আমাদের দেশে আগে কৃষকরা শোষিত হতো জমিদার-জোতদারদের হাতে। তার রেশ থাকতে থাকতে কৃষি ও কৃষক শোষিত ও লুঠ হচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কৃষি-অর্থ-শিল্প নীতির মাধ্যমে কর্পোরেট, বড় বড় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা। তারই জন্য তৈরী করা হয় জমি অধিগ্রহনের জন্য ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অাইন’। যে আইনের মাধ্যমে বহুজাতিক সংস্থা, টাটা-আম্বানি ও বড় বড় শিল্পপতিদের জন্য উর্বর কৃষি জমি, জঙ্গল, জল ও খনিজ পদার্থলুঠের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধেই সারা দেশে এবং আমাদের রাজ্যেও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে কৃষক আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলন সমগ্র দেশে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনে বহু কৃষক ও আন্দোলনকারীদের জীবন যায়। মিথ্যা মামলায় অনেকে গ্রেপ্তার হয়। সেই মামলা আজও চলছে। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের গণ রাজনৈতিক বিদ্রোহ তৎকালীন বাম ফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সেই আন্দোলনকে হাতিয়ার করে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে।বর্তমান সরকার টাটাদের জমি ফেরত নিলেও মাত্র দশ শতাংশ জমি চাষযোগ্য হয়েছে। বর্তমানে সিঙ্গুরের সেই জমিতেই রাজ্য সরকার জাপানের বহু জাতিক সংস্থা কাওয়া সাকি রিকুসো ট্রান্সপোর্টেশনের হাত ধরে বিনিয়োগের পথে এগোচ্ছে। পাশাপাশি সিঙ্গুরের কৃষি মজুর-বর্গাদার- পাট্টাদার-ক্ষুদ্র কৃষকরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেলেন এবং আজও মিথ্যা মামলাগুলি প্রত্যাহার করা হলো না। সিঙ্গুরের কৃষক ও আন্দোলনকারীদের সাথে প্রতারণা করা হল।
অপরদিকে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের কৃষক জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে আজও সেদিনের শাসকদল স্বীকৃতি না দিয়ে এবং তার থেকে শিক্ষা না নিয়ে পুরোনো কথাগুলিই আওড়ে যাচ্ছে। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশে ও রাজ্যে আন্দোলনের পর আজ আবার কর্পোরেটদের কৃষি থেকে হটানো, ভূমি সংস্কার, সার-বীজ-কীট নাশকের মূল্য হ্রাস, জীন প্রযুক্তিতে চাষ বন্ধ করার আওয়াজ উঠেছে। অতীতের মতো কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে স্বামীনাথন কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী—ফসলের উৎপাদনের খরচের দেড়গুণ দাম এবং কৃষকের ঋণ মুক্তির দাবীতে দেশের সমস্ত সংগ্রামী কৃষক সংগঠনগুলোকে নিয়ে গড়ে উঠেছে “সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’’। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতি রাজ্যে কৃষক জনগণ তাঁদের ন্যায্য দাবী ও অধিকার নিয়ে আন্দোলনে সামিল। দিল্লির পার্লামেন্টের সামনে তা আছড়ে পড়েছে। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্রিশগড় বিধান সভা নির্বাচনে কৃষক ও জনগণের রায় বিজেপি-র বিরুদ্ধেই গেছে। যার ফলে কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষি ও কৃষক নিয়ে কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
কেন্দ্র সরকার বলছে ২০২২ এর মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করবে, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলছেন কৃষকের আয় ইতিমধ্যে তারা তিন গুণ করেই ফেলেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই সংখ্যা তত্ত্বের ‘কারসাজি’ করে কৃষক ও গ্রামীন মজুরদের ধোঁকা দিচ্ছে। উভয় সরকারই স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকরি করেনি। যেখানে ধানের মূল্য কুইন্ট্যাল প্রতি ২৩৫০ টাকা হয় সেখানে রাজ্য ঘোষনা করেছে ১৭৫০ টাকা। আলু ও সব্জির কোনো সহায়ক মূল্য ধার্য নেই। আলুর মূল্য কুইন্ট্যাল প্রতি যেখানে ১০০০টাকা হওয়া উচিত সেখানে খুবই কম মূল্যে কৃষকরা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। মোদীর রাজত্বে ইতিমধ্যে ১৮০০০ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। মমতা ব্যানার্জীর আমলে ২০১৭-২০১৮সালে ১৮৫ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে এবং সম্প্রতি শবরদের ৭ জন অনাহারে মারা গেছে। কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা প্রতিদিন ৫৩-তে দাঁড়িয়েছে। কৃষকের আয় বৃদ্ধির জন্য কৃষির যে পরিকাঠামো প্রয়োজন—যেমন, ফসল সংরক্ষণ, সেচ ব্যবস্থা বৃদ্ধি, কৃষির বিভিন্ন উপকরণের মূল্য হ্রাস, মহাজনি ঋণ থেকে মুক্ত করে ব্যাঙ্ক ও সমবায় থেকে বিনা সুদে পাট্টাদার ও বর্গাদার সহ সমস্ত ছোট চাষীদের ঋণ প্রদান, সহায়ক মূল্য দিয়ে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ফসল ক্রয় করার ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
কৃষি মজুর ও গ্রামীণ মজুরদের (অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড-ডে-মিল, নির্মাণ প্রভৃতি) দৈনিক ন্যূনতম ৬০০ টাকা মজুরি হওয়া উচিত, কিন্তু এই অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে আসছে। সমস্ত স্কীম ওয়ার্কারদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি এবং সমস্ত পদযাত্রার আওয়াজের সঙ্গে মিশে গেল স্থানীয় দাবির আন্দোলন সংগঠকের ডায়েরী হুগলীর পান্ডুয়া ব্লকের কোঁচমালি গ্রাম পার্টির অনেক দিনের পুরানো কাজের এলাকা। বিশেষ করে গ্রামটির রায়পাড়ায় দিনমজুর মহিলারা বরাবরই পার্টির ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই ‘কৃষক গ্রামীণ মজুর অধিকার যাত্রায়’ তারা যাতে সামিল হন সে জন্য সপ্তাহ খানেক আগে পার্টির স্থানীয় নেত্রী সরস্বতী তুড়িকে সঙ্গে নিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। সেখানে কয়েকজন মহিলা আক্ষেপ করে বলেন, "পদযাত্রায় না যাওয়ার তো কিছু নেই। কিন্তু আমরা যে কতকাল ১০০ দিনের কাজ পাইনা সে বিষয়ে কী করা হবে?” তখনই ঠিক হয়,পঞ্চায়েতকে না জানিয়ে হঠাৎই পঞ্চায়েত ঘেরাও করা হবে। সেই মত আজ (২২ জানুয়ারি) বেলা ৩টের সময় রায়পাড়ায় স্থানীয় মহিলা কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। আগেই অন্যান্য পাড়ায় (২৫ নং গেট পাড়া, রাজভরপাড়া ও দারোয়ানপাড়া) খবর জানানো ছিল।অতি দ্রুত জনা চল্লিশ নানা বয়সের মেহনতী মহিলা কোথা থেকে যে এসে হাজির হলেন! কাছেই পঞ্চায়েত অফিস।প্রধান ছিলেন না। উপপ্রধানও বিক্ষোভের গন্ধ পেয়ে সড়ে পড়েছেন। তবু মহিলারা নাছোড়। তাদের কথা কর্তাদের শুনতেই হবে।শেষে প্রধানের উদ্দেশ্যে নরেগা প্রকল্পে কাজের দাবি জানিয়ে লেখা স্মারকলিপি সচিবের হাতেই জমা দেওয়া হল। উত্তর পাওয়ার জন্য সাত দিনের চরম সীমা দিয়ে মহিলারা ঘরে ফিরলেন। ফেরার পথে তাঁরা পদযাত্রায় সামিল হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।অনেকেই পদযাত্রাকে সফল করার জন্য হাসি মুখে অর্থ সাহায্যও করলেন। বিক্ষোভ জমায়েতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন লক্ষ্মী রায়, বাসন্তী রায়, সরস্বতী তুড়ির মত লড়াকু শ্রমজীবী মেয়েরা। - মুকুল কুমার । ১০০ দিনের কাজের দাবিতে গ্রামীণ মহিলাদের পঞ্চায়েত অফিস ঘেরাও রকম সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। বাংলার কৃষক ও গ্রামীণ জনগণের কাছে আমাদের আবেদন— কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য ও ঋণ মুক্তি, গ্রামীণ মজুরদের কাজ, মজুরি, খাদ্য ও সামাজিক সুরক্ষা—এই সমস্ত ন্যায্য দাবীকে কার্যকরী করতে এবং রাজনীতি ও আন্দোলনে গণতান্ত্রিক পরিসরকে বাড়িয়ে তুলতে এই অধিকার যাত্রায় সামিল হোন। বিজেপি বাংলায় বিভাজন ও দাঙ্গার রাজনীতি সামনে এনে রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণ করতে চাইছে। আমাদের নীতি হলো সমগ্র কৃষক ও গ্রামীণ জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার বাম ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করা।