সিবিআই, আরবিআই, সুপ্রিম কোর্ট—প্রশাসনের একের পর এক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের লাগামছাড়া যুদ্ধ
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়,
৩০ অক্টোবর ২০১৮)

২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে এক একটা দিন চলে যাচ্ছে আর মোদী সরকার প্রশাসনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তার যুদ্ধকে ক্রমেই তীব্রতর করে তুলছে। যে নাশকতা এতদিন পর্দার আড়ালে চলত তাকে সরিয়ে তার জায়গা নিয়েছে প্রকাশ্য হুমকি ও সংঘাত। সরকারকে দায়বদ্ধ করার প্রতিটি প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দিতে সরকার চোখ রাঙানি, হস্তক্ষেপ এবং জোরজবরদস্তির প্রচ্ছন্ন কৌশল নেওয়ায় সিবিআই, আরবিআই এবং এমনকি সুপ্রিম কোর্টের গায়েও তার আঁচ লাগছে।

এর আগের সরকারের শাসনাকালে সুপ্রিম কোর্ট উল্লেখযোগ্যভাবে সিবিআই-কে খাঁচায়বন্দি তোতাপাখি বলে অভিহিত করেছিল। ঐ তোতাপাখিকে খাঁচা থেকে মুক্ত করার পরিবর্তে মোদী সরকার একেবারে শুরু থেকেই খাঁচার অর্গলকে আরো দৃঢ় করতেই ব্যস্ত থেকেছে, আর জোটকে রূপ দিতে অথবা জোট ভাঙ্গতে যথা সময়ে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই-কে লেলিয়ে দিয়েছে। সিবিআই এবং এনর্ফোসমেন্ট ডিরেক্টরেটকে শাসক এনডিএ জোটের শরিক বলেই লোকে জেনেছে।

সমস্ত বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে মোদী রাকেশ আস্থানাকে সিবিআই-এর বিশেষ ডিরেক্টরের পদে নিয়োগ করেন। মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় এই রাকেশ আস্থানা তার অতি বিশ্বস্ত পুলিশ অফিসার ছিলেন। মোদী দুর্নীতি নিরোধক আইনকেও সংশোধন করেন যার ফলে কর্মরত কোনো অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে সিবিআই বা অন্য কোনো তদন্তকারী সংস্থার পক্ষে সরকারের অনুমতি নেওয়াটা বাধ্যতামূলক হয়। কিন্তু রাফাল চুক্তির খুঁটিনাটি উন্মোচন সৃষ্ট আতঙ্কে মোদী সরকার সিবিআই সম্পর্কেও হুঁশিয়ার হয়ে ওঠে এবং এখন আমরা যা দেখছি তা সিবিআই-কে মোদী-শাহ জুটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে সরকার-চালিত এক অভ্যুত্থান ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সিবিআই ডিরেক্টর অলোক ভার্মা ঘুষ নেওয়ার এক কাণ্ডে রাকেশ আস্থানাকে সাসপেণ্ড করা ও তার বিরুদ্ধে মামলা চালানোর অনুমোদন সরকারের কাছে চাইলে সরকার ডাইরেক্টরকেই অপসারিত করে, তার উপর নজরদারি চালানোর জন্য তার সরকারি আবাসনের বাইরে আইবি-র লোকদের পাঠায় এবং দুর্নীতির অভিযোগে চূড়ান্ত কলঙ্কিত নিম্নপদস্থ অফিসার এম নাগেশ্বর রাওকে অন্তর্বর্তী ডিরেক্টর রূপে নিয়োগ করে। এই অলোক ভার্মাকে যথোচিত পথে বেছে নেয় এক কলেজিয়াম যার সদস্য প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেও ছিলেন এবং তাঁর কার্যকালের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। গুজরাটে তার কার্যকালে অস্থানা তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রমাণ করেন, তা সে গোধরা কাণ্ডে মোদীর পক্ষ নেওয়া অথবা পুলিশ কল্যাণ কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিজেপির নির্বাচনী তহবিলে চালান করার মধ্যে দিয়েই হোক। একইভাবে শ্রীযুক্ত রাও নিজেও উড়িষ্যায় দমকল পোশাক কেলেঙ্কারির মতো বহু দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগের এবং সংঘ বাহিনীর তুলে ধরা বিভিন্ন বিষয়ে মৌখিক সমর্থন দেওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজের যোগ্যতাকে প্রতিপন্ন করেন। মোদী সরকার একদিকে যেমন সিবিআই এবং সিভিসি-কে নিজের অমন বিশ্বস্ত সহযোগীদের দিয়ে ভরিয়ে তুলেছে, অন্যদিকে আবার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির তদন্তে নিযুক্ত অফিসারদের ছাঁটাই অথবা বদলির নির্দেশ দিয়েছে এবং এমনকি অপরিচিত গোয়েন্দা অফিসারদের দিয়ে সিবিআই অফিসে হানাদারি চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলির দখলও নিয়েছে।

সিবিআই-তে চালানো এই হানাদারি দেশে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং বিচারবিভাগীয় শাসনকার্যের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের আচরণের প্রতীক। আরবিআই-এর গভর্ণর রঘুরাম রাজনকে দ্বিতীয় দফার কার্যকাল চালাতে দিতে অস্বীকার করা এবং মোদী সরকারের সবচেয়ে অযৌক্তিক এবং স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ বিমুদ্রাকরণের সমর্থনে আরবিআই-কে বাধ্য করার পর মোদী সরকার ভারতের প্রধান ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্ততা এবং নিয়ন্ত্রণমূলক অধিকারকে লাগাতার খর্ব করে চলেছে। কর্পোরেট সংস্থা ঋণ খেলাপি হলে তার বিরুদ্ধে কঠোরতর ব্যাঙ্ক বিধি গ্রহণ করা অথবা তার নিজের সংরক্ষিত অর্থকে রক্ষা করা অথবা অর্থ গ্রহণ বা প্রদানের সমস্ত ব্যবস্থার উপর তার নিয়ন্ত্রণমূলক অধিকারকে বজায় রাখার উপর জোর দিতে গিয়ে আরবিআই-কে সরকার এবং আরবিআই-এর পরিচালকমণ্ডলীতে ঢোকানো আরএসএস মদতপুষ্ট অর্থনীতিবিদদের দিক থেকে লাগাতার এবং ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

সবচেয়ে প্রকাশ্য সংঘাতটা সম্ভবত এবার রূপ নিচ্ছে সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে। শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশাধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে প্রথমদিকে স্বাগত জানানোর পর বিজেপি ঐ ইস্যুতে এখন সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে গেছে। অমিত শাহ সুপ্রিম কোর্টকে বলেছেন যে, তাদের এমন রায়ই দেওয়া উচিৎ যেটাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব এবং যে এলডিএফ সরকার সুপ্রিম কোর্টের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা ঘোষণা করেছে তাকে উচ্ছেদ করতে তিনি তার পার্টি কর্মীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। আর সুপ্রিম কোর্ট এখন আবার অযোধ্যা মামলার পরবর্তী শুনানি জানুয়ারি মাসে ফেলায় বিজেপি মন্ত্রীরা সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শ দিচ্ছেন যে, তারা যেন হিন্দুদের ‘ধৈর্যের পরীক্ষা’ না নেয়। হিন্দুত্ববাহিনী সোশ্যাল মিডিয়াতে আরো খোলামেলা। সুপ্রমি কোর্টের ভবনটির গম্বুজকে খোলাখুলিভাবেই ধ্বংস করা বাবরি মসজিদের গম্বুজের সঙ্গে একাকার করে তোলা হচ্ছে।

আপনি যদি ভেবে থাকেন যে মোদী সরকার শুধু মুসলিম, দলিত এবং ‘শহুরে নকশালদের’ বিরুদ্ধেই যুদ্ধ চালাচ্ছে, তবে দৃষ্টিকে প্রসারিত করে আপনার আবার নতুন করে ভাবা দরকার। ঐ যুদ্ধ এখন আর সংখ্যালঘু এবং নিপীড়িত ও সমাজের প্রান্তিক অংশগুলির বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়। ফ্যাসিস্ট শক্তির বুলডোজার এখন গণতান্ত্রিক প্রশাসনের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলিকেও গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে। বিপর্যয় কোনো একটা এলাকাকে গ্রাস করলে সে সবকিছুকেই ভাসিয়ে দিতে উদ্যত হয়। মোদী সরকার এক সার্বিক বিপর্যয়ের—অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের অগ্রদূত হয়ে উঠেছে। আর দেরি না করে মোদী বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশকে এখনই উদ্ধার করতে হবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-34