সম্পাদকীয়
ফ্যাসিবাদী নিশানা কবিকেও ছাড়ে না

শিলচরে কবি শ্রীজাত’র ওপর ন্যক্কারজনক হামলার উপক্রম ঘটল চরম অসহিষ্ণুতার মতাদর্শ, সমাজনীতি ও রাজনীতির উৎপীড়নরাজ চলার এক নির্দিষ্ট প্রকাশ হিসেবেই। বলাবাহুল্য, আদতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী চরিত্রের। এর রসদ অসমে আরও জোগাচ্ছে সেখানে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। ওই গেরুয়া সরকার গোড়াপত্তনের অনতিবিলম্বে যে ‘এনআরসি’ প্রয়োগের অভিযান নামিয়েছে, তার আশু নিশানায় তালিকাভুক্ত করেছে এক লপ্তে চল্লিশ লক্ষ অ-অসমীয়া জনসমুদয়কে, যাদেরকে উচ্ছেদ ও বিতাড়ন করাই উপরোক্ত নাগরিক তথ্য পঞ্জিকরণের লক্ষ্য। সোজা কথায়, এর অভিমুখবিন্দু স্থান করে দিতে নয়, স্থানচ্যূত করতেই মুখিয়ে। এই অভিযানের প্রকল্পটা নিয়েছে কেন্দ্রের মোদী জমানা, সারা দেশে কায়েম করার উদ্দেশ্যে, শুরুটা করছে অসম থেকে। হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকার ঝোলা থেকে আরও একটা অস্ত্র বার করে কোপ মারতে মরীয়া। তা হল, নাগরিকত্ব প্রদানের এক সংশোধনী বিল (‘১৬), যার মোদ্দা উদ্দেশ্য হল, এমন এক চরম বৈপরীত্যের সাংবিধানিক বন্দোবস্ত করা, যেখানে একদিকে বহিরাগত কেবলমাত্র হিন্দুদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে প্রশ্নাতীতভাবে, আর বিশেষত মুসলিমদের জন্য দরজা থাকবে চিরতরে বন্ধ। ভাষিক বিদ্বেষপূর্ণ এন আর সি প্রয়োগের সূচনা ও ধর্মীয় বিভাজনপূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদানের সংশোধনী কায়েমের সম্ভাবনা, এই দুই সাঁড়াশী আক্রমণ নামানোর যথেচ্ছ স্বেচ্ছাচারিতা অসমের পরিস্থিতি-পরিবেশকে অত্যন্ত বিপজ্জনক করে তুলছে। বিশেষত শাসকের উপরোক্ত পলিসিদ্বয় যেহেতু অসমের ভেতরে-বাইরে প্রবল প্রতিবাদ ও বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে তাই শাসক ও শাসক মদতপুষ্ট-প্রভাবিত হামলা বাড়ছে। অসহিষ্ণুতার হামলায় আসলে শুধু শ্রীজাত আক্রান্ত হননি, এর আগে আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন বাংলার এক পরিচিত গায়ক শান। শ্রীজাত শিলচরে শুধুমাত্র নয়, এর আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন শিলিগুড়িতেও। বিরোধিতায় সোচ্চার হওয়ার কারণে অসমে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী হীরেন গোহাইঁ, সংগ্রামী কৃষক নেতা অখিল গগৈ প্রমুখ কয়েকজনকে ‘দেশদ্রোহী’ আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র শিল্পী নাসিরুদ্দিন শাহকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, রাজ্যে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে বিজেপি জমানা প্রবর্তনের পরিণামে জাতির নামে বজ্জাতি, দলিত ও আদিবাসীদের ওপর অবর্ণনীয় জাতিবাদী-বর্ণবাদী আক্রমণ, গোরক্ষার নামে মুসলিমদের হাতে মারা-ভাতে মারা হচ্ছে; দলিত ও মুসলিমদের ভোট আর নারীদের ধর্ষণে কোনও অস্পৃশ্যতা-অপবিত্রতা গণ্য করা হয় না, বরং আধিপত্যের সন্ত্রাস বুঝিয়ে দিতে ‘বীরোচিত’ গর্ব করা হয়, এত কুখ্যাতি কুড়োনোর পরেও নিন্দাবর্ষণ থেকে পিঠ বাঁচাতে বিজেপি নেতারা আবার তসলিমা নাসরিনের মতো নির্যাতিতের প্রতি দরদের ছলাকলা দেখান। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করতে ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের একের পর হত্যাকান্ডে নিস্পৃহতা প্রদর্শন, ‘আরবান নকশাল’ দেগে দিয়ে মানবাধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীদের গারদে পুরে দেওয়ার দমন অভিযান ইত্যাদি চলছেই। সুতরাং শ্রীজাত’র ওপর আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, হিন্দুত্ববাদীদের তা অস্বীকার করার উপায়ও নেই, তবে সাফাই দিতে চিরাচরিত ‘হিন্দুত্বের ভাবাবেগ আহত’ হওয়ার জিগির তুলে চলবে।

কিন্তু ফ্যাসিবাদী কোনও হামলা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। হামলার বিরুদ্ধে বরং সংগঠিতভাবে রুখে দাঁড়ানো বাড়ছে, আর সেটা করে চলতে অনেক ক্ষেত্রে নারীশক্তি নিচ্ছে একরোখা অগ্রণীর ভূমিকা। শবরীমালা থেকে শিলচরে। সংগঠিত মোকাবিলা যত বাড়ানো যাবে, সেভাবেই বিধ্বস্ত করে দেওয়া যাবে সড়ক থেকে সংসদে সর্বত্র। রাজ্যওয়াড়ি থেকে দেশের রাজধানীর রাজপথে আছরে পড়ছে শ্রেণী জনতার ও ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের একের পর এক উত্তাল জনআন্দোলন, খোদ হিন্দীবলয়ের তিন রাজ্যের জনগণ বিজেপিকে করে দিল ভূপতিত। সারা দেশের পরিস্থিতিতে উঠছে নতুন এক পরিবর্তনের জন্য উতল হাওয়া। একে এক সার্বিক গতিবেগ দেওয়ার ওপরই নির্ভর করছে মোদী-বিজেপির ফ্যাসিস্ত রাজ অবসানের লক্ষ্যে নির্দ্ধারকভাবে এগিয়ে যাওয়া। জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। সংগ্রাম আর সংহতির লক্ষ্যে অবিচল থাকা।

খণ্ড-26
সংখ্যা-3