কদিন আগে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম এন ডি এ আমলে সর্বোচ্চ আর্থিক বৃদ্ধির বিজেপির দাবিকে নস্যাৎ করে জানিয়েছেন যে নীতি আয়োগের মন গড়া পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করেই ওই সমস্ত আজগুবি কথাবার্তা তারা বলছে। তিনি আরও বলেছেন, ইউ পি এ সরকারের প্রথম দফাই (২০০৪-২০০৯) বৃদ্ধির নিরিখে স্বাধীন ভারতে সবার সেরা। বহুদিন যাবৎ, আমাদের দেশের অর্থশাস্ত্রীরা পরিত্যাক্ত এক তাত্ত্বিক কাঠামোর আধারেই আমাদের দেশের আর্থিক বৃদ্ধি কে পরিমাপ করে এসেছে। কংগ্রেস বিজেপি বা অন্যান্য সংসদীয় রাজনৈতিক দল তারই আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।
শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্ব জুড়েই নয়া উদারপন্থীদের ভ্রান্ত এই ধারণার জন্য বিরাট মাশুল আজও দিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রখ্যাত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ যোসেফ স্টিগলিৎস বলেছেন, ‘‘অত্যন্ত সরলীকৃত নয়া উদারপন্থী বাজার সর্বস্ব তাত্ত্বিক কাঠামোগুলো বিগত চার দশক ধরে যে আর্থিক নীতিগুলোর রূপায়ন করেছে তা প্রবল মাত্রায় বিপথগামী। এর পরিণামে জিডিপির বৃদ্ধি হয়েছে বিপজ্জনক হারে বৈষম্য বাড়িয়ে। চুইয়ে পড়ার তত্ত্ব আদৌ কাজ করলো না। যেভাবে থ্যাচার-রিগানের ‘বিপ্লব’ সমাজের একদম উপরের ভাগ্যান্বেষীদের স্বার্থেনিয়মের বদল ঘটিয়ে বাজারকে পুনর্নির্মিত করেছে তা বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করতেই শক্তি যোগালো। পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা।’’
প্ল্যানিং কমিশন বা যোজনা পর্ষদ সর্বপ্রথম ইনক্লুসিভ গ্রোথ-এর কথাবার্তা আলোচ্যসূচিতে নিয়ে আসে ১১তম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায়, যার মেয়াদ ছিল ২০০৭-২০১২ পর্যন্ত। এই পর্বকাল শেষে বৃদ্ধির হার লক্ষণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেলেও দেখা গেল এরই পাশাপাশি বৃদ্ধি পেল মাত্রাতিরিক্ত দারিদ্র্য আর সুবিপুল সংখ্যক জনগণ থেকে গেল এই তথাকথিত বৃদ্ধির নাগালের সম্পুর্ণ বাইরে। আমাদের নীতিকারেরা ভেবেছিলেন, বৃদ্ধির প্রতি একমাত্রিক অভিঘাত দিলেই বুঝি তা চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিচে পড়বে আর তারই যাদুস্পর্শেনিচু তলার মানুষেরা উঠে আসবে উপরে।
অভিজ্ঞতা এটাই দেখায় যে, ১১ তম পরিকল্পনা পর্বে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধি ৭.৯ শতাংশ হারে, কখনও কখনও ৯ শতাংশ হারে পৌঁছালেও ভারত ওই পর্বকালে বিশ্ব মানব বিকাশ সূচকে ক্রমাগত নিচের দিকে গড়িয়ে পড়েছে। ২০০০ এবং ২০০৫ সালে ওই সূচকে ভারতের স্থান ছিল যথাক্রমে ১২৮ ও ১২৯ কিন্তু, ২০০৯ ও ২০১১ তে তা আরও নিচে গড়িয়ে ১৩৪তম স্থানে এসে দাঁড়ায়। দেখা গেল একদিকে হাতে গোনা কয়েকজন ধনকুবের আরো ফুলে ফেঁপে অর্বুদপতির তালিকায় নাম লেখালো, ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রথম ৪ জন ভারতীয় ২০০৯ সালে বিশ্বের প্রথম ১০ জন সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় নাম তুলল আর বিপরীতে, ওই একই বছরে বিশ্বে প্রথম ১০ জন সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের মধ্যে ৩ জনই ভারতীয় হিসাবে চিহ্নিত হল। বিপুল প্রাচুর্যের চোখ ধাঁধাঁনো ছোট্ট ছোট্ট বদ্বীপের মাঝখানে সীমাহীন দারিদ্রের এই নির্মম বৈপরিত্য আজও ভারতের বাস্তবতা।
ভারতের প্ল্যানিং কমিশন জিডিপি কে বৃদ্ধির মাপকাঠি হিসাবে সরকারী ভাবে গণ্য করলেও ইনক্লুসিভ গ্রোথ (বা বৃদ্ধির সুফলকে সকলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়াটা)-কে কিভাবে জরিপ করা হবে তার কোন মানদন্ড সূত্রায়িত করে নি। কিন্তু এ প্রশ্নে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মডেল ও মাপকাঠি রয়েছে। গিনি কো-এফিসিয়েন্ট (যার মাধ্যমে আয়ের বৈষম্য মাপা যায়) এবং মানব বিকাশ সূচক হল সেই সমস্ত মাপকাঠি, কিন্তু ভারতের নীতিকাররা কোন দিন তাদের রাজনৈতিক সদ্দিচ্ছা বা উন্নয়নী মডেলে এগুলোর স্থান দেয়নি।
ভারতে আর্থিক বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের বিরোধাভাস বার বার পরিলক্ষিত হয়। বিগত দেড় দশক ধরে গড়ে ৭ শতাংশ হারে আর্থিক বৃদ্ধি হলেও তা কর্মসংস্থানের অবস্থাকে উন্নত করতে পারেনি। এই পর্যায়ে কর্মসংস্থানের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২.৮৭ শতাংশ থেকে বিরাটভাবে কমে এসে ঠেকেছে ১ শতাংশের নীচে। ব্যাপক কর্মহীনতা এখন ভারতীয় শাসকদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেন্টার ফর সাস্টেনেবল এমপ্লয়মেন্ট এর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে, কর্মহীনতা ক্রমাগত বাড়ছে। কয়েক বছর তা ২-৩ শতাংশ হারে থাকার পর ২০১৫ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ শতাংশ হারে আর কর্মহীন তরুণদের হার বেড়ে হয়েছে ১৬ শতাংশ—কুড়ি বছরের মধ্যে যা সর্বাধিক। এরই সঙ্গে ওই রিপোর্ট আরও জানাচ্ছে যে, কাজের এই আকালের পাশাপাশি মজুরি বিরাট মাত্রায় হ্রাস প্রাপ্ত হচ্ছে, ৮২ শতাংশ পুরুষ এবং ৯২ শতাংশ মহিলা মাসে মাত্র ১০ হাজার টাকারও কম আয় করছেন।
আমরা এতদিন জবলেস গ্রোথ বা কর্মহীন বৃদ্ধির কথা শুনে এসেছি। এখন নতুন এক প্রবণতার কথা সামনে আসছে—ওয়েজলেস গ্রোথ বা মজুরিহীন বৃদ্ধি। গত বছরের জুলাই মাসে “ও ই সি ডি এমপ্লয়মেন্ট আউটলুক ২০১৮’’ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ও ই সি ডি দেশগুলোর জন্য। ওই রিপোর্টের সম্পাদকীয় কলমের শিরোনাম “ওয়েজলেস গ্রোথ : ইজ দিস টাইম ডিফারেন্ট?” আই এল ও তার “২০১৮/১৯ এর গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, ২০১৭ সালে ১৩৬টি দেশে জনগণের মাসিক উপার্জন ২০০৮-এ সংকটদীর্ণ বছরে যা ছিল তার তুলনায় সবচেয়ে কম। এই রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, শ্রমের মূল্য বা মজুরি এবং উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি পরস্পর বিযুক্ত হয়ে পড়ছে। বা, জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে মজুরির অংশ ক্রমেই হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাই উৎপাদনশীলতা বাড়লেও, জাতীয় আয় বৃদ্ধি হলেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে না। বরং বহু দেশে তা ১৯৯০এর আগের তুলনায়ও নিচে নেমে গেছে। যে ও ই সি ডি (অর্গানাইজেশন অফ ইকনমিক কোওপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) তাদের রিপোর্টে সবসময়ই আশার আলো তুলে ধরে তারাও লিখেছে, “সর্বক্ষণ কাজ করেন এমন কর্মীদের তুলনায় আংশিক সময়ে কর্মরত কর্মীদের আয় দিনের পর দিন খারাপ হচ্ছে। এরই সাথে, বহু দেশে বাধ্যতামূলকভাবে পরিস্থিতির চাপে পড়ে আংশিক সময়ের কর্মীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে চলেছে। উপরন্তু, এতদিন কর্মহীনতায় দিন কাটানো কম মজুরি পাওয়া শ্রমিকরা যখন তখন চাকুরি হারানোর আশংকায় কাজ করছেন কর্মহীনতার বেড়ে চলা পরিমন্ডলে। এর ফলে, কম মজুরীর পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে মজুরির হারকেও অনেক নিচুতে বেঁধে রাখা যাচ্ছে।’’
গোটা বিশ্ব জুড়েই তাই আজ মজুরি বৃদ্ধি, নিরাপদ কর্মস্থল, শোভন কাজ, সম মজুরির দাবী এক আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। এই দাবিতে শ্রমিকদের লড়াই তাই দিনের পর দিন আরো তীব্র জোরালো হয়ে আছড়ে পড়বে দিকে দিগন্তে ।