুই পক্ষ”ই কিছু না কিছ আক্রমণ প্রতি আক্রমণ করে বসে। দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়লে তখন সরকার প্রশাসন “ত্রাণকর্তা” হিসাবে এগিয়ে আসবে, রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে। কিন্তু না, যথেষ্ট প্ররোচনা ছড়িয়ে দেওয়া হলেও ধুবুলিয়া বা পার্শবর্তী এলাকায় কোনোরকম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা ঘটেনি। অবশেষে পুলিশ লাঠিচার্জ করে অবরোধ হঠিয়ে দেয়। উভয় সম্প্রদায়ের ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনাস্থলের কাছেই সিপিআই(এমএল)-এর পার্টি অফিস। জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত সহ পার্টির স্থানীয় কর্মীরা দ্রুতই পথে নেমে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার কাজে উদ্যোগ নেয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতৃত্ব ও নীচুতলার সাধারণ কর্মীদের সাথে কথা বলে সম্প্রীতি ও ঐক্যের পরিবেশ বজায় রাখা, গুজব ছড়ানো বন্ধ করা, গুজবে কান না দিতে মানুষের কাছে প্রচার নিয়ে যাওয়া এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সাম্প্রদায়িক চক্রান্তকে রুখে দেয় ধুবুলিয়ার মানুষ। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পার্টি কর্মীরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছে।

সাম্প্রদায়িক বিজেপি যে এভাবে দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা চালাবে এটা সমগ্র নির্বাচনী প্রচারে সিপিআই(এমএল) তুলে ধরেছিলো। সাম্প্রদায়িক শক্তির ঘৃণা প্রচার ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার রাজনীতিকেই আক্রমণের প্রধান লক্ষবস্তু করেছিলো। বাস্তব ঘটনাবলী পার্টির প্রচারের সঠিকতাকেই প্রমাণিত করেছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার সমগ্র লোকসভা কেন্দ্র জুড়ে উপরিস্তরে প্রচারকাজ ভালোমাত্রায় সংগঠিত হয়েছে। দেশে ফ্যাসিবাদের যে বিপদ নেমে এসেছে সে বিষয়ে জনগণকে এবং আমাদের কর্মী ও প্রভাবিত মানুষকে ওয়াকিবহাল করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে জেলার সমগ্র পার্টি সংগঠন। বিজেপি যে বিভেদের বিষাক্ত রাজনীতি চালিয়ে যাবে, এবং তার জন্য একটা জমি রাজ্যের স্বৈরাচারী শাসকদল তৈরি করে দিচ্ছে—এই ঘটনাবলী সেই বার্তাও তুলে ধরেছে। নির্বাচনী প্রচার চলাকালে বিভিন্ন স্তরে একটা মতামত উঠে আসে যে তৃণমূল যেভাবে দুর্নীতি লুঠ ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে একেই আক্রমণের প্রধান লক্ষবস্তু করা হোক। কিন্তু সারা দেশব্যাপী বিজেপি যেভাবে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে চাপিয়ে দিয়ে এক ফাসিস্ট রাজত্ব নিয়ে আসতে চাইছে তার দিকেই রাজনৈতিক প্রচারের বর্শামুখ রাখার কেন্দ্রীয় দিশা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করা হয়,এবং গোটা পার্টি সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়। তৃণমূল তথাকথিত “সর্ব ধর্ম পৃষ্ঠপোষকতা”র যে রাজনীতির কথা বলছে সেটা আসলে কংগ্রেসী ঘরানার “নরম হিন্দুত্ব”—যা এক ধরনের কপট ধর্মনিরপেক্ষতা। এটাই কার্যত বিজেপিকে ধর্ম নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করার উর্বর জমি তৈরি করে দিচ্ছে। এ প্রশ্নে প্রচার নিয়ে যাওয়া হয়। কৃষি ও কৃষক প্রশ্ন গ্রামীণ মজুরদের প্রশ্নগুলি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়। তৃণমূলের সংখ্যালঘ উন্নয়নের স্বরূপ উন্মোচিত করা হয়। কেন ১০ হাজার মাদ্রাসা অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি পালন করা হলো না। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনে উত্তীর্ণদের নিয়োগের দাবিতে গড়ে ওঠা অনশন আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করা হল, ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাওয়া নিয়ে সরকার নীরব হয়ে রইলো ইত্যাদি সংখ্যালঘুূদের জীবন-জীবিকার মৌলিক প্রশ্নগুলি তুলে ধরা হয়। এই প্রচার পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে খুবই সহায়ক হয়।

অপর দিকে জেলায় তৃণমূলের প্রবল সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করে নির্বাচনী প্রচার সংগঠিত হয়েছে। বিশেষত একটি ব্লকে যেখানে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের পার্টি অফিস এবং পার্টি কর্মী ও নেতৃত্ব আক্রান্ত হয়। সেখানে এমন ভাবে ভয় ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে পার্টি কর্মী-সমর্থকরা খোলাখুলি প্রচার করতে পারছিলেন না। সেখানে যে কর্মপদ্ধতি নেওয়া হয় তা হলো, নিশ্চয়ই সর্বত্র সমানভাবে সন্ত্রাস চলছে না। ভালো করে খতিয়ে দেখা যাক। অন্তত কয়েকটি জায়গায় প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা। এতে ফল পাওয়া যায়। ব্লক সদর থেকে দূরবর্তী একটা গ্রামে কমরেডরা উদ্যোগ নেন, প্রচার চালান এবং বুথ বসিয়ে পোলিং এজেন্ট দিতেও সক্ষম হন। এখানে বেশ কয়েকজন বাম কর্মী আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন। পাশাপাশি অন্যান্য কয়েকটি এলাকাতেও প্রচার করা ও বুথ বসানো যায়। অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সাথে এই ব্লকের পার্টি সংগঠন সন্ত্রাস মোকাবিলা করে নির্বাচনী কাজ চালিয়েছেন। অন্য একটি ব্লকে দীর্ঘদিন ধরে পার্টির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছিলো। সেখানে পার্টি সংগঠক লাগাতার ভাবে লেগে পড়ে থেকে বিভিন্ন পুরানো কাজের এলাকায় যোগাযোগ করেন,দেখা যায় স্থানীয় পার্টি কর্মীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। একটি জায়গায় বাম কর্মীরা বিজেপিতে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। তাদের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে ঐ ভাবনা থেকে নিবৃত্ত করা এবং আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। জেলার সমগ্র পার্টি কর্মীরা মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করেছেন। অন্তর্মূখীনতা কাটিয়ে বড় ধরনের প্রচার কাজ আমরা চালাতে পারি, এ ধরনের আত্মবিশ্বাস সমগ্র সংগঠনে গড়ে উঠেছে। জেলা সদরে স্বল্প সংখ্যক কর্মীরাও নিবিড় প্রচার ও বড় ধরনের পরিকল্পনা গ্রহনে পারদর্শীতা দেখিয়েছেন। বেশ কয়েকজন যুব কর্মী সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন, উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে তারা বিরাট এলাকা জুড়ে দুই দিনব্যাপী প্রচার অভিযান সংগঠিত করেছেন। শ্রমজীবী মহিলাদের মধ্য থেকে এগিয়ে আসা বেশ কয়েকজন কর্মীরা নানান জটিলতা কাটিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করেছেন, মহিলাদের বৈঠক সংগঠিত করেছেন, কয়েকটি ব্লক জুড়ে সারা দিনব্যাপী ভ্রাম্যমান প্রচার করেছেন। এই সমস্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগামীতে যুব ও মহিলা সংগঠন নতুন করে গড়ে ওঠার শর্তগুলি সামনে এসেছে। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন এই সমস্ত ইতিবাচক দিকগুলিকে পাথেয় করে নীচুতলায় সংগঠনকে মজবুত ভিত্তির উপরে দাঁড়করানো এবং আন্দোলনমুখী উদ্যোগ গ্রহণে পার্টি সংগঠনকে সক্ষম করে তোলার কাজে এগিয়ে যেতে জেলা পার্টি সংকল্পবদ্ধ।
- জয়তু দেশমুখ

খণ্ড-26