প্রতিবেদন
আধার এবং ডিএনএ বিল

আধার এর রায় বেরিয়েছে ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮। পাঁচ বিচারপতির মেজরিটি রায়ে বলা হয়েছিল যে কোনো প্রাইভেট মোবাইল কোম্পানি এবং ব্যাঙ্ক তার গ্রাহকদের থেকে আধার চাইতে পারবে না। শুধুমাত্র আধার আইনের ৭ নং ধারাতে যা বলা আছে যে সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা ছাড়া আর অন্য জায়গায় আধার ব্যবহার করা যাবে না। যদি একটু খেয়াল করা যায় তার পরবর্তী সময়ে আধার সংক্রান্ত মেসেজ আসা কিন্তু প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তার মানে কি এই প্রাইভেট কোম্পানি বা ব্যাঙ্কগুলো ভয় পেয়ে বা সেই অর্থে বললে সুপ্রীম কোর্ট কে সম্মান দিয়ে তাদের এই প্রত্যেক নাগরিকের থেকে জোর করে আধার নেওয়াটা বন্ধ করলো? একদমই না, উল্টে তারা অপেক্ষা করে আছে কখন সরকার তাদেরকে এই কাজটা করার জন্য সাহায্য করবে। অর্থ মন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং আইন মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ তাদেরকে স্বান্ত্বনা দিয়েছে যে চিন্তা করার দরকার নেই, সরকার নিশ্চিত তাদের কথা ভাববে।

যখনই কেউ আধারের রায় নিয়ে নাড়াচাড়া করবে তার মনে হবে, যে দু-পক্ষই জিতেছে, যারা আধারের বিরোধিতা করছেন তারা, যারা আধারের পক্ষে আছেন তারাও। কিন্তু একটা জিনিস পরিস্কার যে আধারের লড়াইটা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আরো বেশ কিছু আইনী অদলবদল হবে আধার অ্যাক্টে যার ফলে আবারো সুপ্রীম কোর্টের দরজাতে আরো অনেক মানুষকে কড়া নাড়তে হবে। সরকার সেই জন্যই প্রাথমিক ভাবে এই আধার পরিমার্জন আইন ২০১৮ আনতে চলেছে। যদিও এটি অার বিলের আওতায় নয় তাও এই বিলটি নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি, লোকসভায় হয়তো আলোচনা হবে, কিন্তু নাগরিক পরিসরে এর কি প্রভাব পড়বে সেই আলোচনা করাটাও জরুরী।

কেন আধারের এই সংযোজনী বা অ্যামেন্ডমেন্ট বিলটির বিরোধিতার প্রয়োজন ?

মূলত ৫টি কারণে এই আধার সংযোজনী বিলটির বিরোধিতা করা যায়।

১। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি জাস্টিস চন্দ্রচূড় তার আধারের রায় দেওয়ার সময়ে বলেছিলেন যে আধার আইনটাই বেআইনি, কারণ এটাকে মানি বিল বা অর্থ বিল হিসেবে পাশ করানো হয়েছে। মানি বিল হিসেবে কোনো কিছু লোকসভায় পাশ করানো হলে সেটা আর রাজ্যসভায় আলোচনা করতে হয় না। তাই ঘুরপথে এই আধার অ্যাক্টকে পাশ করিয়ে নেওয়াটা সংবিধান এর সঙ্গে জালিয়াতি ছাড়া কিছু নয়, এরপর যদি এই সংশোধনী বিলটি পাশ হয় তাহলে এই অন্যায়কে আরো বাড়তে সাহায্য করা ছাড়া কিছু নয়।

২। আধার অ্যাক্ট, বিদেশের কেমব্রীজ অ্যানালিটিকার থেকেও ভয়ঙ্কর কারণ এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই ধ্বংস করেছে। কারণ এটার মাধ্যমে বেসরকারী সংস্হারা আধারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে যার মধ্যে দিয়ে তারা ভারতের নির্বাচনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

৩। আধার অ্যাক্ট ভারতের নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করছে যার ফলে আধার কর্তৃপক্ষ ভারতের নাগরিকদের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এর মধ্যে দিয়ে ভারতের নাগরিকদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে। এটাই একমাত্র কারণ যে ইংল্যান্ড তার জাতীয় আই ডি-কে পরিত্যাগ করেছিল। কোনো বেসরকারী সংস্হা কি করে একজনের নাগরিকত্বকে অস্বীকার বা স্বীকার করে ?

৪। তথ্য জানার অধিকার আইনে জানা গেছে যে আধার কর্তৃপক্ষ কখনোই কোনো ইউনিক বা অনন্য তথ্য বার করে আনতে পারে না, কারো হাতের ছাপ বা চোখের মণির ছবি পেলে বলে দিতে পারে না যে এটা অমুক ব্যক্তির হাতের ছাপ, বা চোখের ছবি। কারণ আধার কর্তৃপক্ষ ভালভাবেই জানে যে হাতের ছাপ বা চোখের মণি অনন্য নয়। যার ফলে সে আধারকে কখনোই বলতে পারে না যে ডেমোগ্রাফিক বা বায়োমেট্রিক তথ্য অনন্য। সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সাওয়ান্ত রীতিমতো লিখে দেখিয়েছেন যে প্রায় ৫৮ কোটি আধার ভুয়ো বা ভুতুড়ে। যার ফলে এই ৫৮ কোটি আধারের সাথে যদি ভোটার কার্ড সংযোগ করা হয় তাহলে গণতন্ত্রে শেষ পেরেকটি পোঁতা হবে। (তথ্য সূত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)

৫। আধার কতৃপক্ষ কখনোই বলতে পারে না কে সরকারী সুযোগ সুবিধা বা অনুদান পাবে বা পাবে না, আধার কতৃপক্ষ কখনোই ঠিক করে দিতে পারে না কে সঠিক অর্থে অনুদান পাওয়ার যোগ্য বা যোগ্য নয়। সুতরাং ডিবিটি বা সরাসরি ব্যাঙ্কে টাকা পৌঁছনোর নাম করে এই অনুদানগুলোকে পাচার একটা দুর্নীতি ছাড়া কিছু নয়।

এর সাথে যুক্ত হচ্ছে ডিএনএ বিল, প্রতিটি নাগরিকের থেকে ডিএনএ র নমুনা সংগ্রহ করা হবে, প্রতিটি মানুষকে চোখে চোখে রাখার জন্য এই পদ্ধতি, যাতে নজরবন্দী করে রাখা যায়। প্রথমে বলা হচ্ছে এই পদ্ধতিতে অপরাধী চিহ্নিতকরণ করা হবে আসলে প্রতিটি নাগরিককেই অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে। ঠিক যেমন নোটবন্দীর সময়ে বলা হয়েছিল যে আপনি তো কালো টাকার মালিক নয় তাহলে আপনার অসুবিধা কোথায়? ঠিক তেমনি এই ক্ষেত্রেও তাই বলা হবে। আর আমাকে আপনাকে প্রমাণ করতে বলা হবে আমরা অপরাধী না।

এইটাই ফ্যাসিজিম। বিদেশী টাকা নিয়েছে এই বিজেপি এবং কংগ্রেসের মতো দলগুলো আর আমাকে আপনাকে ওই বিদেশী বহুজাতিকদের সামনে নগ্ন করাটা ওই কোম্পানিগুলোর অধিকার জন্মে গেছে।

রাজ্যসভায় এই আধার অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট এবং ডিএনএ বিল পেশ হবে। যদি বিরোধীরা একজোট হয় তাহলে এই বিলকে আটকানো সম্ভব, কিন্তু বিরোধীরা কি সচেষ্ট হবে?

জরুরী একটা কথা : আধারের রায়ের পর আজ অবধি কিন্তু ফোন এবং মেসেজ আসা অনেক কমে গেছে। সুতরাং এই বিল আটকানো গেলে নিশ্চিত নাগরিক পরিসরে লাভই হবে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-3